আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশিরের ঘ্রান (১-৪)

স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান শিশিরের ঘ্রান কিঙ্কর আহ্সান ১. আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরটার একপাশের জলের রং কালো। গভীর কালো। দেখলে মনে হয় একতাল নিকষ,অসহ্য কালো আঁধারকে টুপ করে গিলে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে পুকুরটার এ অংশ।

কালো হওয়ার পেছনের কারন হলো পাড় ধরে দাড়ানো দৈত্যাকার সব নারকোল আর সুপুড়ি গাছ। তাদের পাতার ভীড় ঠেলে সূর্য এসে ঠাই নেবে এমনটি হবার জো নেই। আলো না আসার কারনে জলও খুব শীতল। গরমকালেও হাত ভেজানো মুশকিল হয়ে পড়ে কখনও কখনও। যদিও এ পাশে কেউই আসেনা তেমন একটা।

পুকুরের এ পাশটাতেই আমাদের পারিবারিক কবরস্থান। কোন আক্কেলে আমার দাদাজান কবরস্থানের পাশে পুকুর কাটলো কে জানে! দাদা,দাদি,চাচা,ফুপু প্রায় সবাই এসে ঠাঁই নিয়েছে এ কবরস্থানে। গ্রামের সবাই ভয় পায় তাদের। কবরস্থানের নাকি বিশ্বাস নাই। রাত বিরাতে যে কোন অলৌলিক ঘটনাই ঘটতে পারে।

পুকুরের এ পাশে সাপখোপের আড্ডাও বেশি। কিছুদিন আগে পুকুরের সবচেয়ে কাছের কবরটা ভেঙে গিয়েছিল। বড় চাচার কবর। কাদা আর জলে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে গিয়েছিল কবরটার। বাবা কবর বাধাই করতে গিয়ে তখন দেখেছিল এক অপরকে পেচিয়ে ধরে গোটা দশেক লিকলিকে সাপ আস্তানা গেড়েছে কবরের ভেতর।

সে এক দেখার মতন দৃশ্য। লাঠি দিয়ে খোঁচা মারলে পিচ্ছিল দেহগুলো নিয়ে তারা আরো বেশি জড়িয়ে ধরে একজন আরেকজনকে। সাপের মতন এ পুকুরটা মাছেরও আড্ডাখানা। কবরের পাশে ঠায় দাড়িয়ে থাকা পুকুরটায় বাড়ির কেউ মাছ ধরতে নামেনা। তাই মাছেরা বাড়ছে,বড় হচ্ছে নিজেদের ইচ্ছেমতন।

দিনভর ঘাই দেয় তারা। বয়স্ক,বেঢপ কিছু মাছ প্রায়ই চলে আসে পাড়ের কাছাকাছি। ভাঙা ঘাটের পাশে দাড়িয়ে তখন তাদের মেটে রংয়ের লোভনীয় শরীর দেখা যায়। বছরের পর বছর শ্যাওলা জমে শরীর সবুজাভ হয়ে উঠেছে যেন সবার। পুকুরটা ভর্তি হয়ে আসে পাড় ধরে লাগানো গাছগুলোর ঝরে পড়া পাতায়।

পাতাগুলো নৈাকার মত বাতাসের টানে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় শুধু। মাঝে মাঝে দু একটা পাতার আড়াল হতে উকি দেয় জলসাপ। তার মুখে থাকে সদ্য শিকার করা হতভাগা কোন ব্যাঙ। সাপের মুখে থাকা অবস্থায়ও ব্যাঙের বুক হাপরের মত ওঠানামা করে। এত আলো বাতাসের ভেতরেও তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

আকাশের দিকে পাগুলো মেলে প্রানীটির বেঁচে থাকার করুন আকুতি দেখতে ভালো লাগে বেশ। সাপ মুখ একটু দেখিয়েই ডুব দিয়ে চলে যায় আবার কই না কই। লুকোচুরি খেলায় পাল¬া দিয়ে পারাই যায়না এদের সাথে। এমন সাপে মানুষ মারা যায়না। তাদের বিষের জোর তেমন একটা বেশি না।

আমার ছোট বোন পুতুলও তেমনটাই জানত। অল্প বিষের এ সাপগুলোকে থোড়াই কেয়ার করে প্রায়ই চলে যেত কবরস্থানে। বেয়ারা মেয়েটার সুপুরি খাওয়ার নেশা। লোভ সামলাতে না পেরে, ভয় ভুলে সুপুরি গাছ থেকে জোগাড় করত কাঁচা,পাকা সুপুড়ি। কখনও গাছের নিচে পড়ে থাকা সুপুড়ির খোল নিয়ে এসে তাতে চড়ে বসে আমাকে বলত,‘ভাইজান সামনের দিকটা ধইরা টানেনতো।

এইডা আমার গাড়ি আর আপনে আমার ড্রাইবার। ’ তারপর হাসত। হাসতে হাসতে চোখে জল চলে আসত তার। আমার দু চারটে কিল তার পিঠে পড়লেও থামত না। হাসতেও পারে মেয়েটা! জানিনা মৃত্যুর আগে হেসেছিল কিনা।

গতকাল সন্ধ্যের দিকে মারা গেছে পুতুল। অল্প বিষের সাপগুলোর ভীড়ে কোন এক বিষধর সাপ দংশন করেছে তাকে। বিষের যন্ত্রনা নিয়ে কতক্ষন টিকতে পেরেছিল মেয়েটা জানা নেই। পুতুলের লাশ প্রথম দেখতে পায় বাড়ির রাজহাসগুলো। সন্ধ্যে হলেই ঠিক ঠিক বাড়ি ফিরে আসে তারা।

ঢুকে যায় যার যার খোপে(গৃহস্থের হাস,মুরগী রাখার ছোট্ট কাঠের ঘর। )। সেদিন বড্ড দেরি করছিল হাসগুলো। চৈাপর দিন পুকুরে সাতার কেটে,শামুক খেয়েও রাজহাসগুলোর এমন দেরি দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল মা। পুতুলকে নিয়ে আমরা একবারও ভাবিনি।

সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি না ফিরলেও এমন বেয়ারা মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করতে হয়না। আমি আর মা দুই ব্যাটারির টর্চ নিয়ে হাস খুজতে গিয়ে শুনি রাজহাসগুলোর ডাকাডাকি। সব মিলে একসাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে তারা। কাছে গিয়ে দেখা যায় পুতুলের নিথর শরীরটা ঘিরে ধরে আছে হাসগুলো। কেউ কেউ ছোট ছোট কাঁদা মাখা ভেজা পা নিয়ে উঠে পড়েছে শরীরের ওপর।

পুতুল মনে হয় সাপের দংশনের সময়ও হেসেছিল। মৃত পুতুলের মুখের এক কোনায় ফুটে থাকা বড় সজীব আর প্রানবন্ত হাসি হাসি মুখ দেখে তাই’ই মনে হচ্ছিল। বিষের প্রচন্ড যন্ত্রনায়ও সে চোখ বন্ধ করেনি। আমি আর মা দেখেছি অসীম আকাশের দিকে তাক করা তার অদ্ভুত সুন্দর,নিস্পলক চাহন্টিা। এরপর ঘরের একমাত্র জোয়ান ছেলে হিসেবে অনেক ধকল গিয়েছে আমার ওপর।

বাড়িজুড়ে লোকজনের কান্নায় কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। মা থেকে থেকে একটু পর পর জ্ঞান হারাচ্ছিল। জ্ঞান ফিরলেই,‘পুতুলরে-পাগলী মা আমার-কই গেলি...। ’ বিলাপ করে সে’কি কান্না তার। বাবা হুজুরকে খবর দিয়েছে।

সারারাত লাশের পাশে বসে কোরান শরীফ পরেছে লোকটা। আতর আর ধূপদানির গন্ধে ভরে গিয়েছিল পুরো বাড়ি। হাটে গিয়ে বরফ নিয়ে এসেছি আমি। পুতুলের শরীর যাতে পঁচে না যায় সেজন্যে বরফের দরকার ছিলো খুব। চা পাতাও নিয়ে আসা হয়েছে পনের-ষোল কেজি।

বরফের চেয়ে চা পাতাই নাকি পঁচন ঠেকানোর জন্যে ভালো। কাফনের কাপড় কিনতে হয়েছে,লাশ কারা গোসল করাবে সেসব ঠিক করতে হয়েছে,গ্রামে মাইকিং করে মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে,পারিবারিক কবরস্থানে কার পাশে পুতুলের জন্যে কবর খোড়া হবে সে জায়গা বাছাই করতে হয়েছে,কাজের কোন শেষ নেই। হাজারো ঝক্কি ঝামেলায় সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সকালেও বিশ্রামের ফুরসত নেই। যেসব আত্মীয়কে খবর দেওয়া হয়েছিল রাতে তারা একে একে ভীড় করল সবাই বাড়িতে।

তাদের সবাইকে ঘটনার বর্ননা দিয়েছি। পুকুরের বর্ননা,ভাঙা ঘাটের বর্ননা,কি সাপ হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে তার বর্ননা,মারা যাওয়ার সময় পুতুল কাত হয়ে পড়েছিল না লম্বা হয়ে আকাশের দিকে চিৎ হয়ে শুয়েছিল তার বর্ননা-এমন সব হাজারো বর্ননায় তাদের মনোরঞ্জন করেছি আমি। তাদের সাথে মা আরেক দফা কান্নাকাটি করেছে। সকাল গড়িয়ে যখন দুপুর হল তখন সবকিছু শান্ত হয়েছে একটু একটু। হুজুর কিসের জন্যে লাশ দাফনে এত দেরি করছিল বোঝা যাচ্ছিলনা।

এত হৈ হুলে¬াড়ের ভেতরে কে যেন উঠোনে ছেড়ে দিয়েছিল রাজহাসগুলোকে। তারা ঘুরছিল এলোমেলোভাবে। আজ কারও সাতার কাটায় মন নেই। ভাঙ্গা ঘাটটার পাশে বসে একটু জিরিয়ে নিতে নিতে বোনকে ভুলে স্বার্থপরের মতন এলোমেলো আকাশ পাতাল ভাবনা ভাবছিলাম আমি। হঠাৎ কে যেন এসে বলল বাবা ডাকছে আমাকে।

বাবাকে পেলাম তার ঘরেই। চোখ দেখলেই বোঝা যায় সবার আড়ালে লোকটা কেঁদেছে সারারাত। কান্নাকাটি অসহ্য লাগে আমার। এক জীবনে অনেক কেঁদেছি,আর না। বাবার পাশে গিয়ে বসলাম আমি।

ধূপ আর আতরের গন্ধটা ভালোমতোই ছড়িয়েছে বাড়িময়। কেমন যেন ঘোর লাগানো ঘ্রান। বাবা পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে দাদাজানের মক্কা থেকে আনা আতরের শিশিটা বের করে আঙুলের তেলোয় মাখিয়ে একটুখানি আতর লাগিয়ে দিলেন আমার শরীরে। তার এমন পাগলামী দেখে অবাক হলাম না। পুতুলের শোকে ভালোমতোই কাবু হয়েছে সে।

আতর লাগানোর পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,‘বাবারে তোর বড় ভাইরে না জানানোডা কি ঠিক হইল? ছোড বইন তার। কবর দেওনের আগে বইনের মুখডা একবার দেখ্বার ইচ্ছাতো তার হইবার পারে। পুতুল বড় আদরের ছিলো তার। বড় আদরের বইন। একবার জানা তারে খবরডা।

নাইবা আইলো তা’ও জানা। একবার। ’ এই প্রথম আমি কাঁদলাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে পাগলের মতন কাঁদলাম। বাবাকে জড়িয়ে পুত্রের এ কান্নার কতটুকু পুতুলের জন্যে আর কতটুকু বড় ভাইজানের জন্যে তা জানা নেই।

সত্যিই আমার জানা নেই। ২. জুমআর নামাজের পর মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে মসজিদে। পুতুলের জানাযার নামায শেষে মাইকে সবাইকে আজকের দিনটিতে মিলাদে আসার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছিল। বেলকুচি গ্রামের একমাত্র মসজিদ ‘বায়তুল আমান’। অনেক দূরের গ্রাম থেকেও নামাজ পড়তে এ মসজিদে জড়ো হয় লোকজন।

