আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তগদ্যঃ মৃত গোলাপের শহরে

অন্ধকার; মৃত নাসপাতিটির মতন নীরব' নীলা বোদলেয়ারের ‘ক্লেদজ কুসুম’ হাতে নিয়ে কবরের মত গভীর এক পালঙ্কে শুয়েছিল নীলা । চারপাশটা গোরস্তানের মত নিশ্চুপ, নির্জন । বাতাসে বাসি বাসি ধোঁয়ার নীরস গন্ধ যেন অজশ্র বছর শুষে নেয়া ধোঁয়া খসে পড়া পলেস্তরার দেয়াল থেকে আজ উদগরিত হচ্ছে । সেলফের টবে ফুঁটে থাকা নিস্পৃহ প্লাস্টিকের ফুলে পড়েছে কয়েক পরত ধুলির আস্তরন । ভুল ফুল গুলো যেন অস্তগামী, বিবর্ন গোলাপ যার পচনের সময় আসন্ন ।

একটা অস্বস্তির বোধ থেকে নীলা আশপাশের রংচটা আসবাবপত্র, কয়েকরাতের শুন্যতা বুকে ধরে থাকা কিছু সিগারেটের প্যাকেটের দিকে চেয়ে দেখে । কার্পেটে জট পাকিয়ে আছে ধুলিবালি আর ময়লা । দালানের চাঁদোয়ায় বর্ষার আঁচর, টুপটুপ করছে কয়েক ফোঁটা । দ্বীপ শহরের রাস্তা, গলিপথ আর ফুটপাতগুলো ঠিক আগের মতই আছে । তবুও ইটপাথরের এই খাঁচায় সব শুন্য মনে হয় ।

এখানে অধিকাংশ মানুয়ের জীবন পুতুলের মত, অপরাপর চাহিদা আর প্রত্যশার ব্যাপারে তারা অনুভুতিহীন । ‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা’ । তুষ্টির দুর্মূল্যের বাজার । প্রাপনিকের অলস সওদাকাল যাপন অনর্থে । সুখসূত্র ভুলে গ্যাছে ভদ্রলোকেরা ।

কারন এই শহরে ব্রোথেল গুলোতে থাকা প্রমোদকাননগুলো হয়ে গ্যাছে ফুল ও ফলহীন, উষর । মৃতগোলাপের এই শহরে মাঝরাতের পানশালায় কিছু মানুষ খুঁজে ফিরে নিরানব্বই প্রুফ হুইস্কির ‘ব্যাড রোমাঞ্চ’ । পাবফেরত মানুষগুলো পাখি ও মৌমাছিদের পদ্যকথা ভাগাড়ে ফেলে তাদের ব্যক্তিগত ঈগলনীড়ে ফেরে পরাজিত সৈনিকের বিমর্ষতা মুখে নিয়ে । গল্পের নায়ক দীপ, নীলার হাজবেন্ড, মৃত গোলাপের এই শহরে একজন পাবফেরত ভদ্রলোক । * মোমবাতি ও ধুপ জানালার ভিতর থেকে জানালার বাহিরে দেখাটা যতটা অবারিত হয় জানালার বাহিরে থেকে জানালা দিয়ে ভিতরে দেখাটা ঠিক ততটা নয় ।

তবে নিত্যনৈমিত্তিক সুর্যের চেয়ে মোমবাতিই আমাদের কাছে বেশি আকর্ষনীয় হয়ে উঠে । তাই নীলা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে আর জ্বালায় ধুপ । ধুপের রিবন ভেষে যায় আলতো সুরে । তার বরফচোখে সম্মোহনের আলোছায়া । সেখানে নৃত্যরত গোলামরিচের বর্ণবিলাস আর কয়েকটা বোতলবন্দী জোনাকি ।

মৃদুগন্ধ ফিরিয়ে আনে নষ্টালজিয়া, ফিরে আসে শৈশরের স্বাধীন খেলার মাঠ আর কল্পনার মেঘ-কোকিলের শহর । সেখানে একটা রাতপাখির ছানার মাতৃনীড় থেকে প্রথম আকাশে উড়ে যাওয়া দেখে মনে পড়ে প্রথম সাঁতার শেখার কথা । হঠাত বাসী ধোঁয়া আর ধুপ মিলিয়ে বিবমিষা জাগায় । মোমবাতির আলো হয়ে উঠে অশ্লিল । জঠর থেকে উড়ে আসে এক ঝাঁক প্রজাপতি ।

অমানিশা-পুর্নিমা অথচ এমন তো হবার কথা ছিল না । এমতো নীলা কখনো চায় নি । নীলা ও দ্বীপ, একসময়ের তথাকথিত তুখর প্রেমিকযুগল । অথচ দ্বীপ আজ যেন নলাকার ব্যারেলবন্দী, নিক্ষেপন্মুখ একলা আখরোট । আর নীলা গভীর সমুদ্রদ্বীপে নিঃসঙ্গ এক লাইট হাউস ।

