নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা । লাষ্ট সাপার কি পৃথিবী ধংশের ভবিষ্যত বানী ?
বিতর্কিত ছবি , বিতর্কিত শিল্পী এবং ড্যান ব্রাউন গং ।
ভ্যাটিকান রিসার্চার সাব্রিনা গ্লিৎজিয়ার দাবী, পৃথিবীতে আপনি লাষ্ট সাপার কবে করবেন তার দিন তারিখ আগেই লিখে গেছেন ভিঞ্চি তার ছবির আড়ালে ।
বেষ্ট সেলার বইগুলির লেখক ড্যান ব্রাউন গংদের দাবী , জেসাসের অনুসারী জন আর কেউ নন, তারই কথিত স্ত্রী মেরী ম্যাগদালেন আর তার গর্ভে জেসাসের সন্তান ।
এ কথারই ইঙ্গিত দিয়েছেন ভিঞ্চি তার ছবিতে ।
এক ইটালিয়ান মিউজিশিয়ানের দাবী, ছবিটি আসলে একটি মিউজিক্যাল কম্পোজিশান ।
এদিকে ভ্যাটিকান বলছে, রসো রসো.. সব গপ্পো তো বটেই, একই সাথে “ ব্লাসফেমাস” ।
১৫ শতকের ম্যূরাল পেইন্টিঙ “দ্য লাষ্ট সাপার” নিয়ে এই যতো কথা লোকের মুখে মুখে । “দ্য লাষ্ট সাপার” নামটি শোনেননি এমোন শিল্পরসিক খুঁজে পাওয়া ভার ।
আর তারা সম্ভবত এটাও জানেন, ছবিটি যেমন বিতর্কিত তেমনি বিতর্কিত তার শিল্পীও ।
দেখা যাক, আসলেই কি তাই !
সেইন্ট জন এর গোসপেলের ১৩:২১ অধ্যায়ে বর্ণিত যীশুখ্রীষ্টের শেষদিনগুলোর একটিকে স্মরন করে আঁকা হয়েছে ছবিটি । “সূর্য্যদয়ের আগেই তোমাদের ভেতর থেকে কেউ একজন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে” এমোন কথার একটি বম্বশেল যখন জেসাস ছুঁড়ে দিলেন উপস্থিত অনুসারীদের দিকে, বাইবেলে বর্নিত এমোন কাহিনীর শেষ কয়েক মূহুর্তের ছবিই এটি । তখন অনুসারীদের ভেতরে যে আতঙ্ক, ক্রোধ আর হতবিহ্বলতা ছুঁয়ে গেছে তাই-ই ফুঁটিয়ে তুলেছেন ভিঞ্চি এখানে ।
ছবিটি আঁকার পর থেকেই শুরু সব জল্পনা কল্পনার ।
ম্যাথু, মার্ক, লুক এবং জন এই চারজন অনুসারীর প্রত্যেকের গোসপেল এ ক্রাইষ্টের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে , তার অনুসারীদের মধ্য থেকে কেউ একজন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে । সকলের অবিশ্বাস সত্বেও ক্রাইষ্ট বারংবার একই কথা বলছিলেন যে , বিশ্বাসঘাতক উপস্থিত অনুসারীদের মধ্যেই একজন । আর তারই চিত্ররূপ “দ্য লাষ্ট সাপার” ।
Click This Link
(অনেক চেষ্টা করেও সঠিক জায়গাতে ছবি আসেনি । দুঃখিত ।
আবার পরে চেষ্টা করবো দিতে কোন্ও সময় । লিংক দিলাম দেখে নেবেন কষ্ট করে । )
ইটালীর মিলান শহরের সান্তা মারিয়া দ্যেল গ্রাজিয়ে মন্যাসট্রির খাবার ঘরের ১৫ ফুট বাই ২৯ ফুট দেয়াল জুড়ে রয়েছে ছবিটি । একটি ভোজনকক্ষের দেয়ালে যেমনটি থাকা উচিৎ তেমন গতানুগতিক চিন্তাধারাতেই ছবিটি আঁকা । যদিও ছবিটি যখন আঁকা হয় তখন এটি মোটেও ভোজনকক্ষ ছিলোনা ।
১৪৯৮ সালেই মাত্র প্রধান গীর্জাটির নির্মান শেষ হয়েছিলো যখন ছবিটিতেও তুলির শেষ আঁচড় পড়েছিলো । আসলে ল্যুদোভিকো ফোর্জা পরিবারের জমকালো সমাধিক্ষেত্র হিসেবে গীর্জাটির পুনঃনির্মান করা হচ্ছিলো আর ছবিটি ছিলো সমাধিক্ষেত্রের “সেন্টার পীস” ।