তবারকের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে আজ। গরম গরম আমৃত্তি আনা হয়েছে কালিশুরির বাজার থেকে। সাথে আরও রয়েছে নিমকি আর দানাদার। ভালো খাবারের খোজ লোকজন পেয়েছে আগেই। আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ তাই এসে করেছে ভীড়।

মসজিদের ভেতর বসার জায়গা হয়নি সবার। বাইরে মাঠের ওপর হোগলা,মাদুর আর বিছানার চাদর বিছিয়ে করা হয়েছে বসার ব্যবস্থা। মানুষ মরলে এইসব লোকগুলোর সোনায় সোহাগা। চল্লিশা,মিলাদ সবকিছু মিলিয়ে পেটপুজোর কাজটা একদম মন্দ হয়না তাদের। নামাযে বাবা আজ ইমামতি করছেন।

মসজিদের হুজুর অসুস্থ থাকলে প্রায়ই ইমামতি করেন তিনি। এ কাজ তার বড়ই প্রিয়। শৈশবে কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন মাদ্রাসায়। কন্ঠ ভালো। শুনেছি আযান দিয়ে নানান প্রতিযোগীতায় কয়েকবার পুরস্কারও পেয়েছেন।

হুযুর সুস্থ থাকলেও ইমামতির কাজটা আজ তিনিই করছেন। থেকে থেকে মোনাযাতে কেঁদে উঠছেন পুতুলের জন্যে। মোনাযাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে। খাবার তদারকির ভার পড়েছে আমার ওপর।

সারাদিন আমৃত্তি নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি। শরীরে,কাপড়ে লেগে আছে মিষ্টি রস। দু-একটা পিপড়াও ঢুকেছে কাপড়ের ভেতর। জায়গায় বেজায়গায় কামড়াচ্ছে তারা কুটকুট করে। মোনাযাত শেষ হতেই তবারকের জন্যে হামলে পড়ল লোকজন।

গ্রামের ছয় সাতটা যুবক ছেলে করছে খাবার বিলিবন্টনের কাজ। এত মানুষ সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে তারা। এতসব হুড়োহুড়ির ভেতর বড় ভাইজানকে প্রথম দেখতে পায় পশ্চিম পাড়ার সুলতান মাঝির ছেলে আইয়ুব। সবার হাতে হাতে আমৃত্তি তুলে দেবার দায়িত্ব ছিলো ছেলেটার। হাসি হাসি,ক্ষুধার্ত মুখ নিয়ে আমৃতির জন্যে হাত পাতা মানুষগুলোর ভীড় হতে জল ভরা চোখে আমৃত্তির জন্যে দাড়ানো একজনকে আলাদা করে ঠাওর করাটা আইয়ুবের জন্যে কঠিন হয়নি।

ভাইজানকে দেখতেই তাকে জড়িয়ে ধরে ‘ভাইজান। ভাইজান আইছে গো। আইছে...। ’ বলে চিৎকার করতে থাকে সে। ততক্ষনে আমিও দৈাড়ে এসে জাপটে ধরি ভাইজানকে।

কতদিনের পুরনো ভালোবাসার ভাইজানটা আমার! কতদিন, কতদিন পর ভাইজানকে কাছে পেলাম। ভাইজানের খবর শুনে দৈাড়ে আসে মুরুব্বিরা। বাবা এসে দাড়ায় ভাইজানের সামনে। ভাইজানের চোখভর্তি তখনও জল। পুতুলের জন্যে কি কাঁদছেন? তাকে তো বেশিদিন কাছে পায়নি সে।

তাহলে কেন এই মায়া! কেন এই কান্না! ভাইজানের মায়া বরাবরই একটু বেশি। তবে আজ তিনি কেন সবাইকে না জানিয়ে অগোচরে এখানে এসে আবার চলে যাবার চেষ্টা করলেন তার কারন বোঝা গেলনা। মা,বাবা তাকে অনেক আগেই ক্ষমা করেছেন। আমারও নেই ভাইজানের ওপর কোন রাগ। এমন ভালো মানুষের ওপর রাগ করা যায়না।

যতই খারাপ কাজ করুক না কেন একদমই রাগ করা যায়না। ‘কাঁদিস না। চল, বাড়ি চল। ’ বাবা এগিয়ে এসে ভাইজানের কাঁধে হাত রেখে বলল কথাগুলো। বড় শান্ত,ধীরস্থির এই মুহূর্তে সে।

‘যাও বাবা। বাড়ি যাও। মাইনষের জীবনে ভুল হইবারই পারে। ’ বাবার কথার পর মুরুব্বিদের ভেতর থেকে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল কেউ একজন। কারো সাথে কথা না বলে বাড়ির দিকে হাটা শুরু করল ভাইজান আচমকা।

কোনদিকেই খেয়াল নেই যেন এখন। তার পেছনে রাজ্যির মানুষ। তাদের হাত ভর্তি আমৃত্তি। তবে এ মূহুর্তে দারুন সুস্বাদু এই খাবারটির কথা ভুলে গিয়েছে অথবা এড়িয়ে যাচ্ছে সবাই। কালিশুরি বাজারে গিয়ে পয়সার বিনিময়ে এমন ঢের আমৃত্তি খাবার সুযোগ পাবে তারা কিন্তু এমন নাটকতো আর দেখতে পাবেনা সচরাচর।

তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভাইয়ার পেছনে হাটতে হাটতেই আমার মনে পড়লো নিশা আপার কথা। পুতুলকে দাফন করার দিনে জামাইকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। জামাই চলে গেলেও মায়ের সাথে কয়েকটাদিন কাটানোর জন্যে বাড়িতেই থেকে গিয়েছেন। মাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন।

সাহায্য করছেন রান্নাবান্নায়। ভাইজানকে দেখে নিশা আপার কি অবস্থা হয় কে জানে। ভয় লাগছে আমার। খুব ভয়। আবার না অঘটন ঘটে যায় একটা! আমি জানতাম ভাইজান আসবেন।

