আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোদেলা

এক শব্দহীন শব্দের শাব্দিক অনুভূতি রোদেলা রোদেলা আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। সব্বাই ঘূম থেকে ঊঠার আগেই খুব সন্তর্পণে সুর্য উদয় হওয়ার সাথে সাথে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল। গত রাতে একটা রিক্সা ঠিক করে রেখেছিল সারাদিন ইচ্ছে মত শহরময় ঘুরবে বলে । তিন দিন হলো নিউ ইয়োর্ক থেকে এসেছে। এমন লম্বা জার্নিতে জেট-ল্যাগের কারণে শরীরটা বেশ কয়দিন বিকল হয়ে পড়ে থাকে, দিনের বেলায় ঘুমটা এখনো চোখে-মুখে, শরীর জুড়ে ঝেকে বসে আছে।

সময়ের তারতম্যেই এমনটি হয়। । তিন রাত জেগে জেগে ছাদে উঠে রাতের ঢাকা শহর দেখার ব্যার্থ প্র্য়াশ চালিয়েছিলো। কিন্তু সুরম্য অট্টালিকার ভিড়ে ইট পাথরের ফাঁকে ফাঁকে রাতের নিভু নিভু আলো আঁধারীর খেলা ছাড়া তেমন কিছুই দেখতে পায়নি। রাতের কঠিন নীরবতা শ্বাসরোধ করার মত অবস্থা।

তাই আজ সকালে চার দেয়ালের মাঝে আর নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারলো না, গোপনে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে এসে রিক্সাচালক শাহাদাতকে বললো, চলো আগে কোথাও গিয়ে নাস্তা খাব আর সাথে গরম গরম চা। -আচ্ছা সকালের নরম সূর্যের ঢাকা শহর, শান্ত সৌম্য নগরপ্রকৃতি। বসন্তের শুরু মাত্র, প্রকৃতি হেসে খেলে উঠতে চায়, কিন্তু কংক্রিট নগরীতে ফাগুনের দোলাও যেন লাগতে চায় না। বিষন্ন নম্র প্রকৃতি নতজানু কঠিন নগরীর কাছে। মানুষের আনাগোনা এখনো বাড়েনি।

ঢাকা শহরে যে ধরনের জ্যাম , এখানে গাড়ির চেয়ে রিক্সাই হলো সহজ বাহন। এদিক ওদিক দিয়ে সহজে গলিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। এয়ারপোর্ট থেকে খিলক্ষেত আসতে আসতে মানুষ আর যানবাহনের যে দৌরাত্মা দেখেছে তাতেই রোদেলার বুঝা হয়ে গেছে ঢাকা শহরের অবস্থা। হঠাৎ করে শাহাদাত মৌচাকের মোড়ে এসে রিক্সা থামিয়ে বললো, আপা এইখানে খাইবেন, এই রেষ্টুরেন্টটা ভালা। -ঠিক আছে, চলো।

-আপা, আপনে যান । আমি এইখানে খাড়ায় থাকুম -না না , তুমিও যাবে আমার সাথে, এক সাথে নাস্তা খাবো। -আপা আমি খাইছি, বউ আমারে গরম ভাত আলু ভর্তা দিয়া খাওন দিছে। আপনে যান আপা। -ঠিক আছে কিছু না খাও, শুধু চা খাবে।

শাহাদাত বুঝতে পারলো এখানে না করার কোন উপায় নেই, রোদেলার কথা তাকে শুনতেই হবে। গত্যন্তর না দেখে সুবোধ বালকের মত রিক্সায় তালা দিয়ে রাস্তার এক পাশে রেখে কাচুমাচু হয়ে রোদেলার পিছু পিছু রেষ্টুরেন্টের ভিতর প্রবেশ করলো। যতটুকু না সঙ্কোচ তারচেয়ে বেশী শঙ্কা শাহাদাতের ভিতর কাজ করছে। এরকম পরিস্থিতে কখনো পড়েনি শাহাদাত। এমন আলীশান রেষ্টুরেন্টে বসে ব্রেকফাস্ট করার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি।

ভাবেনি কখনো এমন সুন্দরী মহিলার (নাকি তরুণী ঠিক বুঝতে পারছে না), পাশে বসে রেষ্টুরেন্টে খাবে। বয় বেয়ারাদের কৌতুকপূর্ণ চাহনীতে শাহদাত বেশ বিব্রত বোধও করছিলো। রোদেলা চোখ তুলে শাহাদাতের দিকে তাকিয়ে বললো, কি ব্যাপার তুমি এমন জড়োসড়ো হয়ে আছো কেন? --না। আপা ঠিক আছি আমি। স্মিতহাস্যে লজ্জায় অবনত হয়ে বললো।

রোদেলার সাবলীল আচরনে শাহাদাত বেশ অবাক হচ্ছে। এরই মধ্যে রোদেলা শাদা রুটি, সব্জী ভাজি, ডিম অমলেট, দই আর মিষ্টির অর্ডার দিলো সাথে গরম গরম চা। দুজনে নাস্তা করে রেষ্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আবার চলতে শুরু করলো। শাহাদাত জিজ্ঞেস করলো, কই যাইবেন আপা? -যাও , যেদিকে মন চায় নিয়ে যাও। -আপা, আপনে মনে হয় এই দেশে থাকেন না -তোমার এমন মনে হলো কেনো? -না, আপনে একটূ অন্যকরম মানে আপনে ভালা মানুষ -নারে ভালা মানুষ না।

ভালা মানুষ হইলে দেশ ছাড়তাম না । রোদেলা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে চারিদিকে চোখের নজর ছড়িয়ে দিলো। দেখলো দিনের আলোয় ঢাকা শহর কিভাবে জেগে উঠছে। লোকে লোকারণ্য ঢাকা নগরী। রিক্সা বেইলী রোড গলিয়ে ধীর লয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।

