আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পড়ন্ত বিকেলে শেষ হিমু - হুমায়ূন আহমেদ

মিজান রহমান শ্রেষ্ঠ নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে টের পেলাম যে বেশ ভালোভাবেই সর্দি ধরেছে। বাম নাক বন্ধ। ডান নাক দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে। তাতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। আর ... সর্দি লাগায় মাথাটা ভার হয়ে আছে।

হাঁটতে নেশা নেশা লাগে। এলোমেলো পা ফেলে এগুচ্ছি শাহবাগের দিকে। সর্দির আরেক নাম উপদংশ। এটা অনেকেই জানে না। সর্দি আর সিগারেট নিয়ে জ্ঞানীমহলে দুটি ধারনা প্রচলিত।

এক পক্ষের মতে- সিগারেট খেলে সর্দি গাঢ় হয়। তাই সর্দি হল তো সিগারেটকে না বলুন। অন্য পক্ষ আবার এক কাঠি বাড়ন্ত- সিগারেটের ধোঁয়া নাক দিয়ে বের করলে নাকি সর্দি বাপ-মা-কাকা-খালা বলে পালায়। দুই দলের কথা পুরোপুরি উলটা। আমার ধারনা এক দল আওয়ামীপন্থী আর অন্যদল বিএনপিপন্থী।

এরশাদ মামা এখানেও সুবিধা করে উঠতে পারেন নাই। এদের কথা থাক। আমি বরং বিখ্যাত কাউকে জিজ্ঞেস করি। এই মুহূর্তে একজনের কথাই মনে আসছে- সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি জীবিত থাকাকালীন সর্দি নিয়ে ব্যাপক গবেষনা চালিয়েছিলেন।

তাঁর লেখা "বেঁচে থাক সর্দি-কাঁশি" গল্পটি একটি সুপাঠ্য। মনে মনে মুজতবা আলী সাহেবকে ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে। - হ্যালো। কে বলছেন? - স্যার, আমি হিমু।

সর্দি বিষয়ে আপনার সাথে একটু আলোচনা ছিল। - বল কি বলবে। আমাকে আবার রসগোল্লা খেতে যেতে হবে। ঝান্ডুদা বসে রয়েছেন। - আপনি বলেছেন 'ওষুধ খেলে সর্দি সারে এক সপ্তাহে আর না খেলে সারে সাত দিনে।

'- এর মানে কি? - মানে কিছুই না। ঔষধে সর্দি ছাড়ে না- এটাই মনে হয় বুঝাতে চেয়েছি। - তাহলে সর্দি থেকে রেহাই পাবার উপায় বাতলে দিন। - রসগোল্লা খেয়ে দেখতে পার। রসগোল্লা সর্বরোগের ঔষধ।

- হুম। আপনি স্যার কোন পন্থী? আওয়ামীপন্থী না বিএনপিপন্থী? - আমি ডানপন্থী। কারন রসগোল্লা ডান হাত দিয়ে তুলে মুখে দিতে হয়। মনে মনে কথা বলছি তাই মুখে বললাম 'খাইছে আমারে'। এই বুড়ার জগৎতো রসগোল্লায় গোল্লাময়।

- আপনার সাথে কথা বলে মাথা ধরেছে। আমি ফোন রাখব। বাই। টিসি। - টিসি আবার কি?? - টেক কেয়ার।

ফোন রেখে বিএনপিপন্থীদের উপদেশ মেনে সিগারেট ধরালাম। নেশা নেশা ভাবটা আরেকটু বাড়লে মন্দ হয় না। "হিমু। এই হিমু। " "হিমু।

এই হিমু। " ভাবলাম হয়ত মুজতবা আলী সাহেব আবার ডাকছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই মেয়েলী কন্ঠে ডাকবেন না। আশেপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সামনে ডাস্টবিনে একটা কুকুর খাবার খুঁজছে।

সে নিশ্চয়ই আমার নাম ধরে ডাকবে না। তার এখন পিক আওয়ার চলছে। রাস্তার ওপাশে একটা পাজেরো দাঁড়ানো। সেখান থেকেই "হিমু। এই হিমু" ভেসে আসছে।

পাজেরো অর্থ 'পাহাড়ি যোদ্ধা'। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ডান নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লাম। সিগারেট ফেলে 'পাহাড়ি যোদ্ধা'র দিকে এগোলাম। গাড়ির ভেতর রূপা বসে আছে। ওকে আগের চেয়ে আরো বেশি সুন্দর লাগছে।

কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের রূপ মনে হয় প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ে। রূপা সেই টাইপের মেয়ে। "গাড়িতে ওঠ। " আমি ড্রাইভারের পাশে উঠে পড়লাম। এই ড্রাইভার নতুন।

আমার দিকে চিকন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এর নাম 'তুই চোর' দৃষ্টি। কাউকে চোর সন্দেহ হলে তার দিকে 'তুই চোর' দৃষ্টি দেয়া যায়। বাসে কারো হাত মানিব্যাগে লাগলে আমরা যেইভাবে তাকাই অনেকটা সেইরকম। পাজেরোর ভেতর আরামদায়ক শীতলতা।

এর নাম ঘুম শীতলতা। ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ঘুমপাড়ানী মাসী এবং পিসী দুজনই নিজেদের কাজ শুরু করেছে। আচ্ছা ঘুমাপাড়ানি মাসী আছে; মেসো নাই কেন? ভাবতে ভাবতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল বা চোখে ঘুম জড়িয়ে এল। ঘুমের মধ্যে বাবাকে স্বপ্ন দেখলাম।

