আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জলদস্যুর দৌরাত্ম ও উপকূলীয় জেলেদের নিরাপত্তাহীনতা: প্রয়োজন কার্যকর প্রশাসনিক ও আর্থ-সামাজিক উদ্যোগ

আসুন ভালো থাকি গত বছর ১৪ ডিসেম্বর ভোলার মনপুরাস্থ ভাষানচর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪জন এবং গণপিটুুনীতে নিহত হয়েছে ৬জন জলদস্যু। পুলিশ ও দস্যুদের বন্দুকযুদ্ধের সময় ক্রসফায়ারে একজন জেলেও নিহত হয়। জানা যায়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে জাকির বাহিনীর লোকজন আহত অবস্থায় আত্মসমর্পণ করতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে থাকা সাধারণ জেলেদের পিটুনিতে ৬ জন নিহত হয়। ১৪ ডিসেম্বরের এই ঘটনা ঘটার মাত্র দু’দিনের মাথায়, ১৬ ডিসেম্বর ঘটে আরও কিছু বড় ধরনের জেলে অপহরণের ঘটনা। ঐদিন বরগুনার সোনারচর ও ভোলা জেলার চরফ্যাসন এলাকার নুরাবাদ এলাকা থেকে ৫৮ জন জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করা হয়।

অর্ধকোটি টাকার মালামাল লুটের পাশাপাশি দাবি করা হচ্ছে আরও অর্ধকোটি টাকার মতো মুক্তিপণ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১)। সংবাদ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে কিছুটা আলোচনা চলছে । কিন্তু উপকূলীয় এলাকার জেলেদের জন্য ভয়াবহ আতঙ্ক এবং ভীষণ এই সমস্যার কোনও সমাধান হচ্ছে না, বরং বাড়ছে। ভোলা সহ পুরো উপকূলীয় এলাকায় জলদস্যুদের দৌরাত্ম চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই, সাধারণ জেলেরা এক কথায় তাদের কাছে অসহায়ভাবে জিম্মি। একটি ঘাটেরই একবছরের ক্ষতি ৬ কোটি টাকা: উপার্জনহীন ২০০০ জেলে পরিবার! ভোলা জেলার চরফ্যাশনে মেঘনা নদীর তীরে প্রায় ১০টি ঘাট রয়েছে, যেখান থেকে মৎস্য আহরণের জন্য নৌকাগুলো নদীতে ও সাগরে যায়, এবং সেখানেই ফিরে আসে।

এইসব ঘাটে আছে অনেক বড় বড় মৎস্য আড়তদার। সাম্রাজ ঘাট এই এলাকার সবচাইতে বড় এবং জনপ্রিয় ঘাট, এখানে আছে ২০-৩০ জন আড়তদার বা মাছ ধরার ট্রলারের মালিক, যাদের আছে প্রায় ৪০০ বড় ট্রলার এবং ৩০০ ছোট ছোট ট্রলার। আমরা এই ঘাটের আড়তদার সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি জানান, এমনিতেই নদী ভাঙ্গনসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এই পেশা। কিন্তু এখন সবচাইতে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই জলদস্যু।

শুধুমাত্র ২০১১ সালেই এই ঘাটের ১০০’র মতো ট্রলার ডাকাতি হয়, বিভিন্ন সময় অপহরণ করা হয় প্রায় ৫০০ জেলেকে। ট্রলার ও অপহৃত জেলেদের মুক্ত করতে প্রায় ২কোটি টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়। মাছ, ইঞ্জিন, তেল ইত্যাদি লুটপাটের মাধ্যমে ক্ষতি হয়েছে আরও প্রায় ৩ কোটি টাকার। জাল ডাকাতি হয়েছে ৫ লাখ টাকার। এই পরিস্থিতিতে প্রায় ১০০ মাছ ধরার ট্রলার এখন আর মাছ ধরতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।

ফলে সরাসরি, শুধুমাত্র এই ঘাটেরই প্রায় ২০০০ জেলে পরিবারের আয়ের পথ এখন বন্ধ। ঐ এলাকার জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বার বার জানানোর পরেও জলদস্যুদের দৌরাত্ম কমানোর ক্ষেত্রে আইন শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা এখনও তেমন কার্যকর হচ্ছে না। ফলে তারা গত বছর নিজেদের উদ্যোগে চট্টগ্রাম থেকে একটি দ্রুতগামী ইঞ্জিনচালিত নৌকা এনে টহল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু অত্যধিক ব্যয়বহুল বলে (এর জন্য তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টাকা) তারা সেটা আর অব্যহত রাখতে পারেননি। এই একটি মাত্র ঘাটের উদাহরণই আসলে সমস্যাটির তীব্রতা উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট। ১০ মাসে সহস্রাধিক ট্রলার ডাকাতি, অপহৃত ৩ শতাধিক, খুন ১৫ জেলে, ২০ কোটি টাকার মুক্তিপণ আদায় বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগর এলাকায় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সহস্রাধিক ট্রলারে আক্রমণ চালিয়েছে জলদস্যুরা।

