আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক সংগ্রামও এক অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ন সংগ্রাম

ভবিষ্যতের আবরণ উন্মোচিত হয় ধীরে ধীরে, অথচ মানুষকে কাজ করে যেতে হয় দিন থেকে দিনে জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক চেতনার সংগ্রামও এক অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ন সংগ্রাম। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বহু বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম করছি। এই লড়াই এক নিরন্তর প্রক্রিয়া হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই লড়াই কি শুধু রাজনৈতিক অধিকারের লড়াই? এই লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক চেতনার লড়াইয়ের ভূমিকা বা অবস্থান কোন পর্যায়ে? এই বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে নীচে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করা হলো। এ বিষয়ে লেখার আগে প্রথমে হয়তো কয়েক লাইনে 'সংস্কৃতি' এই শব্দটির সাধারণ সংজ্ঞা নিয়ে একটু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।

অক্সফোর্ড ডিকশনারী অনলাইন সংস্করণের এই শব্দটির সংজ্ঞা দিতে বলা হয়েছে, 'the ideas, customs, and social behaviour of a particular people or society"। ইংরেজী culture শব্দটি এসেছে ল্যাটিন এবং ফ্রেঞ্চ ভাষা থেকে। মধ্যযুগের ইংরেজীতে এই শব্দটিকে 'চাষাবাদ' অর্থে বোঝানো হতো। পরে তা রূপ নেয় ''cultivation (of the mind, faculties, or manners)"-এ। বর্তমানে এই শব্দটিেযর অর্থ হচ্ছে আমরা আমাদের জীবনাচরণে যা করে থাকি যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ আমাদের রয়েছে তাইই বোঝায়।

বাংলায় সংস্কৃতি অর্থে ইংরেজী culture শব্দটিকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তবে যখন 'সাংস্কৃতিক' শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন সংকীর্ন অর্থে এই শব্দটিকে 'নাচ-গান-নাটক-ছবি তৈরী করা' ইত্যাদি অর্থেও বহুলভা্বে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সাধারণত লোকজনের কাছে 'সাংস্কৃতিক' শব্দটি এই বহুলভাবে ব্যবহৃত অর্থেই বোঝানো হয়ে থাকে। তবে আমরা 'সংস্কৃতি' এবং 'সাংস্কৃতিক' এই শব্দকে "'the ideas, customs, and social behaviour of a particular people or society"-এই অর্থেই বোঝানোর চেষ্টা করবো। কোরিয়ানরা অনেকদিন জাপানীদের শাসনাধীনে ছিল।

এই অধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে তারা রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছিল। এই সাংস্কৃতিক সংগ্রাম মানে নাচ-গান নয়, বরং চিন্তা-চেতনা-আদর্শের সংগ্রামই প্রাধান্যে ছিল। ১৯২২ সালের দিকে তাদের একজন শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। আগে সমাজে শিশুদের একঅর্থে শুধু ছোটো/অবুঝ এভাবে দেখা হতো। তাদেরকে অবজ্ঞাও করা হতো।

তিনি প্রথমে শিশুদের মানসিক-বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য শিশুদের প্রতি সমাজের পূর্ব মানসিকতা বদলানোর আহ্বান জানান। শিশুদের উপরই যে জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে এ বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করেন। তিনি সারা কোরিয়ায় ঘুরে শিশুদের বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা আনার চেষ্টা করেন। বছরের একটি দিন শিশু দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেন। শিশুতোষ প্রকাশনাও তিনি প্রকাশ করেন।

তার এই কার্যক্রম সারা কোরিয়ায় এক আন্দোলনে রূপ নেয়। তবে জাপান শাসকগোষ্ঠি তার এই কাজকে ভালোচোখে দেখেনি। কোরিয়া স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কোরিয়ার জনগণ স্বাধীনভাবে এই দিবসটি পালন করতে পারেনি। স্বাধীন হবার পর তারা আবার এই দিবসটি পালন করতে শুরু করে। কোরিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক উন্নতির পেছনে এই আন্দোলনের বুনিয়াদী ভূমিকা রয়েছে।

