আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তসলিমার সঙ্গে সমঝোতা এবং এক রাম-রমণীর গল্প

ভালো আছি স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বাকস্বাধীনতার ধ্বজাধারীদেরকেও। তাদের কল্যাণেই তো এখনও আমরা তসলিমার লেখা নিয়মিত পাচ্ছি। দেশের পনের কোটি মানুষের ধিকৃত এক নারী, যে প্রায় দেড় যুগ (১৯৯৪ইং) আগে এ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে, এখনও আমাদের কাগজে-কলামে জায়গা করে নিচ্ছে। তার বিকৃত-কদর্য গর্ভ থেকে প্রসবিত রচনা এখনও আমাদের পত্র-পত্রিকাগুলোকে সরবরাহ করে চলেছে এক একটি উৎকট গদ্য-মাদকের।

ধেই ধেই করে নাচছে ইয়োলো জার্নালিজম আর হলুদ সাংবাদিকতার লালন ফকিররা। কারণ এভাবে এখনও তারা তসলিমার সঙ্গে সমঝোতার মনোভাব ধরে রাখতে পেরেছেন নিজেদের সতীত্বে তার অসহ্য আঘাত কোনরকম সয়ে বয়ে। এই সওয়া বওয়ার কারণ হলো, তসলিমা ও তাদের টার্গেট অভিন্ন- মুসলিম মানবতাবাদকে জঘণ্যরূপে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা। তাই তসলিমার ‘ক’-এর কথায় তারা ‘লজ্জা’ পেলেও তাদের লাজ হয়নি। তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিতে’র ভাষায় তাদের সততা ও সতীত্ব ক্ষুণ্ন হলেও সাধুতা যায় নি।

তসলিমার সঙ্গে এদেশীয় বুদ্ধিজীবীদের সেই ‘সমঝোতা’ নিয়েই আজ কথা হবে। তার আগে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। আমাদের দেশে যারা ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের প্রায় সকলের ধারণা, তসলিমা নাসরিন হুজুরদের সফল আন্দোলনের মুখেই এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। না, শুধু ধারণা বললে ভুল হবে, বলতে হবে পকাপোক্ত বিশ্বাস এমনটাই। কারণ তসলিমার উদাহরণ তুলে তসলিমাপন্থীদের নির্বাসনে পাঠাবার হুঙ্কার দিয়ে সচরাচর মাঠ-ময়দান গরম করি আমরা।

তাছাড়া তসলিমার নির্বাসনের ঘটনায় ব্যথিত দেশীয় দোসরদের অভিযোগের আঙুল ওঠে মুসলিম মৌলবাদের দিকেই। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে এখন সে বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে আপামর জনসাধারণের মধ্যেও। ফল হয়েছে, এখন তসলিমা ইউরোপ-আমেরিকা যেখান থেকেই বিতাড়িত হোক না কেন দোষ পড়বে নন্দঘোষ মোল্লাদের ঘাড়ে। আর মোল্লা মানেই জঙ্গি। অতএব, ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত জঙ্গিতে ছেয়ে গেছে।

কলকাতা-বিহার-উড়িষ্যায় রয়েছে জঙ্গিদের বড় বড় ঘাঁটি। সেখানকার প্রশাসনেও জঙ্গিরা ঘাপটি মেরে আছে। তাই ভারতে তসলিমার ভিসার মেয়াদ বাড়ানো যাচ্ছেনা। কিন্তু বাংলাদেশী মোল্লাদের কারণেই যেহেতু এতসব গ-গোলের শুরু, সুতরাং বাংলাদেশই হলো এই ক্যাটাগরির জঙ্গিদের মূল যোগানকেন্দ্র। অর্থাৎ, বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নেই, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নেই, নারীদের সমান অধিকার নেই, তসলিমার মতো ‘নিরীহ’ লেখিকাদের জানমালের নিরাপত্তা নেই।

মোটকথা বাংলাদেশ এখনও সা¤প্রদায়িকতার ঘেরাটোপে বন্দি। নারী-পুরুষের বৈষম্যে এদেশের পথ-ঘাট, কল-কারখানা, কলেজ-বিদ্যালয় অস্থির ও অস্থিতিশীল। সর্বোপরি এখানকার মানুষের নেই যৌনস্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। মানে এই দেশের পর্ণো একট্রেসরা শান্তিতে জনসম্মুখে সেক্সুয়াল এ্যাক্টিভিটি দেখাতে পারে না। কিন্তু এতসব অকারণ কী করে হলো ? তসলিমার কারণে।

