বর্তমান পেরুর কোস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল একটি উপজাতি হিসাবে। এ অঞ্চলেই উপকথার প্রথম সাপা ইনকা মাংকো কাপাক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কোস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে মাংকো কাপাকের উত্তরসূরীদের অধীনে আন্দেস পর্বতমালার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসে এ রাজ্যটি বিস্তার লাভ করে। ১৪৪২ সালের মধ্যেই রাজা পাচকুতিকের অধীনে ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য দূরদুরান্তে বিস্তৃত করে; পাচকুতিক নামের অর্থই হচ্ছে: পৃথিবী কাঁপানো মানুষ। তিনিই ইনকা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের আগে দুই আমেরিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল।
ইনকা সাম্রাজ্য প্রে-কলাম্বিয়ান আমেরিকাতে বৃহত্তম সাম্রাজ্য ছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রাশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক কেন্দ্র ছিল কোস্কো শহর। পেরুর পাহাড়ি এলাকায় ১৩০০ শতকের দিকে ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়।
মাচু পিকচু (কেচুয়া: Machu Pikchu মাচু পিক্চু অর্থাৎ "পুরানো চূড়া") বা মাচু পিচু (স্পেনীয়: Machu Picchu মাচু পিচু) কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগের সময়কার একটি ইনকা শহর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ২৪০০ মিটার (৭,৮৭৫ ফিট)[১]। এটি পেরুর উরুবাম্বা উপত্যকার (Valle de Urubamba) ওপরে একটি পর্বতচূড়ায় অবস্থিত।
মাচু পিচুই সম্ভবতঃ ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শণ, যাকে প্রায়শঃ ইনকাদের হারানো শহর বলা হয়। এটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়, কিন্তু এর এক শ বছর পর ইনকা সভ্যতা যখন স্পেন দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। কয়েক শ বছর অজ্ঞাত থাকার পর ১৯১১ সালে হাইরাম বিঙাম (ইংরেজি: Hiram Bingham) নামে এক মার্কিন ঐতিহাসিক এটিকে আবার সমগ্র বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে মাচু পিচু পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণী দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। এটিকে ১৯৮১ সালে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে এটিকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
এটি বর্তমান বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়েরও একটি।
ইনকা সভ্যতার স্বর্ণযুগে ১৪৫০ সালের দিকে মাচু পিচু নির্মিত হয়। কিন্তু তার ১০০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। সম্ভবতঃ স্পেনীয় অভিযাত্রীদের আগমনের আগেই এই শহরের অধিকাংশ অধিবাসী গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। মাচু পিচুর সন্ধানকারী হাইরাম বিঙাম এবং আরও অনেকেরই মতে এই সুরক্ষিত শহরটি ইনকাদের ঐতিহ্যগত জন্মস্থান অথবা সূর্য কুমারীদের পবিত্র কেন্দ্র ছিল।
অন্য একটি মতবাদ অনুসারে মাচু পিচু একটি ইনকা লিয়াক্তা (কেচুয়া: llacta ল্য়াক্তা) বা এমন একটি উপনিবেশ যা বিজিত অঞ্চল সমূহের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রনে ব্যবহৃত হত। আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি একটি জেলখানা হিসাবে ভয়ংকর অপরাধীদের রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল।