সবুজ ছায়া বীথির তল দিয়ে রিক্সা চলছে। রমনা পার্কের কাছে আসতেই সবুজ প্রশান্তির সুনিবিড় ছোঁয়ায় একটু আপ্লুত হলো যেন রোদেলা। চোখের ক্লান্তি দূর করার জন্যও ঢাকা শহরে সবুজ খুঁজে পাওয়া ভার। এমনই কংক্রিট জীবন এখানে; গত কয়দিনে রোদেলা ঢাকা শহরে বেশ হাফিয়ে উঠেছে। মনে মনে ভাবছে ঢাকা শহর থেকে দূরে কোন গাঁয়ে গিয়ে থাকবে বাকী কয়টা দিন।

হঠাৎ করে মুঠোফোনটা বেজে উঠলো । রোদেলার উত্ফুল চিত্ত। মৌন বিহঙ্গ যেন পাখা মেলছে শত সহস্র আনন্দ রাশি রাশিতে। এমনই একটা ফোনের অপেক্ষা করে আসছে গত কয়দিন ধরে। এই হলো আকাশ; যার নিজ খেয়াল খুশীতে পরিভ্রমন।

কেমন করে যে আকাশের বুকে রোদেলার ঠাঁই হলো, তা ভাবতে গেলে রোদেলা মাঝে মাঝে অবাক বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারপরেও অপেক্ষার প্রহর গুণে রোদেলা, কখন আকাশের কন্ঠ শুনবে বা দুটো লাইন দেখবে ই-মেইল এ “তুমি ভাল আছোতো?” এমনই সব ছিটে ফোঁটা আবেগী আবেদনে রোদেলা দিনের পর দিন বিনম্র নিবেদিত প্রেয়সীতে পরিনত হয়। গত চার বছর ধরে সম্পর্কের ঘনঘটা এভাবেই গড়াচ্ছিলো। সম্পর্কের বুনিয়াঁদ শুরু হয় অযাচিত অনাহত আর অভাবনীয়ভাবে। ঢাকায় আসার উদ্দেশ্যই হল আকাশের সাথে দেখা করা।

এয়াপোর্টে নেমেই প্রথম ফোনটা করা হয় আকাশকে, জানিয়ে দিয়েছিল রোদেলার আগমন বার্তা আর ফোন নাম্বারটা। কিন্তু সবই আকাশের ইচ্ছা। যখন মন চাইবে তখন যোগাযোগ করবে, তাই রোদেলা মুঠোফোনটা মুঠো করে সর্বক্ষণ আগলে চলে; কখন যে ফোনের রিং টোনে তানপুরার সুরে রিনিঝিনি কাঁকনের তালে বেজে উঠবে চারিদিক। তারই অপেক্ষায় প্রহর দ্বিপ্রহর গুণে গুণে রোদেলা অস্থির হয়ে উঠছিলো। এমনই অস্থির মুহুর্তে আকাশের ফোন এলো।

অপর প্রান্তে গুরু গম্ভীর এক কোমল কন্ঠ, কোথায় তুমি? -কোথায় আমি থাকতে পারি! সহাস্যো রোদেলার কঠস্বর... -যেখানে তুমি থাকতে পারো ! কৌতুহলী আবেগ ঝরে পড়ে ফোনের ওপাড়ে -কোথায় আমি থাকতে পারি ! একটু অভিমান সুরে কথাটা বললো রোদেলা -আমার হৃদয় মন্দিরে- -হৃদয় মন্দির কি জেগে উঠেনি আমার আগমন বার্তায় ? -জেগে উঠেছে তোমার সুর লহরী লয়ে, ধী---রে ধীরে... -হুম, তো এখন আমি কি করতে পারি ? -কিছুই না, সোজা চলে আসবে আমার কাছে, আমার গাঁয়ে -তো কিভাবে আসবো? আমিতো তোমার গাঁ চিনি না -চিনিয়ে দিব। তুমি গাড়ি নিয়ে আসবেতো ? -তাতো অবশ্যই , এত দূরতো রিক্সা করে যাওয়া সম্ভব না; যদিও আমার রিক্সা প্রিয় বাহন। -ঠিক আছে, আমি রাতে ফোন করে ডিটেইলস জানিয়ে দিবো, কবে আসতে চাও? -আমি তোমাকে জানাবো, সম্ভবতঃ এই উইক্যান্ডে -ঠিক আছে কথা হবে পরে, ভালো থেকো। আকাশ ফোনটা রেখে দেওয়া মাত্রই চারিদিকে রোদেলার চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলো জায়গাটা বেশ অপরিচিত। গত পনেরো বছরে ঢাকা শহরের অনেক পরিবর্তন।

অনেক কিছুই আর চিনা যায় না। রাস্তার দুধারে পাথর ভাঙ্গার এক করুন দৃশ্য। বৃদ্ধ শিশু মহিলা সবাই এক সারে বসে পাথর ভাঙ্গছে। শিশুর হাতে পাথর ভাঙ্গার দৃশ্য দেখে রোদেলা সাথে সাথে শাহাদাতকে বললো রিক্সা থামাতে, আমি এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো। শাহাদাত রিক্সা থামিয়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো।

রোদেলার বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠে। কোমলমতি শিশুর হাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে নগর সভ্যতার কঠিন হৃদয় আর মানবতার ভীত ! বেশীক্ষণ সেখানে দাঁড়াতে পারলো না রোদেলা। শাহাদাতকে বললো, চলো। এ পথ দিয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছো? -আপা , আপনারে নদীর ধারে লইয়া যাইতেছি -কোন নদীর ধারে? -বুড়িগঙ্গা -তাই ! বুড়িগঙ্গাতো অনেক দূর ! রোদেলা খুশীতে নেচে উঠলো। -আমি জানি আপনে নদী ভালবাসেন, কিচ্ছু হইবো না, আমি লইয়া যামু আপনারে -এই ছেলে বলে কি! আমি কি তোমাকে বলেছি ,আমি নদী ভালোবাসি? রোদেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো -না, বলেন নাই, তয় আপনারে দেখলে মনে হয়।

