আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তড়িঘড়ি আইন সংশোধন হয়রানির আশঙ্কা

সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংবিধান ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ আইনের অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হবে।
৩ জুন সম্পূরক কার্যসূচি হিসেবে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল, ২০১৩ সংসদে উত্থাপন করা হয়। মাত্র আট দিনের মধ্যেই সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষা পর তড়িঘড়ি করে গত মঙ্গলবার বিলটি পাস করা হয়। এর আগে প্রায় দুই বছর ধরে এ আইনটি সংশোধনের কথা ভাবা হচ্ছিল।


মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আন্তরাষ্ট্রীয় যেসব চুক্তি আছে, সেগুলোর উদ্দেশ্যও ছিল দেশের সীমানার বাইরে বসে কেউ যাতে নিজ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধমূলক ঘটনা না ঘটাতে পারে। কিন্তু এ জন্য নতুন করে আইন করার দরকার ছিল না। কারণ, এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট আইন বিদ্যমান আছে। এ আইনের মাধ্যমে ব্যক্তির নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হবে।
আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠনের ফেসবুক, স্কাইপি, টুইটার বা ইন্টারনেটের যেকোনো মাধ্যমের অপরাধসংশ্লিষ্ট আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা অপরাধসংশ্লিষ্ট স্থির ও ভিডিওচিত্র অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবে এবং তা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে।


আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক এ ধারা প্রসঙ্গে বলেন, কেউ যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে, ইন্টারনেট মাধ্যমের এ-সংক্রান্ত কথাবার্তা, ছবি ও ভিডিও আদালতের জন্য আমলযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ হওয়াটা দোষের নয়। কিন্তু তার আগেই অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সেই সব কথাবার্তা, ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করতে হবে এবং সেটা তিনি সংগ্রহ করবেন অন্যায়ভাবে। কারণ, সংবিধানের মৌলিক অধ্যায়ের মাধ্যমে ব্যক্তির গোপনীয়তাকে সুরক্ষা দেওয়া আছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এ আইনের ২১ ধারা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
সংবিধানের ৪৩ ধারায় বলা আছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে এবং চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।


সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারা ২ অনুসারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের উদ্দেশে ম্যানুয়াল/ইলেকট্রনিক/ডিজিটাল কিংবা যেভাবেই লেনদেন করা হোক না কেন, তা এ আইনের আওতায় আসবে। অর্থের উৎস দেশ বা বিদেশ যেকোনো স্থান থেকে হতে পারে। শুধু যদি মনে হয়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে টাকা পাচার করা হচ্ছে, তাহলে তা এ আইনের আওতায় চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে নগদ টাকা পাঠানোর বিষয়টি যে প্রমাণিত হতে হবে তা নয়; চেক, মানি অর্ডার, পে-অর্ডার, ডিডি, টিটি, ক্রেডিট কার্ড এমনকি ই-মেইল বার্তায় প্রমাণ পাওয়া গেলে তা এ আইনের আওতায় অর্থ পাচারের অভিযোগে সাক্ষ্য হিসেবে আমলে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সন্দেহজনক যেকোনো লেনদেন এ আইনের আওতায় আসবে।


সুলতানা কামাল বলেন, টাকা পাচারসংক্রান্ত ই-মেইল বার্তার তথ্য যেকোনো মানুষকে ‘ভিকটিম’ বানাতে পারে। কারণ, আজকাল যে কারও ই-মেইল যেকোনো সময় হ্যাক করা যায়। এই ধারা অনুযায়ী উদ্দেশ্যমূলকভাবে হ্যাক করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যে কাউকে ‘ভিকটিম’ বানানোর সুযোগ রয়েছে।
৪০ ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করতে পারবেন।
সুলতানা কামাল বলেন, এই ধারা পুলিশ বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।

একই সঙ্গে এ আইনের কারণে পুলিশ বাহিনীর চেইন অব কমান্ড নষ্ট হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ৪০ ধারা সম্পর্কে পুলিশের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। কিন্তু সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মত প্রকাশ করেনি। পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, এতে পুলিশের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে পুলিশ অপরাধ আমলে নিয়ে নিজে থেকেই তদন্ত করতে পারে।

এ জন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা. নুরুল হুদা এ প্রসঙ্গে বলেন, এ আইনে ধরে নেওয়া হয়েছে যে তদন্তকারী খুব দুর্বল। যদি আগে থেকেই তদন্তকারীকে দুর্বল ভাবা হয়, তাহলে কেন তাঁকে দিয়ে তদন্ত করানো হবে? তিনি বলেন, প্রচলিত আইনে মামলা করার বিষয়টি কাউকে অবহিত করার বিধান নেই। মামলা করে পুলিশ নিজের মতো করে তদন্ত করবে, সেটাই বিধান।
আইনের ৩৪ খ(২) ধারায় বলা আছে, এ আইনের অধীন দণ্ডপ্রাপ্ত হোক বা না হোক, কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সত্তা বা অন্য কোনো ব্যক্তির দখলে থাকা কোনো সন্ত্রাসী সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।


এ ধারা সম্পর্কে মুহা. নুরুল হুদা বলেন, এতে নিরপরাধ মানুষের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা আদালতের। আদালত ছাড়া আর কারও হাতে এ ক্ষমতা দিলে সেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আইনের ১৫(ছ)(৩) ধারায় বলা হয়, ‘অপরাধটি যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রে সংঘটিত হয় বা অন্য কোনো রাষ্ট্রে বিচারাধীন থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক উক্ত বিদেশি রাষ্ট্রের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বা কোনো আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুসমর্থিত জাতিসংঘের কনভেনশন বা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংশ্লিষ্ট রেজুলেশনের আওতায় কোনো ব্যক্তি বা সত্তার হিসাব জব্দ করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংশ্লিষ্ট দেশের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব আসতে হবে।

আবার সেই প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতে হবে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে। দুই দেশের মধ্যে সম্পূর্ণ পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ক্ষমতা ব্যবহার হতে হবে।
সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা অবশ্যই চাই রাষ্ট্রের হাতে সন্ত্রাস দমনের উপযুক্ত ও কার্যকর আইন থাকুক। তবে অবশ্যই তা মানবাধিকারের পরিপন্থী হবে না। কিন্তু সংশোধিত আইনের কারণে সেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এর অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তির নিরাপত্তা ও গোপনীয় বিষয়গুলো প্রায় আইনসিদ্ধভাবে আক্রান্ত হতে পারে। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.