বসে বসে রসগোল্লা খাচ্ছেন। চুক চুক শব্দ হচ্ছে। আরামে তার চোখ বন্ধ। বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছেন বোঝাই যায়। আমি বললাম,'বাবা, কি করছ?' বাবা বললেন,'কানামছি ভোঁ ভোঁ খেলছি।

ছাগল ছেলে। দেখিস না রসগোল্লা খাচ্ছি। ' - তোমার কি শরীর খারাপ? - শরীর ঠিকই আছে। মেজাজ খারাপ। অত্যাধিক খারাপ।

তোর ব্যাপারটা কি? পাজেরোতে বসে ঘুমাচ্ছিস যে। - কারন এখানে দাঁড়িয়ে ঘুমানোর কোন চান্স নেই। - তুই কি আমার সাথে রসিকতা করার চেষ্টা করছিস? বাবার সাথে কথাবার্তা আর এগুলো না। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি রূপাদের বাড়ি পৌছে গেছি।

- হিমু, তুমি কেমন আছ?? - আমি ভাল আছি রূপা। - চা খাবে? - চা খাওয়া যায়। রূপা বের হয়ে গেল। আমি বসে আছি রূপার রুমে। পরিপাটি রুম বলতে যা বোঝায় রূপার রুম ঠিক তাই।

দেয়ালে রূপার আঁকা একটা ছবি টাঙ্গানো। ছবিতে সাপুড়ে সাপখেলা দেখাচ্ছে। চারদিকে লোকে লোকারন্য। তবে সাপটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়। মনে হয় অজগর।

কোন সাপুড়ে বীণ বাজিয়ে অজগর সাপের খেলা দেখায় কিনা জানি না। ব্যাপারটা রূপাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। রূপা ট্রেতে করে দু'কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি চা নিলাম। - তোমার মহাপুরুষ হওয়া কতদূর? মহাপুরুষ হতে পেরেছ? আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম।

এই হাসির নানা রকম অর্থ হয়। - অকারনে হাসবে না। তোমার হাসি মোটেও সুন্দর না। তোমার হাসি অনেকটা হায়নার হাসির কাছাকাছি। আমি আবারও হাসলাম।

- হিমু - হু.... - তুমি কি জান আগামী পরশু আমার বিয়ে। হিমুদের কখনো হকচকিয়ে যেতে হয় না। হিমুরা থাকবে সব বিষয়ে উদাসীন। তবুও আমি ধাক্কার মতো খেলাম। - আমি জানি না রূপা।

রূপার চোখে সন্ধ্যার বিষন্নতা ভর করে। সেই বিষন্নতা আমাকেও ছুঁয়ে যায়। রূপা হাসার চেষ্টা করল। হাসিটা ঠিকভাবে ফুটল না। কষ্টের হাসি ঠিকভাবে ফোটে না।

রূপা বলল,'তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করতাম?' - করতাম বলছ কেন? এখন আর করো না? - না। 'না' বলার সময় রূপার গলাটা কেঁপে গেল। প্রকৃতি এই ব্যবস্থাটা করেছে যেন কেউ মিথ্যা বললে অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝে যায়। আমি হিমু। বাবার মহাপুরুষ হবার ট্রেনিং-এর চোটে আবেগ-টাবেগ পালিয়েছে বলেই ধারনা ছিল আমার।

সেই ধারনা ভুল প্রমান করতেই যেন গলার নিচে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠতে চাচ্ছে। চোখের আদ্রতাও বাড়ছে টের পাচ্ছি। লক্ষন সুবিধার না। আর অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় কার যেন ছায়া পড়েছে।

আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম বাবা। বাবার মুখ অসম্ভব করুন। রূপার কথায় বাস্তবে ফিরি,'হিমু, তুমি কি আমার হাতটা একটু ধরবে?' রূপা আমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল। আমার পাগল বাবা আমাকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। ঠিক অন্যরা যেমন চায় তার ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক।

এজন্য বাবাকে অনেকটা পথ চলতে হয়েছে। রূপার বাড়িয়ে দেওয়া হাত যদি ধরি তবে আমার পক্ষে ওই হাত আর ছেড়ে দেয়া সম্ভব না। ভালবাসার শক্তি অন্যরকম। - রূপা, চা শেষ। আমি উঠব।

আর ভাল থেকো। - এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পার। রূপা আবারো হাসার চেষ্টা করল। আমি রূপাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। রূপা বারান্দার দাঁড়িয়ে আমার প্রস্থান দেখছে।

না তাকিয়েও বুঝতে পারছি রূপার চোখে জল। বিকেলের আলো তাড়াহুড়ো করে বিদায় নেওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। কোন এক তরুনীর চোখের জল সেই আয়োজনে বিঘ্ন ঘটাতে পারছে না। আমার এক চোখ ঝাপসা। ডান চোখ।

এটাও কি সর্দিজনিত সমস্যা কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একচোখ ভর্তি ভালবাসার উপহার নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। বারান্দার রূপা আর এগিয়ে যাওয়া আমার মধ্যখানে বাবা দাঁড়ানো। বাবার মুখ প্রসন্ন। ছেলের এসএসসির ভালো রেজাল্ট জেনে বাবার মুখ যেমন চাপা খুশিতে ভরে থাকে তেমন।

ইচ্ছে করছে পেছনে ফিরে তাকাতে। আর বাবাকে বলতে,'বাবা, আমার মহাপুরুষ হবার কোন ইচ্ছা আর নেই। রূপার হাত ধরে আমি বেশ সাধারনভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। ' কিন্তু পারলাম না। সবাই যা পারে হিমুরা তা পারে না।

পড়ন্ত বিকেলের অশুভ হাওয়া গায়ে মেখে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাই। মনে পড়ল ছবির সাপটা অজগর কিনা রূপাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।