তসলিমা না থাকার কারণে। সুতরাং যে কোন মূল্যে তসলিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ একমাত্র তসলিমার আছে ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’। সে-ই পারতো এ দেশে একটা ‘স্থিতিশীল’ পরিবেশ তৈরী করতে। গণমাধ্যমে তাই এত তোড়জোর, এত লেখালেখি।

কিন্তু না, তসলিমাকে দেশে আনা যাবে না। বরং তসলিমার কাজটিই শাহ্নাজ মুন্নী, মুন্নী শাহা কিংবা রাশেদা কে চৌধুরী টাইপের গংদের দ্বারা করিয়ে নিতে হবে। তসলিমাকে আনা যাবে না। কারণ তসলিমার মুখ খুব পাতলা, কলমের মুখ বেশি খোলা। সেই পাতলা মুখে সত্যের সঙ্গে অতিসত্য কথাটিও আটকায় না।

এবং খোলাকলমে তথ্যের সাথে নেপথ্যও বেরিয়ে আসে। কাঁঠালের কোষ খেতে যেয়ে সে বিচিটাও ছাড়ে না। তাই তার মলে দুর্গন্ধ বেশি। তাতে সহচরদের মান বাঁচে না। সততা নষ্ট হয়।

সতীত্ব ক্ষুণ্ন হয়। সুতরাং তসলিমা দেশে ফিরতে পারছে না কেন? অথচ তার প্রগতিশীল সহচরেরা ক্ষমতায়? মৌলবাদের ভয়ে? মোটেও না। প্রগতিশীলেরা মৌলবাদকে ভয় পায়? একদমই না। বরং এই প্রগতিশীলেরাই প্রধান বাধা তসলিমা দেশে ফিরতে না পারার। এবং এরাই হলো মূল কারণ তসলিমা দেশ ছাড়তে বাধ্য হবার।

আরেকটু খুলে বলি। তসলিমার প্রথম বিতর্কিত বই ‘লজ্জা’ প্রকাশিত হওয়ার পর এদেশের ইসলামপন্থী গণশক্তি ফুঁসে উঠেছিল সত্য। এবং সেই সত্যকথাটা তসলিমা নিজেও তার রচনায় লিখেছে বহুবার। কিন্তু এই ফুঁসে ওঠাটা তসলিমার পিলে চমকে দেয়ার মতো কোন ব্যাপার আদৌ ছিল কিনা- সন্দেহ। কারণ সেই ফুঁসে ওঠায় তসলিমার দেশান্তর তো দূরের কথা, উপরন্তু আমরা দেখেছি, সেই উত্তাল আন্দোলনের মাঝে পরপর আরো দু’টি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে তসলিমার।

সেই সব গ্রন্থের মধ্যেই উঠে এসেছে যে, তার চলার পথের পথিক সে একা নয়; বন্ধু রয়েছে অনেক। এবং পথ নির্মানের নেপথ্যে রয়েছে নামজাদা সব লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও ভার্সিটির প্রফেসররা। যারা ভোগের চোখে তাকে দেখেছে, তাকে ডেকেছে নানা ছলনায় এবং তাদের সংসর্গেই কেটেছে তসলিমার যাপিত জীবন। ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া রগরগে কাহিনীর সেই সরল স্বীকারোক্তিই গোলমাল বাধিঁয়েছে তসলিমার বৈষয়িক জীবনে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তসলিমা।

দশ বছর পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘুরেফিরে অবশেষে ভারতে মাথা গুঁজেছে নাসরিন বাংলাদেশের আর দশটা ক্রিমিনালের মতো। তবে নিরাপদ ঠাঁই হয়নি সেখানেও। দ্বিতীয় অত্মজীবনী ‘খ’ প্রকাশের পর ঠিক একই কাহিনীর জের ধরে পাগল তাড়া খেয়ে এখন সে ভবঘুরে। প্যারিস থেকে নিউইয়র্ক, লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন চলে তার যাযাবরি যাত্রাবহর। এরপরই এল সমঝোতার পালা।

