আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও আমার দেশের কাণ্ড!

“In a gentle way, you can shake the world.” হ্যাকগেট, রুপার্টগেট, মারডকগেট এই শব্দগুলোর সঙ্গে মিডিয়া জগতের কর্মীরা এখন খুবই পরিচিত। রুপার্ট মারডক তার মিডিয়া মোঘল নাম থেকে অতি দ্রুত এই নতুন তকমা পেয়েছেন। অপরাধ হ্যাকিং। রুপার্ট মারডকের নিউজ কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠান নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাকিংয়ের দায়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংবাদপত্রের কর্মীরা ফোন হ্যাক করে, পুলিশকে ঘুষ দিয়ে এবং অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খবর বের করে তা প্রকাশ করেছে।

২০০৫ থেকে টানা দুই বছর অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে পত্রিকাটির এই অবৈধ তৎপরতার শিকার হয়েছেন অনেক সেলিব্রেটি, রাজনীতিক। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্যরাও বাদ যাননি। আর অনৈতিক এই চর্চার মাশুলও গুনতে হয়েছে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডকে। ২০১১ সালের জুলাইয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে রুপার্ট মারডক ও তার সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞাপনদাতারা পত্রিকাটি বর্জন করেন।

ফলে প্রকাশনার ১৬৮ বছর পর ২০১১ সালের ১০ জুলাই বন্ধ হয়ে যায় নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। হ্যাকিংয়ের অপরাধেই এই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে সংবাদপত্রটিকে। আর যাই হোক অনৈতিক এ চর্চাকে সাংবাদিকতা বলা চলে না। এটা চৌর্যবৃত্তির সামিল। ঠিক যেমনটি ঘটেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের আলাপচারিতা হ্যাকিংয়ের ঘটনায়।

ব্যক্তিগত কম্পিউটার থেকে তার বন্ধুর সঙ্গে আলাপচারিতা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বের করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে। এটি চৌর্যবৃত্তি। এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এনিয়ে দৈনিক আমার দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম স্কাইপে ট্রাইব্যুনাল-১-এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ও বেলজিয়াম-প্রবাসী বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে ব্যক্তিগত কথোপকথনের গোপন তথ্য ফাঁস করেছে পত্রিকাটি।

মামলায় আমার দেশের প্রকাশক ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৬ ও ৫৭ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১২৪(এ) ও ৫০৫(এ) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক পরস্পর যোগসাজশে বিচারপতি নিজামুল হকের গোপন তথ্য প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেছেন। বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি- এমন কোন কম্পিউটার, সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন, যাতে তিনি মালিক বা দখলকার নন তা হলে তা একটি হ্যাকিং অপরাধ৷ কোনো ব্যক্তি হ্যাকিং অপরাধ করলে অনধিক দশ বত্সর কারাদণ্ডে, বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৬ (১) ও (২) ধারায় এ কথা বলা হয়েছে। আইনটির ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে- মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়া হলে তা একটি অপরাধ বলে গণ্য হবে৷ এই অপরাধেরও সাজা অনধিক দশ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড। এ ছাড়া দণ্ডবিধির ১২৪(এ) ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।

দণ্ডবিধির ৫০৫(এ) ধারায় সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। হাস্যকর বিষয় হচ্ছে দৈনিক আমার দেশ হ্যাকিং করে পাওয়া কিছু তথ্য প্রকাশ করে দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছে! কেউ কেউ একে অনুসন্ধানি সাংবাদিকতা বলতেও পিছ পা হচ্ছেন না। এ কথা বলতে দুই-একজন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির উদাহরণও টানছেন। সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে বিষয়টি প্রতিবাদ করা প্রয়োজন বোধ করছি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁসের ওই ঘটনা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উদাহরণ হিসেবে সাংবাদিকতার পাঠ্য বইয়েও অন্তর্ভূক্ত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের একটি আড়িপাতার ঘটনা সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেটে ডেমোক্রেটিক দলের সদর দফতরে দলটির নির্বাচনী প্রচারণা, পরিকল্পনা এবং অন্যান্য আলাপচারিতা টেপ করে নিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনের সহযোগীরা তা আড়ি পাতেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বানস্টাইন দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনীতির এই নোংরা চর্চা আবিস্কার করে তা ফাঁস করে দেন। এতে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ শুরু হয়। সবাই এ কুকীর্তির নিন্দা জানায়।

