আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কি সেলুকাস!

মারামারি, কাটাকাটি, খুন, রাহাজানি, আন্দোলনের খবর পড়তে পড়তে কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর এসব খবর ছাড়া দিন পার করতে কেমন যেন লাগে। সেই সকাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে মাঝে মাঝেই ঢুকছি গরম খবর পাব বলে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আসে নাই। এখন তো মেজাজ পুরাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

এই অভ্যাসের জন্যে অবশ্যই গুরুতর অবদান রাখে আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং আয়িন ভাঙ্গার মানসিকতা। যে দেশে গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখান হয়, সাগর-রুনিকে খুন করে ফেলা হয়, প্রকাশ্যে বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়, লিমনকে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হয়, আহসানউল্লাহ মাস্টারকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, আত্মঘাতী বোমা হামলা চালান হয়, হরতালের দিনে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন প্রকার গনতান্ত্রিক কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়, সে দেশের মানুষ পত্রিকায় যদি একদিন এমন খবর না পায়, তাহলে দিনটা ভাল কাটবে কি করে? আমাদের জন্যে মজাদার একটা দিনের বর্ণনা হতে পারে নিম্নরুপঃ সকালে ঘুম ভেঙ্গে পত্রিকা হাতে নেব। সেখানে হেডলাইনে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকবে "গতরাতে অমুক দলের সমর্থকেরা এই দাবিতে শতাধিক গাড়ি ভাংচুর করেছে" অথবা "বাংলাদেশ এখন রণক্ষেত্র" অথবা "শতাধিক মানুষের মৃত্যু ওই দুর্ঘটনায়" অথবা অন্য যেকোনো গরম খবর। খবরে আতঙ্কিত হয়ে সাথে সাথে টিভি অন করব। সেখানে লাইভ টেলিকাস্ট হতে থাকবে রাজনৈতিক সমর্থকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ, অথবা কাউকে কুপিয়ে জখম করার দৃশ্য অথবা যানবাহনে আগুন লাগানোর দৃশ্য।

এসব দেখে সকালের নাশতা সারতে সারতে মাথা নেড়ে বেশ মুড নিয়ে মন্তব্য করতে থাকব, দেশটা রসাতলে যাচ্ছে! তারপর চাকরিজীবীরা যাবে অফিসে, ছাত্ররা যাবে শিক্ষাঙ্গনে, আর বেকাররা যাবে ইজি কাজে বিজি থাকতে। কিন্তু সবাই রাস্তায় চলার পথে আনন্দদায়ক কিছু খুঁজতে থাকব। ককটেল না ফুটলেও কমপক্ষে চাকা পাংচার হওয়ার শব্দ শুনতে উদগ্রীব থাকবে সবাই। ভাগ্যগুনে এমন কিছু দেখতে পেলে সেটা নিয়ে যে যার মত করে গল্প ফেঁদে বসে যাবে আড্ডায়। চাকরিজীবীরা কর্ম বাদ দিয়ে কলিগদের সাথে, ছাত্ররা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডায় আর বেকারদের তো সারা দুনিয়া অফিস।

অতএব তারা যারে পাবে তারেই গল্প বলা শুরু করবে। সব আড্ডার সারমর্ম এসে দাঁড়াবে, দেশটা চলে যাচ্ছে সর্বনাশের অতলে। তারপর এভাবেই দিন পার করে বাসায় ফিরে আসি মনে এক আতঙ্কিত আনন্দ নিয়ে। আমরা এভাবেই দিন পার করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এবং ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটা খুব ভাল ভাবেই করেছি।