নিজেদের জাত-মান বাঁচাতে গিয়ে গোপনে তসলিমাকে দেশ ছাড়া করার ষড়যন্ত্রে মদদ জুগিয়েছে যারা; বহুদিন ধরেই একটা সমঝোতার সুযোগ খুঁজছিল তার সেই মুনাফালোভী সতীর্থরা। এখন আবার সেই প্রগতিশীল সরকার ক্ষমতায়; যারা একসময় দুধ-কলা খাইয়ে তসলিমাকে বড় করেছে। উভয়ের লক্ষ্যমাত্রা এক ও অভিন্ন, সুতরাং সমঝোতা হতেই পারে। আর সেই সমঝোতা চূড়ান্ত হয়েছে বলেই আমরা দেখি, যেখানেই থাকুক তসলিমা, বাংলার মাটির ঘ্রাণ সে ঠিকই পায়। অর্থবিত্তেরও অভাব হয় না তার।

ফলে আবার জেঁকে বসেছে তসলিমা আমাদের সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। তসলিমার বই নিষিদ্ধ হলেও তার অসিদ্ধ রচনার তাজা চালান নিয়মিতই পৌঁছে যাচ্ছে হলুদ সাংবাদিকদের পাড়ায় পাড়ায়। সে যাই হোক, খুনসুঁটি ঝগড়াঝাটি কোনকালেই ভালো নয়। তারচে’ বরং সমঝোতা ঢের ভালো। সুতরাং আত্মসম্মানের মাথা খেয়েও যারা তসলিমার সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে পেরেছেন, তারা যে বেশ ভালো কাজটিই করেছেন- সে কথা স্বীকার না করে যাই কোথায়।

কিন্তু সঙ্গত কারণেই আমরা তাদেরকে এবং তাদের এই ঐতিহসিক সমঝোতাকে সাধুবাদ জানাতে পারছিনা। তবে কিছু শর্ত-টর্ত মানতে পারলে সমঝোতা আমরাও চাই। ইসলামও সমঝোতা চায়। ইসলাম চায় বলেই আমরা চাই। রাসূল সা. সমঝোতা পছন্দ করতেন।

আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে সা. সমঝোতার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী, আপনি বিধর্মীদেরকে বলুন, এসো তোমরা সেই কালিমার প্রতি, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে অভিন্ন, যে, আমরা আল্লাহকে ছাড়া আর কারো উপাসনা করবো না এবং তার সঙ্গে কোনকিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করবো না...। ’ তো তসলিমার ইদানিংকালের একটি রচনা থেকেই আমরা অযাচিত সমঝোতার রসদ খুঁজে পেয়েছি। বুঝেছি সদিচ্ছা থাকলে তসলিমার সঙ্গেও আপোষ-সমঝোতা সম্ভব। তাহলে সেই রচনাটার দিকে একটু নজর দেয়া যাক।

অধুনা প্রকাশিত সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক কাগজ ‘নতুন ধারা’র চতুর্থ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে ‘এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়’ শিরোনামের প্রবন্ধটি। কোনরকম ভূমিকা-ভণিতার আশ্রয় না নিয়ে লেখিকা সরাসরি প্রতিবাদে নেমেছেনÑ ‘‘আমাকে যখন বলা হতো, আমি এখন বড় হয়েছি, যেন কালো বোরখায় আপাদামস্তক ঢেকে বাইরে বেরোই, আমি প্রশ্ন করেছি, আমি মানিনি। রাস্তায় হাঁটলে আমাকে যখন গালি ছুড়ে দিত অচেনা ছেলেরা, যখন ওড়না কেড়ে নিত, স্তন টিপে ধরতো, প্রতিবাদ করেছি। ...’’ ধন্যবাদ তসলিমা। অচেনা ছেলেদের বখাটেপনার বিরুদ্ধে যেই সাহসিক প্রতিবাদ আপনি করলেন, তার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত।