এই সময় অপহরণ করা হয়েছে ৩ শতাধিক জেলেকে, হত্যা করা হয়েছে ১৫ জনকে। এই ১১ মাসে মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা, ট্রলারে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ লুট করা হয়েছে। একই সময় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ১৯ জলদস্যু। নভেম্বরের পরেও আরও ডাকাতি, অপহরণ আর মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু সংবাদ শিরোনাম এই বিষয়ে আমাদের ধারণা দেয়: - বঙ্গোপসাগরে জেলে বহরে গণডাকাতি ৩ ট্রলারসহ ৪০ জেলে অপহরণ (নিউজমিডিয়াবিডি.কম, ৮ নভেম্বর ২০১২) - সুন্দরবনের বদরা এলাকা থেকে ২০০ জেলে অপহরণ - বঙ্গোপসাগরে ৬ ট্রলারে জলদস্যুদের হামলা: ২৪ জেলে অপহরণ (প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর) - চারমাসে ৫০০ জেলে অপহরণ (সকালের খবর, ২০ ডিসেম্বর) - বঙ্গোপসাগরে মুক্তিপণের দাবিতে ২৪ জেলে অপহরণ (আজকের বরিশাল, ১৭ ডিসেম্বর) - মুক্তিপণের দাবিতে সুন্দরবনে ১০জেলেসহ ট্রলার অপহরণ (জনকণ্ঠ, ১৫ ডিসেম্বর) - সাগরে ভাসছে লাশ (মানব জমিন, ১৪ ডিসেম্বর) - সাগরে ভাসছে লাশ: জেলেরা ভয়ে (কালের কণ্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর) ২০১০ সালে এই এলাকায় প্রায় দেড় হাজার ট্রলারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, অপহরণ করা হয়েছে ৩৮০ ট্রলারসহ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জেলেকে, মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকার, খুন হয়েছে ১০ জেলে।

অন্য আরেকটি হিসাব অনুযায়ী, গত ৬ বছরে বঙ্গোপসাগর এলাকায় ২৫ হাজার ট্রলারে ডাকাতদল আক্রমণ চালিয়েছে এবং হত্যা করেছে ৮৩ জন জেলে। সমস্যা বহুমুখী: সমাধানের উদ্যোগ জরুুরি এই সমস্যায় জর্জরিত ভোলা ও নোয়াখালী জেলাসহ পুরো উপকূলীয় এলাকার জেলেরা। এই এলাকায় বর্তমানে প্রায় ২ লাখেরও বেশি লোক মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। জলদস্যুদের ভয়ে ভোলা ও নোয়াখালীর জেলেরা এখন আর বঙ্গোপসাগরে যাননা বলেই চলে, তারা এখন ঘাটের আশেপাশেই থাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ফলে এই ২ লাখ জেলে পরিবারের আয় ও উপার্জন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত।

মুন্সিয়া বাহিনী (বর্তমানে বিলুপ্ত), কামাল বাহিনী, নাসির বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী নামের জলদস্যুদের নাম জেলেদের কাছে মূর্তিমান আতংক। এদেরকে নিয়মিত মাসোয়ারা বা চাদার বিনিময়ে মাছ ধরতে হয়। এক পক্ষকে চাদা দিলেও অপহরণ করে আরেক পক্ষ। বিবাদমান বিভিন্ন পক্ষের সংঘর্ষের কারণেও সাধারণ জেলেকে প্রাণ দিতে হয়। জানা গেছে যে, সুন্দরবন উপকূলে প্রায় ২০টির মতো বিভিন্ন দস্যু বাহিনীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিশেষ টোকেন সংগ্রহ করতে হয়।

এই টোকেন সঙ্গে থাকলে সাধারণত নৌকায় হামলা চালানো হয় না। নিয়মিত চাদা দিয়ে এই এলাকায় মাছ ধরতে হয়। টোকেন দেখাতে ব্যর্থ হলেই অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়, নির্যাতন চালানো হয় জেলেদের উপর, কখনও কখনও হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় নদী বা সমুদ্রের পানিতে। গণপিটুনি সমাধান নয়, আগুনে ঘি ঢালা গণপিটুনীতে কুখ্যাত জাকির বাহিনীর প্রধান জাকির নিহত হওয়ার খবরে চরফ্যাসনে আনন্দ উৎসব হয়েছে ঠিকই, চাপা আতংকও ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র আকারে। কারণ, জাকিরের লাশ সনাক্ত করা যায়নি, ফলে জাকির আসলে নিহত হয়েছে কি-না সে ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান।

সাধারণ জেলেরা আশংকা করছেন যে, জাকির তার দলবল নিয়ে কোন চরে লুকিয়ে আছে, ফলে তারা প্রতিশোধ নিতে আরও মরিয়া হয়ে যাবে। জাকির মারা গেলেও তার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা প্রতিশোধ নিতে চাইবে বলে ধারণা করছেন সবাই। কেউ কেউ অবশ্য ডাকাত দলের সদস্যদেরকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার বিষয়টি নিয়েও সন্দেহ পোষণ করছেন। নিহতদের সবাই ডাকাত কি-না সে ব্যাপারেও কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তারা গণপিটুনিতে নিহত না-কি পুলিশের গুলিতে নিহত সে সন্দেহও রয়ে যাচ্ছে।

সুতরাং গণপিটুনিতে মেরে ফেলা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়, হতেও পারে না। সমস্যার সমাধান কোথায়? জেলেদেরকে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করতে মাঝেমধ্যে কয়েকটা অভিযান বা গণপিটুনি স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং আর্থ-সামাজিক নানা উদ্যোগ। যেমন: - নৌবাহিনীর টহল জোরদার - দস্যুদলের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন প্রত্যাহার - আইন শৃংখলা বাহিনীর আধুনিকায়ন - চর এলাকাগুলোতে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন - সুন্দরবন এলাকায় আইন শৃংখলা বাহিনীর চিরুনি অভিযান - জাটকা নিধন প্রতিরোধে প্রশাসনের যে সমন্বিত ও ব্যাপক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়, সেরকম সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন - যদি দস্যুদলের কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় তবে তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.