জীবনের অমানিশা সব আর কিছু দুঃখক্লেশ গ্রাস করেছে তাদের দুজনের সব পুর্নিমার আলো, থেমে গ্যাছে নতুনের স্বপ্ন দেখা । তাদের রাতের দেয়ালে স্বপ্নের রঙ হয়ে গ্যাছে খয়েরি । সম্পর্কের শরীরে ভাজ পড়েছে, গোলাপ হয়ে পড়েছে নীরক্ত । নির্লিপ্ত, হলুদাভ সময়ে মুখসের আড়ালে তাদের অতৃপ্ত জীবন আজ নগ্ন হয়ে পড়েছে । গোলাপঝড় দ্বীপের চুলে বিলি কেটে দেয়ার সময় নীলার প্রজাপতির ঝলমলে ডানার মত চোখের গভিরটা কেমন নির্লিপ্ত, নিষণ্ন লাগছিল ।

বিষন্নপুকুরে ডুব দেয় দ্বীপ । ম্লানালোকে মুখোমুখি দু’জন । ফুঁটে উঠে পাজরের হাঁড়ে নিমীলিত গোলাপ । সাধারনত নীলবর্ষায় গোলাপহৃদয় বৃষ্টিপ্রবণ । হঠাত অলকমেঘ উড়ে আসে কন্টকিত গহন বনে বুকের কার্নিশে, আর মনে ।

মন্দানিল অভিসারে মেঘের ফেরিওয়ালারা ক্রশম বাজপাখি হয়ে উঠে । ফুল আর পাখিরা বাতাসে ছড়িয়ে দেয় গোলাপঝড়ের সতর্কসংকেত । আদ্রবাতাসের নাওয়ে অজশ্র গোলাপ জলজবিহার মেতে উঠে । বাজপাখির ডানারা ভিজে আসে । গোলাপঝড়ের চোখে প্রণয়াকুল হয়ে উঠে মেঘডম্বর রাত, পাতাদের মন্দ্রস্বর ।

গোলাপের কলি, পাতা আর পাপড়ি গুলো মগ্ন হয় জলকেলীতে, ডুবজলে রচিত হয় জলতৃঞ্চার পদ্য । ঝড় শেষে গোলাপের বিভায় আলোকিত নীলা নবম মেঘে বসে জ্যোৎস্না দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । মেঘ-কোকিলের শহরতলী সুর্যপ্রয়ানের কাছাকাছি সময়ে নীলা মেঘের দ্রুততায় সাঁতরে বেড়ায় স্মৃতির সিন্ধু । সুর্যের সর্বোশেষ রশ্মিটাকে নিশ্বাষে টেনে নিয়ে কঁচি ঘাসেদের ডানায় চেপে ছুটে যেতে চায় সবুজে অবারিত প্রজাপতিগ্রামে । সেখানে একটা কুহক বাতাস বয়ে যাবে কানের কাছে দমকা হাওয়ার মত, বসন্তচিত্রে বাতাসের পায়ে থাকবে শুকনো পাতার নুপুর ।

“তুমি দেখে নিও যখন বৃষ্টি থেমে যাবে তখন আমরা ঐ আকাশের কাছে বুঝে নিব নক্ষত্রদের বিস্তারিত গোপন” মালতীরঙের সন্ধা পেরিয়ে ভানুমতির খেলা শেষ হয়ে এলে তারা সিড়ি ভেঙে উঠে আসবে মাঝরাতের ছাদে । নীলা অশুভ পুষ্পের উপাসক বোদলেয়ার থেকে আবৃতি করে- And guarding their last embers till the end, Our hearts shall be the torches of the shrine, And their two leaping flames shall fade and blend In the twin mirrors of your soul and mine. তারাদের পানে চেয়ে থাকে দ্বীপ- “কোন তারার দিকে একনিবিষ্টে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলে তারাটা তোমাকে আপন করে নিবে । এরপর যতই সময় অতিবাহিত হবে ততই ঐ তারা থেকে তোমার আত্মিক দুরত্ব কমে আসবে” কপোতনিশিথের আকাশ গেয়ে যাবে ঘুমপাড়ানীর গান যতক্ষন তারারা জেগে থাকে তাদের সাথে । “এরপর ঐ আকাশের সুদুরে যদি আস্থাভাজন কিছুই খুঁজে না পাই, যদি মুছে যায় অতিকায় নক্ষত্ররা তবে আমরা হব কোন নবতর ধর্মের প্রবর্তক” La Mort des Amants পাংশু আলোর নিচে রতিবিলাসিনী এই নিশিথের শেষ দৃশ্য উপনিত হয় নীলা আর দ্বীপ । নক্ষত্ররা মুছে গ্যাছে।

তাদের ঘুমন্ত করোটির ভেতরে নিরেট আঁধারে থৈ থৈ করে পঁচে যাওয়া গার্হস্থ্য জ্যোৎস্নার হেমলক, পড়ে থাকে নৃশংস ভাবে হত্যাকৃত একটা কবিতা আর ঝরে পড়ে ভুল গোলাপের সমস্ত পাপড়ি । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।