আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেগম জিয়ার ভারত সফরঃ বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে কতোটা পরিবর্তন আনতে পারে?

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! দেশের রাজনীতি এখন শতভাগ ভারতমুখী। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমাদের দেশের দু’জন শীর্ষ রাজনীতিবিদ ভারত সফরে গেছেন। এদের একজন হচ্ছেন প্রাক্তন সামরিক শাসক ও বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের অন্যতম অংশীদার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদ এবং অপরজন হচ্ছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা তথা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দু’জনের সফরের লক্ষণীয় পার্থক্য এখানে যে, জেনারেল এরশাদ সেখানে গিয়েছে ভারতীয় রাষ্ট্রপতির বিশেষ আমন্ত্রণে, অপরদিকে বেগম জিয়া গেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে। সফরকালে এরশাদ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচিত ইউপিএ চেয়ারম্যান সোনিয়া গান্ধীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন।

বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট থেকে সময় পেয়েছেন। কয়েক দফা পিছানোর পর অবশেষে ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পেলেও ইউপিএ চেয়ারম্যান সোনিয়া গান্ধীর দেখা তিনি পাননি। এ পর্যালোচনার আলোকে পতিত স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেই পারেন। জেনারেল এরশাদ ভারতে এতোটা মর্যাদা পাওয়ার কারণটা কি হতে পারে? ঐতিহ্যগত ভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি মিত্রতার সম্পর্ক রয়েছে। আমি এটাকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন দৃষ্টিতেই দেখছিনা।

তবে এটা স্বীকার না করলে অকৃতজ্ঞতা হবে যে, আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ মিত্রতা বিশাল ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। দল দুটোর আদর্শ এবং নীতিও প্রায় একই রকমের। সময়ের পরিক্রমায় নীতি, আদর্শ এবং পারস্পরিক স্বার্থের আদান প্রদানের মাধ্যমে এদের মিত্রতা বা বুঝা-পড়া ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। উপরন্তু বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সরকার কর্তৃক পরোক্ষভাবে হলেও ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং উগ্রপন্থীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক এসব উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ভারত সরকারকে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুকে পরতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সে বিবেচনায় আওয়ামী ক্ষমতায় থাকলেই ভারত কিছুটা স্বস্তিবোধ করবে এবং এ স্বস্তির বহমানতা ধরে রাখার তাগিদেই জেনারেল এরশাদ যাতে আওয়ামী লীগের প্রতি তার সমর্থনের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন সেটা নিশ্চিত করার জন্যই তার প্রতি এ গুরুত্ব।

কিন্তু গত চার বছরের মহাজোট সরকারের শাসনের ফলে জনমত কোনদিকে সে সম্পর্কে ভারত ভালভাবেই অবগত। । ভারত এই জনমতের বিপক্ষে যেতে চায় না। কাজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তার দ্বারা যাতে ভারতের জন্য কোন অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি না হয় সেটা নিশ্চিত করতেই বেগম জিয়াকে ভারত সফরের এই আমন্ত্রণ। উপরন্তু ভারত এর দ্বারা এটাও বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, বাংলাদেশের কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের অতিরিক্ত আকর্ষণ নেই।

আমাদের দেশের রাজনীতির মূল এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতা অর্জন। নীতি-আদর্শের বালাই এখানে কোন কালেই ছিল না, এখনও নেই। আর এদেশের মানুষ খুব সহজেই অতীত ভুলে যায়। এ কারণেই বেগম জিয়া এটা নিশ্চিত যে, দেশের জনগণ চারদলীয় জোটের আমলে তার পুত্রদের কর্ম এবং হাওয়া ভবনের কাহিনীগুলো পুরোপুরি ভুলে গেছে। জনমত আবার তার দিকে।

বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একমাত্র ভারতের অবস্থানকেই কিছুটা প্রতিপক্ষ ভাবছেন। সেটাকে নিজের অনুকূলে আনার প্রয়াসে তিনি ভারত সরকারের আমন্ত্রণকে খুশিমনে লুফে নিয়েছেন। বিবেচনায় আনেননি ভারত সরকার এরশাদকে কতোটা মর্যাদা দিয়েছে এবং তাকে কতোটা দিচ্ছে। এটাও ভুলে গেছেন এই ভারতকেই তিনি অতীতে বহুবার আমাদের স্বাধীনতা এবং ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সব ভুলে শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় নাকে খত দিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও স্বীকার করে এসেছেন যে তার সরকার ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল এবং ভবিষ্যতে কোন অবস্থায়ই এমনটা করবে না।

সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সফরকে গুরুত্বহীন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ক্ষমা চেয়েই বলতে হয় এ ধরণের বক্তব্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্ণধারদের অপরিপক্কতাই প্রমাণ করে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণে বেগম জিয়া এ সফরে গিয়েছেন। কাজেই এ সফরকে গুরুত্বহীন বলে প্রচার করা মূলত ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর বা তার দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রীকেই খাটো করা। অবশ্য সরকার মুখে এ সফরকে যতই গুরুত্বহীন বলে প্রচার করুক না কেন সরকারের ছোট-বড় মন্ত্রীরা এটা নিয়ে যেভাবে বাহাসে লিপ্ত হয়েছেন তাতে এটা স্পষ্ট যে তারা ভিতরে ভিতরে কিছুটা হলেও নার্ভাস।

সরকার হয়তো এটা ভেবে একটু হলেও চিন্তিত যে, ভারত না আবার বিএনপির দিকে ঝুকে পড়ে। তবে বেগম জিয়ার এ ভারত সফর বা নাকে খত দেওয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তন আনবে বলে মনে করিনা। বিএনপি হয়তো আগের মতো আর কারণে অকারণে ভারত বিরোধীতার রাজনীতি করতে পারবে না বা করলেও প্রতিপক্ষরা তখন বেগম জিয়ার এ সফরকে তার বক্তব্যের বিপক্ষে যুক্তি হিসেবে দাড় করাবেন। পরিবর্তনটা হয়তো এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে পুনরায় সেই দুর্নীতি এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে।

কারণ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে যেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি তেমনি জামায়াত নির্ভরতাও কমেনি। বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের আতুর ঘর হচ্ছে জামায়াত। যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ কেউ জেলে থাকলেও সরকার দলটির অর্থনৈতিক শক্তিকে মোটেও খর্ব করতে পারেনি। জামায়াতের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেদারসে টিকে আছে। আমি নিশ্চিত বিএনপি জামায়াত জোট পুনরায় ক্ষমতায় আসলে জামায়াত সে জোটের চালকের আসনে বসবে এবং পুনরায় ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে।

বেগম জিয়ার ভারত সফর এদেশের রাজনীতিতে যেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন আনবেনা তেমনি এর ফলে ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতিতেও কোন পরিবর্তন আসবেনা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বা কিছু কিছু বিশ্লেষক ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখছেন তেমনটা হওয়ার মতো কোন উপলক্ষ্য আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছিনা। কারণ আওয়ামী লীগ তার গত চার বছরের শাসনামলে এমন কিছু করেনি যার কারণে ভারতের সাথে দলটির সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। মাঝখানে মমতা ব্যানার্জীর কারণে দু’দেশের মাঝে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হলেও এটাতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বা আওয়ামী লীগের কারোরই কিছু করার ছিলনা। ভারত মূলত এখানে আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের দা-কুমড়া সম্পর্ককে ব্যবহার করে ‘দুই বানরের রুটি ভাগ মামলায়’ বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

এর পিছনে তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করা। ভারতের দৃষ্টিকোণ কিংবা পররাষ্ট্রনীতির আলোকেও এমন প্রচেষ্টা অনৈতিক নয়। কারণ যেকোন দেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্দেশ্যই থাকে নিজ দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করা। সরকারের অপরিহার্য্য অঙ্গ হিসেবে আমাদেরও একটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়েছে। তবে আমার ধারণায় দেশের স্বার্থের চেয়ে এ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বেশি দৃষ্টি থাকে বিত্তশালী দেশে পোস্টিং নিয়ে আয়েশী জীবনযাপন করার আর এর দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রীর একমাত্র কাজ হচ্ছে হাওয়াই জাহাজ থেকে ওঠা আর নামা এবং ভ্রমণের ক্লান্তিজনিত কারণে বিশ্রাম নেয়া।

অবশ্য বেগম জিয়ার ভারত সফরে আর কিছু হোক আর না হোক আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিদেশ সফর ছাড়াও যে আরও কিছু কাজ করা শুরু করেছেন সেটা টের পাওয়া গেল। বেগম জিয়ার এ সফরের সৌজন্যে জানলাম তিনি বিরোধী রাজনীতিবিদদের সফরের গুরুত্ব নিয়েও যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছেন। তবে যেহেতু তিনি নিজেই বলেছেন সফরটি গুরুত্বহীন তাই এনিয়ে আর অযাচিত ভাবনা না ভেবে তিনি পুনরায় হাওয়াই জাহাজে ওঠা-নামা শুরু করতে পারেন এবং ভ্রমণের ক্লান্তিজনিত কারণে রুটিনমাফিক বিশ্রাম নিতে পারেন। সার্বিক বিশ্লেষণে, বেগম জিয়ার ভারত সফরের ফল হিসেবে আমাদের রাজনীতি এবং ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তনের আশা সুদূর পরাহত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।