ফুলের সৌরভে সুরভিত কলমের কণ্ঠস্বর
১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানব ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মূলত সে দেশের জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হলেও একটি বিশেষ বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেটি আন্তর্জাতিক মাত্রা অর্জন করে। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানের পক্ষে তথা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও চীন প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করে, অন্যদিকে মুক্তিকামী বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সুস্পষ্ট সমর্থন জানায়। এজন্য ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট একটি মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বস্তুত, তৎকালীন দুই পরাশক্তির মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রতিফলিত হয়।
এটি আশ্চর্যজনক বিষয় যে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে চলি্লশের দশকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিতব্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি হয় এর লিখিত প্রমাণ রয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে এ আলোচনা থেকে বিরত থাকলাম। উক্ত আগ্রহের ধারাবাহিকতাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পঞ্চাশের দশকে যখন পাকিস্তান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বলয়াধীন সামরিক জোট সিয়াটো ও সেন্টোর অন্তভর্ুক্ত হয় বস্তুত তখন থেকেই তৎকালীন পূর্ববাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশে ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়। যেহেতু পাকিস্তান মার্কিন নেতৃত্বাধীন সিয়াটো ও সেন্টোভুক্ত ছিল সেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কার্যত অনিবার্যভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের রূপ নেয়। বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানের কথা বিবেচনা করেই তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এরূপ অবস্থান গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রমনা রেসকোর্স ময়দানে যে যুগান্তকারী ও অবিস্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেন তাতেই তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এই বলে যে, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। " আর একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার বরণের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ৭ মার্চের ঐ ঘোষণা শুনেই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সদম্ভে বলেছিলেন, 'কদধ্রর্ ধবণ ওদণধপদ ুলনধঠ ষধফফ ভর্ম থম লভযলভধ্রদণঢ'. পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে রাওয়ালপিন্ডি জেলে আটক থাকা অবস্থায় হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব জনমত এর বিরুদ্ধে থাকায় তা তারা করতে পারেনি। বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
তবে তারা তাঁর বিলম্বিত শাস্তি বোধ হয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাদের দোসরকে দিয়ে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে সম্পন্ন করে। সেজন্য সম্ভবত আমেরিকার বিখ্যাত 'টাইম' পত্রিকা (সাপ্তাহিক) তার এক সংখ্যায় ৭ মার্চের জনসভার ছবিসহ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির নিচে শিরোনাম দেয়, "ওদণধপদ ুলনধঠ : এরমব ঔণরমর্ ম ুটর্রহর"। অর্থাৎ "শেখ মুজিব বীর থেকে শহীদ"। আসলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বীরের যথোচিত মর্যাদা লাভ করেন, আর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হয়ে শহীদের সম্মান অর্জন করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে আন্তর্জাতিক মাত্রা অর্জন করেছিল তার অন্য একটি বিশেষ প্রমাণ হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম ভাগে যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও আমেরিকা সমর্থিত 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি' প্রস্তাবের বিপক্ষে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পর পর তিনটি ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের ঘটনা ঘটে।
এর ফলে এ প্রস্তাব বানচাল হয়ে যায় এবং পাকিস্তান ১৬ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর এ ঘটনাটিও ঘটে রমনা রেসকোর্স ময়দানে_ যেখানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ মুক্তিসংগ্রামের ডাক দেন। এ প্রসঙ্গে এখানে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ আবশ্যক। আর সেটা হলো এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাইস ও সময় দেয়ার জন্য এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী রাষ্ট্র ভারতকে বিরত ও ভীতসন্ত্রস্ত করার জন্য একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর তার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন করে। আর তখনও গণতান্ত্রিক ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন তার একটি নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করে ভারত ও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের মনোবল বৃদ্ধি করে।
এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের কী ভূমিকা ছিল। সে যা হোক বর্তমান নিবন্ধে আমি এ সম্পর্কে যৎসামান্য আলোকপাত করার প্রয়াস পেয়েছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে (১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হয়। স্বৈরাচারী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত তখন মার্কিন প্রশাসন কী নীতি গ্রহণ করেছিল এবং তা বাস্তবায়নে কী ভূমিকা পালন করেছিল তা জানা আবশ্যক। এটি একটি অবিসংবাদিত সত্য যে, আমেরিকার কেন্দ্রীয় প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই পাকিস্তানের সপক্ষে তার নীতি ঘোষণা করে।
তারা গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। তারা দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা অগণতান্ত্রিক শক্তির সপক্ষে। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড এম. নিঙ্ন এবং হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন নিঙ্নের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি, যিনি তখন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রেসিডেন্টের একান্ত সহকারী। এই নিঙ্ন-কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত মার্কিন নীতিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা পাকিস্তানের এমন একটি অত্যাচারী সরকারের সপক্ষে দাঁড়াল যে সরকার তার পূর্বাঞ্চলের নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তানের পক্ষে নিঙ্ন-কিসিঞ্জারের প্রকাশ্য সমর্থন কিংবা পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া নীতি অনুসরণ নিছক পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা ছিল না। তখনকার মার্কিন প্রশাসনের নীতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়, যা ঐ ঝুঁকে পড়ার সীমা ছাড়িয়ে যায়। বলা যায়, প্রায় অনেকটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তথা পাকিস্তানের সপক্ষে আমেরিকার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কিংবা মদদদান। আমেরিকা ঐ অবস্থান গ্রহণ করার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পাকিস্তানকে সামরিক ও নৈতিক সমর্থন জানায়।
পাকিস্তানের পক্ষে নিঙ্ন প্রশাসনের ঝুঁকে পড়ার নীতির এক বলিষ্ঠ প্রয়োগকারী ব্যক্তি হচ্ছেন- হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী ও পারদশর্ী।
কিসিঞ্জার তাঁর নিজের উচ্চতর ক্ষমতা ও যোগ্যতার অধিকারী হয়ে এবং প্রেসিডেন্ট নিঙ্নের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সমীকরণের বলে তিনি এমনই একজন শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন যার ফলে তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি প্রণয়নের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আবিভর্ূত হন। হেনরি কিসিঞ্জার কি করে এতটা শক্তিশালী হলেন? তিনি ছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদের শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার অন্যতম ধনকুবের রকফেলারের আশ্রিত ব্যক্তি। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রীধারী ও ঐ বিশ্ববিদ্যলয়ের এক সময়ের সরকার বিভাগের একজন প্রভাবশালী শিক্ষক। নিঙ্ন আমেরিকার জাতীয় স্বার্থে কিসিঞ্জারের মেধা ও যোগ্যতাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। নিঙ্নকে যদি পাকিস্তানের পক্ষে ঝুঁকে পড়ার নীতির প্রবক্তা বলা হয়, তাহলে কিসিঞ্জার হচ্ছেন ঐ নীতি বাস্তবায়নে একজন বলিষ্ঠ ব্যক্তি ও অনুগত সহচর।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কিসিঞ্জারের রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যখন কিসিঞ্জারের সাক্ষাত হয় তখন কিসিঞ্জার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে অনেকটা ত্যক্ত বিরক্তির ভাব নিয়ে বলেন, "মুজিব হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি, যাঁর রয়েছে ব্যাপক ধারণা, অর্থাৎ মুজিব মোটা বুদ্ধির মানুষ। তিনি নাকি বাংলাদেশের জাতির পিতা, যাঁর রয়েছে বিরাট অভিজ্ঞতা। "
শেখ মুজিব সম্পর্কে কিসিঞ্জারের উক্ত মন্তব্য শোনার পর ঐ সময় এক সাংবাদিক কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করেছিলেন "মুজিব যদি ব্যাপক ধারণার লোক হয়ে থাকেন তাহলে আমেরিকা একাত্তরে কেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রণতরী বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছিল? কিসিঞ্জার সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান এবং তাড়াতাড়ি সেই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হয়ে যায়। লরেন্স লিপশুল্ রচিত "বাংলাদেশ : অসমাপ্ত বিপ্লব" (১৯৭৭) শীর্ষক গ্রন্থে ঐ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
ঐ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যখন নিউইয়র্কে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিসিঞ্জারের প্রথম সাক্ষাত হয় তখন কিসিঞ্জার সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে শেখ মুজিবকে জিজ্ঞাসা করেন "তিনি কি পাকিস্তানের জেলে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। ' মুজিব এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন "আপনি নিশ্চয়ই ওটা জানেন, পাকিস্তানের কোথায় আমাকে রাখা হয়েছিল এবং কি ব্যবহার করা হয়েছে। " শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঐ সাক্ষাতের সময়ই কিসিঞ্জার একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা সম্পর্কে মিথ্যাচার করে বলেন, "আমেরিকা বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেনি। " সত্যি, মিথ্যা বলতে কিসিঞ্জার কত দক্ষ ও কুশলী।