উল্টোদিকের দেয়ালে ছিলো জিয়োভান্নি দোনাত্তোর ফ্রেসকো পেইন্টিঙ “ ক্রুশিফিকসন ” যেখানে আবার ভিঞ্চি ফোর্জা পরিবারের লোকদের ছবিও বসিয়েছেন টেম্পেরায় ।
১৪৯৫ তে ভিঞ্চি এটা আঁকতে শুরু করলেও একনাগাড়ে আঁকেন নি । ৩ বছর সময় নিয়েছেন তিনি ছবিটি শেষ করতে ।
গপ্প প্রচলিত আছে, মন্যাসট্রির কোনও এক সন্যাসী লিওনার্দোকে সরাসরি অভিযোগ করে বলেছিলো , এতো দেরী করছে কেন সে কাজটি শেষ করতে । এটা লিওনার্দোকে রাগিয়ে দিয়েছিলো । আর লিওনার্দো ও এই অভিযোগের জবাবে মন্যাসট্রির অধ্যক্ষকে লিখে বসলেন, “মহাশয়, জুডাসের অতি দুবৃত্ত চেহারার (ভিল্যানিয়াস) ঠিক কি ভাবটি ফুটিয়ে তুলবো ছবিটিতে , আমি তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাবছি । আমার মনের মধ্যে যে ভাবটি আছে তা যদি ঠিক মতো পেতে আমার অসুবিধা হয় তবে আপনি নিশ্চিত জেনে রাখুন, অভিযোগকারী সন্যাসীর মুখটি আমি জুডাসের মুখের বদলে বসিয়ে দেবো । ”
ছবিটিতে কি আছে ? আছে অনেক কিছুই ।
ছবিতে যে মুখগুলি আছে আর সেই মুখগুলিতে যে ভঙ্গী ফুঁটে উঠেছে তা বিশেষভাবে এক ইতিহাসেরই একটি মূহুর্তের চিত্ররূপ । আর আছে সর্বকালের রহস্যময় শিল্পী ভিঞ্চির নিজস্ব কুহেলীকাময় উপস্থাপন ।
উনিশ শতকে প্রাপ্ত “দ্য নোটবুক অব লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি” নামে পরিচিত ভিঞ্চির খসড়ার ২৩২ পৃষ্ঠায় লেখা আছে সেই মুখগুলির পরিচয় ।
A study for The Last Supper from Leonardo's notebooks showing nine apostles identified by names written above their heads. Click This Link
এর আগে রহস্যময় এই ছবিটিতে কেবল মাত্র জুডাস, পীটার, জন আর স্বয়ং জেসাস কে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করা গিয়েছিলো । ভিঞ্চির খসড়ায় পুরো চিত্রটির পাত্রদের পরিচয় মিলেছে ।
তারা সবাই জেসাসের একান্ত কাছের ১২ জন অনুসারী (অ্যাপসল)। তিনজন তিনজন করে মোট চারটি দলে এদেরকে সাজিয়েছেন ভিঞ্চি ।
জেসাসের সর্বডানে তিনজনের একটি দলে আছেন বার্থোলোমিউ, আলফায়্যুসের পূত্র জেমস এবং এ্যান্ড্রু । চিত্রে সবাই হতবাক ।
তিনজনের পরবর্তী দলটিতে আছেন বিশ্বাসঘাতক জুডাস, পীটার এবং জন, যেখানে আধো-অন্ধকারে সবুজ আর নীল রঙের কাপড়ে আছেন জুডাস ।
তার চোখেমুখে আঁকা হয়েছে নির্লিপ্ততা এবং তার গোপন দুরভিসদ্ধি হঠাৎ প্রকাশিত হওয়ায় হতচকিত ভাব । তার হাতে ধরা আছে ছোট্ট একটি ব্যাগ । সম্ভবতঃ এটা দিয়ে বোঝানো হয়েছে জেসাসের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার তার হাতে । অথবা বারোজন অনুসারীর মধ্যে সে যে দলের কোষাধ্যক্ষ এটাও বোঝানো হতে পারে । একই সাথে দেখানো হয়েছে যে, সে টেবিলের উপরে রাখা লবনদানীটি উল্টে দিয়েছে ।