ইসলাম কিন্তু এই বখাটেপনার বিরোধিতাই শুধু করেনি বরং পরম শাস্তির ঘোষণাও দিয়েছে। তবে এই বখটেপনা থেকে বাঁচতে হলে আগে তো আপনাকে আপন চরিত্রের বৈপরিত্য ঘোচাতে হবে। অর্থাৎ বাইরে বেরোতে হবে ‘আপাদামস্তক কালো বোরখায় ঢেকে’ রেখে। নয়তো আপন খেয়ালে যদি আপনি স্তন দুলিয়ে দু’নালের ওড়না ঝুলিয়ে ‘বখাটিনী’র মতো করে হাঁটেন, আর তা দেখে অচেনা বখাটেরা কিছুমিছু করে বসে- তবে তা এমন দোষের কী হবে বলুন। এতো ‘হাজারুন আলা হাজার’ বা বখাটে বখাটে ধাক্কা।

পাপ সম্পাদনকারী এবং পাপের উস্কানীদাতা উভয়ে কি সমান অপরাধী নয়? তারপরও আমরা জানি, এই প্রতিবাদ লেখিকার আন্তরিক প্রতিবাদ নয়। বাইরে কলমবাজি করলেও ভেতরে ভেতরে এমন অজস্র বখাটেপনার কামনা তিনি রীতিমতোই হৃদয়ে পুষতেন। তার রচিত আত্মজৈবনিক গ্রন্থগুলোতে নিজের মেলামেশার যে অবাধ কামকলা তিনি চিত্রিত করেছেনÑ তা-ই আমাদের যুক্তি প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। তসলিমা লিখেছেন, ‘‘পুরুষেরা চার চারটে মেয়েকে বিয়ে করে ঘরের দাসি বানাচ্ছে, উত্তরাধিকার শুধু মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে বঞ্চিত হচ্ছে...। ’’ চার চারটে শব্দ দ্বারা স্পষ্টতই তিনি ইসলামে চার বিবাহ বৈধতার প্রতিবাদ করেছেন।

স্যরি তসলিমা, উই আর এক্সট্রিমলি স্যরি। না না, আপনার যুক্তির সামনে অবনত হয়ে নয়, আপনার মতো একজন সচেতন লেখিকার অজ্ঞতার বাহার দেখে। জানেন না বুঝি, ইসলামে বিবাহ মানে দাসত্ব নয়, বরং পরিবারের ছোট্ট রাজ্যে একজন মূকুটহীন রাণীর প্রবেশ। এমনকি দাসীকে দাসী রেখে বিবাহ করার বৈধতাও তো ইসলাম দেয়নি। হ্যাঁ, কেউ যদি সেই রাণীর সঙ্গে দাসীর ন্যায় আচরণ করে তবে তার জন্য সমুচিত শাস্তির বিধানে ইসলাম সর্বদা সোচ্চার।

আর চার চারটেÑ এক্ষেত্রে আপনি জরিপ করলে ভরসা পাবেন জনাবা, যে, পৃথিবীর তাবৎ মতবাদ কিংবা ধর্মের রীতিনীতি মতে বিবাহের জন্য এই চার সংখ্যাটিই সবচেয়ে সহনীয় সংখ্যা। তাছাড়া বউ পালনের যেসব শর্ত-সংজ্ঞা শরীয়তে রয়েছে তা পূর্ণরূপে মেনে চলতে গেলে এক বৈ দুই বিবাহের চিন্তাও অন্তত এযুগের কারো মাথায় আসবে বলে মনে হয় না। জানতে চাই, তসলিমা, রাজা পঙ্গত যে নয় হাজার বিয়ে করে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম লিখিয়েছে, তাতে আপনার কোন মাথাব্যাথা হয়না? আর মেয়েদের উত্তরাধিকার নিয়ে তসলিমা যে প্রশ্ন তুলেছেন সে সম্পর্কে আমি কোন কথা বলতে চাই না। কারণ মনে হচ্ছে, এ ব্যাপারে তার জ্ঞানের পরিমাণ একেবারে শূন্যের কোঠায়। শুধু অনুরোধ করি, বাঙালী মৌলভী মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের লেখা ‘নারীর অধিকার ও লিঙ্গ সা¤প্রদায়িকতা’ প্রবন্ধে একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন, সংক্ষেপে অগাধ জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।

