আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুগলের বাড়ি

জাদুনগরের কড়চা [পিএইচডি করার সময় ২০০৭ সালের মে থেকে আগস্ট এই তিন মাস গুগলে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পেয়েছিলাম। লেখাটা সেই সময়েরই গল্প। মূল লেখাগুলো সেসময় সামহয়ারে পোস্ট হয়েছিলো। সেগুলার লিংক পেতে পোস্টের শেষে দেখুন। এই সংক্ষেপিত লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর ঈদুল আজহা সংখ্যা ২০১২ এ প্রকাশিত হয়েছে।

] গুগলে তিন মাস টানা কাজ করে যখন ফিরছিলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে, তখন মনে হলো, এই তিনটা মাস এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দ্রুত কেটে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্য-উত্তর ভাগে, সানফ্রানসিসকো আর সান হোসে শহরের মাঝে, সেই সুবিখ্যাত সিলিকন ভ্যালির কেন্দ্রস্থলের মাউন্টেইন ভিউ শহরে গুগলের সদর দপ্তর, যার নাম গুগলপ্লেক্স। জায়গাটা চমৎকার, আবহাওয়াটা বাংলাদেশের হেমন্তকালের মতো থাকে বছরজুড়েই। ভারি সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ। গুগলে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটা সহজ নয়।

প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে পুরো আমেরিকার সব নামকরা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এখানে ইন্টার্নশিপ বা তিন মাসের শিক্ষানবিশ কাজের জন্য আবেদন করে থাকে। মাইক্রোসফট, এইচপি, কিংবা ইয়াহুর থেকে অফার পেলেও গুগলে কাজ করার ইচ্ছাটা অনেক বেশি ছিল আমার। স্ট্যান দ্য ডাইনোসর গুগলে কাজ শুরু করি ১৫ মে। আগের পুরো সপ্তাহ গাড়ি চালিয়ে আমেরিকা মহাদেশের এপার থেকে ওপারে গিয়েছি প্রায় দুই হাজার ৫০০ মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে। প্রথম দিনে ওরিয়েন্টেশন, নির্দেশ ছিল সকাল নয়টার সময় গুগলের বিল্ডিং ৪৩-এর লবিতে হাজির থাকার।

গুগলের ক্যাম্পাসে ঢুকতেই ভিরমি খাবার দশা। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক ডাইনোসর। তাও আবার ডাইনোসরদের রাজা টিরানোসরাসরেক্স! বিশাল হাঁ করে বিদঘুটে, ধারালো, তেকোনা দাঁতগুলো মেলে আছে, যেন এই ধরতে এল। গুগলের মূল ক্যাম্পাসের চারটি ভবন বিল্ডিং ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩-এর মাঝের মাঠে রাখা, ঠিক যেন ঢুকে পড়া অনাহূত সবার পিলে চমকে দেওয়ার জন্য স্থাপিত। এই ডাইনোসরটির নাম স্ট্যান।

৬৫ মিলিয়ন বছরের পুরোনো এই ডাইনোসরটি পাওয়া গিয়েছিল সাউথ ডাকোটার এক পাহাড়ে। গুগলে অবশ্য আসল ডাইনোসরের হাড়গোড় নেই, বরং আসলটার বোঞ্জে তৈরি প্রতিমূর্তি রাখা আছে। কেন গুগলে ঢোকার মুখে এটা রাখা, ওরিয়েন্টেশনে করা এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাইনি, তবে মনে হয়, ঠাট্টার ছলে এটা রাখা। গুগলের এই অফিসগুলো আগে ছিল সিলিকন ভ্যালিরই এক নামকরা কোম্পানি, সিলিকন গ্রাফিকসের। এককালে চুটিয়ে ব্যবসা করা সিলিকন গ্রাফিকস ডাইনোসরদের মতোই হঠাৎ বিলীন হয়ে যায় ব্যবসায় লালবাতি জ্বেলে।

জনশ্রুতি অনুসারে, রসিকতা করে সিলিকন গ্রাফিকসের স্মৃতির উদ্দেশে এই ডাইনোসর এখানে স্থাপিত। গুগলের ইঞ্জিনিয়ারদের রসবোধের আরও প্রমাণ পেলাম, ডাইনোসরের গলায় গুগলের আইডি কার্ড ঝুলতে দেখে। মেংয়ের অ্যালবাম পাশেই প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেয়ালে দেখানো হচ্ছে, দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গুগল সার্চের একটু অংশ। আর তার পাশে আছে মেংয়ের অ্যালবাম। মেং গুগলের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।