রোদেলা সজোরে হেসে দিয়ে তৃপ্তির সাথে বললো, বাহ, তুমিতো ভাল বুঝো ! শাহাদতও রোদেলার ভালোলাগার মত একটা কিছু আবিস্কার করতে পেরেছে ভেবে ভীষন গর্বীত হলো আর হাসতে হাসতে, হেলতে দুলতে রিক্সা চালাতে লাগলো। অনেক দূর যাওয়ার পর রোদেলার হঠাৎ মনে হল শাহদাত অনেকক্ষণ ধরে রিক্সা চালাচ্ছে, এতোক্ষণে শাহাদাততো ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কথা। রোদেলা বেশ উদবিগ্নতার সাথে জিজ্ঞেস করলো শাহাদাতকে, তুমিতো অনেকক্ষণ ধরে রিক্সা চালাচ্ছো , তোমার একটু রেষ্ট নেওয়া দরকার। চলো কোথাও গিয়ে বসে আমরা একটু খাওয়া দাওয়া করি। –আপা সামনে একটা ভালা রেষ্টূরেন্ট আছে, অইখানে পুরা দেশী খাবার পাইবেন, এক্কেবারে ভর্তা , ডাল শাক সব্জী যা খাইবার চান তাই পাইবেন, হেইয়ানে গিয়া আমরা খামুনে।

শাহাদাতকে বেশ উৎফুল্ল লাগছে। মনে হচ্ছে রিক্সাতো নয়, যেন এক পঙ্খীরাজ চালাচ্ছে। রোদেলাও বেশ খুশী শাহেদের এমন খোশ মেজাজ দেখে। শাহাদাতের সঙ্গ রোদেলার বেশ লাগছে। সূর্য তখন গড়িয়ে মধ্য গগনে এসে ঠেকেছে, কখন যে এত বেলা হয়ে গেলো রোদেলা বুঝতে পারেনি।

একটা রেষ্টুরেন্টের সামনে গিয়ে রিক্সা থামিয়ে রোদেলাকে বললো, আপা নামেন , এইহানে খামু। রোদেলা দেখলো শাদা মাটা , টিনের ছাউনি ঘেরা একটা রেষ্টুরেন্ট, মনে মনে বললো, মন্দ না , দেখা যাক কেমন লাগে ! এইবার শাহাদাত আগে আগে রেষ্টুরেন্টের ভিতর ঢুকলো । অনেকটা হাক ছেড়ে জানান দিতে চাইলো সবাইকে যে সে এসেছে। রোদেলা বুঝতে পারলো এখানে সবাই শাহাদাতকে চিনে। শাহাদাতের পিছু নিয়ে ভিতরে ঢুকলো রোদেলা।

। একটা বেয়ারাকে ডেকে শাহাদাত বললো, ঐ টেবিলটা পরিস্কার কইরা দেরে ভাই, আমি বড় আপারে লইয়া আইছি, ভালা কইরা খাওন টাওন দিবি কইলাম। বেয়ারাটা টেবিলটা পরিস্কার করে মৃদু হেসে চলে গে্লো। চেয়ারে বসতে বসতে শাহাদাত রোদেলাকে জিজ্ঞেস করলো, আপা সমস্যা নাইতো এইখানে খাইতে? -না্ না, সমস্যা হবে কেনো? আমার ভালো লাগছে। শাহাদাত কথাটা শুনে বেশ খুশী হয়ে গেল।

বললো, এইহানে সবরকম মানুষ আসে, বড়লোক গরীব সবরকম মানুষ, শুধু ঐ ভর্তা ভাত খাওনের লাইগ্যা। -তাই। একটা বয় এসে খাবারের অর্ডার নিতে চাইলো। শাহদাত রোদেলাকে জিজ্ঞেস করলো, আপা কি কি খাইবেন ওরে কইয়া দেন। রোদেলা ম্যানু শুনে শুনে অর্ডার দিলো চিংড়ি মাছের ভর্তা, শুটকি ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ছোট মাছের চচ্চরি, গরুর মাংসের ভুনা, ডাল, সাথে সব্জী সালাদও নিলো।

বেশ তৃপ্তি সহকারে খেয়ে রোদেলা শাহাদাত সেখান থেকে বের হয়ে আবার চলতে শুরু করলো। শাহাদাত যে কোথা দিয়ে কোথা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোন রাস্তাই চিনতে পারছে না। তবে এক অজানা অচেনা আশঙ্কায় ঘুরতে ভালই লাগছে, একটা থ্রিলিং ফিল করছে। আবার মুঠোফোনটা বেজে উঠলো, এবার ঘরের মানুষের জোর তলব শুরু হলো, কোথায় রোদেলা, কি করছে ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়। রোদেলা একটু বিরক্ত হয়ে বড় ভাইকে জানিয়ে দিলো, আমাকে নিয়ে ভেবো নাতো, আমি ভালো আছি।

এধরনের খবরদারীগুলো আর ভাল লাগে না রোদেলার। সামাজিক আত্মিক সবরকম বন্ধন থেকে মুক্তি চায় রোদেলা, দম আটকানোর মত বন্ধন । নিজ ইচ্ছায় রোদেলা মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়তে চায়, কোনরকম বন্ধনের মাঝে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না । হঠাৎ করেই শাহাদাত জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্বামী ছেইলা মাইয়া নাই? -না, তোমার ছেলে মেয়ে আছে? -আছে আপা, মাশাল্লাহ দিলে এক ছেলে এক মেয়ে -বাহ, তোমারতো সুখী পরিবার -হয় আপা, আল্লায় রাখছে একরকম। ছেলে মেয়ে দুডারে ইস্কুলে দিতাছি।

কষ্ট করা দুইডারে মানুষ কইরাম। নিজেতো আর মানুষ হইতে পারলাম না। বেশ আক্ষেপের সুরে কথা কটা বললো শাহাদাত। -তুমি মানুষ না, কে বললো শাহাদাত? -গরীব মানুষেরে মানুষ , মানুষ মনে করে না। সবাই আপনের মত না আপা।

রোদেলা কথার প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বললো, বুড়িগঙ্গা আর কত দূর? -এইতো আইসা গেছি। আপনে পানি দেখতে পান না? -হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি , কিন্তু এখনো তো অনেক দূর -আর আধা ঘন্টার মইধ্যে পৌছাই যামু। -শু্নো তুমি একটা জায়গায় রিক্সা থামিয়ে একটু রেষ্ট নিয়ে নাও , তুমিতো অনেকক্ষণ ধরে রিক্সা চালাচ্ছো। -না আপা কোনো অসুবিধা হইবো না। আমি একবারে ঐহানে গিয়া রেষ্ট লইমু।