এই দুর্গনগরীটি ইনকাদের রাজধানী কোস্কো (কেচুয়া: Qusqu ক্বোস্ক্বো, স্পেনীয়: Cuzco কুস্কো) থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) দূরে অবস্থিত। কিন্তু এর অবস্থান অজ্ঞাত থাকার কারণে অন্যান্য ইনকা নগরীর মত এই শহরটি কখনও স্পেনীয়দের দ্বারা আক্রান্ত এবং লুট হয় নি। কয়েক শ বছর জনমানবহীন থাকার ফলে শহরটি এক সময় ঘন জঙ্গলে ঢেকে যায় এবং তখন খুব কম লোকই এর অস্তিত্ব সম্বেন্ধে জানত।
পরবর্তীকালে ১৯১১ সালের ২৪শে জুলাই মার্কিন ঐতিহাসিক ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রভাষক হাইরাম বিঙাম শহরটিকে বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন। আগেই মাচু পিচুতে গিয়েছিলেন এমন কিছু স্থানীয় মানুষ তাঁকে সেখানে নিয়ে যান। সেখানে বিঙাম শহরটির পুরাতাত্ত্বিক নিরীক্ষা ও জরিপ করেন। তিনিই মাচু পিচুর নাম দেন ইনকাদের হারানো শহর। মাচু পিচুকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়[২]।
এ ঘোষণায় মাচু পিচুকে বর্ণনা করা হয়েছে ধ্রুপদী বাস্তুকলার নিদর্শন ও ইনকা সভ্যতার অনন্য স্বাক্ষর হিসেবে। ২০০৭ সালের ৭ই জুলাই New Open World Corporation কর্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় মাচু পিচু বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়ের একটি নির্বাচিত হয়।
মাচু পিচু ইনকাদের রাজধানী কোস্কো থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩৫০ মিটার (৭৭১০ ফিট) উচ্চতায় মাচু পিচু পবর্তের চূড়ায় অবস্থিত। এটি দক্ষিণ আমেরিকার একটি অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র এবং পেরুর সবচাইতে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান।
মাচু পিচুর বেশির ভাগ স্থাপনাই ইনকা বাস্তুকলার ঐতিহ্যবাহী নির্মাণ পদ্ধতিতে তৈরি।
স্থাপনাগুলোর দেয়াল পাথর নির্মিত এবং জোড়া দেবার জন্য কোনওরকম সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ বা চুন-সুরকির মিশ্রন এখানে ব্যবহার করা হয় নি। অ্যাশলার (ইংরেজি: ashlar অ্যাশ্লার্) নামক এই নিমার্ণ কৌশলে ইনকারা খুবই দক্ষ ছিল। এই পদ্ধতিতে পাথরের খণ্ড এমন নিখুঁত ভাবে কাটা হত যেন কোনওরকম সংযোগকারী মিশ্রণ ছাড়াই পাথরগুলো খাজে খাজে শক্তভাবে একটার ওপর আরেকটা বসে যায়। ইনকারা পাথরের এই নির্মাণ পদ্ধতিতে পৃথিবীর সেরাদের সেরা ছিল। তাদের নির্মিত পাথরের দেয়ালগুলোর জোড় এতই নিপুন যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও সেগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো যায় না।
ইনকারা কখনওই ব্যবহারিক কাজে চাকার ব্যবহার করে নি। তাই তারা কীভাবে এত সংখ্যক বিশাল আকৃতির পাথর খণ্ড এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে গেছে সেটা এক রহস্য; যদিও সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এই বিশার আকৃতির পাথর খণ্ডগুলো পাহাড়ের সমতল ঢাল দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলতে তারা শত শত শ্রমিক ব্যবহার করেছিল। এখনও কিছু কিছু পাথরের গায়ে হাতলের মতো গাঁট রয়েছে যা পাথরগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। পাথর খণ্ডগুলো জায়গামতো স্থাপনের পর ইনকারা হয়ত হাতলগুলোকে গুড়িয়ে সমান করে দিয়েছে।
শহরটিতে ১৪০ টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কিছু মন্দির, পবিত্র স্থান, উদ্যান এবং আবাসিক ভবনসমূহ (আবাসিক ভবনগুলো খড়ের ছাউনি দেয়া ছিল)।
