অরুণালোক লোকটার আসল নাম মোঃ মহিউদ্দিন আর ডাক নাম জন। জন্ম ১৯৩৯ সালে তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুরে। গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষা জীবনের শুরু। তারপর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ শেষ করে এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলোসফি বিভাগে। এরপর পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার উপর এম.এ ডিগ্রি লাভ করে যোগদান করেন পাকিস্তানের মর্নিং সান পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে।
১৯৬৯ সালের কথা। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পত্রিকাটির সম্পাদক বদলে যান। আসেন এবিএম মুসা পরে এসজিএম বদরুদ্দিন। মহিউদ্দিন এঁদের সাথে কাজ করেন দীর্ঘদিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এরপর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
মহিউদ্দিন এরপর পেশা বদল করে ব্যবসায়ে মন দেন। কিন্তু লেখালেখি যার নেশা, তার পক্ষে লেখা ছাড়া থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সংসার জীবনের নানা টানাপোড়েন তাঁকে কিছুতেই থিতু হতে দেয় নি।
আমার সাথে গত ৭ অক্টোবর ২০১২ তারিখে প্রেসক্লাবের সামনে লোকটির সাথে দেখা। আমি আর আমার সহযোগী সোহরাব আলী তুষার প্রেসক্লাবের কাজ সেরে বাইরে এসে দাঁড়ালা।
দাঁড়াতেই লোকটি সালাম দিয়ে কিছু সাহায্য চাইল। লোকটাকে দেখে আমার ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছিল না। কৌতুহল বশত: তার নাম এবং আনুসাঙ্গিক বিষয়ে জেনে নিচ্ছিলাম। এ সময় লোকটি অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছিলো। আমি ক্রমে ক্রমে বিস্মিত হচ্ছিলাম।
তার ভাষ্যমতে, তার লেখা গান নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগে পাঠ্য করা হয়েছে। এছাড়া এমনসব চমকপ্রদ বিষয়ে এবং বাংলাদেশের স্বনামধন্য কিছু ব্যক্তিবর্গের নামে তাঁর উঠাবসা সম্পর্কে তথ্য দিতে থাকলো। আমি বিস্ময়ের উপর বিস্মিত হচ্ছিলাম। আমার সহযোগী প্রথমে লোকটাকে পাত্তা দিতে না চাইলেও পরে কৌতুহলী হয়ে উঠছিলো বেশ বুঝতে পারছিলাম। এদিকে লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে দেখলাম চারপাশে একটা ভীড় জমে গেছে।
কিন্তু লোকটা সে ব্যাপারে নির্বিকার ছিলো কিন্তু কথা বলার সময় কাঁপুনি রোগীর মতো কাঁপছিলো। বিষয়টি জানতে চাইলে বললেন, এটা উনার কোন রোগ নয় বরং একধরনের মুদ্রাদোষ। ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকদের সামনে পড়া দেওয়ার সময় কাঁপতেন কিনা জানতে চাইলে বললেন, না না, কাঁপতাম না। এটা আমার বছর দশেক যাবৎ শুরু হয়েছে। চেহারাটায় একটা মার্জিত ভাব আছে।
এমন একটা লোক যে সাহায্য চাইতে পারে তা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলছিলো। যাহোক, তাকে কুড়ি টাকা মানিব্যাগ থেকে বের করে দিতেই দেখলাম, চেহারায় একটা বিব্রতকর ভাব ফোটে উঠলো। আমি জেনে গেলাম, হয়তোবা পকেটমানি জোগাড় করতেই তার অন্যের কাছে এ হাত পাতা। যাহোক, কথা প্রসঙ্গে জানলাম পাকিস্তানের অনেক মন্ত্রী সম্পর্কে যারা উনাকে পাকিস্তানে বিভিন্নভাবে উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগিয়েছেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক সম্পর্কে উনার সরল মন্তব্য শুনতে খারাপ লাগছিলো না।
আমি বিবর্তন পত্রিকায় কর্মরত। পত্রিকাটির চলতি কপি আমার হাতে ছিলো। উনাকে সেখান থেকে এক কপি দিতেই খুব আগ্রহ ভরে গ্রহণ করলেন। পরে আমার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে উনার মোবাইল নাম্বারটা চাইতেই দেখলাম, উজ্জ্বল চেহারায় বেদনার ছাপ। বললেন, উনার কোন নাম্বার নেই।
