একাত্তরের রণাঙ্গনে জেড ফোর্স এক অবিস্মরণীয় নাম।
স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সর্বাধিনায়ক জেনারেল
এমএজি ওসমানী তিনটি ব্রিগেড গঠন করেছিলেন। এর
মধ্যে অন্যতম ছিল এই জেড ফোর্স। স্বাধীনতার ঘোষক
তত্কালীন মেজর জিয়া জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন।
তার নেতৃত্বে জেড ফোর্স যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ
করে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাভূত করেছে,
তা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা।
‘জেড ফোর্স’ কামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ
থানা, চিলমারী, হাজীপাড়া, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট,
টেংরাটিলা, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই
চা-বাগান, ধামাই চা-বাগান, জকিগঞ্জ, আলি ময়দান,
এমসি কলেজ, ভানুগাছ, কানাইয়ের ঘাট, বয়মপুর,
ফুলতলা চা-বাগান, বড়লেখা, লাতু, সাগরনাল চা-বাগান
ইত্যাদি স্থানে পাক সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে নজিরবিহীন
দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই চট্টগ্রামে পাক হানাদারদের
বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন জিয়ার
নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা। মুজিবনগর সরকারের
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালের ১১
এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন,
সেখানে তা উল্লেখ করেছেন। তাজউদ্দিন আহমেদ পাক
হানাদারদের বিরুদ্ধে জিয়ার
নেতৃত্বে যুদ্ধকে স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধের
সঙ্গে তুলনা করেন। তাজউদ্দিন আহমেদ তার
ভাষণে উল্লেখ করেন—‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের
সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের
ওপর।
নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের
মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধব্যুহ
গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার
ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর
মোকাবিলা করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই
প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে, চট্টগ্রাম
শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ
নোয়াখালীকে মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ’
তাজউদ্দিন আহমেদ তার ভাষণে আরও উল্লেখ করেন,
‘প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান
একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান
থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম
কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের
কথা ঘোষণা করা হয়। ’
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের দশম খণ্ডে ‘জেড ফোর্স’
গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। ক্যাপ্টেন
অলি আহমেদ এ সম্পর্কে লেখেন, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের
প্রথম ব্রিগেড ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হয় একাত্তরের ৭ই
জুলাই।
মেজর জিয়াউর রহমানের নামানুসারে এই ব্রিগেডের
নামকরণ করা হয় ‘জেড’ ফোর্স (জিয়া ফোর্স)। বাংলার
স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘জেড’ ফোর্স এক বিশেষ অবদান রেখেছে।
এই ফোর্সে তিনটি নিয়মিত পদাতিক বাহিনী ছিল— প্রথম
ইস্টবেঙ্গল, তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল এবং অষ্টম ইস্টবেঙ্গল
ব্যাটালিয়ন। ব্রিগেড কমান্ড করেন তত্কালীন মেজর
জিয়াউর রহমান (বর্তমানে মেজর জেনারেল)।
আমি নিজে ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন
করি।
প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যেসব অফিসার কর্তব্য
পালন করেছিলেন তারা হলেন :
কমান্ডিং অফিসার : মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী। আগস্ট
মাস থেকে মেজর জিয়াউদ্দিন এই ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব
নেন। মেজর জিয়াউদ্দিন পাকিস্তান
থেকে পালিয়ে এসে বাংলার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
সেকেন্ড-ইন-কমান্ড : ক্যাপ্টেন বজলুল
গনি পাটোয়ারী অ্যাডজুট্যান্ট এবং কোয়ার্টার মাস্টারের
দায়িত্ব পালন করেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত
আলী খান।
ব্যাটালিয়নে ৪টি কোম্পানি যারা কমান্ড করেছেন
তারা হলেন :
‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন মাহবুব।
‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দীন।
‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন আবদুুল কাইয়ুম
চৌধুরী।
‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন বজলুল
গনি পাটোয়ারী।
লে. আনিসুর রহমান এবং লে. এম. ওয়াকার হাসানও এ
ব্যাটালিয়নে কাজ করেছেন।
তৃতীয় বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন
তারা হলেন :
কমান্ডিং অফিসার : মেজর শাফায়াত জামিল।
সেকেন্ড ইন-কমান্ড : ক্যাপ্টেন মহসীন।
‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন।
‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন।
‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন মহসীন।
‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে. নুরুন্নবী চৌধুরী।
এছাড়া লে. মঞ্জুর, লে. ফজলে হোসেন, ফ্লাইট
লেফটেন্যান্ট আশরাফুল আলম প্রমুখ অফিসার এ
ব্যাটালিয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই
ব্যাটালিয়নে নায়েক সুবেদার আজিজের
নেতৃত্বে একটি সাপোর্ট প্লাটুনও ছিল।
অষ্টম বেঙ্গলে যেসব অফিসার কমান্ড করেছেন
তারা হলেন :
কমান্ডিং অফিসার : মেজর এটিএম আমিনুল হক।
সেকেন্ড ইন-কমান্ড : ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী।
‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান
চৌধুরী।
‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার : ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন।
‘সি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে. মোদাসের হোসেন।
‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার : লে. মাহবুবুর রহমান।
এছাড়া লে. এমদাদুল হক, লে. কাজী মনিবুর রহমান, লে.
