বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। বর্তমানকালে বাংলাদেশ ও ভারতে যেসব সনাতন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দ্যাখা যায় সেগুলোর অধিকাংশই প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রচলিত ধর্মকর্মের পরিবর্তিত রূপ। প্রায়ই দ্যাখা যায় আগে যেই দেবতাকে নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলের মানুষেরা পূজা করতো পরবর্তীতে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ ঐ একই দেবতার পূজা করছে, আবার কোন একটি পূজনীয় প্রাণী স্বকীয়তা হারিয়ে বড়ো কোন দেব-দেবীর সাথে মিশে গেছে। আবার কোন কোন উৎসব একেবারেই হারিয়ে গেছে, কোনটি অন্য কোন উৎসবের সাথে মিশে নতুন রূপ পেয়েছে। প্রাচীন বাঙলায় প্রচলিত কিছু উৎসব অথবা ব্রত অথবা ধর্মকর্ম দেখি,
গ্রাম-দেবতা : প্রাচীন বাঙলার পাড়াগাঁয়ে অজনপ্রিয় কয়েক দেব-দেবী ও অপদেবতা পূজার জন্য বট, পাকুড় অথবা অন্য কোন বড়ো আকারের গাছের নিচে ‘থান’ অথবা ‘স্থান’ নামে একটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিল।
এই দেব-দেবী ও অপদেবতা শুধুমাত্র ঐ গ্রাম ও এর আশেপাশের এলাকায় পরিচিত ছিলেন, কোন কোন দেব-দেবীর ক্ষেত্রে তা পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ভারতবর্ষের সব অঞ্চলে এইসব দেব-দেবীগণ একই নামে পরিচিত ছিলেন না, য্যামন বর্তমানকালে ‘কালী’ নামে পরিচিত দেবী কোথাও ‘ভৈরবী’, কোথাও ‘চণ্ডী’, কোথাও ‘বনদূর্গা’ নামে পরিচিত; শুরুতে কিন্তু ‘কালী’ একজন গ্রাম-দেবী ছিলেন। প্রথম প্রথম গ্রামের ব্রাহ্মণ সমাজ ঐ দেব-দেবীদের স্বীকৃতি দিতে আপত্তি জানালেও পরবর্তীতে তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় এইসব দেব-দেবী ও অপদেবতাগণ মূল ধর্মে ঢুকে পড়ে। শীতলা, চণ্ডী, কালী, বনবিবি, ষষ্ঠী, মনসা, শিব এইরকম কয়েকজন গ্রাম-দেবদেবী। অ্যাখনো ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, ধামরাই সহ কিছু কিছু অঞ্চলে ‘নিশকাইন্দা’ নামক গ্রাম-অপদেবতা’র পূজা হয়।
আর সুন্দরবন অঞ্চলের দেবী বনবিবি’র কথা তো সবারই জানা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে বগুড়া অঞ্চলের সন্যাসী’র থানের উল্লেখ আছে।
ধ্বজা পূজা : ‘ধ্বজা’ অর্থ পতাকা, নিশান। এখানে ‘ধ্বজা’ বলতে প্রাচীন বাঙলায় ভিন্ন ভিন্ন কোম ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ভিন্ন ভিন্ন পশু-পাখি ও পৌরাণিক প্রাণী বোঝানো হয়েছে। কোম ও গোষ্ঠীগুলোতে গরুড়ধ্বজা, মীনধ্বজা, ইন্দ্রধ্বজা, ময়ূরধ্বজা, কপিধ্বজা, সিংহধ্বজা, হংসধ্বজা, নন্দীধ্বজা, পেঁচকধ্বজা, মকরধ্বজা ইত্যাদি ধ্বজা পূজা প্রচলিত ছিল।
মীন, গরুড়, ময়ূর, সিংহ, হাঁস, পেঁচা সেইসব কোম অথবা গোষ্ঠীর প্রতীক হিশেবে ব্যবহৃত হতো। আর কোম অথবা গোষ্ঠীর যিনি নেতা তিনি মীনধ্বজ, পেঁচকধ্বজ, হংসধ্বজ , সিংহধ্বজ, মকরধ্বজ ইত্যাদি নামে পরিচিত হতেন। সময়ের পরিবর্তনে ধ্বজা পূজা হারিয়ে গ্যালেও ‘ধ্বজা’ হারিয়ে যায়নি, বরং মূল স্রোতে মিশে গিয়েছিল বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন হিশেবে। য্যামন কার্তিকের বাহন ময়ূর, বিষ্ণুর বাহন গরুড়, শিবের বাহন নন্দী, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, স্বরস্বতীর বাহন হাঁস, গঙ্গার বাহন মকর ইত্যাদি। আলাদাভাবে আজও ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে ‘থান’ এর সাথে ধ্বজা পূজা হয়।