রোদেলা আর কোন কথা না বলে চুপচাপ চারিদিকটা দেখতে লাগলো। যাত্রা বাড়ী ছেড়ে এসেছে অনেক আগে। চোখের সীমানায় বুড়িগঙ্গার ব্রীজটা চলে এলো। দেখতে দেখতে একেবারে নদীর ধারে চলে গেলো শাহাদাত। নদীর গা ঘেষে চায়ের দোকান দেখে রোদেলার খুব ইচ্ছে হলো চা খাওয়ার।

শাহাদাতকে চা খাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া মাত্রই রাজী হয়ে গেলো। চায়ের দোকানের পাশে পাতানো একটা বেঞ্চে বসে রোদেলা চা খেলো। কিছুক্ষণ পর শাহদাত জিজ্ঞেস করলো, আপা নৌকায় চড়বেন? -হ্যাঁ, চড়বো। বলা মাত্রই শাহাদাত দৌড়ে গিয়ে ঘাটে বাধা নৌকা ঠিক করে এসে রোদেলাকে নিয়ে নৌকায় চড়ে বসলো। নৌকায় চড়ে বেশ দূর পর্যন্ত নদীর বুকে ভাসলো কিন্তু বুড়িগঙ্গার করুন অবস্থা দেখে বেশীক্ষণ ভাসতে ইচ্ছে করলো না রোদেলার ।

কেমন এক বীভৎস গন্ধ থেকে থেকে নাকে এসে বাড়ী খেতে লাগলো। কোথাও কোথাও নদীর পানি ময়লা আবর্জনা্র মিশ্রিত দুর্গন্ধযুক্ত কালচে রঙ এর । বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য্য আর কোথাও খুঁজে পেলো না রোদেলা। নদীর বুকেও নৈ-পরিবহনের জ্যাম লেগে আছে, এতো ব্যাস্ততার ভীড়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য ভোগ করা দায়। তাই তড়িৎ গতিতে শাহাদাতকে বললো, এখান থেকে চলো তাড়াতাড়ি, নদীর পরিবেশটা আর ভালো লাগছে না ।

ঘন্টাখানিক বুড়িগঙ্গায় ভেসে আর এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে ফিরে চললো গন্তব্যমূখী। ঙ্কিছুদূর যাওয়ার পর শাহাদাত বললো, আপা এখন আমি আপনারে একটা বিশেষ জায়গায় লইয়া যামু -কোথায় ? -ঐখানে গেলে শরীর গরম হইয়া রক্ত মাথায় উইঠা যায়, মনে হয় ভাইঙ্গা চুইড়া আবার নতুন কইরা কিছু একটা করি। এমন একখান জায়গা, ঐখানে খাড়াইলেই পুরা দেশটা মাথার উপর চইলা আসে। রোদেলা চিন্তায় পড়ে গেলো। এ কোন জায়গার কথা বলছে শাহাদাত! দেখা যাক কোথায় নিয়ে যায়? রোদেলা আর কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলো।

থেকে থেকে আকাশের কথা খুব মনে পড়ছে। আকাশের বিষয়টা মাঝে মাঝে রোদেলা একেবারে বুঝে না। রোদেলাকে দেখার জন্য আকাশ এত বেশী উতলা হয়েছিল যে রোদেলা আর নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারলো না। অফিস থেকে ইমার্জেন্সি বেসিসে পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে শুধু আকাশের জন্য। অথচ আসার পর আকাশের এই নীরব ভূমিকা রোদেলাকে খুব অবাক করে তুলছে।

যদিও আকাশের কিছু নিজস্ব ব্যাপার স্যাপার আছে যেখানে কারোর কোন হস্তক্ষেপ সে পছন্দ করে না । এমন কি রোদেলার ব্যাপারেও কেমন যেন মাঝে মাঝে অনুভূতি শূণ্য এটিচিউড দেখায়। তখন রোদেলার মন অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠে, উতলা হয়ে খুঁজতে থাকে এদিক সেদিক। যখন আবার স্বাভাবিকতার মাঝে চলে আসে আকাশ, তখন যদি রোদেলা অনুযোগের সুরে কিছু বলেছো তো ওমনি পালটা অভিযোগ করে বলবে, তুমি আমাকে কখনো বুঝলে না আর কোনদিনও বুঝবে না। এভাবে বুঝার চেষ্টা করে আসছে গত চার বছর ধরে, কখনো বুঝে আবার কখনো বুঝে না।

এখন যেমন বুঝতে পারছে না। আকাশকে পেয়েছিলো অনলাইনের ফেইসবুকে। ফেইসবুক খুললেই দেখা যায় কবিতার ছড়াছড়ি। কবিতার প্রতি ভীষন দূর্বলতা কাজ করে রোদেলার। সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবা হাত ধরেই কবিতার রাজ্যে প্রবেশ করা।

বাবা কবিতা পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দিতেন কবিতায় কোন শব্দে কি অর্থ বহন করছে বা কবিতার ভিতর নিগূঢ় রহস্যটুকু। সেই তখন থেকে কবিতা নিয়ে এক ধরনের রহস্য উন্মোচনের নেশা কাজ করে রোদেলার ভিতর। সেই নেশায় আক্রান্ত রোদেলা ফেইসবুকে কবিতা পড়তে শুরু করে দেয় আর সেই সাথে কবিতার নীচে মন্তব্য করাটাও রোদেলার একটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়। রোদেলার এই মন্তব্যগুলিই আকাশের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষন করে। তারপর থেকে অনলাইনে আসলেই কিছু না কিছু ম্যাসেজ রোদেলাকে উতলা করে তোলে।