যে সকল জাতি-সমাজ আজ পর্যন্ত স্বাধিকার-অধিকার পেয়েছে তার পেছনে এইধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিরাজমান ছিল। ভারতবর্ষে যারা প্রথমদিকের বিপ্লবী ছিলেন তারা এই সাংস্কৃতিক সংগ্রামশুরু করেছিলেন প্রথমে 'শরীরচর্চা-কুস্তি-ব্যায়াম' ইত্যাদি দিয়ে। ভারতবর্ষীয় বিপ্লবীরা এটা দিয়ে শুরু করেছিলেন কারন, তারা প্রথমেজনগণের মধ্যে এই সাহস আনতে চেয়েছিলেন যে, ভারতের জনগণও এইবেনিয়া-ফারাঙিদের বা ইংরেজেদের মতো সবকিছুতে সমকক্ষ হতে পারে। এমনকিশক্তি-সাহসেও। অনুশীলন সমিতির ইতিহাস নিয়ে জীবনতারা হালদারের বইয়ে লেখা রয়েছে,"১৯০০ সালের বহু পূর্বের কথা।

সেই কালে "ভীরু কাপুরুষ" বাঙালীকে সকলে ঘৃণা করিত। এই কলঙ্ক মোচনের জন্য কলিকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বিভিন্ন স্থানে 'আখড়া' স্থাপন করিয়াছিলেন। তাহাতে প্রধানতঃ ডন, বৈঠক, মুগুর, কুস্তি প্রভৃতি ব্যায়াম শিক্ষা দেয়া হইত। " ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অনুশীলন সমিতি। আদর্শ যুব সমাজ গঠনই ছিলো এই সমিতির লক্ষ্য।

এই লক্ষে তারা এলাকায় এলাকায় ক্লাব গঠন করেছিলেন, ব্যায়ামাগার স্থাপন করা হয়েছিল। শরীরচর্চার পাশাপাশি মানসিক উন্নতির জন্য দেশ-বিদেশের বীরপুরুষদের জীবনচরিত,বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী সহ উৎকৃষ্ট বই পড়তে উৎসাহ দেয়া হত। নৈতিক উন্নতির জন্য সপ্তাহের একটি দিন একসাথেবসে Moral Class এর আয়োজন করা হত। জীবনতারা হালদার লিখছেন,"... প্রত্যহ নিয়মিত ব্যায়াম করিতে হইত, Moral Class প্রভৃতি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হইত, সকল বিষয়ে স্বাবলম্বী হইতে হইত- খেলার মাঠ ঝাড়ু দেওয়া, পাঠাগারের বই রৌদ্রে দেওয়া ও ঝাড়া,আলমারী সাফ করা, অফিসঘর কলি দেওয়া, এমনকি ড্রেন সাফ করা, জঞ্জাল ফেলা, নৌকায় দাঁড় টানা,হালধরা, দীর্ঘপথ ভ্রমণ, সাইকেল চালানো ইত্যাদি। " পৃথিবীর দেশে দেশে বা নানা জাতির মধ্যে এই সাংস্কৃতিকচেতনার সংগ্রামের ধারা বা স্তর এক নয় ; কিন্তু তাদেরকে প্রথমেসাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক-আদর্শিক সংগ্রামই শুরু করতে হুয়েছিল।