বর্তমানে বিরোধীদল বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছে, আরেকদল আন্দোলন করছে তাদের নেতাদের মুক্তির দাবিতে, যারা কোনও এক সময় দেশের স্বাধীনতা চায়নি। কিন্তু কাউকেই দেখলাম না, সাগর-রুনির হত্যার বিচারের দাবিতে মুখোর হতে, কাউকেই দেখলাম না,"না ভোট" কে জাতীয় নির্বাচনে যোগ করার জন্যে দাবি করতে, কাউকেই দেখলাম না, চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার ভেঙ্গে মানুষ মারা যাওয়াতে বিচারের এবং ক্ষতিপূরণের দাবি জানাতে, কাউকেই দেখলাম না, গার্মেন্টসে আগুন লেগে কয়েকদিন আগে যারা পুড়ে কয়লা হল, তাদের মৃত্যুর জন্যে বিচার চাইতে। এসব চাইবে কেন? এসব ক্ষেত্রে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা বাংলাদেশের জনগন হলেও, ভোট দেয়ার অধিকার থাকলেও তারা তো মানুষ না, তারা জন্তু-জানোয়ার। তাদের জীবনের মুল্য কারোর কাছে নেই। তাদের জন্যে সংগ্রাম করে সময় নষ্ট করার মত সময় কার আছে? এই সময় সরকারেরও নেই, এই সময় বিরোধীদলদেরও নেই।

বিশ্বজিতকে কারা খুন করেছে, তাদের ভিডিও, তাদের ছবি সারা দেশবাসী দেখলেও সরকারের কেউ দেখেনি আর তাই খুনিদেরকে ধরতে তদন্ত কমিটি গড়তে হয়েছে। কি সেলুকাস! আমরা, বাংলার জনগন আসলেই জন্তু জানোয়ার। তা না হলে, যারা আমাদের জীবনের মুল্য দেয় না, তাদেরকেই আবার আমরা ভালবাসি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব এবং অহংকারের উৎস। আর সেটা নিয়েও রাজনীতি করে আমাদের নেতানেত্রিরা।

মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে এমন সব কর্মকাণ্ড হাতে নেয়, মাঝে মাঝে নিজের বাপকে মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন নাবালক ছিল বলে যুদ্ধে যায়নি, সে অপরাধে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এই দেশটা এখন শুধুই রাজনৈতিক দলগুলোর, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের আর নারীদের। বাকি আমরা যারা বিপুল সংখ্যায় আছি, তারা সবাই জন্তু জানোয়ার। আমরা মরলেও কারোর কিছু যায় আসে না, বাঁচলেও যায় আসে না। আমার বাবার মত যাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধে নাবালক ছিলেন বা অন্য কোনও কারনে যুদ্ধে যান নাই, তাদের সবার মনেই একই ক্ষোভ।

কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না কেউ ভয়ে। আমিও পারি না। কারন প্রকাশ করলেই বিপদ হবে। আর তাই সবাই চুপচাপ মেনে নেয় সব। সত্যি কথা বলতে কি? স্বাধীনতাবিরোধীদের, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমি যেমন চাই এবং চাইব সবসময় ঠিক তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর থেকে কেমন যেন দিন দিন সম্মান কমে যাচ্ছে আমার ভেতরে।

আমি জানি, আমার এই এক লাইনে যে কেউ আমাকে এই যুগের রাজাকার বলে ডাকতে চাইবে বা ডাকবে। কিন্তু যা বাস্তব আমি তাই বললাম। বড্ড আফসোস হয় নিজের বাবা মুক্তিযোদ্ধা না। অন্তত নিজে নারী হয়ে জন্মাতে পারতাম। কমপক্ষে বাবা যদি রাজনীতি করত, তবুও হয়তো কিছু হত।

জন্তু জানোয়ারের জীবন থেকে মুক্তি পেতাম। এত কিছুর পরেও আমরা আগামী নির্বাচনে আবার পূর্বের মত ভুল করে আসব। ভোট দিয়ে আসব প্প্রধান তিনটা রাজনৈতিক দলের কাউকে না কাউকে। এদের কাউকে না দিলেও এরশাদ চাচার সমর্থন করব, সেই বাপারে নিশ্চিত। একবারও ভাবব না, এরা যেসব কথা মুখে বলে, সেসব কথা জীবনেও কাজে দেখাতে পারেনি।

প্রধান দুই দল তো কথা দিয়ে কথা না রাখার প্রতিযোগিতায় আছে। এরশাদ চাচা আছেন দুই নেত্রির মাঝে ফুটবল হয়ে একবার এর গোলবারে আবার আরেকজনের গোলবারে ঢুকে যাওয়ার ধান্দায়। আর বাকি থাকে আরেকদল। এরা বড্ড আজব দল। মুখে বলে, আমরা ইসলামের আয়িন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি।