‘ আমার কবিতা পড়বেন প্লিজ’, ‘আপনার কমেন্ট না পেলে আমার কবিতা সম্পূর্ণ হবে না’; এভাবে প্রায়ই ম্যাসেজ আসতে থাকে রোদেলার ম্যাসেজ বক্সে। কে সে আকাশ ? ভালো করে রোদেলা আকাশের প্রোফাইল ঘেটে দেখলো, বাহ, ভাল কবিতা লিখে তো ! সেই থেকে শুরু হয়ে যায় কবিতা নিয়ে কথোপকথন। -কবিতা কেনো শুধু কবির মনের বা কবির একান্ত নিজস্ব কথা হবে? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিল রোদেলা আকাশ মিত্রের দিকে। শুরুটা এভাবেই শুরু করেছিল । আকাশের ছিল নির্ভেজাল উত্তর, আমি আমার মনের ভিতরের আলোড়নটাই কবিতায় তুলে আনি, যে্টা আমার শুধুই নিজস্ব চিন্তা ভাবনা।

-এই জন্যই কি আপনার কবিতায় মানুষের কথা খুঁজে পাই না? -কেন খুঁজে পাবেন না ? চারিপাশ দেখে আমার ভিতর যে অনুভূতি হয় তারই প্রতিফলন হয় আমার কবিতায়। -সেই অনুভূতিগুলো আপনার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি, যা পাঠক পড়া মাত্রই বুঝে উঠতে পারে না -পাঠক কিভাবে নিবে, সেটা পাঠকের দায়িত্ব। তবে একটা বিষয় আপনি আবশ্যই স্বীকার করবেন, যেহেতু আপনি কবিতা বুঝেন সেই অর্থেই বলছি; সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলেছে, কবিতাও বদলেছে। আমরা এখন প্রথাগত কবিতার বাইরে চলে এসেছি, যেটাকে বলে আধুনিক কবিতা। -প্রথাগত কবিতা বলতে কি বুঝাচ্ছেন? -যে কবিতায় মানুষের সরল আবেগের কথা, যৌবনের কথা, স্বপ্ন কাতরতার কথা আছে অর্থাৎ পাঠকের জীবন-জীবিকার অভিজ্ঞতার কথা আছে তাকে বলছি প্র্থাগত কবিতা -তার মানে আধুনিক কবিতায় প্রথাগত এসব বিষয়গুলো থাকবে না -থাকবে, তবে তা হবে কবির একান্ত ব্যক্তিগত অনন্য অভিজ্ঞতা যার সম্পূর্ণটাই কবির মানসিক।

এর অভিনব প্রকাশভঙ্গী আর ভাষার অলঙ্করণ থাকবে। -তাহলেতো সাধারণ পাঠকের বোধের বাইরে এই কবিতা -কিছুটা বলতে পারেন -তবে কি, শুধু কবির নিজস্ব মনঃতুষ্টির জন্য কবিতা লিখা হয়? -হুমম... অনেকটা -তাহলে সমাজ ,দেশ, মানুষের কাছে আধুনিক কবিদের কি কোন দায়বদ্ধতা নেই? -সেই দায়িত্ব আমি নিতে চাই না, আমার লিখা অঙ্গুলি নির্দেশ করবে সমাজ দেশ মানুষকে তবে আমি দিক নির্দেশক নই... -তাহলে আপনি কি? -আমি নিজেই জানি না আমি কি? কখনো সারস পাখি, কখনো সন্ন্যাসি, বলতে পারেন অনেকটা ধুলো উড়ানো মুসাফির। আবার যখন আমার কোন বোধ বুদ্ধি কাজ করে না তখন মাঝে মাঝে রবোটও হয়ে যাই । -কঠিন মনের কবি -কঠিন বলুন আর যাই বলুন, আপনি যে কবিতা বুঝেন তা বেশ বুঝতে পারি -হয়ত বুঝি, হয়ত বুঝি না... এভাবে কথা বলতে বলতে কখন যে একে অপরের হৃদয়ের এত কাছাকাছি চলে এসেছে তা বুঝতে পারেনি। আকাশ মিত্র যার নাম, কবিতা নিয়ে যার চরাচর।

ইতিমধ্যে বেশ কয়টি স্বরচিত কবিতার বইয়ের জনকও । কবি মানুষ কিছুটা আত্মভোলা হয় যা কবিদের সহজাত বা প্রাকৃত। কবিদের এই সহজাত বিষয়টি অনেক সময় কবিতাপ্রেমীদের অস্থির করে তোলে, তেমনি অস্থির হয়েছিল রোদেলাও। কবিতা পড়তে পড়তে কবিদের বিড়ম্বনাতেও বেশ কয়েকবার পরেছে রোদেলা। কারণ কবির কবিতায় কবিকে খূঁজে পাওয়া যায় না।

কবিকে যখন দেখা হয় তখন আর কবিতা বুঝা যায় না। কবিতা হয়ে যায় অন্তসারশূণ্য এক পরিখা,তাতে শুধু তলিয়েই যাওয়া হয় কিন্তু , কবিকে আর খুজে পাওয়া যায় না। কবি এবং কবিতার মাঝে বিস্তর পার্থক্য দেখে রোদেলা বিস্ময় প্রকাশ করে ! কবি কেমন হবে বা হওয়া উচিত তা রোদেলা বলতে পারবে না। তবে কবিতার মত যে কবি নয় তা বেশ বুঝতে পারে। যেই কবিতা পড়ে আবেগে আহলাদে ভালোবাসায় ডুবে যাওয়া হয়, সেই কবিতার কবিকে দেখা হয় এক সাধারন মানুষরূপে।

যার ভিতরে আছে নিদ্রা ক্ষুধা সহবাস আর আছে লোভ লালসা ঘৃণা হিংসা পরশ্রিকাতরতা, দাম্ভিকতা, আরো আছে আত্মপ্রচারনা, পদবী পাওয়ার হুঙ্কার। এ সবের উর্ধ্বে আছে কোন কবি? যাকে শুধু কবিতার আদলেই ভাবা যায় , ভালোবাসা যায় কবিতার দেবতা রূপে !! শূণ্য থেকে উল্কার গতিতে ছুটে আসে কবিতা, আছর করে কবির ঘাড়ে, গলগলিয়ে বের হয়ে আসে কবিতার রসধা । অনেকটা প্রসব যন্ত্রণার মত। কবিতার সৃষ্টি হলে সারা, কবির হয় ছুটি। তাৎক্ষণিকভাবে কবি হয়ে যায় এক জাগতিক মানুষ।