বড় বড় দাঁতে বিশাল এক হাসি দিয়ে বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে ছবি তোলাই তার শখ। গুগলে প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের নামজাদা সব লেখক, রাজনীতিবিদ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীরা আসেন। আর বিখ্যাত কেউ আসছে শুনলেই ব্যস, মেং ছুটে যায় ক্যামেরা নিয়ে। ক্লিনটন, কার্টার থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, এঁদের ছবি তো আছেই, রয়েছে অন্য অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি, নানা লেখক আর চিত্রতারকাদের ছবি, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আর শান্তিকর্মীদের ছবি। এতসব ছবি যখন এক এক করে সবাই দেখে চলেছে, তখন আমি তাকিয়ে রয়েছি বিপুল গর্ব নিয়ে মেংয়ের অ্যালবামের এক প্রান্তে, যেখানে মেংয়ের সঙ্গে শোভা পেয়েছে আমাদের ড. ইউনূসের ছবি।

মাকড়সা বাইকে মিটিং গুগলপ্লেক্সের চারটি ভবন ছাড়াও এই এলাকাতেই কেবল গুগলের অফিস রয়েছে মোট ১৬টি। এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত প্রায় দুই মাইল দূরত্ব। আমার অফিসটি পড়েছিল পশ্চিম পাশে। অবশ্য এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাওয়ার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে। পুরো ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবনের সামনেই রয়েছে গুগলের মনোগ্রাম লাগানো বাইসাইকেল বা জি-বাইক।

যে কেউ যেকোনো জি-বাইক নিয়ে অন্য অফিসের সামনে গিয়ে পার্ক করে রাখে, পরে আবার সেটা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে। তালা মারার ব্যাপার নেই। এটা ছাড়াও রয়েছে ইলেকট্রিক স্কুটার, শাটল বাস এবং দুই চাকার অদ্ভুত যান সেগওয়ে। কিন্তু সবকিছুকে হার মানায় মাকড়সার মতো আকৃতির কনফারেন্স বাইক। প্রথম যেদিন দেখলাম, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

মাকড়সার অনেকগুলো পায়ের মতো এই বাইকের সাতটি বসার জায়গা বৃত্তাকারে বসানো, কেন্দ্রের একটি বিন্দুতে যুক্ত। বসার সময় কেন্দ্রের দিকে মুখ করে সবাই বসে। প্রতিটি সিটের নিচে প্যাডেল রয়েছে। সবাই প্যাডেল চালালে এক অদ্ভুত উপায়ে সেটা একসঙ্গে যুক্ত করে বাইকটিকে চালায়। আটজনের মধ্যে একজনের হাতে স্টিয়ারিং থাকে, সে এটা কোন দিকে যাবে, তা ঠিক করে।

আর এই বাইকের নাম কেন কনফারেন্স বাইক হলো? আসলে গুগলের প্রকৌশলীরা কনফারেন্স রুমে মিটিং না করে অনেক সময় এই বাইকে মজা করে চালাতে চালাতে মিটিং করে থাকে, এমনকি ল্যাপটপে করে ইন্টারনেটে যোগাযোগ, সবই করা সম্ভব এটাতে। মাটির মানুষ ব্রিন আর পেইজ ব্রিন আর পেইজকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তারা গুগলের প্রতিষ্ঠাতা। এখনো দুজনে মাটির মানুষ, ভাবভঙ্গিতে সেই পিএইচডি করতে থাকা গ্র্যাজুয়েট স্কুলের ছাত্রের মতো। গুগলে ইন্টার্নশিপ পাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, পুরা গুগলের সবার বস ব্রিন, পেইজ এবং গুগলের সিইও এরিক স্মিড্টকে আদৌ চোখে দেখতে পাব কি না। বাংলাদেশে অন্য কারও কথা বাদ থাক, বুয়েটে শিক্ষকতা করার সময়েও বুয়েটের ভিসির সঙ্গে দেখা করতে এক দিন ঘণ্টা পাঁচেক বসে থাকতে হয়েছিল।

