অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে গত তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াসহ ওই পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ২৫টি। ইতোমধ্যে একাধিক মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জসীট দেয়া হয়েছে। আবার একটি মামলায় অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওয়ায় কোকোর বিরুদ্ধে আদালত ইতোমধ্যে সাজা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেছেন। পাশাপাশি একাধিক মামলার বিচারকার্য বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকার তৎপর বলে অভিযোগ জিয়া পরিবারের আইনজীবীদের।
তারা বলেছেন, মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে একটি মামলাও সঠিক প্রমাণিত হবে না। অথচ সরকার তাড়াহুড়া করে শুধু বিরোধী দলকে চাপে রাখতে ওই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া এবং তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মোট ২৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচটি, তারেক রহমানের ১৪, কোকোর ৫ এবং তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।
খালেদা জিয়া তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলার সব ক’টিতে জামিনে রয়েছেন। এর মধ্যে চারটি মামলাই হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা ১৪ মামলার মধ্যে চারটি উচ্চ আদালতের নির্দেশে বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে গেলে তার অনুপস্থিতিতে পলাতক বিবেচনায় জামিন বাতিল করেন আদালত। এদিকে অর্থ পাচার মামলায় কোকোর ৬ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
জোবাইদা রহমানের মামলাটি স্থগিত এবং তিনি এ মামলায় জামিনে। বর্তমান সরকারের সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে একটি করে। অন্য মামলাগুলো বিগত এক-এগারো পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের।
জিয়া পরিবারের অন্যতম আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, মামলাগুলোর প্রত্যেকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ন্যায়বিচার হলে সব মামলায় সবাই খালাস পাবেন।
তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বিচার বিভাগের মাধ্যমে অশুভ তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে। তবে আদালতের ওপর আমাদের আস্থা আছে। আশা করি, ন্যায়বিচার পাব।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জানান, জিয়া পরিবারকে হেয়প্রতিপন্ন করতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক এসব মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও অন্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাগুলো রহস্যজনকভাবে বাতিল হয়েছে।
সরকার জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে থাকা রাজনৈতিক মামলাগুলোও প্রত্যাহার করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কারণ মামলা-হামলা করে বিরোধী দলকে দমন করা যাবে না। বরং এর ফলে সরকার পরিবর্তন হলে বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক মামলা হতে পারে। এসব মামলা তড়িঘড়ি করে নিষ্পত্তির চেষ্টা চালালে কোনো অবস্থাতেই গণতন্ত্র ও সুস্থ রাজনীতির ক্ষেত্রে সরকারের জন্য শুভ হবে না।
জিয়া পরিবারের অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন জানান, বর্তমান সরকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।
সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিরোধী দলকে দমনে মামলা-হামলা চালায়। এসব ষড়যন্ত্র করে কোনো লাভ হবে না।
খালেদা জিয়ার মামলা
গ্যাটকো দুর্নীতি : কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য গ্যাটকো লিমিটেডকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রের এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগে খালেদা জিয়া ও আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনকে আসামি করে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ দুর্নীতি : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এ মামলাটি করে দুদক।
একই বছরের ৫ আগস্ট আদালতে চার্জসিট দাখিল করা হয়। মামলাটির অভিযোগ গঠনের বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি : জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশনÑ দুদক। এ মামলায় খালেদা জিয়া ৮ ডিসেম্বর হাজির হয়ে আবেদন করলে হাইকোর্ট আট সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন। তবে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেননি উচ্চ আদালত।
মামলাটি বর্তমানে নিম্ন আদালতে সচল রয়েছে।
বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি : বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ঠিকাদারি কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটির কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।
নাইকো দুর্নীতি : নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে অবৈধভাবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলাটি করে দুদক।
এ মামলার কার্যক্রমও উচ্চ আদালতের নির্দেশে বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।
তারেক রহমানের মামলা
অর্থ পাচার : সিঙ্গাপুরে প্রায় ২১ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় তারেকের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকেও আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে গত বছর ৬ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। মামলাটির অভিযোগ গঠন সম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জন : অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। এ মামলায় তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমানকেও আসামি করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটির কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।
আয়কর ফাঁকি : কর ফাঁকির অভিযোগে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট ঢাকার বিশেষ আদালতে মামলাটি করে এনবিআর।
এটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : বিস্ফোরক ও হত্যার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলায় আসামি করা হয়। মামলা দুটি বর্তমানে বিশেষ আদালতে বিচারাধীন। এছাড়া তারেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অভিযোগে আরও ৮টি মামলা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ছেলে তারেককেও আসামি করা হয়েছে।
আগামী ১ অক্টোবর এ মামলায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে চার্জ গঠনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা।
কোকোর মামলা
অর্থ পাচার : ৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২ মার্কিন ডলার এবং ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬০৪ সিঙ্গাপুর ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩ কোটি টাকা) পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। এ মামলায় কোকো ছাড়াও সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেনের ছেলে সায়মনকেও আসামি করা হয়। গত বছর ১২ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় চলতি বছর ২৩ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত কোকোকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেন।
চাঁদাবাজি : চাঁদাবাজির অভিযোগে গুলশান থানায় ২০০৭ সালের ১৬ মে ও ২৭ মার্চ পৃথক দুটি মামলা হয়। মামলা দুটির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জন : ২ কোটি ৪ লাখ ৬১ হাজার ২০৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১১ লাখ ২০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৩ এপ্রিল রমনা থানায় মামলা করে দুদক। মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
আয়কর ফাঁকি : ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ২২৬ টাকার কর ফাঁকির অভিযোগে গত বছর ১ মার্চ মামলাটি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মামলাটির অভিযোগ গঠনের বিষয়টি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
ডা. জোবাইদার মামলা : অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় জোবাইদা রহমানসহ তার মাকেও আসামি করা হয়। মামলাটির কার্যক্রম হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।
বিএনপির ঘরে-বাইরের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল মনে করছেন, আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা পরিবারের বিরুদ্ধে নথিভুক্ত মামলাগুলো গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে সরকার। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগেই আদালতের রায়ে খালেদা পরিবারের অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে অনুযায়ী উপরিউক্ত মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক, কোকোসহ খালেদা পরিবারের অনেকের বিরুদ্ধেই সাজামূলক রায় হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিতে শুরু হয়েছে নানামুখি হিসাব-নিকাশ, জল্পনা-কল্পনা। খালেদা পরিবারের দুর্দিনে কে দলের হাল ধরবেন।
কে কার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। এ নিয়ে দলে এখনই শুরু হয়েছে গ্রুপিং-লবিং এবং নানামুখি ষড়যন্ত্র। অনেকে দলের দুর্দিনে নতুন দল গঠনের প্রয়াস চালাচ্ছেন গোপনে। আবার দলের প্রভাবশালী অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে সরকারের সাথে গোপনে আঁতাত করার গুরুতর অভিযোগ। অনেকেই সরকারের হামলা-মামলার ভয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষে বিশেষ ভূমিকায় সুনিপুণভাবে অভিনয় করছেন।
বিএনপির সম্ভাব্য ভাঙন, ঘরে-বাইরে নানামুখি ষড়যন্ত্রে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে স্বয়ং খালেদা পরিবারই বর্তমানে বেশ উদ্বিগ্ন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।