কোন এক কবি জিজ্ঞেস করেছিলো রোদেলাকে , কবিতা ভালোবাসো, কবিকে ভালোবাসো না ? রোদেলা মনে মনে বলে, কিভাবে ভালোবাসি কবিকে ? আমি যে কবিতার মাঝে কবিকে দেখি না, শুধু দেখি নিরেট একাটা মানুষ !!! সেই হতাসা থেকে মনকে স্থির করে ফেলেছিল রোদেলা ,কবিদের মাঝে আর নয়, কবিকে নিয়ে হাবুডুবু খেলে রীতিমত হিমসিম খেতে হয়। তাই কবিকে নিয়ে নাড়াচাড়া নয় শুধু কবিতার মাঝে ডুবে থাকাই শ্রেয়। এমনই মানসিকতার জালে কখন যে কেমন করে আটকে গেল আজ রোদেলা আকাশের মাঝে তা বুঝতেই পারলো না। চার বছরের সম্পর্কে ঘটনার ঘনঘটা ঘটতে থাকে নানাভাবে। ফোনে ফোনে কথা আর অনলাইনে চ্যাটিং এর মধ্য দিয়ে দুজন দুজনাকে পেয়ে এসেছে নিবিড়ভাবে।

মাঝে মাঝে সম্পর্কের ছন্দপতন যে ঘটেনি তা নয়, তবে ভুল বুঝাবুঝির সুত্র ধরে সম্পর্কের গভীরতাই বেড়েছে দিনের পর দিন। আজ শুধু আকাশের জন্যই রোদেলা এসেছে ঢাকায়, এরই মধ্যে শুধু একবার আকাশের ফোন পেয়েছে। রোদেলার আগমনে আকাশের ভিতর কী কোন উচ্ছ্বাস বা আবেগের লেশ মাত্রও নেই? রোদেলা জানে না আদৌ আকাশের সাথে দেখা হবে কিনা ! কষ্টটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রোদেলা। দেখা হবে কি , হবে না তা নিয়ে রোদেলা আর মাথা ঘামাতে চায় না। ছুটির সময়টা ভালো মত এনজয় করতে চায়, সেটা যে কোনভাবে।

ছয় বছর পর দেশে এসেছে , অতএব বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে সময় কাটাবে এই বলে মনস্থির করে মুঠফোনটা হাতব্যাগের মধ্যে রেখে দিলো। হঠাৎ করে সম্বিত ফিরে পেতেই দেখে সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সোনালি রোদের নরম আলোর ছিটেফোটায় এক স্বর্নাভ পরিবেশ চারিদিকে । রিক্সা যে কখন হাইকোর্টের মাজার ছেড়ে কার্জন হলের পাশ দিয়ে এসে দোয়েল চত্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারেনি। সারাদিনের ছুটাছুটিতে এখন যেন ক্লান্তি এসে ভর করছে।

শাহাদাতকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার জায়গাটা কোথায়? -এইতো আপা, চইলা আইছি। বাংলা একাডেমি ছেড়ে টিএসসির কাছ ঘেষে এসে স্বপার্জিত স্বাধীনতার সামনে গিয়ে রিক্সা থামিয়ে শাহাদাত বললো, আপা, এই জায়গাটা -এই জায়গাটা ! রোদেলা বেশ বিস্ময় প্রকাশ কোরে বললো। এই জায়গা্টায় আসলে তোমার এমন মনে হয় কেনো? - কি কন আপা, এই জায়গাটা হইলো দেশের মাথা, এইহান থন জ্বালাও পোড়াও বদলাও , যত্তরকমের আন্দোলন সব এইহান থেইক্কা শুরু হয়। এইহানে আইলে কিছু একটা কইরা ফেলবার মন চায়, দেখছেন্নি দেশটা কোন্দিকে যাইতেছে ! সব চোর চট্টায় ভইরা যাইতেছে ! ক্যান আপনের এই জায়গাটা ভাল লাগে নাই ? -ভালো লাগবে না কেনো, আমিতো এখানে পড়াশুনা করেছি। রোদেলা অবাক চোখে শাহাদাতের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কতটা আগুন এ দেশের প্রতিটা মানুষের বুকে দাউ দাউ করে জ্বলছে ! -ওঃ, তাইলেতো এইডা আপনের ঘর বাড়ী -হুম, তা বলতে পারো ।

টিএসসির বাহিরে বাউন্ডারি ঘেসে চায়ের দোকানের (যে জায়গাটাকে রোদেলাদের সময়ে বলা হত হাকিম চত্বর, এখন কি নাম আছে কে জানে ) দিকে আঙ্গুল তাক করে শাহাদাত বললো, -আপা, আমি এইহানে দিনে একবার আইয়া ঐ বেঞ্চাটাতে বইয়া এক কাপ চা খাই আর বইয়া ভাবি, কত বড় বড় মাথা এই বেশ্ববিদ্যালয়ে আছে ! রোদেলা একটু হেসে বললো, সত্যই তুমি আমার একটা প্রিয় জায়গায় নিয়ে এসেছো। আমি ভাবিনি আজ এখানে আসবো, তবে এসে ভীষন ভালো লাগছে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। -ধন্যবাদ দিতে হইবো না আপা, আপনি খুশী হইছেন এইডাই আমার অনেক ভালা লাগছে। রোদেলা চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করলো পরিচিত কোন মুখ।

এত বছর পর কে যে কোথায় আছে, ক্ষণিকের জন্য বারো বছর আগে চলে গেলো । স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে কত কিছু যে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। হাঁটতে হাঁটতে ডাচ বাংলার কাছে গিয়ে দুকাপ চা নিয়ে বসলো স্বপার্জিত স্বাধীনতার পাদদেশে। সেখানে চুপচাপ দুদন্ড বসে শাহাদাতকে বললো , এখন চলো বাসার দিকে, অনেক ঘুরলাম সারাদিন। অন্ধকার হয়ে আসছে, আবার খুব টায়ার্ডও লাগছে।