আসবেনই। সেই ছোটবেলা থেকে ভাইজান আর নিশা আপার সাথেই কেটেছে আমার বেশিরভাগ সময়। আমরা তিনজন ছিলাম বন্ধুর মতন। আমি ছোট হলেও তিনজনের মাঝে ছিলাম সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। নিশা আপার মা মারা যাবার পরই তিনি আমাদের বাড়িতে এসে থাকা শুরু করেন।

আমার এখনও মনে আছে একদিন দুপুরের দিকে তার বাবা তাকে মারতে মারতে আমাদের বাড়ির উঠোনে এনে ফেলে বলেছিল,‘ এই নাও। তোমগো মাইয়া তোমরা পালো। এই বজ্জাত মাইয়া নিয়া বসবাস করা আমার পক্ষে সম্ভব না। ’ নিশা আপা কান্না ছেড়ে তখন হাসা শুরু করেছে। পাগলের মতন হাসি।

তখনই বুঝেছিলাম আমার খালাতো বোন এই মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে। কঠিন সমস্যা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই অবস্থায় সে মাকে বলে,‘খালা ভাত দেও। ক্ষিধা লাগছে। দুধ আর গুড় দিয়া ভাত খাইতে ইচ্ছা করে।

’ আমি সেই মুহুর্তেই চিকন চাকন শ্যমলা দেখতে পঁচা চেহারার পাগলী নিশা আপাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। শুধু আমিই না। আমরা দুই ভাই। আমি বুদ্ধিমান বলে আমার ভালোবাসার কথাটা নিশা আপা কোনদিনই জানতে পারেনি। তবে ভাইজানেরটা বুঝতে পেরেছিল।

সেদিনই। তাইতো ভাত খাবার জন্যে মাযের সাথে বাড়ির ভেতরে যাবার সময় ভাইয়াকে ধমক দিয়ে বলছিলো,‘ঐ ছেড়া,এ্যামনে ড্যাবড্যাব কইরা দেকবিনা আমারে। চোখ গাইলা দিমু। আর খবরদার প্রেমে পইড়বিনা। একদম না।

’ ভাইজান নিশা আপার কথা শুনে ভয় পেয়েছিল। তবে সেই ভয়ের সাথে ছিলো ভালোবাসা। অনেক অনেক ভালোবাসা। নিশা আপাকে এই মুহূর্তে লুকিয়ে ফেলার কোনো উপায় নেই। তারপরও কিছু একটা করতে হবে।

কিছু একটা। আমি দ্রুত পা চালালাম। অন্য পথ ধরে ভাইজানের আগেই পৈাছাতে হবে বাড়ি। ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে,কাচাঁ ধানক্ষেত পেরিয়ে ছুটলাম আমি। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল।

অনেকদিন পর ভাইজান এসেছে বাড়িতে। নিশা আপার জন্যে তাকে আর হারাতে চাইনা আমি। শেষ রক্ষা হলোনা। বাড়ির সামনে আসতেই চোখে পড়ল উঠোনের ভীড়। রান্না ঘর থেকে ছুটে এসেছে মা।

হাতে লেগে আছে কাঁচা হলুদ। রান্নাবান্না করেই কাটল এই মহিলার পুরো জীবন। তার সকল সুখ,দুঃখ গোপন কথা রান্নার ঘরটার সাথে। কোন তরকারীতে কি দিলে স্বাদ একটু বাড়বে বা কমবে এই নিয়ে গবেষনা করতে করেতেই চলে যায় তার দিনের বেশিরভাগ সময়। একটানা দৈাড়ের পর হাপাচ্ছি আমি।

ভীড় ঠেলে ভাইজানের পাশে গিয়ে দাড়াবো সে ইচ্ছে নেই একদম। পরিবারের এই আবেগঘন মুহূর্তে একটু দূরে থাকাই এখন নিরাপদ। মায়ের পাশে এসে দাড়িয়েছে নিশা আপা। বড় আবেগী এই মেয়ে। কি করে বসে এখন কে জানে! পুরো জনতা তাকিয়ে আছে নিশা আপার দিকে।

তার জীবনের গল্প এ এলাকার সবারই জানা। সবাই’ই চাচ্ছে কিছু একটা করুক নিশা আপা। নাটকীয় কিছু একটা। নইলে এতটা পথ হেটে আসা বিফলে যাবে সবার। নিশা আপা এগিয়ে এলেন ভাইয়ার দিকে।

পাশেই দাড়িয়ে আছেন মা। তারপর প্রচন্ড জোরে চড় মারা হল ভাইয়ার গালে। জ্ঞান হবার পর এই প্রথম এমন কান্ড দেখলাম। মা কখনও হাত তোলেন না ভাইজানের ওপর। এবারই প্রথম।

চড় মারার সাথে সাথেই ভাইজানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। সাথে তাল মেলানোর জন্যেই যেন ‘মা। ও মা। ’ বলে এতক্ষনে কাঁদা শুরু করলেন ভাইয়া। জনতার মন ভাঙল।

অন্য কিছু হয়ত আশা করছিল তারা। আফসোস করতে থাকা এই মানুষগুলোর মতনই এ নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র নিশা আপার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। এবার হয়ত তিনি কিছু একটা করবেন। কিন্তু নিশা আপা কিছুই করলেন না। কিছুই না।

শুধু মায়ের পাশে চুপটি করে দাড়িয়ে রইলেন। আপাতত হাফ ছেড়ে বাঁচা গেল। নিশা আপার ব্যবহারে অন্যরা অবাক হলেও অবাক হলামনা আমি। কারন নিশা আপা চুপ করে থাকার মেয়ে না। আজ না হলেও পরে কিছু না কিছু একটা করবেনই তিনি।

করবেনই। ৩. রোদ উঠেছে আজ। মিষ্টি রোদ। এমন মিষ্টি ওম ওম হলুদ রোদে ঘুম পায় খুব। গতকাল রাতে জেগেছিলাম অনেকক্ষন।

তাই এই দুপুরবেলা ঘুমুলে কেউ কিছু বলবেনা আমাকে। শুধু মা হয়ত একবার ঘরে এসে জানতে চাইবে শরীর খারাপ কিনা। জ্বর আছে কিনা দেখবার জন্যে হাত দেবে কপালে। দুপুরের দিকে ঘুমুতে পারিনা কখনও। যত রাতেই বিছানায় যাইনা কেন সূর্য ওঠার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে যায় ঠিক ঠিক।