ব্রতোৎসব : প্রাচীন ও বর্তমান বাঙলা এবং বিহার, উড়িষ্যা, আসামের একটি বড়ো স্থান অধিকার করে আছে ব্রতোৎসব। আর্য-ব্রাহ্মণেরা যাদের ‘ব্রাত্য’ বলে গণ্য করতেন তাদের নিজস্ব যেই উৎসব ছিল সেগুলোই ব্রতোৎসব। আবার এও বলা হয় ‘ব্রত’ শব্দটির অর্থ আবৃত করা, সীমা টেনে পৃথক করা। ব্রতোৎসবের অন্তর্গত উৎসব বা অনুষ্ঠানগুলো যাদুশক্তির বিশ্বাস প্রচ্ছন্ন, বিশ্বাস করা হয় নির্দিষ্ট কিছু মন্ত্র পড়ে অথবা আঙ্গুল ছুঁইয়ে-ঠেকিয়ে, ব্যক্তির চারপাশে ঘুরে তাকে অপশক্তির প্রভাবমূক্ত রাখা যায়। মূলত ব্রতোৎসব নারীদের অনুষ্ঠান, পুরুষের অংশগ্রহণ ত্যামন একটা দ্যাখা যায় না।
এই উৎসবের ব্রতগুলো কালভিত্তিক ছিল, য্যামন :
বৈশাখ : পুণ্যপুকুরব্রত (বৃষ্টি’র জন্য অদৃশ্য শক্তির পূজা), শিবপূজা (প্রজনন শক্তির পূজা), গোকালব্রত (গৃহপালিত পশুর প্রজনন সংক্রান্ত)। কৃষি সংক্রান্ত বেশ কিছু ব্রত প্রচলিত ছিল য্যামন অশ্বত্থপটব্রত, মধুসংক্রান্তি ব্রত, সন্ধ্যামণি ব্রত, বসুন্ধরা ব্রত ইত্যাদি।
জৈষ্ঠ : জয়মঙ্গলের ব্রত (প্রজনন শক্তির পূজা)
ভাদ্র : ভাদুরি ব্রত ও তিলকুজারি ব্রত (কৃষি সংক্রান্ত)
কার্তিক : কুলকুলটি ব্রত, ইতুপূজা ব্রত (প্রজনন শক্তির)
অগ্রহায়ণ : যমপুকুর ব্রত ও তুষতুষলি ব্রত (কৃষিসংক্রান্ত ও গৃহপালিত পশুর প্রজনন শক্তির)
মাঘ : তারণ ব্রত ও মাঘমণ্ডল ব্রত (গৃহপালিত পশুর প্রজনন শক্তির)
ফাল্গুন : ইতুকুমার ব্রত, সসপাতা ব্রত (গৃহপালিত পশুর প্রজনন শক্তির)
চৈত্র : নখছুটের ব্রত
এছাড়াও আরও কয়েকশ ব্রত আছে তিথি-নক্ষত্র ভিত্তিক। মঙ্গলকাব্য হতে উদ্ভুত মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদিও ব্রতোৎসবের অন্তর্গত ছিল।
কামমহোৎসব : প্রাচীন বাঙলার কৃষিসমাজে এক উৎসবের প্রচলন ছিল যেখানে শস্যের ভালো উৎপাদন কামনায় যৌনলীলাময় নাচ ও গানের সাথে মদন ও রতি দেবীর পূজা এবং নরবলি দেয়া হতো।
কালের পরিবর্তনে এই উৎসবের সাথে হোমযজ্ঞ মিলেমিশে নরবলির পরিবর্তে পশুবলির প্রথা শুরু হয় এবং যৌনলীলাময় নাচ ও গানের পাশাপাশি প্রচলিত কিছু ঘৃণার উক্তি, যৌন আবেদনপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি এবং নানান ব্যঞ্জনা যুক্ত হয়। কামমহোৎসব নামক এই উৎসবটি সংঘটিত হতো চৈত্র মাসের প্রচণ্ড রৌদ্রে অশোক বৃক্ষের নিচে অশোক ফুলের সুপ্রচুর বর্ষনকালে। এরপর ফাল্গুনের হোলী’র সাথে কামমহোৎসব মিশে যায় এবং আরও কিছুকাল পরে আবীর-কুমকুম খেলা ও রাঁধা-কৃষ্ণের ঝুলন উৎসবের সাথে মিলেমিশে এই উৎসবটি স্বকীয়তা হারায়। মুসলমান শাসকদের আগমনের ফলে ধর্মীয় কারনে উৎসবটি চিরতরে হারিয়ে যায়। বাৎস্যায়নের কামসূত্র, শ্রীকৃষ্ণের রত্নাবলী ও মালতীমাধব নাটকে এই উৎসবের উল্লেখ আছে।
চলবে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।