মাচু পিচুতে রয়েছে ১০০টিরও বেশি সিড়ি যার মধ্যে কিছু কিছু একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরের খণ্ড কুদে তৈরি করা হয়েছে। এখানে আরও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ঝরনা, যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত এবং এসব মূলতঃ সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই সেচ ব্যবস্থা ব্যবহার করে একটি পবিত্র ঝরনা থেকে পানি প্রতিটি বাড়িতে সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
মাচু পিচুর ইনকা দেয়াল
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মাচু পিচুর শহর ব্যবস্থা তিনটি বড় বিভাগে বিভক্ত ছিল, এগুলো হল:
1. পবিত্র এলাকা
2. জনসাধারণের এলাকা; এ দুটি শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। এবং
3. পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেনীর এলাকা।
পবিত্র এলাকায় মাচু পিচুর প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদগুলো অবস্থিত, যেমন: ইন্তিউয়াতানা পাথর, সূর্য মন্দির এবং তিন জানালা ঘর। এসব স্থাপনা উৎসর্গ করা হয়েছিল ইন্তি, তাদের সূর্য দেবতা এবং মহান দেবতার প্রতি। জনসাধারণের এলাকার সাধারণ নিম্ন শ্রেনীর লোকজন বাসবাস করত। এই এলাকার স্থাপনা গুলোর মধ্যে রয়েছে গুদামঘর এবং বসত বাড়ি।
অভিজাত এলাকায় সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর থাকার জন্য একটি অংশ ছিল।
এ অংশের বাড়িগুলো একটি ঢালের ওপর কয়েক সারিতে অবস্থিত। হামাউতা বা বিচক্ষণ ব্যক্তিদের (কেচুয়া: Hamawt'a) বাড়িগুলোর দেয়াল কিছুটা লালচে রঙের। অন্যদিকে নিউস্তা বা রাজকুমারীদের (কেচুয়া: Ñusta ন্যুস্তা) অংশের ঘরগুলো অসম আয়তাকার। স্মৃতিসৌধ একটি খোদাইকৃত ভাস্কর্য যার ভেতর একটি নকশাকৃত কক্ষ রয়েছে। এটি যজ্ঞ এবং উৎসর্গের কাজে ব্যবহার করা হত।
সড়ক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে ইনকারা মাচু পিচু পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করেছিল। বর্তমানে হাজার হাজার পর্যটক ইনকাদের পথে পায়ে হেঁটে মাচু পিচু ভ্রমণ করে। তবে এর জন্য আগে কোস্কোতে যাত্রাবিরতি করে স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়ে তারপর উরুবাম্বা উপত্যকা হয়ে আন্দেস পর্বতমালার ওপর দিয়ে দুই থেকে চার দিনের এই পদযাত্রায় বের হতে হয়।
ইন্তিউয়াতানা পাথর
স্থানীয় উপাখ্যান অনুসারে কোনও অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ যদি এই পাথরে তার কপাল ঘসে তাহলে আধ্যাত্মিক জগৎ দেখতে পাবে। ইন্তিউয়াতানা (কেচুয়া: Intiwatana) পাথর দক্ষিণ আমেরিকার পূজিত পবিত্র পাথরগুলোর একটি।
স্পেনীয়রা ২০ শতকের আগে এই পাথরটি খুঁজে পায় নি; ফলে এটি ইনকাদের অন্যান্য পবিত্র পাথরের মতো ধ্বংস হবার হাত থেকে বেঁচে যায়। এই পাথরগুলো এমন ভাবে স্থাপন করা হয় যাতে শীতকালে এগুলো সরাসরি সূর্যের দিকে নির্দেশ করে। একে "সূর্যের আকঁড়া বিন্দুও" বলা হয়, কেননা উপকথা অনুসারে এটি সূর্যকে তার জায়গায় আটকে রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত। ২১শে মার্চ ও ২১শে সেপ্টেম্বর, বছরে এই দুবার দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্য ইন্তিউয়াতানা পাথরের একেবারে ওপরে থাকে; ফলে এর কোনও ছায়া তৈরি হয় না[৩]। প্রকৃতপক্ষে ইন্তিউয়াতানা একটি "মহাকাশ ঘড়ি"[৪]।
এটি ২০০০ সাল পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ছিল। সেই বছর একটি মদ কোম্পানির বিজ্ঞাপন নির্মাণের সময় ৯৯০ পাউন্ড ওজনের একটি ক্রেন এই পাথরের ওপর পড়ে গেলে কলমের আকারের একটুকরা ভেঙে যায়। কোম্পানিটির দাবী তারা এই ঘটনার জন্য দায়ী নয়। অনেক মানুষ মনে করে এই ঘটনার পর আত্মারা ইন্তিউয়াতানা ছেড়ে চলে গেছে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।