তখন মাথায় ব্যাথা হয় খুব। তীব্র যন্ত্রনায় হুশ লোপ পাওয়ার মতন অবস্থা হয়। তবে আজ যন্ত্রনা হচ্ছেনা। ঘুম না হলেও শরীরটা ঝরঝরে লাগছে বেশ। সুতি কাপড়ের একটা জামা গায়ে চড়িয়ে বের হলাম বাইরে।

কমলেশের আসার কথা আজ। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। সেই ছোটবেলা থেকেই এই বন্ধুটি নিজেদের বাড়ির চেয়েও বেশি সময় কাটাতো আমাদের বাড়িতে। এখনও কাটায়। কিছুদিন হল বিয়ে করেছে কমলেশ।

তারপরও আমাদের বাড়ির মায়া কাটাতে পারেনি। এ নিয়ে অবশ্য ওর বউয়ের অনেক আফসোস। প্রতিদিন একবারের জন্য হলেও আমাদের বাড়িতে আসা চাই’ই চাই। সকালের দিকে রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের কাছে মুড়িভাজা,কাঁচা চাল কিংবা তরকারীর ঝোলে লুকিয়ে থাকা আলুর জন্যে হাত না পাতলে দিনটা নাকি মাটি হয়ে যায় গাড়লটার। শুধু কাঁচা চাল চিবোতে চিবোতেই পুরো একটা দিন পার করে দিতে পারে কমলেশ।

উঠোনে একটা মাদুর পেতে তার ওপর শুয়ে বই পড়ছে ভাইজান। নিজের ঘরটা ঘেটে পুরনো কোন গল্পের বই খুজে পেয়েছে হয়তো। গত এগার বছরে কাউকে ভাইয়ার ঘরে ঢুকতে দেয়নি মা। ঝাট দিয়ে,ধুয়েমুছে ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছে এতগুলো দিন। ভাইজানের পাশেই বসে আসে কমলেশটা।

এলোমেলো কথা বলে বিরক্ত করছে ভাইজানকে। ‘সকাল সকাল এসে ঘুম থেকে উঠালি না ক্যান গাঁধা? গতকাল না বললাম মাছ ধরতে যাবো। এত বেলায় ঘুম থেকে উঠে মাছ ধরতে যাওয়ায় লাভ আছে কোন? কোনদিনই কি ঠিকমত কাজ করতে শিখবিনা তুই?’ কমলেশের ঠিক অপরদিকে মাদুরের এক কোনায় বসে ধমক দিয়ে কথাগুলো বললাম আমি। বাড়ছে রোদের তেজ। চারপাশের ধুলোর রং কেমন সাদাটে পাউডারের মতন হয়ে আছে।

সেগুলো উড়ছে বাতাসে। ঝড় আসবে মনে হয়। আজকাল বড় হুটহাট করে ঝড় আসে! ‘কেলো করিসনাতো। এমনেই মন মেজাজ ভালো নাই। সবসময় ঝগড়া করতে ইচ্ছা করেনা।

’ একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে জবাব দিলো কমলেশ। ‘কেলো করলাম কই! শুধু প্রশ্ন করলাম কয়েকটা। জবাব দিতে ইচ্ছা না হইলে দিবিনা। বিয়ের পর সবসময় মন মেজাজ খারাপ থাকে তোর। কাহিনী কি?’ ‘ধুর, বউডা খালি ঘ্যানর ঘ্যানর করে।

খালি এক কথা,‘সংসারে মন দেও। সংসারে মন দেও। ’ আরে বাপ্, বিয়া কইরা মনতো দিছি বউরে। এক মন আমি কয়জনারে দিমু। ’ ভাববার মতন একটি বিষয়! হাসি চেপে চুপ হয়ে গেলাম আমি।

তাছাড়া কমলেশের দুঃখে সবসময় হাসি এমন অপবাদটা চাঁপা দেবার জোর চেষ্টা করছি ইদানীং। আমি না হাসলেও ভাইজানটা ফিক করে হেসে দিল। কিছুক্ষন পর সেই হাসিতে তাল মেলালাম আমি আর কমলেশ। ‘আমাদের ছোট্ট কমলেশটা বিয়া করছে এইটাই তো বিশ্বাস হয়না আমার। বোঝা যায় মন নিয়া তার জানাশোনা ভালো।

আজব মন!’ হাসতে হাসতে বলল ভাইজান। ‘বউ আমার মেয়ে ভালো ভাইজান। গায়ের রং আপেলের মতন। ’ বেশরমের মতন নিজের বউয়ের প্রশংসাটা করল কমলেশ। ‘ঘটনা মিথ্যা না।

মেয়ে আসলেই ভালো। সংসারের দিকে মন খুব। সংসারী মেয়ে। ’ সুযোগ পেয়ে ভাইজানের কাছে বন্ধুর বউয়ের প্রশংসা করে নিলাম আমিও একটু। বউকে নিয়ে ভালো কিছু বললে কমলেশ খুশি হয়।

সামনের কয়েকটা দিন কমলেশকে খাটাতে হবে অনেক। এই মুহূর্তে তাই ওকে খুশি রাখা দরকার। ‘সামনে পুজা। পুজা পর্যন্ত থাকতে হইবো কিন্তু ভাইজান। আপনের চাঁদা ধরছি।

হুনছি আপনার এখন অনেক পয়সা। ’ ‘দেবো, চাঁদা দেবো। ’ কমলেশকে কথাটা বলেই একটু চুপ হয়ে গেল ভাইজান। পুজা পর্যন্ত থাকবেন কিনা সে বিষয়ে কিছু বললেন না। ‘ভাইজান চলেন মাছ ধরতে যাই।

পশ্চিম পাড়ার পুকুরটায় ভালো মাছ আছে বলে শুনেছি। ’ মাদুর থেকে উঠে দাড়িয়ে বললাম আমি। ‘হুম। আমারে খুশি করার চেষ্টা। ভালো।