ফরাসী বিপ্লবের পূর্বেও তো এক বিরাট বৌদ্ধিক লড়াই সংঘটিত হয়েছিল! চীনবিপ্লবের আগে চীনে এসেছিল এক বিরাট জাতিগত চেতনার জাগরণ। চীনকে এগিয়েনিতে এই সময় চীনের যারা সচেতন ছিলেন তারা শত শত ব্যক্তিকে দেশের বাইরে উন্নত সংস্কৃতির সমাজ ইউরোপে পাঠিয়েছিল যাতে তারা ভালো সৃস্কৃতিকে আয়ত্তকরতে পারে এবং পরে চীনে এসে তারা যাতে চীনের উন্নতিতে ভুমিকা রাখতেপারে। এই উদ্যোগ তারা সচেতনভাবেই নিয়েছিলেন। চীনা একটি প্রবাদে বলা হয়েছে-একটি দেশ সম্পর্কে হাজারবার শোনার চেয়ে একবার নিজ চোখে সেই দেশ দেখে আসা অনেক ভালো। একজন চীনা বুদ্ধিজীবী বলেছেন , জাতিগঠনের জন্য তিনটি উপাদানের প্রয়োজনঃ(ক) দ্তিহিক বল বৃদ্ধি।

(খ) জ্ঞানের উন্মেষ। (গ) নৈতিক চরিত্রশক্তি। চীনের মাহন সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বিরাট এক দক্ষযজ্ঞ। মহান এক কর্মযজ্ঞ।

যার অভিঘাতে গোটা চীন থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। যার প্রভাব সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। যার লক্ষ্য ছিল মহান সমাজতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদ অভিমুখী এক চীন। যা সফল হতে পারেনি, তবে যা আজকের এই পুঁজির অধীন চীনকে উচ্চ শিখর অভিযানের এক অন্যতম অভিযাত্রীরূপে দৃশ্যমান হতে দেখা যাচ্ছে। তা সম্ভব হচ্ছে তারই কল্যাণে।

আজকে পুঁজিবাদী পথবাহী চীনের নেতৃত্ব এই মাহন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মযজ্ঞকে ঝেরেবংশে নিকুচি করার চেষ্টা করে। কিন্তু এমন একটি মহান কর্মকান্ডের অভিজ্ঞতা তারা পেয়েছে এলই তারা জানতে পেরেছেন জাগরণের শক্তি কত ভয়াবহ এবং কত মহীয়ান! চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নানা দুর্বলতা সাদা চোখে দৃশ্যমান। তবে তার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবই কিন্তু আজকের এই চীন তা কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন। এই দক্ষযজ্ঞ যদি না চলতো তবে চীন তার শক্তিকে চীনতে পারতোনা, শক্তিকে কাজে লাগানো যোগ্য হতোনা। বাস্তবে যখন তাদের নেতৃত্ব জনগণের সাথে থেকেছে, মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারনে তাদের 'শাস্তিস্বরূপ' শারীরিক শ্রমের কাজে, শ্রমিকে হিসেবে, কঠোর পরিশ্রমের কাজে, গ্রামে থাকতে হয়েছে তখনই তারা বুঝেছিলেন চীন কোথায় ছিলো এবং যারা প্রতিভাময় নেতৃত্ব তারা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন সামনের চীনকে জাগাতে হলে কী ভুমিকা নিতে হবে।

তারা চীনকে জাগিয়েছে পুঁজির অধীন এক ভারবাহী হিসেবে পার্থক্য শুধু এটাই। অন্যান্য জাতি বা দেশের সমৃদ্ধি বা উন্নতির পেছনে যেমনসাংস্কৃতিক-আদর্শিক লড়াই মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে তেমনি আমাদেরকেও যদিলড়াইয়ে বিজয় অর্জন করতে হয় তবে আমাদেরকেও সেই সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করতেহবে। শেষে এটাই বলা যায়, সাংস্কৃতিক-সামাজিক বুনিয়াদী লড়াই ব্যতীতস্বাধীকার বা রাজনৈতিক অধিকারের লড়াই যেন build a castle in the air! তবে সঠিক রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকনির্দেশনা অথবা রাজনৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দেলনই সমাজে নতুন কিছু জোয়ার আনতে সক্ষম হয়্। আমাদের পরবর্তী আলোচনার বিষয় হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে কী ধরণের সাংস্কৃতিক সংগ্রাম আমাদের করতে হবে তা নিয়ে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.