সেই কখন থেকে চায়ের কাঁপে চুমুক দিচ্ছি তো দিচ্ছিই, চা আর ফুরোয় নাহ! শুধু ধোঁয়া ওঠে। ছাই রঙের ধোঁয়া। বই পড়া শখের একটা ব্যাপার। বই পড়ার নেশাটা এখনকার চাইতে ছোটবেলায় অনেকাংশেই বেশি ছিল। রাস্তায় হাটছি, এমন সময় দেখলাম রাস্তার পাশে একটা পত্রিকার টুকরা পড়ে আছে, ব্যস! ওমনিতেই পত্রিকার টুকরাটা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতাম।
রাতের শেষ ক্লাশটি করার পর সবাই যখন খেয়ে-দেয়ে মশারী টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে, আমি তখন ঘুমের ভান করছি। সবাই ঘুমিয়ে গেলে বালিশের নিচে রেখে দেয়া পত্রিকার টুকরাটা বের করে পড়তাম। ভাগ্য ভালো থাকলে সুন্দর কোন লিখা পেয়ে যেতাম, পড়তে খুব ভালো লাগতো। তবে বেশিরভাগ সময়ই ভাগ্য খারাপ থাকতো। ভাবতাম মজার একটা ফিচার হয়তো আছে আজকের কাগজটিতে, কিন্তু অনেক রাতে পড়ার উদ্দেশ্যে কাগজটি খুলে যখন দেখতাম পত্রিকার বিজ্ঞাপণ পাতা, তখন মেজাজটা যেত বিগড়ে।
প্রতি মাসে বাড়ী থেকে দেয়া টাকা থেকে কিছু কিছু জমিয়ে সুলতান মাহমুদের চার খন্ডের একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস কিনেছিলাম। প্রতিটা খন্ডের দাম একশত আশি টাকার উপরে। রাতে ছাত্রবন্ধুরা সবাই ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি বইগুলো পড়তাম। তাঁর কিছুদিন পর আবার কিনলাম মিশরের সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে নিয়ে লিখা আট খন্ডের আরেকটা বই । দাম আগের বইটার মতই।
মাঝে মাঝে ভাবতাম, হুজুরেরা শুধুমাত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ করা ছাড়া অন্য কোন বই কেন পড়তে দেয়না। তাদের যুক্তিটা তখন অস্বীকার করার মত সাহস আমার ছিলনা। তাঁরা বলতো, অন্য কোন বই পড়লে সবক মুখস্থ করার সময় সেই বইগুলোর কথা মাথায় ঘুরপাক খাবে। তাই কোরআন শরীফ ছাড়া অন্য কোন বই পড়া যাবেনা। আমার আবার ছিল মারাত্মক রকমের বই পড়ার নেশা।
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। পড়ার মত তেমন ভাল কোন বই আমি তখন পাইনি। কেও বই উপহারও দিতনা। বই থাকলেও লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া ছারা উপায় ছিলনা। দুইশত পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কেনা সুন্দর একটা গল্প ও কার্টুনের বই একদিন পড়তে গিয়ে হুজুরের কাছে ধরা খাই।
সেদিনই আমার সামনে হুজুর আগুন দিয়ে বইটা পুরিয়ে ফেলেন। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। একটা কিশোরের কাছে এরকম একটা বই যে কত বড় সম্পদ, তা তাঁর থেকে কেও ভালো বুঝবে না। আমার ছোট্ট ছোট্ট দুইটা ষ্টীলের বাক্স ছিল। একটাতে রাখতাম বিস্কুট, হরলিক্স, গুরো দুধ আর সাবান-টাবান হাবিজাবি।
আরেকটা ভরা ছিল খালি গল্পের বই। কিন্তু বেশিরভাগ বই-ই অর্ধেক পড়া হতে না হতেই হুজুরের কাছে ধরা খেয়ে ছাই হয়ে যেত। অভিমান করে মাদ্রাসা পড়া বাদ দেয়ার পেছনে যতগুলো কারন ছিল, তাঁর মাঝে এইটা অন্যতম। আমি হয়তো অনেকটাই বদলেছি, কিন্তু কওমী মাদ্রাসার “হিফজুল কুরআন” বিভাগটা হয়তো আগের মতই আছে। আমার মত অনেক শিশুই হয়তো ভয়ে ভয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে পছন্দের বইগুলো পরে।
সেই সমস্ত শিশু-কিশোরদের আঁটকে রাখা জ্ঞানের বিকাশ ঘটুক, বট গাছের মত ডালপালা ছেয়ে বিস্তৃত হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।