তসলিমার আরেকটি প্রতিবাদ, ‘‘উঠোনে গর্ত করে সেই গর্তে ঢুকিয়ে মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে মারা হচ্ছে...। ’’ এই উক্তির জবাবে আমাদের কয়েকটি কথা বলার আছে। এক. ব্যাভীচারের শাস্তির বিধানে নারী-পুরুষ উভয়ে সমান। এখানে আলাদাভাবে মেয়ে লিখে সাবোটাজ করার প্রয়োজন নেই। দুই. আইন তৈরী হয় মানুষের নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে।

সুতরাং সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা রোধে সেই সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র আইনানুগ যে কোন পদ্ধতির শাস্তির বিধান জারী করার ক্ষমতা রাখে। এতে কারো কিছু বলবার নেই। তাই আমরা দেখি, পাথর মারার থেকেও নিদারুণ শাস্তির অসংখ্য নজির পৃথিবীতে আছে। তিন. একটি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য ব্যাভীচারের মতো জঘণ্য অপরাধের শাস্তি ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে পাথর ছুঁড়ে হত্যা। তবে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা করে এছাড়া ভিন্ন কোন শাস্তি বিচারক প্রয়োগ করতে পারেন।

চার. চশমার আয়না যেমন, চশমাওয়ালার চোখে সবকিছুই তেমন। নইলে সদ্য বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের তালেবান শাসনামলের পাতায় চোখ রাখুন। দেখতে পাবেন, এই পাথরমারার শাস্তি কার্যকর হওয়ার ফলে তখন একজন নির্বান্ধব নারী একাকী কান্দাহার থেকে খাইবার পর্যন্ত হেঁটে গেলেও তার প্রতি কোন বখাটে পুরুষ চোখ উল্টে দেখার সাহস পেত না। পাঁচ. তসলিমা, যেই শাস্তিকে আপনি মেয়েদের ওপর পুরুষের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের অত্যাচার ভেবেছেন, ইতিহাস দেখুন, সেই অমোঘ শাস্তি বরণ করে নিজেকে কালিমামুক্ত করতে গামিদী বংশের এক মহীয়ষী নারী সাহাবির রা. কী আকুতিই না ছিলো। রাসূলের সা. দরবারে স্বীয় অপরাধের অকপট স্বীকারোক্তি দিয়ে শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘রাসূল, আমাকে পবিত্র করুন।

’ আলোচ্য রচনায় তসলিমা উষ্মা প্রকাশ করেছেন, ‘‘ধর্মীয় স্পর্শকাতরতায় আঘাত দিয়েছি আমি, এমন প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে। ধর্মের সঙ্গে নারীবাদের বিরোধ চিরকালের। আমি ধর্মও মানবো, নরীর অধিকারও মানবো, এ অনেকটা আমি বিষও খাবো, মধুও পান করবোর মতো। ’’ আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি তসলিমা, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও সর্বোত্তম জীবন ব্যবস্থা তথা আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন। তাই এই দীনকে অন্য দশটা ধর্মের স্রোতে অবাধে ভাসিয়ে দিলে চলবে না।

সুতরাং যে কোন ধর্ম আপনার মতে ‘আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক’ হতে পারে, কিন্তু ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার স্বভাবতই অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায়ও বেশি। তবে জলচর ও স্থলচর প্রাণীর মতো নারী ও পুরুষের কক্ষপথে নির্দিষ্ট কিছু ভিন্নতা ও স্বতন্ত্রতা সৃষ্টিগতভাবেই রয়েছে। একজন পুরুষ যেমন ইচ্ছে হলেই নারীর অন্দর মহলে প্রবেশ করতে পারে না, তেমনি একজন নারীও মন চাইলেই বেরিয়ে পড়তে পারেনা পুরুষের খোলা আঙিনায়। অবশ্য তসলিমা তার প্রবন্ধে মুসলমানদের পক্ষে চমৎকার একটি তথ্য উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “আজ ব্রিটেনে মুসলিমরা তাদের শরীয়া আইন আনার দাবী তুলেছে, এতে সায় দিচ্ছে ইংলেন্ডের বিশপসহ বেশ কজন ব্রিটিশ মন্ত্রী। ” এই তথ্যের শেষে তসলিমার মুসলিম দরদী (!) মন আবার হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে, “যারা আজ সমানাধিকারের সংস্কৃতি অস্বীকার করে মুসলিমদের সংস্কৃতি লালনের পক্ষে, তারা মুসলিমদের মঙ্গলাকাক্সক্ষী নন, তারাই মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু।