শাহাদাৎ বাসাবোর দিকে রিক্সা চালাতে চালাতে রোদেলার দিকে পিছন ফিরে বললো, আপা, আপনের যখন রিক্সা লাগবো , আমারে খালি ডাক দিবেন, দেখবেন এই পঙ্খীরাজ এক্কেবারে আপনে দুয়ারে আইসা হাজির হইবো। -আচ্ছা জানাবো। একদিন তোমার বউ বাচ্চাদের নিয়ে এসে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। -আইচ্ছা দিমুনে। ঘরে ঢুকতেই মায়ের কড়া নজর চোখে পরতেই রোদেলা ভিমরি খেলো।

কিছু বলার আগেই নিজের রুমে চলে গেলো। বুঝতে পারলো বাড়ীর সবাই খেপেছে । এতদিন পর দেশে এসে এভাবে কাউকে না বলে সারাদিন লাপাত্তা হয়ে থাকাটাকে কেউ স্বাভাবিক চোখে দেখছে না। বড় ভাইও কটমট করে এদিক ওদিক ঘরময় হাঁটাহাঁটি করছে। এসব বিষয়গুলো রোদেলা আর মেনে নিতে পারছে না।

এমন করবে কেনো , ঠিক বুঝতেও পারছে না। রোদেলা এখন ছোট মেয়ে না। লেখা পড়া জানা শিক্ষিত একটা মেয়ে। নিজে নিজেকে পরিচালনা করার সবরকম ক্ষমতা রাখে। তাছাড়া বাড়ীর সবাই জানে রোদেলা এমনই, নিজ খেয়াল খুশীতে মত্ত থাকা একটা মেয়ে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে মায়ের রুমে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে রোদেলা বললো, মা তোমরা এমন অস্থির হও কেন বলতো ? মা, রাহেলা বেগম নামাজের জায়নামাজে বসে তসবি গুনছিলেন । মেয়ের আহলাদি কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, এটা মানুষের জীবন হতে পারে না । তুই যেভাবে চলছিস, এটাকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বলা চলে না। -কেন মা, সমস্যা কোথায় ? আমিতো আমার মত আছি, কাউকে জালাতন করছি না -তুই জালাতন করছিস না বলেই কি আমরা তোর কথা ভাব্বো না? সব বাবা মাই সন্তানদের সেটেল অবস্থায় দেখতে চায়, দেখ তোর বান্ধবীরা কি সুন্দর সংসার করছে, স্বামী সন্তান নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে -মা, আমাকে আমার মত করে থাকতে দাও প্লিজ , আমার দ্বারা সংসার টংসার হবে না আহলাদ করতে করতে মাকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বললো রোদেলা। রাহেলা বেগম একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললো, -কি জানি বাপু, আমি মা, সন্তানদের এমন ছন্নচারা জীবন দেখতে আমার ভালো লাগে না, আমি দেখতে চাই আমার ছেলে মেয়েরা সুখে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছে।

রোদেলা আরো গভীর আহলাদের সুরে বললো,- আমি অনেক সুখী আছি মা। কোন ঝুট ঝামেলার মধ্যে নেই, কারোর কথার মধ্যে নেই, বেশ আছি মা... -ইকবাল ফোন করেছিল। ইকবালের নামটা শুনা মাত্রই রোদেলা এক ঝটকায় মায়ের বুক থেকে সরে গেল। বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মা ইকবাল কেন? হঠাৎ ইকবাল কেন? ইকবাল কেমন করে জানলো আমি এসেছি? -তোর বড় ভাই জানিয়েছে। রোদেলা রাগতঃ স্বরে বললো, মা ভাইয়া কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছে।

তোমাদের এসব বাড়াবাড়ির কারণেই আমি স্কলারশীপ নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই। আর তোমাদের বাড়াবাড়ির জন্যেই আমি দেশে আসি না। তোমরা কী চাও না আমি সুস্থ্য স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করি ! কথা কটা বলেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মায়ের দিকে। আবারো চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, মা, ভাইয়া সিক, ম্যানটালি সিক। ধর্মের নামে সে নিজেকে চ্যাঞ্জ করেছে করুক তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।

কিন্তু অন্যের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করাটাকে আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না । ধর্ম একটা জীবনের অংশ অথচ জীবনের প্রতিটা পরতে পরতে ধর্মকে টেনে এনে জীবনটাকে ব্যতিব্যাস্ত করে তুলছে, ঘরে বাইরে কোথাও এক ফোঁটা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। রাহেলা বেগম মেয়েকে থামানোর চেষ্টা করছে মাত্র কিন্তু রোদেলা যেন রাগে ফুলে ফেপে উঠছে আরো, বললো, মা আমি তোমাদের কাছে এসেছি দুটোদিন একটু স্বস্তিতে থাকার জন্য , প্রাণ খুলে হাসবো, মন খুলে দুটোকথা বলবো, তা না; বরঞ্চ এখন আমার রীতিমত দম বন্ধ হয়ে আসছে। রাহেলা বেগম রোদেলাকে শান্ত স্বরে বললো, --শুন,এমন পাগলামী করিস কেন? ইকবাল ছেলেটা কিন্তু ভালো। ধর্ম-কর্ম করার ছেলেরাইতো ভালো হয় , ওরা কখনো খারাপ কাজ করতে পারেনা... রাহেলা বেগমের মুখ থেকে কথাটা লুফে নিয়ে প্রায় চিৎকার করেই বললো, ধর্মের নামে যা করছে তা কি সুস্থ্য মস্তিষ্কের কাজ? এই যে আমার স্বাধিনতায় হস্তক্ষেপ করছে, এটা যে একটা অমানিবিক কাজ এটা বুঝো? আর শুনো, কখনো ইকবালের কথা বলবে না।

ভাইয়াকেও বলবে এ কথা, নাহলে কিন্তু ভালো হবে না, বলে দিচ্ছি। রাহেলা বেগম একটূ রেগেই বললেন,-আর কতকাল নিজেকে আইবুড়ো রাখবি। -সারাজীবন রাখবো। তাতে তোমাদের কোন সমস্যা আছে? -আছে সমস্যা। কারণ তুই আমাদের মেয়ে, তোর একটা ব্যবস্থা আমাদের করতেই হবে -তোমরা যদি বাড়াবাড়ি করো, তাহলে আমার চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ।