প্রথম দিনেই ধারণাটা পাল্টে গেল ব্রিন আর পেইজকে দেখে। প্রতি শুক্রবার গুগলে এক বিশাল পার্টি হয়। টিজিআইএফ, অর্থাৎ থ্যাংক গড ইটস ফ্রাইডে হলো এই পার্টির নাম। আসলে সোমবার থেকে কাজ শুরু হয়ে শুক্রবার আসতে আসতে মানুষের মেজাজ বিগড়ে যায়, কাজের চাপে মাথা গরম হয়ে থাকে। শুক্রবার আসলে আসন্ন দুই দিনের উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের ছুটির আনন্দে শুকরিয়া করে।

সেই থেকেই এই মিটিংটার নাম হয়েছে। যা হোক, এই মিটিংয়ের মোদ্দা কথা হলো, গুগলের বিশাল ক্যাফেটাতে হাজার কয়েক গুগল ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য কর্মী জড়ো হবে। ওখানে হাজির হয়ে তো অবাক। দেশে থাকতে দেখতাম, কোনো কোম্পানির বড়সাহেব, এমনকি সরকারি কোনো অফিসের জিএম সাহেবের বিশাল ভাব, আর আশপাশে চামচার দল, অনেক সময় সিকিউরিটির লোকজনের হুমকি-ধমকি। সে তুলনায় বিলিয়নিয়ারদের তালিকার শুরুর দিকে থাকা ব্রিন ও পেইজকে দেখে বোঝারই উপায় নেই, ওরাই এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং অধিকাংশ শেয়ারের মালিক।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতি শুক্রবার ওরা প্রথমে এই সপ্তাহে কী কী প্রডাক্ট গুগল ছাড়ছে, তার কথা বলে খানিকক্ষণ। এর ফাঁকে ফাঁকে ব্রিন ও পেইজের ভাঁড়ামি চলতে থাকে। দুজন নানা রকমের রসিকতা করার চেষ্টা করে। এর পরই শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। যেকোনো ধরনের প্রশ্ন যে কেউ নির্ভয়ে বলতে পারে।

এমনকি গুগলের কোনো একটা পদক্ষেপ খুব বাজে এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, এ রকম প্রশ্ন করতেও কোনো বাধা নেই। ব্রিন আর পেইজকে প্রশ্ন করার সুযোগ আমিও হাতছাড়া করিনি। অনলাইনে যে প্রশ্ন করার ব্যবস্থা আছে, তাতে শুক্রবার সকালবেলা প্রশ্ন দিলে বিকেল নাগাদ ভোটাভুটিতে যে প্রশ্ন টিকে যায়, সেটাই করা হয়। বেশ কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে আমার প্রশ্নটা একদিন প্রথম ১০টি প্রশ্নের মধ্যে এল। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশের দিকে গুগলের নজর কবে পড়বে, আর গুগল যেসব ভাষাকে প্রাধান্য দেয়, তাদের মধ্যে ২৫ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা কবে আসবে? প্রশ্নের জবাব সের্গেই ব্রিন খুব আগ্রহের সঙ্গেই দিল।

বলল, গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটা অনেকটা অর্থনীতিভিত্তিক। বাংলাদেশে কয়েক কোটি মুঠোফোন ব্যবহারকারী আছে, তাই অচিরেই ওদিকে গুগল চিন্তা করবে, মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য কাজ করবে। ব্যাগি প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা ব্রিনকে দেখলে মনে হয়, ইউনিভার্সিটির ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসেছে এই মাত্র। পেইজকেও তা-ই। মজার ব্যাপার হলো, আমি সেদিন গিয়েছি বিল্ডিং ৪৩-এর নো-নেইম ক্যাফেতে।

খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো, সামনের লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতেই টের পেলাম, এটা সের্গেই ব্রিন। মনে হলো, ভলিবল কোর্টে অন্য কর্মীদের সঙ্গে খেলে এসে এখন খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অন্য সব সাধারণ গুগল কর্মীর সঙ্গে। দ্য গুগল ফিফটিন গুগলের কর্মীদের সবাই ভীষণ কাজপাগল। দিনে আট ঘণ্টা কাজ করার জন্য গুগল পয়সা দেয়।

কিন্তু গুগলের কর্মীরা অফিসে থাকে আরও অনেক বেশি সময়। ধরাবাঁধা সময় নেই, যে যার মতো সময়ে আসতে পারে। অফিসের পরিবেশটা অসাধারণ, আশপাশে এত চমৎকার ল্যান্ডস্কেপিং, দেখে পার্ক মনে হয়। অফিসের ভেতরে আবার খাবারের ছড়াছড়ি। প্রতিটি তলাতেই একটু পর পর মাইক্রোকিচেন আছে, যাতে থরে থরে সাজানো আছে নানা রকম ফলের রস, চিপস, আইসক্রিম, স্যান্ডউইচ থেকে শুরু করে কত কি!! এই ব্যাপারে নাকি সের্গেই ব্রিনের একটা নীতি আছে, কোনো মানুষকেই খাবারদাবারের থেকে ১৫০ ফুটের বেশি দূরে রাখা ঠিক নয়।