” দুঃখিত তসলিমা, আপনাকেও যে আমরা বন্ধু ভাবতে পারছি না। তাতে যতই আপনি এই বলে মায়াকন্না কাঁদুন যে, ‘‘চলমান মানসিকতার মানুষ মুসলিম সমাজের কত বড় যে ক্ষতির কারণ, তা মুসলিমরা আজ না বুঝলেও নিশ্চয়ই একদিন বুঝবে। ’’ প্রবন্ধের শেষদিকে এসে তসলিমা বড় খোলামেলা কথা বলেছেন, ‘‘সম্ভবত তারা আমাকে মুসলিম হিসেবে দেখেছে। কবিতা সিংহ নারীবাদের কথা লিখলে ঠিক আছে, আমি লিখলে ঠিক নেই। কারণ আমি ‘মুসলিম’।

আমাকে ‘মুসলিম রিফর্মার’ ভেবে ভুল করা উচিত নয়। আমি রিফর্মার নই, কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীরও কেউ নই। আমার গোষ্ঠী ধর্মমুক্ত মানববাদীর। ’’ না, তসলিমা, ভুল আমরা করিনি। ভুলটা সম্ভবত আপনারই হয়েছে।

আমরা তো শুরু থেকেই আপনাকে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছি। তবে আপনি যে গোষ্ঠীর কথা বললেন অর্থাৎ ধর্মমুক্ত মানববাদ, এখানেও একটা বৈপরিত্যে জড়িয়ে পড়েছেন আপনি, বোধ হয় নিজের অজান্তেই। মানববাদ বা মানবতাবাদ, সেতো ইসলামের মূল নীতিকথা, দীনের অন্যতম শ্লোগান। সুতরাং ইসলামকে কোন ধর্ম মেনে থাকলে ‘ধর্মমুক্ত মানববাদ’ বলার একদিকে যেমন কোন সুযোগ থাকেনা। তেমনি ইসলামকে দীন মেনে নিলে পুরোটাই ইসলামের শ্লোগানে পরিণত হয়ে যায়।

তাহলে তসলিমা আপনাকে আবারও বলতে হবে, আপনার গোষ্ঠী আসলে কোনটি। সে যাই হোক, আমরা বলেছি, তসলিমার সঙ্গে একটা সমঝোতা আমরা চাই। উপর্যুক্ত বৈপরিত্যগুলো ছাড়া আলোচ্য প্রবন্ধের বাকি সব বাদ-প্রতিবাদের সাথে রয়েছে ইসলাামের অপূর্ব ঐক্য । সুতরাং সমঝোতা হতেই পারে। সেই প্রত্যাশিত সমঝোতার পূর্বে আসুন একটা সমঝোতার গল্প শোনা যাকÑ একঘেয়েমির জীবন ঘাঁটতে ঘাঁটতে সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে রামের স্ত্রী।

রেগেমেগে একদিন স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘সংসারের সকল ঝক্কি-ঝামেলা আমার একার পক্ষে পোহানো আর কিছুতেই সম্ভব নয়। ’ রাম হকচকিয়ে বললো, ‘মানে?’ ‘মানে সোজা’- স্ত্রীর শান্ত জবাব। ‘সন্তান জন্ম দেয়া থেকে শুরু করে পরিবারের যাবতীয় কাজ সামাল দিতে হয় আমার একার। আর তোমরা পুরুষেরা পদ্মাসনে বসে কেবল খাও আর বউয়ের গলা ধরে ঘুমাও। এটা অবিচার।

এ বৈষম্যের একটা বিহীত করতে হবে। নইলে আমি নির্বাসনে যাব। ’ রাম বেচারা অস্থির। কী যে করবে কিছুই ঠাহর করতে পারছেনা। বউ ছাড়া তার একদিন তো ভালো একমুহূর্তও চলে না।