খুব ভালো। চল যাই। মাছ ধরিনা আজ এগার বছর। বড়শি টরশি কই?’ ‘আনছি ভাইজান। আনছি।

’ কথাটা বলেই দৈাড়ে আমার ঘরের খাটের নিচ থেকে তিনটে ছিপ নিয়ে হাজির হল কমলেশ। ঘুমের ভেতর কখন যে এসে আজ এগুলো আমার ঘরে রেখেছে কে জানে। শালা চুরিচামারি করলে জীবনে শাইন করতে পারতো। এমন ঘরের ভেতর শব্দ না করে বিড়ালের মতন হাটাচলা করাটা চোরদের জন্যে বহু আকাঙ্খিত এক বিদ্যার নাম। মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে পশ্চিম পাড়ার পুকুরটার দিকে হাটা শুরু করলাম তিন জন।

এগার বছর পর আবার একসাথে। আমার খুশি হবার কথা। কিন্তু ভালো লাগছেনা। বুঝলাম, বোকা-সোকা ভাইজানটা এখন যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আমি তাকে খুশি করবার জন্যে মাছ ধরবার আয়োজন করেছি এটা আগে হলে এত সহজে বুঝতেননা তিনি।

যাওয়ার আগে মা তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বললেন। হাসের মাংসের ঝোল দিয়ে চালের রুটি খেতে পছন্দ করেন ভাইজান। নিশা আপা আর মা সকাল থেকেই মাংস রান্নায় ব্যস্ত। আপাতো টুক টুক করে শখানেকের মতন রুটি বানিয়ে ফেলেছেন এর মধ্যে! সবাই আনন্দে আছে। ভালো আছে।

পুতুলের মৃত্যুর দুঃখ যেন মুছে যেতে বসেছে ধীরে ধীরে। হায়রে জীবন! যে যত ভুলতে পারে সে তত সুখে থাকে। দুঃখ ভোলার সুখ। পুকুর ঘাটে তেমন একটা লোকজন নেই এখন। নিরিবিলি দেখে একটা জায়গায় মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লাম আমি আর ভাইজান।

কমলেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেঁচো খোজার কাজে। ছোট্ট কোদাল দিয়ে মাটি খোড়া শুরু করল। অল্পক্ষনের ভেতরেই জোগাড় করে ফেলল নাদুসনুদুস, জঘন্য দেখটে ছয় সাতটা ঁেকচো। তারপর সেই কেঁচো গাথতে লাগল বড়শিতে। সাথে করে বাটিতে সামান্য ভাত’ও নিয়ে আসা হয়েছে।

পুটি মাছ ধরার জন্যে ভাত খুব ভালো টোপ হিসেবে কাজ করে। একটু পর পর জলেতে ঘাই দিচ্ছে মাছগুলো। শোল মাছগুলো এই কাজে বেশি পারদর্শী। পেটে ডিম আসলেই নাকি ঘাই দেয়ার দিকে মনযোগ বেড়ে যায় তাদের। স্বভাবে ধূর্ত হলেও পেটে ডিম থাকলে কেন জানি সহজেই ধরা পড়ে যায় মাছগুলো।

মাছ সম্পর্কে আমার ধারনা কম। অল্প কিছু যা জানি সব কমলেশের কাছ থেকে শেখা। পশ্চিম পাড়ার এ পুকুরটায় মাছশিকারীদের ভীড় হয় খুব। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘোষনা দিয়ে মাছ ধরা হয়। আশেপাশের কয়েক গ্রামের শিকারীরা জড়ো হয় মাছ ধরার জন্যে।

‘ছুটোবেলায় ঘন্টার পর ঘন্টা ছিপ নিয়া বইসা থাকতাম এই পুকুরপাড়ে, মনে আছে?’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল ভাইজান। দু হাত দিয়ে ছিপ ধরে বসে আছে সে। ‘আছে। থাকবো না ক্যান। ’ ‘আমাগো চাইরজনের মাঝে সবচেয়ে বেশি মাছ ধরত তোদের নিশা আপা।

আর তাই দেইখে রাগ হত খুব। ’ ‘তোমার রাগ হতনা ভাইজান। তুমি মাছ ধরায় ছিলা সবচাইতে ভালো। নিশা আপা কষ্ট পাবে এই জন্যে সবসময় তার চাইতে কম মাছ ধরতা। জিতাইয়া দিতা নিশা আপারে।

’ কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেলাম আমি। বুঝলাম এ কথাগুলো এই মুহূর্তে বলাটা ঠিক হয়নি। কষ্ট পেয়েছে ভাইজান। মুখ দেখে বোঝা যায়। নিজের ওপর খুব একটা নিয়ন্ত্রন নেই আমার আজকাল।

আবেগ সামলানো কষ্টকর হয়ে যায় প্রায়ই। কমলেশটা চুপ করে আছে। কিছু একটা বলতে যেতেই ওকে ইশারা করলাম চুপ থাকার জন্য। আমাকে অবাক করে দিয়ে কমলেশ ইশারার মানেটা বুঝল। চুপ করে কোঁদাল দিয়ে মাটি খুড়ে কেঁচো ধরা শুরু করল আবার।

‘কেমন আছে নিশা?’ জলের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে প্রশ্নটা করল ভাইজান। দেখেই বোঝা যায় ভয়াবহ অপরাধবোধে ভুগছে সে। ‘আপাকেই জিজ্ঞেস কইরো। ’ ভাবলেশহীন ভাবে বললাম আমি। ‘তোরা সবাই আমার ওপর রেগে আছিস অনেক, তাইনা?’ এ প্রশ্নের জবাব দিলাম না।

দিতে ইচ্ছে করলনা। প্রশ্নটা শুনেই রাগ হল খুব। পুরো একটি পরিবারকে শেষ করে দিয়ে এতগুলো বছর পর এমন ফালতু প্রশ্ন করার কোন মানে হয়না। প্রশ্নটাকে বড় বেশি উপহাসের মতন মনে হয়। আমার জায়গায় আপাকে এই প্রশ্ন করা হলে হয়তো ভাইজানকে খুনই করে ফেলত! নিশা আপার মতিগতির ঠিক নাই।