আবার রাস্তাঘাটে নামলেই এমন ধরনের কাজ করে বসে, যা মোটেই ইসলামের সাথে যায় না। ইসলাম হল শান্তির ধর্ম। এটা একটা জীবনবিধান। কিন্তু তাদের যদি বলি, ইসলামে তো মারামারি, হানাহানির অনুমতি নেই। তখন তারা বলে, আমরা জ্বিহাদে আছি।

এদের এই উত্তর শুনে মনে মনে বলি, তোমরা জ্বিহাদের সংজ্ঞাই জান না। আল-কুরআন, হাদিসের বই খুলে দেখ, জ্বিহাদ কি জিনিশ। কিন্তু মুখে বলতে ভয় লাগে এসব। কারন আমি মনে হয় আল্লাহর চেয়েও এই মানুষগুলোকে বেশি ভয় পাই। আল্লাহর হুকুম না মানলে, আল্লাহ কখনও আসমান থেকে নেমে এসে আমার রগ কেটে দেবে না বা আমাকে মারধর করবে না।

যে কাফের, আল্লাহ তাকেও বাঁচিয়ে রাখেন, তাকেও রিযিকের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ইসলামের জন্যে জ্বিহাদকারী এই মানুষগুলো কাউকে বাঁচিয়ে না রাখতে পারলেও, মেরে ফেলতে বা আহত করতে খুব পারদর্শী। ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, নবি করীম ( সাঃ ) এর সময় যেসকল জ্বিহাদ হয়েছে, সেখানে কখনও মুসলিমরা নিজে থেকে আক্রমন করেনি। কাফিরদের আহ্বানে বা অত্যাচারে তারা জ্বিহাদে অংশগ্রহন করেছেন। এবং আজ পর্যন্ত কোনও জ্বিহাদে এক মুসলিম ভাই আরেক মুসলিমকে আঘাত বা হত্যা করেনি।

কিন্তু আমাদের বর্তমানে তথাকথিত ইসলামের ধারকবাহক এই সংগঠন যখন আক্রমন করে রাস্তাঘাটে, পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন মনে হয় তাদের মনে থাকে না, এদের মাঝেও মুসলমান আছে। তাহলে কি করে এটা জ্বিহাদ হল? আমার মাথায় এসব জটিল ব্যাপার কিছুতেই ঢুকতে চায় না। আমি চাই এমন একটা দেশ, যেখানে থাকবে না কোনও হানাহানি, যেখানে ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে চলবে না ক্ষমতা দখলের রাজনীতি, যেখানে জনগনের জন্যে গনতন্ত্র থাকবে এবং সরকার যা খারাপ করবে বিরোধীদল সেটা প্রতিহত করতে চেষ্টা করবে আর সরকার ভাল কিছু করলে সবাই একাত্মতা ঘোষণা করবে। দুর্নীতির শিকার হয়ে মরবে না সাধারন জনগন। আর জনগন থাকবে সেই গনতান্ত্রিক দেশের সকল ক্ষমতার উৎস।

সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বা চাকরি নিয়োগের ক্ষেত্রে থাকবে না কোনও কোটা পদ্ধতি। সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে শতভাগ যোগ্য মানুষকে সুযোগ দেয়া হবে দেশ সেবার জন্যে। আর যারা চাকরি পাবে না, তাদেরকে সরকার থেকে উৎসাহিত করা হবে ব্যাক্তিগত কর্মসংস্থান রচনায়। প্রয়োজনে সরকার থেকে সাহায্যের এবং বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হবে। এমন একটা দেশ চাই, যে দেশে থাকবে না কোনও গৃহহীন, যে দেশে থাকবে না মৌলিক চাহিদার অভাবে অভুক্ত মানুষ বা হাসপাতালের বারান্দায় অবহেলে থাকবে না পড়ে কোনও অসুস্থ।

এমন দেশ কি আমি চাইতে পারি না? এই চাওয়াতে কি অন্যায় আছে? যদি থেকে থাকে, তাহলেও আমি চাইব। যদি চান এই অপরাধে আমাকে ফাঁসী দিয়ে দেন তবু মরতে মরতে বলব, এমন দেশই আমি চাই আর মুক্তিযুদ্ধে এমন দেশের স্বপ্নই দেখেছিলেন দেশের আপামর স্বাধীনতাকামী জনগন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।