আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মালালা, তালেবান এবং আলেম-সমাজ

লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু। মালালা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে স্কুল-বাসেই গুলিবিদ্ধ হয়। পাকিস্তানের স্থানীয় মিডিয়াসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। প্রায় সবাই নিজ অবস্থান থেকে এর সমালোচনাসহ নিন্দা জানাচ্ছেন।

কিন্তু পাকিস্তানের আলেম সমাজ এ ব্যাপারে একেবারে নীরব। টিভি টকশো-তে আলেমদের এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায় নি, যাচ্ছে না। অথচ এই টকশো-তেই ফোন করছে তালেবানের নামে অনেকেই। তারা সরাসরি এর দায় স্বীকার করছে এবং নিজেদের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শরিয়ার বৈধতার ব্যাপারে পাল্টা প্রশ্ন করলেই তালেবান নামধারীরা ফোন রেখে দিচ্ছে।

অর্থাৎ শরিয়াভিত্তিক কোনো যুক্তি তাদের কাছে নেই। তাহলে এ অন্যায়ের সমালোচনা ও নিন্দাজ্ঞাপনে নেতৃত্ব-স্থানীয় আলেম সমাজ নীরব কেন? পাকিস্তানে আমেরিকান ড্রোন-হামলায় হাজারো মালালার মৃত্যু হচ্ছে। এটি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী নৃশংস নীতির অংশ। এ ড্রোন হামলাকে কেউ সমর্থন করে না, করার প্রশ্নই আসে না। পাকিস্তানের ভিতরে-বাইরে এ নিয়ে প্রবল সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় অতীতেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।

এ নিন্দায় আবার আলেম-সমাজ সরব, যারা মালালার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। আফগানিস্তানে তো অবশ্যই, পাকিস্তানে এবং আমাদের এই বাংলাদেশেও এক ধরনের অন্ধ অবোঝ গোঁড়া ধরনের লোক রয়েছে, যারা এখনো তালেবানকেই স্বচ্ছ ধর্ম ইসলামের নিটোল প্রতিনিধি ভাবে! আল্লাহ মাফ করুন, এরাই যদি নিখুঁত ইসলামের প্রতিনিধি হয়; অন্তত তাদের মতানুসারে, তাহলে ইসলামের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। কারণ, ইসলামের ইতিহাস মানে যুদ্ধোন্মাদনার কোনো ইতিহাস নয়, নয় তা গোত্রাবদ্ধ আধিপত্য বিস্তারের নৃশংস ও আত্মঘাতী প্রচেষ্টা। অথচ তালেবান মানে সীমাহীন পীড়ন-উৎপীড়ন-নিপীড়ন, নির্মম জোরজবরদস্তি এবং নিজের পক্ষে ঝোল টানাটানির ধুন্ধুমার ইতিহাস। এখানে ইসলামের ঔদার্য, সৌহার্দ্য-সহানুভূতি এবং মহানুভবতার কোনো স্থান নেই।

মালালা সামান্য একটা মেয়ে। নিজের আবেগের বশেই হোক বা মুক্তমনা পিতা-মাতার প্রশ্রয়ে, বিবিসির ব্লগে লিখে মনের দুঃখ-ক্ষোভ মেটানোর প্রয়াস পায়। কিন্তু তালেবান এতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এক মালালাই যেন আমেরিকার পর তাদের সব চেয়ে ভয়ঙ্কর শ্ত্রু! আরে বাবা, এক মালালা যদি আপনার বিপক্ষে লিখে, পাক-আফগানে তো আরো মালালা রয়েছে, তারা আপনার হয়ে লড়ছে না কেন? আপনি যদি সৎ হন, আদর্শ যদি আপনার অমলিন ও নিখুঁত হয়, এক মালালার লেখায় তা কি কালিমালিপ্ত হতে যাবে কেন? আসলে মনস্তাত্ত্বিকদের কথাটাই বোধ হয় ঠিক যে, নিপীড়ন-নিষ্পেষণে যাদের বেড়ে উঠা, তারা অন্যের প্রতি সদয় হতে পারে না। সে হিসাবে তালেবানের জন্য অবশ্যই করুণা জাগে।