ভাইজান চলে যাবার পর পরই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল সে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দেবার আগে আমাকে ডেকে বলেছিল,‘তোর ভাইজানরে ঘৃনা করি আমি। একটা মানুষরে যত ঘৃনা করা যায় তার সবটুকু, সবটুকু ঘৃনাই করি। সামনে যদি তারে এখন পাইতাম, চোখখান গাইলা দিতাম। সেই চোখ যেই চোখ দিয়া ড্যাবড্যাব কইরা দ্যাকত সে আমারে সারাদিন।

সারাদিন। ধুর তোর মতো ছুটো মানুষরে এইসব কি বলতাছি। যা, যা ফুট। ’ নিশা আপা সবসময়ই আমাকে তাড়িয়ে দিত। কাছে ঘেষতে দিতনা।

আমি ছোট ছিলাম এটাই আমার দোষ। ছোট হলেও আমি বড়দের মতন করে বুঝতাম। সব বুঝতাম। আপার এলোমেলো কঠিন কথাগুলো বুঝে তাকে আরও ভালোবাসতাম। ভাইজানের চেয়েও বেশি ভালোবাসি আমি নিশা আপাকে।

অনেক অনেক বেশি। কিন্তু আফসোস আপা এই ভালোবাসা বুঝল না! ছোট বলেই ছোট মানুষের ভালোবাসাটা বোঝার চেষ্টাও করলোনা। আমি তাই বড় হবার জন্যে অপেক্ষা করেছি। করছি। আমার সেই অপেক্ষার পালা ফুরোয়নি এখনও।

কখনও ফুরোবে বলেও মনে হয়না। ‘নিশার চোখে সবসময় কাজল থাকত। বলত নিজের মেয়ের চোখেও সবসময় কাজল মাখিয়ে রাখবে সে। একদম পাগল ছিল মেয়েটা। ’ আপনমনে কথাগুলো বলে হাসতে লাগল ভাইজান।

‘আপা এখন আর কাজল দেয়না ভাইজান। ’ ‘জানি সব দোষ আমার। পাপ আমার। সবাই দোষী ভাবে আমারে। কিন্তু কেউ কোনদিন আমার নিজের কষ্টের কথা জানতে চাইল না।

জিজ্ঞেস করলোনা ক্যান্ আমি এমন করছি। জানিস, তোদের নিশা আপাটা কাজল লাগাইত বলে আমার মেয়েটার চোখেও সবসময় কাজল দিয়া রাখতাম। মেয়েটা যেদিন মারা যায় অইদিনও চোখে কাজল ছিলো তার। কি যন্ত্রনাই না দেখ্ছিলাম কাজলমাখানো চোখে। জীবনের শেষ কয়টা দিন একবারের জন্যেও বাবার কোলে আসে নাই সে।

ভয় পাইত আমারে। অচেনা ছিলাম আমি। আমারে দেখলেই দিত ভয়ে চিৎকার। কি কষ্ট। কি কষ্ট।

বাপ হইলে বুঝা যায়। আমি বুঝছি। শোন এইসব কথা কাওরে বলবিনা তুই। নিশারে তো একদম’ই না। বুঝছস্?’ এতগুলো কথা বলে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল ভাইজান।

হাপিয়ে গেছে। আমি আড়চোখে ভাইজানের দিকে তাকালাম। দেখতে লাগলাম তাকে। এমন কষ্টের কথা বলার পরও চোখের কোথাও জমা হয়নি লোকটার এক টুকরো জল। কি জানি, জল হয়ত নেই এখন আর তার চোখে।

তবে ভাইজানের মেয়েটা কেমন ছিলো জানতে ইচ্ছে হলো তা আমার। নাক কেমন ছিলো, চোখ কেমন ছিলো, কেমন ছিলো গায়ের রং,কিভাবে কথা বলতো, আমার ভাইজানকে কিভাবে বাবা বলে ডাকত সব সব সব জানতে ইচ্ছে করলো হঠাৎ। কিন্তু জানা হলোনা। কমলেশের চিৎকারে আচমকা চাপা পড়ে গেল সব। ‘পাইছি রে মাছ,মাছ।

পাইছি। ’ বলে চিৎকার করে লাফাতে লাগল সে। চোখে পড়ল তার হাতে ধরা ছিপটির বড়শিতে গাথা মাগুর মাছটিকে। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে মাছটি। শেষ বিকেলে পুকুরের একদিকে হেলে পড়েছে সূর্যের আলো।

গাছের পাতায় পাতায় চলছে কেমন একটা মায়া মায়া রোদ আর ছায়ার লুকোচুরি খেলা। সামান্য রোদের তেজে পুকুরের জলের আয়নায় কাতরানো মাছটির শরীর দেখতে লাগলাম আমি। আমারও এই মাছটির মতন অবস্থা। অনেক অনেক ওপরে থাকা ক্ষমতাবান কেউ একজনের ছিপের বড়শিতে আটকা পড়ে গিয়েছি। আটকা পড়ে কাতরাচ্ছি ভয়ঙ্কর যন্ত্রনায়।

বড়শি থেকে ছোটার কোনো উপায় নেই। একমাত্র জীবননাশ হলেই মিলবে মুক্তি। তবে তার জন্যে করতে হবে অপেক্ষা। কঠিন যন্ত্রনাদায়ক অপেক্ষা। ৪. পুতুলের কবরের চারপাশে বাশের বেড়া দেওয়া হয়েছে আজ।

চারপাশটা করা হয়েছে পরিস্কার। কয়েকদিন আগে মেয়ের কবর জিয়ারত করতে এসে বাবার মনে হল তার ছোট্ট মেয়েটি এমন জায়গায় থাকতে ভয় পাবে। আগাছা,বুনো পোকামাকড়ে ভরা.দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে এমন একটি জায়গা তার ছোট্ট মেয়েটির পছন্দ হতে পারেনা। তাইতো জিয়ারত শেষে কান্নারত কন্ঠে তিনি আমাকে বললেন, ‘ বাবারে, লোকজনরে খবর পাঠাও। এই জায়গায় আমার মেয়ের থাকতে কষ্ট হয়।

যত তাড়াতাড়ি পারো কবর পরিস্কারের কাজ শুরু করো। ’ কান্না পুরুষ মানুষের সাথে যায়না। এসব মেয়েছেলের ব্যাপার। তারা যত কাঁদবে তাদের চোখ তত পরিস্কার হবে। সুন্দর হবে।

