এস এম আরিফ দুপুর ১টা প্রায় বাজে। কর্কশ কণ্ঠে মোবাইলটা বেজে উঠল।
ও প্রান্ত থেকে বন্ধু জাবির। হালিমের দোকানে চলে আয়, জরুরী কথা আছে বলেই লাইন কেটে দিল। মেজাজ সপ্তমে চড়ার পর্যায়ে।
এটা বাইরে যাওয়ার কোন সময় হল?
মোবাইলে মিনিমাম ব্যালেন্স পর্যন্ত নাই যে ফোন দিয়ে না করব।
বাসায় বসে থেকে এমনিতেই মেজাজটা হট হয়ে আছে। ভাবলাম দেখেই আসি না ব্যাটা কি বলে।
হালিমের দোকানে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক এখনও আসেননি! হালিমের মোবাইলটা নিয়ে দুইবার রিং করলাম। জানি এখন সে ফোন ধরবে না।
বসে বসে চুল ছেঁড়া ছাড়া কিছুই করার নেই। হালিম ক্যাশের টাকা গোনায় ব্যস্ত। মনে হয় বাসায় চলে যাবে। তখন আমার জন-মানবহীন এ তিন রাস্তার মোড়ে খাঁ খাঁ করা রোদে একা একা জাবিরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
-ভাইয়া HB একটা পেন্সিল দেননা।
মেয়েলি কণ্ঠের আওয়াজ শুনে তাকালাম। শহরের নাম করা কলেজের ড্রেস পরা এক ছাত্রী।
-পেন্সিল নাই।
-ওমা, কাল না কয়েকটা দেখে একটা নিয়া গেলাম।
-কাল নিচ ত আজকে আবার লাগে কেন?
-আরে ওইডা হারায়া ফালছি।
-পড়ে আইসো, সব বেইচালছি।
-কী ঝামেলায় পরলাম, বলে মেয়েটি চলে গেল।
হালিমকে বললাম, কিরে পেন্সিল রেখেও দিলি না কেন? খাতাপত্রগুলোর আড়ালে চকচকে কতগুলো পেন্সিলের মাথা দেখা যাচ্ছে।
-আরে, .......(অশ্লীল বকা) মাইনশের বাসাত করে কাম। আবার HB পেন্সিল মারায়!
-কাম করে মানে!? দেখলাম কলেজ ড্রেস পরা।
বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-আরে ব্যাডা কইছনা, সামসুদ্দিন চাচার বাসার কামের মাইয়া না এইডা?
-কছ কি ব্যাটা তুই!? কাজের মেয়ে পড়ে ওই কলেজে? খরচ-টরচ কেডা চালায়?
-ভাই, এত কিছু জানিনা। আমার বাসাত যাওন লাগব।
-আরে বাসায় তো যাবিই। আচ্ছা, সামসুদ্দিন চাচাটা কে?
-বিকালে আইছ, চিনায়া দিমুনে।
জাবিরের সঙ্গে দেখা করে বাসায় চলে আসি। কিন্তু মাথায় ঘোরপাঁক খাচ্ছিল সেই মেয়েটির কথা, যে নাকি অন্যের বাসায় কাজ করেও পড়াশোনা করে যাচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা যে কলেজে সে পড়ছে সেই কলেজে পড়তে অনেক ভালো রেজাল্ট লাগে। মানুষের বাসায় কাজ করে এত ভালো রেজাল্ট কি করে করা সম্ভব? এসব ভাবতে ভাবতে বিকেলের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কখন সামসুদ্দিন আঙ্কেলের সাথে দেখা হবে।
বিস্তারিত জানব।
বিকেলে গেলাম। সামসুদ্দিন আঙ্কেলের দেখাও পেলাম। পঞ্চাশঊর্ধ্ব ভদ্রলোককে আমি আগে থেকেই চিনি। তবে নাম জানতাম না।
ভদ্রলোকের কাছে গিয়েও কিভাবে কথা শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। হালিম আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আঙ্কেলকে কি যেন বলল। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক একটু ঝামেলায় পড়ে গেলেন। তারপরও হালিমের দোকানে এসে বসলেন। নাম পরিচয় জানার পর বলতে শুরু করলেন-
-মেয়েটির নাম সামিয়া।
বয়স ৮-৯ হবে। গ্রামে আমার প্রতিবেশিই বলতে পার। ওর বাবার ৪ সন্তানের বড়টি। বাবা ছিল অনেকটা অকর্মণ্য। কোন কাজ-টাজ পারত না।
একবার গ্রামে গেলাম। সামিয়াকে নিয়ে ওর বাবা আসল আমার কাছে। মিনতি করে বলতে লাগল তার মেয়েটিকে আমার বাসায় কাজের জন্য নিয়ে আসার জন্য। মেয়ের বয়স দেখে আমি রাজি হলাম না। তাছাড়া আমার আর্থিক অবস্থাও যে খুব ভালো তাও তো নয়।
কোন রকম খেয়ে পরে বউ, বাচ্চা মেয়ে দুইটাকে নিয়ে দিন যায়। ওর বাবা হাতজোড় করে বলতে লাগল, ভাইজান ওকে আপনার সাথে নিয়ে যান। না হয় মেয়েটা না খেয়ে মারা যাবে। মেয়েটার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলাম, সে নিয়মিত খেতে পায় না। মেয়েটার ওপর অনেকটা মায়া লেগে গেল।