ফলে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট নিক্সনকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। ভিয়েতনাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তিপ্রচেষ্টা এবং রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়ন নিক্সনের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলেও ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি তার রাজনৈতিক জীবনের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। অবশ্য ৩৬ বছর পর অর্থাৎ মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর পর ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে মুক্তিও পান আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নিক্সন। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু যারা ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির ওই ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে আমারদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের কথপোকথন প্রকাশের মধ্যে মিল খুঁজতে চাচ্ছেন তারা ভুল করছেন।

ওয়াটার গেট, মারডক গেট ও নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপে কথপোকথন আমার দেশে প্রকাশ এই তিনটি ঘটনার সঙ্গেই আড়িপাতার বিষয়টি জড়িত। প্রথম অপরাধটি করেছেন একজন রাজনীতিক। যা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটিয়েছে একটি মিডিয়া। যা তার ১৬০ বছরের প্রকাশনার ইতি ঘটিয়েছে।

তার তৃতীয় ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। তবে হ্যাকিং করে আনা তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে একটি মিডিয়া। মিডিয়াটি যেহেতু জানায়নি কিভাবে তারা এই তথ্য পেলো তাই আপাতত মিডিয়াটিকেই আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম স্কাইপেতে যে কথা বলেছেন তাতে আড়ি পেতে কিংবা তার ব্যক্তিগত কম্পিউটার হ্যাক করে অপরাধ করেছে হ্যাকার। সংবাদকর্মী হিসেবে প্রথম বিবেচনা হওয়া প্রয়োজন ওই হ্যাকারকে খুঁজে বের করা।

যদি সম্ভব হতো তাহলে সেটিই হতে পারতো আমারদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। কিন্তু হ্যাকারকে না খুঁজে বরং নিজামুল হক নাসিম ওই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কি বলেছেন তার প্রতিই ছিলো আমারদেশের ঝোঁক। সেটাই তারা খুঁজে বের করেছে কিংবা সহজে পেয়ে গেছে। আর দেরি না করে, দেশের স্বার্থের উর্ধে উঠে একজন বিচারপতির ব্যক্তিগত কথপোকথন বন্ধুর সঙ্গে তার নিজের ব্যবহৃত ভাষা রীতিতেই প্রকাশ করে দিয়েছে খণ্ডে খণ্ডে। এর ফলে যা হয়েছে তা দেশের জন্য উপকারের নয় মোটেই।

স্রেফ ক্ষতির। কারণ এতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের কথপোকথন থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারটি তিনি সঠিকভাবে করতে চেয়েছেন। সেই জন্যই তার ওই কথা বলা। তার সেই সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমারদেশের রিপোর্টের জেরে শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালেই থাকতে পারলেন না তিনি।

হ্যাক হতে পারে, কেউ আড়ি পেতে জেনে যেতে পারে এমন একটি মাধ্যম ব্যবহার করে বিশেষজ্ঞ বন্ধুর সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রসঙ্গে দুই-একটি কথা বলে ফেলে যে ভুলটি করেছেন তার দায় মাথায় নিয়ে দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন বিজ্ঞ ও মর্যাদাসম্পন্ন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম নিজেই। কিন্তু সাংবাদিকতার এই অপচর্চার কী হবে? আইনি লড়াইয়ে আমার দেশকে কি পরিণতি বরণ করতে হবে সেটি আইন-আদালতই নির্ধারণ করবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষে আমার দেশ তার অবস্থান ঘোষণা করেছে কিংবা প্রমাণ রেখে আসছে আরও আগে থেকে। এমন একটি সুযোগ আমারদেশ সন্ধান করবে তাও অসম্ভব বা অবাস্তব নয়। কিন্তু যারা আমারদেশেকে সাহসী সাংবাদিকতার তকমা দিচ্ছেন, তাদের প্রতিবেদনকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উদাহরণ বলছেন তারা মোটেই সঠিক নন।

তাদের এই বক্তব্যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দীর্ঘ সময়ের উদাহরণ যা বই-পুস্তকেও স্থান পেয়েছে সেই ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি স্রেফ লজ্জ্বা পাবে। ছোট করা হবে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস করা দুই বিখ্যাত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বানস্টাইনকেও। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও আমার দেশের কাণ্ড! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.