জলেতে গলে তাদের চোখের কাজলে যখন পুরো মুখ মাখামাখি হবে তখন প্রিয় পুরুষটির বুকে হাহাকার শুরু হবে। ভালোবাসা আর কাছে পাবার হাহাকার। কিন্তু বাবার কথাটা ভিন্ন। তিনি কাঁদলে মন ভালো হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় সাধু,সন্ন্যাসীর মতন দেখতে এই মানুষটির কাছে নিজের সব লুকোনো পাপের কথা বলতে।

একটু আশ্রয়ের জন্যে,মন খুলে নিজের কথাগুলো বলার জন্যে বাবা ছাড়া অন্য কারও কথা চিন্তাই করা যায়না। তবে লুকোনো পাপের কথা বাবাকে বলব এতটা বোকা আমি নই। মনের ভেতর যতই আকুলি বিকুলি হোকনা কেন বাবার কাছ থেকে সবসময়ই চেষ্টা করি দুরে থাকার। বাড়ির সদর দরজা লাগোয়া রেইনট্রি গাছটার নিচে বিছানার চাদর পাতা হয়েছে। ভরদুপুরেও ছায়া ছায়া শান্তির একটা পরশ চারপাশে।

গোটা সাতেক লোক খেতে বসেছে। কবর পরিস্কার করার মজুরি দেবার পরও মা সবার জন্যে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়া শেষে তার নাতনি আর পুতুলের জন্যে দোয়া হবে। নাতনির মৃত্যুর কথা শুনেছেন তিনি। ভাইজানের কথা না শুনে সবাইকে বলে দিয়েছি আমি।

মেয়ের মৃত্যর ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই বলেনি ভাইজান। তাকে এসব নিয়ে ঘাটাবে এমন সাহস নেই কারও। তবে মা বরাবরের মতন নিয়ম করে এক দুপুর কাঁদলেন। বিলাপে পুতুলের সাথে যোগ হল নাতনীর শোক। ‘ ওরে পুতুল, ওরে আমার নাম না জানা, চেহারা না দেখা কইলজার টুকরা নাতনী, তোগের আগে ক্যান গেলাম না আমি।

দয়াল ক্যান এত দুঃখ দিলো আমারে। মইরবার চাই আমি। মইরবার চাই। ’ এমন সব কথা বলে মা যখন কাঁদছিলো তখন আমার হাসি পাচ্ছিল খুব। মা পারেও! দুপুরের আয়োজনে রয়েছে আতপ চালের পোলাও আর ডিম ভূনা।

গরীব লোকগুলো অনেকদিন পর খাচ্ছে পেটপুরে। ডিমের ঝোলে ঝাল হয়েছে খুব। একটু পর পর লোকগুলোর পানি খাওয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে তা। যাদের সর্দি আছে তারা ঝালের কারনে শোস্ শোস্ শব্দ করে সর্দিটুকু টেনে নিচ্ছে নাকের একদম ভেতরে। একটু পরই আবার নাকের ডগায় ফিরে আসছে সে সর্দি।

গভীর সাদাটে হলুদ ছোট্ট বেলুনের মতন ঝুলে থাকছে নাকের সাথে। সিকনি ঝাড়ার সময় নেই কারও। এত ভালো খাওয়া দাওয়ার সময় এসব ছোটখাট জিনিষ নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। মাথা ঘামালে সৃষ্টিকর্তা নারাজ হন। খাওয়া শেষ হবার একটু পরেই পশ্চিম পাড়ার ছেলে আইযুব এসে জানাল নদীর পাড়ে ট্রলার এসে দাড়িয়ে আসে।

বাবা ব্যবসার কাজে কালিশুরি যাবেন। সেখানকার বাজারে দুটো দোকান আছে আমাদের। প্রতি মাসে একবার লাভ লোকসানের খবর নিতে বাবা যান সেখানে। ব্যবসা বানিজ্য আমি বুঝিনা। তাইতো সাথে করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই বাবাকে বললাম,‘ কমলেশরে নিয়া যান।

আমার কাজ আছে। জরুরী কাজ। ’ বাবা কমলেশকে নিয়ে যেতে রাজি হলেন না। বিধর্মীদের তিনি পছন্দ করেন না। তাছাড়া আমার মতো বেকারের কোন জরুরী কাজ থাকতে পারেনা।

তাই যেতেই হবে বাবার সাথে। অনেক দোনামোনা করেও পার পেলাম না। কমলেশের ওপর রাগ হলো খুব। বেচারার কোন দোষ নেই। তারপরও কিছুৃ একটা হলেই ওর ওপর রাগ হয় আমার।

কবরস্থান পরিস্কার করা হয়েছে আজ এ খবর পেয়েছে কমলেশ। সাপেতে তার দারুন ভয়। পরিস্কার করবার সময় পুরনো কবরগুলো থেকে লিকলিকিয়ে বের হয়েছে সাপ। একটিও মারা হয়নি। কবরস্থানের সাপ মারার নিয়ম নেই।

এতে ঘোরতর পাপ। সাপগুলো যে কোন সময় আমাদের বাড়িতে হানা দিতে পারে এমন ধারনা কমলেশের। সাপেতে কোন বিশ্বাস নেই তার। রীতিমতো ঘোষনা দিয়ে জানিয়েছে আগামী কয়েক সপ্তাহ এ বাড়িমুখো হবেনা সে। তবে ঘোষনায় লাভ নেই।

যতই যাই’ই হোকনা কেন এ বাড়িতে তাকে আসতেই হয়। না এসে থাকতেই পারেনা উজবুকটা। ট্রলার ছাড়তে দেরি করলনা আইয়ুব। সন্ধ্যের আগে আগেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে। আকাশের অবস্থা হুটহাট করে খারাপ হয় আজকাল।

তাছাড়া জলপথে এ এলাকায় ডাকাতির পরিমানটাও বেড়েছে খুব। রাত নামলেই তাই ভয়। ট্রলার স্টার্ট দিতেই আমার পাশে এসে বসলেন বাবা। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর কথা শুরু করলেন। ‘আছরের নামাযটা গিয়া পামু বইলাতো মনে হয়না।

কি কস তুই?’ ‘পাবেন। আর না পাইলে ট্রলারেই তো না।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।