আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধুনিক পুত্র

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। আধুনিক পুত্র মোহাম্মদ ইসহাক খান রাত দশটা। রাজিয়া বেগম টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছেন।

অপেক্ষা করছেন। না, স্বামীর জন্য নয়, স্বামী আহসানুল হক বহু আগেই গত হয়েছেন। রাজিয়া বেগমের আপনজন বলতে একজনই আছে, তাঁর ছেলে রিয়ান। রাজিয়া বেগম নিজের নামের সাথে মিলিয়ে ওর নাম রেখেছিলেন রিয়ান। রিয়ান যখন ছোট্টটি ছিল, তখন মাথা বড় ছিল বলে ঠিকমতো হাঁটতে পারতো না, টলমল করে কয়েক পা গিয়েই পড়ে যেত।

মা ছাড়া কিছু বুঝত না, তিনি ঘরের কাজ করতেন, আর রিয়ান ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে তাঁর আঁচল ধরে পেছনে পেছনে ঘুরত। রাজিয়া বেগমের জা, ননদ, পাড়াপ্রতিবেশি, যারাই দেখতেন, তাঁরাই হাসাহাসি করতেন, ছেলে এত মা ন্যাওটা কেন? রিয়ান ছিল খুব লাজুক স্বভাবের, কারো সাথে কথা বলতে, বন্ধুত্ব করতে ভয় পেত। বাবা মারা গেছেন, কাজেই মা-ই ছিল তার সব। এক মুহূর্ত মা-কে না দেখলে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলত। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় প্রতি ক্লাসের শেষে সে ক্লাস ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসতো, বারান্দায় মা দাঁড়িয়ে আছেন কীনা দেখার জন্য, না দেখলেই কান্নাকাটি শুরু করতো।

রাজিয়া বেগম রিয়ানের প্রাইমারী লেখাপড়ার বছরগুলো খুব ঝামেলা করে পার করেছেন। প্রতিদিন এসে রিয়ানের ক্লাসের পাশের বারান্দায় এসে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতো। কি লজ্জা। অন্য ছেলেমেয়েদের মায়েরা এই নিয়ে কম তামাশা করেননি। সেই রিয়ান বড় হয়েছে।

বিএসসি পাশ করেছে। এখন সে একজন পূর্ণ যুবক। সেই রিয়ান এখন আর আগের রিয়ান নেই। তার মুখ ফুটেছে, বন্ধুদের আড্ডায় এখন সে নিজেই কথা বলে, অন্যরা শোনে। বাইরে যেতে সে ভয় পেত, কিন্তু এখন সে রাত দশটা, এগারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকে, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যায়, সিগারেট ফোঁকে।

রিয়ান বদলেছে, কিন্তু রাজিয়া বেগম তো মা, তিনি বদলান নি। এখনো তিনি ছেলের জন্য সমান দুশ্চিন্তা করেন। সবসময় আঁচলের নিচে থেকে এসেছে ছেলে, হঠাৎ আঁচলের নিচ থেকে বের হতে চাইলে যদি তার কোন বিপদ হয়? তাই সারাদিন একটু পরপর ফোন করে খোঁজ নেন তিনি, ছেলে কোথায় আছে, কী করছে। রিয়ান বিরক্ত হয়। কাটা কাটা জবাব দিয়ে ফোন রেখে দেয়।

এখন সে বড় হয়েছে, তার এখন স্বাধীনতা দরকার। উঠতে বসতে জবাবদিহি তার পছন্দ নয়। বন্ধুরা হাসাহাসি করে। রাজিয়া বেগম রাত আটটা থেকে একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছেন রিয়ানের মোবাইলে, কিন্তু রিয়ান ফোন ধরছে না। ছেলে যদি বাইরে থাকে, তাহলে রাত একটু গভীর হলেই রাজিয়া বেগমের বুক ধড়ফড় করে; প্রথম চিন্তা যেটা মাথায় আসে, সেটা হল রিয়ান কোন বিপদে পড়ে নি তো? সারাদিন অফিস করে রাজিয়া বেগমের শরীর ক্লান্ত থাকে, ভীষণ ক্লান্ত।

তাঁর এখন বয়স হয়েছে। খেয়েদেয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন, কিন্তু সেটা তিনি কখনোই করেন না। ছেলে আসবে, গরম ভাত আর তরকারী দিয়ে পেটপুরে খাবে, তিনি যত্ন করে খাওয়াবেন। তারপর নিজে খেয়ে ঘুমোতে যাবেন। তিনি খাবার ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন, ছেলে এসে ঠাণ্ডা ভাত-তরকারী খাবে, তা হবে না।