পরিবারের সব সদস্যের মোবাইল আছে, তবে তা তাকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। পরিবারের সদস্যরা উনাকে পাগল হিসেবেই ট্রিট করে থাকেন। অথচ আমার সাথে কথা বলার সময় উনাকে আমার পাগল মনে হলো না। সে যাক, আমি তো উনাকে মাত্র মিনিট বিশেক ধরে দেখছি, কথা বলছি। কিন্তু যারা উনার সাথে দীর্ঘদিন একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে বাস করছেন, তারা নিশ্চয়ই আমার চাইতে উনাকে ভাল জানবেন।
তা নইলে উনি উনার একটা ইংরেজি গান (কম্পোজকৃত ফটোকপি) আমার হাতে দিলেন। এ গানটির বেশ ক’টি কপি দেখলাম উনার ঝোলার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। উনার কি সত্যিই মস্তিষ্ক বিকার কিনা সেটি বিচারের ভার আমি পাঠকদের দরবারে পেশ করলাম।
মহিউদ্দিনের ইংরেজি গান:
Bangladesh Police in song
To trina
Refrain Police, Police, Police’, say, alo, lolona,
Without police, world in inhuman arena
Bangladesh policemen,
Their women and men
Shun sublunary p[en,
Scaling the heart and mind
For grace of god to find
God is in the heaven
An’ on earth policemen
To maintain peace and order
The matter to be thought over
Policing the Satan
Was started be Adam, the first man,
To check anyone to kill
Just as satanic Kabil
John
এমন একটা লোক, যাকে ফেলে চলেও আসতে পারছিলাম না। উনার প্রতি আন্তরিক হয়ে বারবার উনাকে চা কিংবা অন্যকোন খাবার খাওয়াতে আমি জোরাজোরি করছিলাম কিন্তু উনাকে কোন খাবারের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারছিলাম না।
আমার আন্তরিক আচরণে লোকটা বললেন, মনে হচ্ছে আমি আমার মায়ের আত্মার সাথে কথা বলছি। উনার কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। বললাম, এটা কেমন কথা হলো? উনি জানালেন, “আজ বহুদিন পর আপনার সাথে কথা বলে আমার সত্যিই মনে হচ্ছে যে, আমি আমার মায়ের সোলের (আত্মা) সাথে কথা বলছি। ” আয় সুবহান আল্লাহ! আমি তো দুনিয়াতে কিচ্ছু না, একটা শুকনো মাটির ঢেলাও আমার চেয়ে মূল্যবান! আমার আচরণে লোকটাকে বেশ সুখি মনে হচ্ছিল। বারবার চা খেতে বলায় বললেন, আমার লাগবে না, আপনি চা খান।
আমি তখন অন্য জগতে চলে গেছি। লোকটাকে চা কিংবা অন্য কিছু খাওয়াতে পারলে খুব ভাল লাগতো। সে যাক, কেউ যদি এত অনুরোধের পর না খায় তো করার কিছু নেই। আমার সহযোগীও চা খেতে চাইছিলেন না। অগত্যা আমি প্রেসক্লাবের গেটের মুখে একটা চায়ের দোকানীকে আমার জন্য এক কাপ চা বানাতে বললাম।
দোকানী চা বানিয়ে দিলো। অথচ লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে আমি এতোটাই তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম যে, কী আর বলবো। শেষকালে আসার সময় চা দোকানীকে টাকা দিতেও ভুলে গেছি। হায় আল্লাহ! আমি যে ঋণী হয়ে রইলাম, এখন কী হবে? মিরপুর ফেরার পর আমার সহযোগীর সাথে বিষয়টি বলতেই সেও আফসোস করলো এবং বললো, আগামী সপ্তাহয় প্রেসক্লাব এলে দোকানীকে চায়ের বিলটা দিয়ে দেবে কিংবা আমি গেলে আমিই দিয়ে দেবো বলে মনস্থ করলাম।
কথা প্রসঙ্গে জানলাম, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই নন, বরং শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উনি দারুণভাবে সফল ছিলেন।
কর্মজীবনে পত্রিকা ও বিভিন্ন লেখালেখি সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস, আজ তাকে ভিখারি সাজিয়ে দিয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।