ওয়ালি-উল ইসলাম, লে. বাকের প্রমুখ তরুণ অফিসার এ
ব্যাটালিয়নে কাজ করেন।
জুলাই মাসে জেড ফোর্স গঠিত হওয়ার পরপরই মেজর
জিয়াকে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার অপারেশনাল
দায়িত্ব দেয়া হয়।
তিনি তার বাহিনী দিয়ে প্রথমত তিনটি বড়
অপারেশনের দায়িত্ব নেন। এগুলো হচ্ছে কামালপুরের যুদ্ধ,
বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ ও নকশী সীমান্ত ফাঁড়ি আক্রমণ। ৩০-৩১
জুলাই কামালপুরে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের
সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। এই
রেজিমেন্টের প্রথম কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর মইনুল
হোসেন চৌধুরী। কামালপুরে ব্রিগেডের অ্যাটাক সরেজমিন
তদারকি করার জন্য মেজর জিয়াউর রহমান নিজেও
অ্যাটাকিং ট্রুপসের সঙ্গে রওনা হন।
মেজর
জিয়া একটি টিলা থেকে যুদ্ধ তদারকি করতেন। মেজর মইন,
ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন, লে. মান্নানের নেতৃত্বে ডেল্টা ও
ব্র্যাভো কোম্পানি দুটি পাকবাহিনীর ওপর
বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধের
পাশাপাশি হাতাহাতি যুদ্ধও হয়েছে। কামালপুরের যুদ্ধ পাক
সেনাদের মনে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধ
সম্পর্কে মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরীর যে স্মৃতিচারণ
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের দশম খণ্ডে ছাপা হয়েছে,
তাতে তিনি লেখেন, ‘কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন
সালাউদ্দিনের ডেল্টা কোম্পানি, ক্যাপ্টেন হাফিজের
ব্র্যাভো এবং ব্যাটালিয়ান আর গ্রুপে ছিলেন মেজর মইন।
তাদের সঙ্গে স্বয়ং যোগ দিয়েছিলেন জেড ফোর্স
অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। সম্ভবত ব্রিগেডের
প্রথম অ্যাটাক সরেজমিন তদারকি করতেই তিনি আসেন।
৩০-৩১ জুলাইয়ের গভীর রাতে যুদ্ধ শুরু হয়।
একপর্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মেজর জিয়াউর রহমান
সহযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বাঘের মতো গর্জে উঠলেন
—‘কাম অন, অ্যাট এনি কস্ট উই উইল লাঞ্চ দ্য
অ্যাটাক’। অস্ত্রের যুদ্ধের পাশাপাশি হাতাহাতি যুদ্ধও
হচ্ছে।
বাঘের থাবাতে যত্রতত্র ভূপাতিত হয় পাক সৈন্যরা।
মুক্তিযোদ্ধারাও শহীদ হচ্ছেন।
মেজর জিয়া তখন মেজর মইনকে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ
দিচ্ছেন,—‘আই উইল একসেপ্ট নাইনটি ফাইভ পারসেন্ট
ক্যাজুয়েলটি বাট… দেম আউট মইন। ’ আহত ক্ষতবিক্ষত
জওয়ানরা বলছেন, ‘স্যার’—নিয়ে এলেন কেন? আর
সামান্য বাকী—কি হতো, আমি না হয় মরে যেতাম। ’ এই ছিল
চিত্র।
ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ লেখেন, ময়মনসিংহ
জেলার কামালপুরে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত
ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিকে আঘাত করার পরিকল্পনাই নিয়েছিল
জেড ফোর্স। কামালপুরের যুদ্ধে আমাদের পক্ষে একজন
অফিসারসহ ৩১ জন যোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে শত্রুপক্ষ
পাকসেনা নিহত হয় ৫০ জন। এই আক্রমণ যদিও
পুরোপুরি সফলকাম হয়নি, তবুও মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাসে এটা একটি স্মরণীয় যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে প্রমাণ হয়
বাঙালি সৈন্যরা সম্মুখ সমরে যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী ও
সাহসী। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা কাঁটাতারের
বেড়া ও মাইন বসানোকে উপেক্ষা করে আমাদের
যোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ১০
সেপ্টেম্বর আমাদের ডি-কোম্পানি ঘাসিপুরে পাকিস্তানি দুই
কোম্পানি সৈন্যের আক্রমণ প্রতিরোধ করে। এ সময় ৪০
জন পাক সেনা নিহত হন। কোটালকাঠির যুদ্ধে শত্রুপক্ষের
প্রায় ৭০ জন নিহত হয়।
একইভাবে সিলেটের চা-বাগান ও
অন্যান্য এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে জেড
ফোর্স সাহস ও বীরত্বের স্বাক্ষর রাখে। এসব
যুদ্ধে পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে পড়ে।
সিলেটে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের পর আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার
জিয়াউর রহমান স্থির করেন সিলেট শহরে অন্যান্য
বাহিনীর আগেই আমাদের বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করতে হবে।
পাকবাহিনীর শত্রু ঘাঁটি ভেদ করে অনুপ্রবেশ করব। ১৫
ডিসেম্বর পাকিস্তানি কমান্ডাররা আত্মসমর্পণ করে।
আমরা বিজয়ীর বেশে সিলেট শহরে প্রবেশ করি।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে খুব কম ব্যাটালিয়নই এ ধরনের
নেতৃত্ব দিয়েছে এবং যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। জেড
ফোর্সের অসাধারণ কৃতিত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করে শত্রু
সৈন্যকে হতাহত এবং জীবিত বন্দি করেছে।
কৃতজ্ঞতা :সৈয়দ আবদাল আহমদ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।