এর অর্থ, নিমকহারামী । সে -ই একমাত্র ব্যক্তি যার কনুই রয়েছে টেবিলের উপরে আর তার মুখখানিকে আঁকা হয়েছে বাকী সকলের মুখমন্ডলের লাইনের নীচে ।
পীটারকে দেখা যাচ্ছে, জেসাসের বিপরীত দিকে তাক করে ধরে রাখা ছুরি হাতে রাগান্বিত অবস্থায় । হয়তো গেথসেমেনের খেজুর বাগানে জেসাসের গ্রেপ্তার হওয়ার সময় যেমন ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি, সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি এখানে ।
বয়সে সবচেয়ে ছোট অনুসারী জন কে মূর্ছিত অবস্থায় দেখানো হয়েছে এখানে ।
মাঝখানে রয়েছেন জেসাস স্বয়ং ।
বামদিকের দলে আছেন থমাস, জেমস দ্য গ্রেটার এবং ফিলিপ । থমাসকে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণরূপে হতাশ । যখন উর্দ্ধে হাত তুলে জেমস রয়েছেন অবাক হয়ে তখন ফিলিপসকে দেখা যাচ্ছে, এর একটা ব্যাখ্যা জানতে চাচ্ছেন তিনি ।
শেষ দলে আছেন ম্যাথু, জুড এবং সিমন ।
ম্যাথু আর জুড উভয়েই তাকিয়ে আছেন সিমনের দিকে যেন জানতে চাচ্ছেন এই অভিযোগের কোনও উত্তর তার কাছে আছে কিনা ।
ছবিটিকে সত্যিকার ভাবে একটি “ফ্রেসকো” বলা যাবেনা কারন এটি আঁকা হয়েছে ভেজা প্লাষ্টারের পরিবর্তে শুকনো দেয়ালে । প্লাষ্টারের বদলে ভিঞ্চি পাথরের দেয়ালটিতে লাগিয়েছেন পীচ, গেসো আর মাস্টিক । আর এ কারনেই ছবিটি শেষ হবার অল্প সময়ের মধ্যেই নষ্ট হতে শুরু করে। তাই বর্তমান ছবিটিতে আপনারা কিছু কিছু বিষয় দেখতে পাবেন না ।
এই ছবিটির কেবলমাত্র সরাসরি দু’টি নকল বা কপির হদিশ পাওয়া গেছে । সম্ভবত ভিঞ্চির সহকারীদের কেউ এ দু’টো এঁকে থাকবেন । ভিঞ্চির ছবিটি আংশিক ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও এ ছবি দু’টিতে মূল ছবিটির আসল বিসয়বস্তু অবিকল রয়েছে এখোনো । লন্ডনের রয়্যাল একাডেমী অব আর্টসে রয়েছে গিয়ামপেত্রিনোর আর সুইজারল্যান্ডের পন্ট ক্যাপ্রিয়াস্কার সেইন্ট এ্যামব্রোজিও গীর্জায় রয়েছে সীজারে দ্য সেস্ত এর আঁকা ছবি দু’টি ।
বেলজিয়ামের এ্যান্টওয়ার্পের এ্যাবে অব টনগার্লোতে রয়েছে ১৬শতকের আঁকা একটি ছবি যেখানে ফুঁটে উঠেছে অনেক বিশদ কিছু যা মূল ছবিটিতে দেখা যায়নি ।
১৮শতকের প্রথম দিকে রোমান মোজাইক শিল্পী গিয়াকোমো রাফ্যায়েলী আবার ছবিটির লাইফ সাইজ কপি এঁকে ফেলেছেন ।
পোলান্ডের এক লবন খনিতে আবার লবন দিয়ে আঁকা হয়েছে ছবিটি ।
The Last Supper made in salt in Wieliczka Salt Mine (Poland) Click This Link
স্বনামখ্যাত শিল্পী সালভাদর দালী ও পিছিয়ে থাকবেন কেন ! তিনিও ছবিটি আঁকলেন তার মতো করে । এখানে জেসাস দেখতে ব্লন্ড, পরিষ্কার করে দাঁড়ি কামানো তাঁর । একটি ভৌতিক দেহের দিকে তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশিত ।
অনুসারীরা রয়েছেন টেবিল ঘিরে । তাদের মাথা নোয়ানো, তাই কাউকেই আপনি চিনবেন না এখানে ।