কিন্তু ওটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও ইতিহাসের নির্মম পরিহাসসূচক ব্যাপার যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী ব্যক্তি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে প্যারিসে ১৯৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালের ইউনেস্কোর শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
কিসিঞ্জার তখন তাঁর বক্তব্যে একাত্তরে তার ন্যক্কারজনক ভূমিকার জন্য বিবেকের তাড়নায় কষ্ট পেয়েছিলেন কিনা জানি না। তিনি নাকি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ও রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার প্রশংসা করে অনেকটা গর্বভরে বলেছিলেন "তিনি শেখ পরিবারকে কয়েক দশক ধরে চিনেন। " কপটতা আর কাকে বলে। কিসিঞ্জার ঐ অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতায় বলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান সরকারের ভবিষ্যদ্বাণীর বিপরীতে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করায় তিনি একটি নতুন জাতির পিতা হিসাবে আবিভর্ূত হয়েছিলেন। কিন্তু কথা থেকে যায়_ কিসিঞ্জার কেন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় যখন পাকিস্তানের জেলে নির্যাতন ভোগ করছিলেন তখন তাঁর কষ্ট লাঘব তথা তাঁকে মুক্তিদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
কিংবা বাংলাদেশ নামক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের নেতা হিসাবে তাঁকে স্বীকৃতি দেননি। অথচ বিশ্বের গণতন্ত্রকামী শান্তিপ্রিয় সকল মানুষ বিশ্বাস করে যদি ঐ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবুর রহমানের সাংবিধানিক অবস্থানের মূল্য দিত তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নরনারী নির্মমভাবে নিহত হতো না, ১ কোটি লোক ভারতে শরণাথর্ী হতো না এবং বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ বিনষ্ট হতো না। এছাড়া কিসিঞ্জারের শেখ পরিবারকে চিনেন এ বাগাড়ম্বরমূলক বক্তব্যের বিপরীতে বলা যায়, তিনি মাত্র দুবার শেখ মুজিবুরের সঙ্গে মিলিত হন। পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরম মিত্র হওয়া সত্ত্বেও কেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি বিজয়ী দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মার্কিন প্রশাসন অভিনন্দন জানায়নি? কেনই বা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেনি? কিসিঞ্জার বরং পাকিস্তানের উক্ত নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের তৃণমূল রাজনীতি ও তাঁর পাশ্চাত্য ভাবধারাবিরোধী মনোভাব নিশ্চয়ই কিসিঞ্জারের পছন্দ হয়নি।
এটি অনেকেই মনে করেন যে, কিসিঞ্জার ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর ধমর্ীয় প্রণোদনা ও সহানুভূতির কারণে হয়ত তিনি একাত্তর সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলে আরব রাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সমর্থক পাকিস্তানের ভাঙ্গনকে স্বাগত জানাবেন। কিন্তু কিসিঞ্জার তখন যে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের সীমা অতিক্রম করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত ভারতের বিরুদ্ধে তথা আমেরিকা ও চীনের যৌথ মিত্র পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ানোই সমীচীন মনে করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই ইতিহাসের চূড়ান্ত বিচারে নিঙ্ন-কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে ঘৃণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল সে দায় থেকে তাদের অব্যাহতি পাওয়া অসম্ভব। বাঙালীর রক্তে যেমন পাকিস্তানীদের হাত রঞ্জিত হয়েছে তেমনি পাকিস্তানের মদদদাতা আমেরিকানদের হাতও কলঙ্কিত এ কথা অকপটে বলা যায়।
সে যা হোক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় এক দশক পর হেনরি কিসিঞ্জার তার স্মৃতিকথায় (১৯৭৯) লিখিছেন : "আমরা ভারতীয় ও আমেরিকার দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থকে সর্বক্ষণ বিবেচনা করেছি... এবং পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি অংশ হিসাবে থাকুক_ এ ব্যাপারে আমরা জিদ করিনি" এবং "এর স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতাকে সম্ভাব্য সমাধান হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম।
" অর্থাৎ তিনি দ্বৈততার আচরণে আসল সত্য আড়াল করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তাই তো তিনি লিখেছেন : "পদ্ধতির ক্ষেত্রে আমাদের মতপার্থক্য ছিল, লক্ষ্যে নয়। " কিন্তু কিসিঞ্জার কখনও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমালোচনা করে কোন দ্ব্যর্থবোধক বিবৃতি প্রদান করেননি। তিনি বরং সব সময় ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থনের সর্বাত্মক ও সর্বোচ্চ প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলন। মুক্তিযুদ্ধে নয় মাসে তিনি কখনও পূর্বাবাংলার জনগণের দুঃখ-দুর্দশা কিংবা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নের সপক্ষে কোন অর্থপূর্ণ মন্তব্য করেননি।