কাজ করতে করতে একটু খিদে পেলেই দূরে যাওয়ার দরকার নেই, অফিস থেকে দুই পা হাঁটলেই একটা মাইক্রোকিচেন, আর সেখানে এ রকম জিবে জল আনা সব খাবার। সবই ফ্রি—যার যখন ইচ্ছা এসে খেয়ে যাচ্ছে বা দুই হাত ভর্তি করে অফিসে নিয়ে যাচ্ছে ভূরিভোজনের জন্য। এ তো গেল কেবল মাইক্রোকিচেন। প্রতিটা অফিসেই রয়েছে একটা করে ক্যাফে। আর ক্যাফেগুলো মোটেও গতানুগতিক নয়, একেকটা ক্যাফে একেকটা ধাঁচে সাজানো।

যেমন আমার অফিসের ক্যাফের নাম অফ দ্য গ্রিড, ওখানে একটু অন্য রকমের বিচিত্র প্রকারের খাবার দিত। প্রায় দিনেই অদ্ভুত সব খাবার আসত, যেমন ক্যাঙ্গারুর বার্গার, হরিণের মাংসের কাবাব। সপ্তাহে এক দিন বারবিকিউ, আর সকালে প্রতিদিন থাকত ডিমভাজিসহ নানা রকমের নাশতা, বেলা তিনটার সময় আবার বিকেলের নাশতা দিয়ে পেট পূজার ব্যবস্থা থাকত। পাশের ভবনেই ফাইভ নামের ক্যাফে, প্রতিটা খাবার ঠিক পাঁচটা করে উপাদান দিয়ে তৈরি। আরেকটা ক্যাফে ছিল ইউরোপীয় খাবারের।

আরেকটা (প্যাসিফিক ক্যাফে) হলো চীনা, জাপানি সুশি ও অন্যান্য খাবারের। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় গুগলপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলের চার্লিজ ক্যাফে। গুগলের প্রথম শেফ ছিল চার্লি, তবে বেতনের বদলে শুরুতে গুগলের শেয়ার পেত বলে চার্লি এখন মিলিয়নিয়ার হয়ে রিটায়ার করেছে, তার নামেই এখন রয়ে গেছে ক্যাফেটা। বিশাল ফুটবল মাঠের সাইজের ওই ক্যাফেতে পাঁচটা সাব-ক্যাফে ছিল—নমস্তে হলো ভারতীয় খাবারের, পাশেরটা জাপানি খাবার আর ইতালীয় খাবারের ক্যাফে, তার সামনেরটা ইস্ট মিটস ওয়েস্ট অর্থাৎ ফিউশন ধাঁচের। এগুলোতে প্রতিদিন দুপুর আর সন্ধ্যায় ভিড় হতো প্রচণ্ড।

পুরোটা অবশ্য প্রচণ্ড সুশৃঙ্খল, সবাই ট্রে নিয়ে লাইন বেঁধে খাবার নিয়ে টেবিলে, অথবা বাইরের মাঠে বসানো পিকনিক টেবিলে চলে যায়। প্রতিদিন কম করে হলেও হাজার চারেক কর্মী এখানে খেয়ে থাকে। অনেকে মনে হয় বিকেলবেলায় পুরো পরিবারের মা-বাবা, বাচ্চাকাচ্চাসহ গোটা দশেক লোক সঙ্গে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য, প্রত্যেকেই অতিথি নিয়ে আসতে পারে, কোনো বাধা নেই। আর খাওয়া যে ফ্রি, তা তো আগেই বলেছি।

গুগলের এই খাওয়ার অঢেল ব্যবস্থার কারণে নতুন আসা গুগল কর্মীরা হাপুস হুপুস করে খেতে থাকে, নিজের চোখে দেখা। ‘গুগল ফিফটিন’ বলে একটা কথা চালু আছে, গুগলে ঢোকার প্রথম দুই সপ্তাহে নাকি কর্মীদের ওজন বাড়ে অন্তত ১৫ পাউন্ড। শুধু কি খাওয়াই মূল আকর্ষণ? মনে হয় না, কারণ গুগলের অন্যান্য ব্যবস্থাও চমৎকার। চুল কাটা দরকার? কোনো সমস্যা নেই, গুগলের চুল কাটার মিনিবাস আছে একটা, সারা দিন অফিসে অফিসে ঘুরতে থাকে, জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলেই নেমে গিয়ে চুল কেটে ফেলা যায়। গাড়ির অয়েল চেঞ্জেরও ব্যবস্থা আছে।