আর ভাবলাম বাচ্চা একটা মেয়ে কয়েকদিন থেকেই বাবা-মার জন্য কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন না হয় আবার ফেরত দিয়ে যাব।
বাসায় নিয়ে এসে তো পরলাম আরেক বিপদে। আমার স্ত্রী কোনভাবেই এই মেয়েকে নিয়ে বাসায় উঠতে দিবে না। কয়েকদিন রেখে তারপর বিদায় করে দেব ইত্যাকার বলে কোনরকম বুঝিয়ে বাসায় ঢুকলাম।
মেয়েটিকে দিয়ে আমার স্ত্রী বাসার এহেন কোন কাজ নেই যা করাতো না। মেয়েটিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব কাজ করে চলল। আমার স্ত্রীর দর্শন ছিল বেশি বেশি কাজ করালে মেয়েটি ভয়ে পালাবে। আমি প্রতিবাদ করতে চাইলেও স্ত্রীর ভয়ে ওর পক্ষে কথা বলতে পারতাম না। তাছাড়া এমন একটা ভাবনাও আমাদের মাঝে কাজ করত, কাজের মেয়ে তো কাজের মেয়েই।
কিন্তু ওর কিছু অসাধারণ গুণ আছে। গরিব ঘরের মেয়ে বলেই হয়তো আল্লাহ্ ওর মাঝে ওই গুণগুলো দিয়েছে। ও দ্রুত আমার মেয়েদের আপন করে নিল। স্ত্রীর কড়া মানা সত্যেও মেয়েরা অবসরে ওর সাথে খেলা করত। রাতের বেলায় বড় মেয়ের বই নিয়ে কিছুটা সময় নাড়াচাড়া করত।
একবার আমার ছোট শালী আসল আমাদের এখানে বেড়াতে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সে। সে মেয়েটির নতুন এক গুণ আবিষ্কার করল! মেয়েটি নাকি পড়াশোনায় অনেক ভালো করবে, এই তার অভিমত। খুব বলে কয়ে আমার স্ত্রীকে কীভাবে যেন রাজি করে ফেলল। তবে স্ত্রী শর্ত দিল যে, সে স্কুলে যেতে পারবেনা।
শুরুটা এভাবেই। সারাদিনের কাজের শেষে বড় মেয়ের সাথে রাতে একটু পড়তে বসত। মাঝে মধ্যে আমিই ওদের পড়া দেখিয়ে দিতাম। দেখলাম সত্যিই মেয়েটা অনেক ভালো। স্ত্রী কে বললাম ওকে একটু সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
ততদিনে সে অনেকটা মেনে নিয়েছে মেয়েটাকে। বড় মেয়েটাও অনেক বেশি সাহায্য করছে। যাক, বার্ষিক পরীক্ষায় সে অনেক ভালো ফল করল। আর পেছনে ফিরে তাকানো নয়।
সবার সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে লাগল সামিয়ার পড়াশোনা।
ও নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে, ক্লাস করছে। বাসার কাজগুলো সবাই মিলে গুছিয়ে নিচ্ছে। এভাবেই কাজের মেয়ে থেকে সে আমার মেয়ে হয়ে উঠছিল। মেয়েটার নাম পাল্টে আমার আর আমার মেয়েদের নামের সাথে মিল রেখে রাখলাম সামিয়া। ফ্লোরিং বাদ দিয়ে তুলে নিয়ে আসলাম বড় মেয়ের সাথে বিছানায়।
আমার স্ত্রী এসবে এক কাঠি এগিয়ে ছিল। একই কাপড় পরা, একই খাবার খাওয়া, এক সাথে বেড়াতে যাওয়া এসব নিত্য ব্যাপার তো আছেই।
দেখতে দেখতে মেয়েটা এসএসসি পাস করে ফেলল। মোটামুটি ভালো ফলই করল। চিন্তায় পরে গেলাম, এখন কি করি? মেয়ের মা সরাসরি বলে দিল বড় মেয়ের কলেজেই ওকে ভর্তি করতে হবে।
অনেক খরচের কথা চিন্তাও করলেও স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে ওই কলেজই ভর্তি করতে হল। মেয়েটাও আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে ভর্তি হতে চাচ্ছিল না। যাক, সে এখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।
বড় মেয়েটাকে সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। আগামীতে সামিয়া।
এসব চিন্তায় আর সুস্থ থাকতে পারছিনা। মানুষজন মাঝে মধ্যেই ওকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলে। অতীতের মত সামনেও অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। তবু মেয়েটাকে সুখী দেখার জন্য নিরন্তর লেগে আছি। তোমরা মেয়েটার জন্য একটু দোয়া করবে বাবা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।