রিয়ানকে এই নিয়ে আঠারোবার ফোন দিলেন রাজিয়া বেগম। রাত বাজে এগারোটা। রাজিয়া বেগম ঘুমোতে যেতে পারছেন না, টিভি দেখতেও বসতে পারছেন না, খুব অস্থির লাগছে। ছেলের কী হল? কলিংবেল বেজে উঠলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রাজিয়া বেগম।

ছুটে গিয়ে খুলে দিলেন দরজা। রিয়ান এসেছে। মা'কে পাশ কাটিয়ে সে ঢুকে গেল ভেতরে, কোন কথা বলল না। রিয়ানের দু'চোখ লাল, লক্ষ করলেন রাজিয়া বেগম। কোথায় ছিলি বাবা? আমি তো টেনশনে আধমরা হয়ে গেছি।

রিয়ান বলল, বন্ধুর বাসায়। এই একটু কাজ ছিল। তোর এত কীসের কাজ? দিনের বেলায় কাজগুলো সারতে পারিস না? দিনকাল ভাল না, এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিস ... ... রিয়ান আজকাল অল্পেতেই রেগে যায়, সে উঁচুগলায় বলে উঠলো, মা, সারাদিন পর বাসায় এলাম, আর তুমি ঘ্যানরঘ্যানর শুরু করলে। আমি এখন একজন "অ্যাডাল্ট", কেন বুঝতে চাও না? এখনো সবসময় পেছনে লেগে থাকো। একটু মডার্ন হও মা।

রাজিয়া বেগম লজ্জিত স্বরে বললেন, মায়ের মন, তুই কী বুঝবি বাবা? নিজের যখন ছেলেপুলে হবে, তখন বুঝবি। ফোন করেছিলাম, বলে দিলেই পারতি ... ... আবারো মায়ের মুখের কথা কেড়ে নেয় রিয়ান, ইচ্ছে করে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। তুমি একশো একবার ফোন করে ডিস্টার্ব কর, বন্ধুদের সামনে আমার প্রেস্টিজ থাকে না। এই বাংলাদেশ হয়ে হয়েছে যন্ত্রণা, বাবা-মায়েরা কিচ্ছু বোঝে না, সবসময় ছেলেমেয়েদের ওপর খবরদারী করতে চায়। ইউনাইটেড স্টেটসের মতো দেশগুলোতে এসবের বালাই নেই।

আঠারো বছর পার হওয়ার পর ছেলেমেয়ে কোথায় যায়, কী করে, সেটা জিজ্ঞেস করার কারো কোন অধিকার নেই, জানো? কারণ তখন সে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ। তাছাড়া এত টেনশনের কী আছে? ট্রাকের নিচে চাপা পড়লে কিংবা মরে-টরে গেলে তো জানতে পারবেই। উফ, তোমার জন্য কোথাও গিয়েও শান্তি নেই। রাজিয়া বেগম নিজের দুই গালে চাপড় মেরে তওবা কাটেন। বালাই ষাট, ছি ছি, এসব বলতে হয় না বাবা।

তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল্‌? খিদে পেয়েছে মা, এখন এসব আলতুফালতু কথাবার্তা বন্ধ কর। খেতে দাও। যা, হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি খাবারগুলো গরম করে দিচ্ছি। রিয়ান বাথরুমে ঢুকে গেল।

তরকারী ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, গরম করতে দ্বিতীয়বার চুলোয় চাপালেন রাজিয়া বেগম। নিজেকেই মনে মনে দোষ দেন তিনি, কী দরকার ছিল ছেলেটাকে এত কিছু জিজ্ঞেস করার? ছেলে এখন বড় হয়েছে, নিজের জীবন হয়েছে, এখনো কি অষ্টপ্রহর নজরদারিতে রাখলে চলবে? ঠিকই বলেছে রিয়ান, তাঁর একটু "মডার্ন" হওয়া দরকার, ছেলের মাথার ওপর থেকে আঁচল সরিয়ে নেয়া দরকার। তবুও বুকের একপাশে একটু ব্যথার মতো ছেলের কথাগুলো বাজে। ছেলে তাঁর, ওকে তিনি দশ মাস পেটে ধরেছেন, বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছেন, এই ছেলে ছোটকালে তাঁর আঁচল ধরে পেছনে পেছনে ঘুরেছে, চোখ বুজলেই তিনি সেই দিনগুলো এখনো দেখতে পান। আজ ছেলে তাঁকে বলছে, আঠারো বছর বয়স পার হবার পর আর তাঁর কিছু জিজ্ঞেস করার কোন অধিকার নেই।

ঠিকই বলেছে হয়তো। জামানা পাল্টায়, সেই সাথে মানুষও পাল্টায়। রাজিয়া বেগম চুলোর আঁচ কমিয়ে দিলেন। আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। চোখে পানি আসার কী আছে ভেবে পেলেন না তিনি, ছেলে তো অযৌক্তিক কিছু বলেনি।

(৩ ডিসেম্বর, ২০১২) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।