In 1955, Salvador Dalí painted The Sacrament of the Last Supper, Click This Link
সবকিছু মিলিয়ে ছবিটিকে ঘিরে রয়েছে রহস্য । লেখক থেকে শুরু করে ইতিহাস বিশ্লেষকরা পর্য্যন্ত এর ভেতরে লুকানো কোনও বার্তা রয়েছে কিনা, খুঁজে দেখছেন ।
“লাষ্ট সাপার” এর উপরে আঁকা সমসাময়িক ছবিগুলোতে যেখানে সবাইকে টেবিলের চার ধার জুড়ে বসা দেখানো হয়েছে ভিঞ্চি কিন্তু তা করেননি ।
তিনি সবাইকে বসিয়েছেন টেবিলের একধারে যাতে কারো মুখ অস্পষ্ট বা অদেখা না থাকে । বেশীরভাগ ছবিতেই জুডাসকে দেখানো হয়নি যা দেখিয়েছেন তিনি তার ছবিতে ।
ছবিটিতে আরো চমকপ্রদ যা রয়েছে তা হলো “৩” সংখ্যার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ । অনুসারীরা ৩ জনের এক একটি দলে ভাগ হয়ে আছেন । তাদের পেছনে জানালা রয়েছে ৩ টি ।
আর দু’পাশে ছড়ানো হাত সহ স্বয়ং জেসাসের ফিগার একটি ত্রিভুজাকৃতির । শিল্পী কি খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের “হলি ট্রিনিটি”র দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করছেন ? কেন ?
সালভাদর দালীর ছবিতেও ভৌতিক দেহটির দিকে খেয়াল করলেই মনে হবে - এখানেও ট্রিনিটির ছোঁয়া । দালীও কি ভিঞ্চির ছবিতে এমোন কিছুর ইঙ্গিত রয়েছে তা বোঝাতে চেয়েছেন ?
Click This Link
[ ট্রিনিটিতে “গড” বা ঈশ্বরকে বোঝানো হয়েছে তিন স্বর্গীয় স্বত্তার একীভুত রূপকে । এখানে পিতা, পূত্র আর হলি স্পিরিট এই তিন স্বত্তা আলাদা আলাদা হলেও তারা এক এবং অবিচ্ছেদ্য হিসেবে সৃষ্টি করেছেন গডকে । ]
কেউ কেউ জেসাসের ডানে থাকা জেসাসের অনুসারী “জন” নামের পুরুষ চরিত্রটিকে শনাক্ত করেছেন নারী বলে ।
কে এই নারী ? নারীটি আর কেউ নন , জেসাসের স্ত্রী কিম্বা রক্ষিতা বলে কথিত “মেরী ম্যাগদালেন” ।
এই “মেরী ম্যাগদালেন” বিষয়টি উঠে এসেছে লীন পিকনেট এবং ক্লাইভ প্রিন্স এর বই “ দ্য টেম্পলার রিভিলেশান” এ । আর আপনাদের অবশ্যই পড়া এবং দেখা ড্যান ব্রাউনের “ দি দ্য ভিঞ্চি কোড” বইটি এবং ছায়াছবিতে ।
ছবিটি নিয়ে আরো কতো যে জল্পনা–কল্পনা । কেউ মনে করছেন ছবিটিতে মদের গ্লাস রয়েছে অনেকগুলি ।
জেসাসের ডান হাতখানিও একটি মদের গ্লাসের দিকে বাড়ানো । অথচ কোনও “কাপ” (মদ রাখার পাত্র) এর অস্তিত্ব নেই টেবিলে । সেল্টিক মিথলোজীর কথামতো স্বর্ন নির্মিত “হলি গ্রেইল” ( পরে যে পাত্রে জেসাসের রক্ত ধরে রেখেছিলেন জোসেফ ) নামের যা থাকার কথা ছিলো এখানে । কিন্তু ভিঞ্চি তো জোর দিয়েই বলেছেন, এটা একটা রিয়েলিস্টিক পেইন্টিঙ । তাহলে এখানে এটি নেই কেন ?................
[ দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত …]
পাদটিকা - এই ছবিটি নিয়ে হয়তো অনেক পোষ্ট অতীতে হয়েছে, যা হওয়াটাই স্বাভাবিক ।
এখানে আমি নতুন কিছু যোগ করতে পেরেছি কিনা জানিনে । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।