কথাটা বলেই দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে রোদেলা দরজা বন্ধ করে দিলো । এ কোন দোজখের মধ্যে এসে পরেছে ভাবতে ভাবতে রোদেলার মন বিষিয়ে উঠে। আকাশের জন্য দেশে আসতে হলো, নাহলে দেশে আসার কথা কখনই মাথায় আসতো না । আকাশের উপর ভীষন রাগ হচ্ছে। যদি আকাশ ঠিকমত যোগাযোগ করতো তাহলেও অনেক কিছু পুষিয়ে নেওয়া যেতো।

একেতো আকাশের নীরব ভুমিকা তার উপর ঘরের মানুষের এমন মানসিক অত্যাচার সব কিছু মিলিয়ে রোদেলা এখন পাগল প্রায়। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে এলোমেল চিন্তায় ডুবে গেলো রোদেলা। কখন যে ঘু্মের কোলে ঢলে পরেছে বুঝতে পারেনি। ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন দেখলো সূর্যটা মধ্য আকাশে উঠে এসেছে। এত ঘুম ঢাকায় আসার পর এই প্রথম এলো।

বেশ ঝরঝরা ফুরফুরা হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতেই দেখে ঘড়ির কাটা দুপুর একটা ছুঁই ছুঁই করছে। এত বেলা হয়ে গেলো, কেউ ডাকেনি কেন, ভেবে একটু অবাক হলো রোদেলা। নিজ রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমের দিকে যেতেই দেখে বড় ভাবী রান্নাঘরে ব্যস্ত সব রান্নাবান্নায়। রোদেলাকে দেখে ভাবি বললো, কি, শাহজাদীর ঘুম ভাঙ্গলো ? -হুম, ডাকোনি কেন? -ডাকিনি ইচ্ছে করে,রাতেতো ঘুমাতে পারো না তাই ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে নিক -থ্যাঙ্কস ভাবী, আমার সুইট ভাবী, বলেই ভাবীকে জড়িয়ে ধরলো -আজ ইকবাল আসছে তোমার সাথে দেখা করতে। ইকবালে নাম শুনেই বিদ্যুৎ গতিতে ছিটকে গেলো রোদেলা।

বললো,-ভাবী আসলে তোমারা কি চাও? -কেন সমস্যা কি? ইকবাল তোমাকে ভালোবাসে -কিন্তু আমি ইকবালকে পছন্দ করি না -নিজেতো একবার পছন্দমত বিয়ে করে দুবছরও সংসার করতে পারোনি। এখন মুরব্বিদের পছন্দে বিয়ে করো, ভালো থাকবে। তাছাড়া তোমার একবার বিয়ে হয়েছে জেনেও ইকবাল তোমাকে চাচ্ছে। -একবার বিয়ে হয়েছে মানে ওটা আমার বড় খুত, তাই না? বিয়ের বাজারে আমি আর বিকোবো না, বেশ তো এটাইতো চাই আমি। আমার বিয়ে শাদীর দরকার নেই, আমাকে আমার মত থাকতে দাও প্লিজ ভাবী।

আর কথা না বাড়িয়ে রোদেলা এক কাপ চা হাতে নিয়ে চলে গেল নিজের রুমে। সবাই মিলে কি শুরু করলো, রোদেলা মনে মনে ভাবে , আমিতো পাগল হয়ে যাব। এমন সময় মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। আকাশের নাম্বার দেখে মেজাজটা খিঁচিয়ে উঠলো। কথা বলতে আর ইচ্ছে করছে না রোদেলার।

রিংয়ার টোনে যে কি আছে, মন্ত্রমুগ্ধের মত ফোনটা কানে তুলে নিলো, হ্যালো ! -কি ব্যপারা কন্ঠ এত গম্ভীর কেন? -এমনিতে , বলো কেমন আছো? -আমি ভালো আছি। তোমার কি হয়েছে বলো? -তোমার সাথে আমার দেখা হবে না , মনে হচ্ছে। -কেনো এমন মনে হচ্ছে ? -আমি সর্বগ্রাসি সুন্দরী তাই, কোন সুন্দরের কাছে কবিদের আসতে নেই, এতে সমূহবিপদ আসন্ন -হুম। এটা অবশ্য চিন্তার বিষয়, শুনো একটা নতুন কবিতা লিখেছি। তোমাকে শুনাবো বলে ফোন করেছি -কিন্তু আমার এই মুহুর্তে কবিতা শুনতে ইচ্ছে করছে না -ওহ , থাক তাহলে ।

আকাশ যেন একটু ধাক্কা খেলো। আবারো জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে তোমার আমাকে বলবে? -ভাবছি চলে যাব তাড়াতাড়ি -কেন, আমাদের দেখা হবে না ? -না আর দেখা হবে না। বেশ কষ্টভরা অভিমান নিয়ে কথাটা বললো রোদেলা -এসেছো তো আমার জন্যে ? -সেটাই আমার বড় ভুল হয়েছে। -ভুল বলছো কেন? -জানি না। বলেই ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে আঝোরে কাঁদতে শুরু করলো রোদেলা।

ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ব্যতব্যস্ত জীবন এখন রোদেলার। ভালবেসে বিয়ে করেছিল ধ্রুবকে, কিন্তু সংসার টিকেনি দুবছরেরও বেশী। সমস্যাটা যে কোথায় ছিল আজো রোদেলা বুঝে উঠতে পারেনি। দিনরাত দুজনের মধ্যে খিটমিট লেগেই থাকতো। বিনা কারনেই বলতে গেলে অনেকটা ছোট ছোট কারণে ধ্রুবর মেজাজ চওড়া করে কথা বলাটা শেষের দিকে রোদেলা আর সহ্য করতে পারছিলো না ।

সব কিছুতে এত বেশী বিরক্তভাব প্রকাশ করতে শুরু করলো যে রোদেলা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। তাই একদিন না বলে চলে গেলো এক বান্ধবীর বাসায়। ধ্রবও আর কোন খোঁজ করলো না , এমন কি কোন ফোন কলও করলো না। এই রাগে দুঃখে ক্ষোভে রোদেলা নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলো। আর পিছনে ফিরে তাকালো না।

ছয় ছয়টা বছর নিজেকে এভাবে আগলে চলেছে একাকিত্বের সাথে বসবাস করে। ক।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.