এছাড়া, আমেরিকা ইচ্ছা করলে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে চেষ্টা করতে পারত। এটি তাদের মোটেই অজানা ছিল না যে, মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগারে রেখে পূর্ববাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বাস্তব কোন উপায় নেই। এবং মাকিন যুক্তরাষ্ট্র তার সকল সরকারী বিবৃতিতে বলেছে পূর্ববাংলার সঙ্কট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারা জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের কোন মূল্য দেয়নি।
অনুরূপভাবে, আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম. নিঙ্ন তাঁর আত্মকথায় (১৯৭৮) লিখেছেন, "আমরা জানতাম ইয়াহিয়া খান পরিণামে হয়ত পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবির কাছে নতি স্বীকার করবেন।
" তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, যদি বাংলাদেশের অনিবার্য অভু্যদয়ের বিষয়টি নিঙ্ন প্রশাসনের জানাই থাকে তাহলে পূর্ববাংলার জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে তারা কেন ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আসলে নিঙ্নের বিবেচনায় আমেরিকার বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের বলিদান অগ্রহণযোগ্য নয়। তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কিভাবে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে এ ব্যাপারে বিরত রাখা যায়। অর্থাৎ কিছুতেই "ভণ্ডামিপূর্ণ ও দ্বিচারী ভারতকে (তাঁর ভাষায়) পাকিস্তান ভাঙ্গতে দেয়া হবে না এবং পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক চীনকে আশ্বস্ত করা যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তার কৌশলগত মিত্রের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করবে। " বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ধ্যান-ধারণা পোষণ করত তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই মার্কিন কংগ্রেসে ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিদেশনীতি বিষয়ক যে প্রতিবেদন প্রদান করা হয় তাতে নিঙ্ন দাবি করেন যে, ইয়াহিয়া খান পূর্ববাংলার সর্বপ্রকার বিরোধিতা দমনে যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন সেসব বিষয়ে তার প্রশাসন সম্যকভাবে অবহিত ছিল।
ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণ, শেখ মুজিবুরের গ্রেফতার, পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, বেসামরিক প্রশাসনের কাঠামো ধ্বংস, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা এবং জীবন বাঁচাতে অগণিত মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ ইত্যাদি। একই প্রতিবেদনে নিঙ্ন দাবি করেন যে, "এটি একটি অগ্রবতর্ী সিদ্ধান্ত যে, যদি যুদ্ধ বাধে তাহলে ভারত জয়ী হবে। " যুদ্ধ বাধলে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে, ভারত জয়ী হবে_ এসব বিষয় যদি আমেরিকার জানা থাকে তাহলে এহেন পরিস্থিতি পরিহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমেরিকা গ্রহণ করেনি কেন? বস্তুত, বাংলাদেশের বাস্তবতা আমেরিকা আমলে নেয়নি, কিংবা জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে মূল্য দেয়নি। যদি তারা বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিত তাহলে হয়ত একাত্তরের এ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মাত্রা কম হতে পারত। এ সম্পর্কে ১৯৯৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মার্ক ফিশার নামক 'ওয়াশিংটন পোস্ট' পত্রিকার এক প্রতিবেদক বলেন, নিঙ্ন আমেরিকার করুণাউদ্রেককারী একজন শঠ ব্যক্তি, যাকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের জার্মানির হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি মনে রেখেই ফিশার নিশ্চয়ই এ মন্তব্য করেছেন।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, নিঙ্ন-কিসিঞ্জার ছিলেন একাত্তর সালের বাংলাদেশ বিষয়ে আমেরিকার নীতি নির্ধারণে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁরা গোপনে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারাই ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর আমেরিকার সপ্তম নৌ-বহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েনের নির্দেশ দেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বোচ্চ ভীতিপ্রদান এবং পূর্ববাংলা থেকে সরে আসতে পাকিস্তান যেন কিছু সময় পায়। কিন্তু হানাদার পাকিস্তান বাহিনী সে সুযোগ পায়নি।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৭ মার্চ যে রমনা রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদত্ত হয় সে স্থানেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাদেরকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর যৌথ কর্তৃত্বের কাছে নির্লজ্জের মতো আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। শত চেষ্টা ও চলচাতুরি করেও আমেরিকা পাকিস্তানের পরাজয়বরণ পরিহার করতে পারেনি। এবারের বিজয় দিবসে আবারও আমরা ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বাংলাদেশে একটি সমতাভিত্তিক এবং সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য শপথ গ্রহণ করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।