আবার রুশ-মার্কিনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এ কষ্ট ও পীড়ন-সহা মানসিকতাই সাহায্য করছে বেশি। কিন্তু আধিপত্য-বিরোধী সংগ্রামী মানুষও বিজয়ের পর স্বৈরাচারী নিপীড়ক হিসাবে আবির্ভূত হয়। আর নিপীড়ন তো তালেবানের মজ্জাগত অধিকার! ইসলাম সর্বজনীন ও সর্বকালীন ধর্ম। এখানে স্থানিক-কালিক অজুহাতে কালোকে সাদা এবং সাদাকে কালো বলার কোনো সুযোগ নেই। সে তালেবান হোক আর মালাউন হোক।

মালালার ওপর আক্রমণ অমানবিক, পাশবিক এবং অবশ্যই ইসলামের মূলনীতি বিরোধী। কারণ, একে তো সে অ-প্রাপ্ত বয়স্ক, অপরদিকে সে হল নারীদের অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু তার অবস্থান কোনোভাবেই ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, বরং স্ব-ঘোষিত ইসলামের একমাত্র বৈধ (?) প্রতিনিধি তালেবানের বিরুদ্ধে। তালেবান-বিরোধিতা আর ইসলাম-বিরোধিতা এক কথা নয়, তালেবানই বর্তমান ইসলামের অ-বিকল্প ঠিকাদার নয়। তাই মালালার ওপর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ইমানেরই দাবি।

আর হ্যাঁ, এক মালালাকে নিয়ে এখন প্রচণ্ড তোলপাড়, মহা শোরগোল, উতাল-পাতাল চিৎকার! মনে হয় পাকিস্তানে কোনো মানুষ, নিদেন পক্ষে কোন নারী বা শিশুর অপঘাতে মৃত্যু হয় না। হয়, হয়, বিলক্ষণ হয়। পাকিস্তান হল এক অন্ধকার মৃত্যুপুরী। সর্বত্রই আজরাইলের নিত্য আনাগোনা। স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই।

এর জন্য প্রধানত দায়ী অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা। এ বিষয়ে পৃথিবীর সচেতন বিবেকবান কোনো মানুষেরই মনে সংশয় নেই। আমেরিকাও কিন্তু ড্রোন হামলার বৈধতা নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করে না। সাম্রাজ্যবাদের অমোঘ কৌশল হিসাবে একে নিদারুণভাবে অব্যাহত রাখে মাত্র। কিন্তু তালেবান এখানে ব্যতিক্রম।

এরা নিজ অপরাধের ব্যাপারে অনুতপ্ত তো নয়-ই, বরং পাল্টা বলছে যে, সে বেঁচে উঠলে মৃত্যু পর্যন্ত আক্রমণ চালিয়ে যাবে! এই হল তালিবানি মানসিকতার আসল পরিচয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানে যে সব ব্যক্তিবর্গ, লেখক-কলামিস্ট এ আক্রমণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাদেরকেও হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে! মাওলানা মুফতি তকি উসমানির ওয়েবসাইটে হামিদ মীরসহ একাধিক সাংবাদিক-কলামিস্টের কলামগুলো শোভা পাচ্ছে, যা একান্ত মালালার সমর্থনে লেখা। যদিও মুফতি তকি উসমানিসহ দেওবন্দি ধারার অপরাপর সকল মুফতি-ই এব্যাপারে নীরব। শুধু বেরেলী ধারার জনা পঞ্চাশেক মুফতি মালালা-আক্রমণের বৈধতাকে শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এর পাল্টা কোনো ফতওয়া এখনো আসে নি।

দেওবন্দি ধারার নেতৃত্ব-স্থানীয় আলেমদের এ নীরবতা কি মালালার পক্ষে না বিপক্ষে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন! প্রশ্নের উত্তর হয়ত কোনো দিন পাওয়া যাবে না। বরং তার প্রতিধ্বনিই শুনতে পাবো শুধু। তাই শেষ করছি রবি ঠাকুরের পংক্তি দিয়ে- “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে” ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.