সে কিনা যাবে নির্বাসনে! রামের অবস্থা দেখে বউয়ের মায়া হলো। বললো, ‘আচ্ছা আমি নির্বাসনে যাব না। তবে তার আগে আমাদেরকে একটা সমঝোতায় আসতে হবে। সংসারের সকল কর্ম দু’জনে আধাআধি করে সামাল দিতে হবে। ’ রাম একপায়ে রাজি।

তবুও বউ ঘরে থাক। এখন থালাবাসন ধোয়া, কাপড় কাচা, গরু চড়ানো, দুধ দোয়ানো, রান্নাবান্না- সব কাজেই অন্তত অর্ধেকটা হাত লাগানোর চেষ্টা রাম করে। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল। সমস্যা হলো বউ পোয়াতি হওয়ার পর। প্রশ্ন উঠলো, বাচ্চা জন্ম দেয়া নিয়ে।

এটাও তো সাংসারিক কাজের মধ্যেই পড়ে। বউয়ের এক কথা, ‘এটাতেও ভাগাভাগি হবে। সন্তান তো আর মায়ের একার নয়, বাবারও ভাগ আছে। অতএব, দশমাস পেটে বওয়ার কষ্ট না হয় আমি সইবো, তবে তোমাকে সইতে হবে প্রসব যাতনা। ’ এবার রাম পড়লো মহাফাঁপরে।

এ কী করে হয়। কিন্তু হতেই যে হবে। না হলে যে বউ যায়, জান যায়। নিরুপায় রাম কাচুমাচু হাতে বিগলিত গলায় ঢলে পড়লো উপাসনায়। নিমগ্ন প্রার্থনায় প্রশান্ত আশ্বাস পেল, ‘ভয় নেই।

তোমার বউয়ের কথাই সই। ’ নিশ্চিন্ত রাম শান্তমনে ফিরে এল ঘরে। দিন-তারিখ গুণে যথাসময়ে শুয়ে পড়লো আঁতুরঘরের বিছানায়। এক্ষুণি প্রসব বেদনা শুরু হবে। তারপর মাটিতে নামবে ফুটফুটে নবজাতক।

কিন্তু কিসের যন্ত্রণা, কোথায়? সময় বয়ে যায়। এদিকে বিশ্বস্ত গৃহভৃত্যের সদ্য পরিণিত বধু এসে হাউমাউ কান্না জুড়ে দিয়েছে রামের হাত-পা জড়িয়ে ধরে, ‘রামজি আমার সোয়ামিকে বাঁচান। ’ মুহূর্তেই বাতাস বদলে গেল। প্রত্যাশিত রামজির পরিবর্তে আঁতুরঘরে এলো বাড়ির অপয়া পরিচারক। তারপর আর কি।

সহজ হিসাব। রামের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, বউয়ের এতদিনের সমঝোতা আসলে তার সঙ্গে ছিল, নাকি চাকরের সনে। রাম-রমণীর গল্প এখানেই শেষ। আমাদের কথাও শেষ। এখন তসলিমাইে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, প্রকৃত সমঝোতাটা তিনি কার সঙ্গে করবেন।

বিচার দিনের স্বামী সুমহান আল্লাহর সঙ্গে? তাহলে পৃথিবীর সোয়াশ’ কোটি মুসলিমকে সঙ্গী পাবেন তিনি। নাকি ওইসব দেহলোভী ভৃত্যদের সঙ্গে। সবশেষে মাত্র একটি কথা। তসলিমা ক’দিন আগে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি ভালো নেই। নির্বাসনের এ সময়ে মনে হয়, আমি যেন এক মন্থর মৃত্যুর মুখোমুখি।

’ আমরা তসলিমাকে আশ্বাসবাণী শোনাতে চাই, যদি আপনি স্ববিরোধী বক্তব্য আর স্বভাবের বৈপরিত্য ছেড়ে রাম-রমণীর লাম্পট্য ত্যাগ করে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা রক্ষা করতে পারেন, তবে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যেকারণেই আপনাকে নির্বাসনে যেতে হোকনা কেন দেশে এনে আপনাকে সবুজ গালিচা সবংর্ধনা জানাতে আমরা প্রস্তুত। আর যদি তা না হয় তবে কবির কথাই সই- বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। মানে সোজা- তসলিমার জন্য নির্বাসনই ভালো, আমাদের জন্য মাতৃভূমি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।