আর ওই রাজভোগ খেয়ে ওজন বাড়লে ভুঁড়ি কমানোর জন্য রয়েছে জিম। বাচ্চাদের রাখার জন্য নার্সারি। ডাক্তার, ডেন্টিস্ট। আর কাজ করতে করতে অবসন্ন বোধ করলে ম্যাসাজ করার জন্য অটোম্যাটিক চেয়ার ম্যাসাজ বা এক ঘণ্টার টেবিল ম্যাসাজের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর সব সময় কাজ করা? তা নয় মোটেও, বরং খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে বিস্তর।

ক্যাফের পাশেই ভলিবল কোর্ট, আর টেনিস খেলা, কৃত্রিম স্রোতে সাঁতার ও সার্ফিংয়ের ব্যবস্থা, এসব তো রয়েছেই। টেস্টিং অন দ্য টয়লেট গুগলের অনেক কিছুই বেশ ইন্টারেস্টিং, সাধারণ কোম্পানি যেভাবে কাজ করে, তার পুরা উল্টো দিকে অনেক কাজ করতে তাদের আগ্রহ বেশি। তারই একটা উদাহরণ হলো টেস্টিং অন দ্য টয়লেট। গুগলের বিভিন্ন প্রোগ্রামের কোড প্রতিনিয়তই পরীক্ষা করে চলতে হয়, যাতে করে কোনো বাগ ঢুকে না পড়ে। সেই টেস্টিংয়ের ব্যাপারে কর্মীদের সচেতন করার জন্যই গুগলের টেস্ট ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের আইডিয়া—টয়লেটে টেস্ট করা।

আইডিয়াটা এই রকম, টয়লেটে প্রত্যেকেই যায় এবং কম-বেশি সময় ব্যয় করে। টয়লেটে মূল কাজ ছাড়া করার বেশি কিছু থাকে না, তাই বন্ধ দরজা বা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার বদলে সেই সময়টাতেও মাথা ঘামানো, কিংবা বুদ্ধিতে শান দেওয়া ভালো। তাই গুগলের প্রতিটি টয়লেটের সামনে, দরজার পেছনে প্রতি সপ্তাহে কিছু টিউটোরিয়াল থাকত। গুগলের টয়লেটগুলোও ছিল অত্যাধুনিক। না, ইন্টারনেট ব্রাউজের সুযোগ ছিল না তখন পর্যন্ত, কিন্তু সবকিছু ইলেকট্রনিক ছিল, সিট গরম থেকে শুরু করে সবকিছু কনট্রোল প্যানেল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা চলত।

অনেক মজার, অনেক স্মৃতি শেষে গুগলে কাজের পালা শেষ হলো আমার আগস্টের ১৭ তারিখে। শেষের দু-তিন দিন আমাদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে কেটে গেল, আমার হোস্ট রিচার্ড আর ব্রায়ানের সঙ্গে পুরো অফিসের সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হলো বিভিন্ন স্থানে। একেবারে শেষ দিনে গুগলপ্লেক্সকে বিদায় জানাতে বেশ খারাপ লাগছিল। তবু জীবনের গান চলতেই থাকে, ঘুরতে থাকে প্রযুক্তির স্রোতে গুগলের কর্মীদের অবগাহন, এগিয়ে চলে পৃথিবী। রাগিব হাসান: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সেস ডিপার্টমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা এট বার্মিংহাম, ইউএসএ।

মূল লেখাগুলার লিংক গুগল কথন ১ - প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্রে বসবাস গুগল কথন ২ - ডাইনোসরের ছায়ায় স্পেসশীপ গুগল কথন ৩ - গুগলপ্লেক্সের ভিতরে বাইরে গুগল কথন ৪ - ব্রিন আর পেইজের কথা গুগল কথন ৫ - কর্মীরা যেখানে রাজা গুগল কথন ৬ - প্রযুক্তির স্রোতে অবগাহন গুগল কথন (বোনাস) - টেস্টিং অন দ্য টয়লেট আর কুকুর সমাচার  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।