যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর। উইকিপিডিয়ার মতে ক্ষমতা শব্দটি ক্ষেত্র বিশেষে শক্তি, সামর্থ্য বা দক্ষতাকে নির্দেশ করে। পদার্থ বিজ্ঞানের পরিভাষায় একক সময়ে সম্পাদিত কাজের পরিমাণই ক্ষমতা। সাধারণ অর্থে কাজ হলো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো কিছু সম্পাদন করা।
সারাদিন একটি দেওয়ালকে শক্তি প্রদর্শন করে ধাক্কিয়ে নড়াতে না পারলে পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় এটি কোনো কাজ হবে না। অর্থাৎ কাজের পরিমাণ হবে শূন্য। তাই এক্ষেত্রে ক্ষমতার পরিমাণও শূন্য।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য পদার্থ বিজ্ঞানের ক্ষমতা নিয়ে নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা একটি বহুল চর্চিত বিষয়।
ঘরে, বাইরে, সংসদে, রাজপথে, থানা-আদালতে সর্বত্রই ক্ষমতার চর্চা চলছেই। ওমুক ব্যক্তি খুব ক্ষমতাবান- কথাটি যখন আমরা শুনি, আমাদের মনের মধ্যে উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কাল্পনিক একটি ধারণা জন্মে। হয় লোকটির প্রচুর টাকা আছে নয়তো লোকটির টাকা বানানোর মেকানিজম আছে। তাহলে ধরে নিতে পারি যে, টাকাই হচ্ছে লোকটির ক্ষমতার উৎস।
এখন আমরা ভাবতে পারি লোকটির টাকা বানানোর এই মেকানিজম কি? টাকা থাকলে ক্ষমতা আপনা আপনিই এসে যায়।
টাকা থাকলে সন্ত্রাসী বাহিনী পোষা যায়। টাকা থাকলে থানা-আদালত কিনে ফেলা যায়। টাকা থাকলে মন্ত্রী-আমলা পকেটে পোরা যায়। টাকা থাকলে জৌলুষ প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষকে ক্ষমতার দম্ভ দেখানো যায়। আর এরূপ ঘটতে থাকলেই আমরা বলি লোকটি বেশ ক্ষমতাবান।
কখনও কখনও শক্তি প্রদর্শন করে ক্ষমতা দেখানো যায়। যেমন একজন সন্ত্রাসী শক্তি প্রদর্শন করেই তার ক্ষমতা দেখায়। আবার রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনকারীও অনেক ক্ষমতাবান হয়। গায়ের জোরেও কেউ কেউ ক্ষমতা দেখিয়ে থাকেন। মুখ চালিয়ে ক্ষমতা দেখানোতেও অনেকে পারদর্শী হন।
কলম চালিয়েও কাউকে ক্ষমতাবান হতে দেখা যায়। যেমন অনেক পত্রিকার হলুদ সাংবাদিকতা এরকম উদাহরণ হতে পারে।
কখনো কখনো ক্ষমতার হ্রাসবৃদ্ধিও ঘটে থাকে। ক্ষমতা কমানো বাড়ানো নিয়েও অনেক মেকানিজম চলে সাধারণ আমজনতার চোখের সামনে। বুয়েটের ভিসি, প্রোভিসি ক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছেন শত প্রতিকূলতার মাঝেও।
তাদের ক্ষমতার খুঁটি মনে হয় অনেক বেশি শক্ত। ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতা খর্ব করে ব্যাংকটিকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে ক্ষমতার হ্রাস ঘটানোও একটি উদাহরণ হতে পারে। সংসদীয় কমিটি কর্তৃক দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার প্রচেষ্টাও ক্ষমতা হ্রাসের আরেকটি উদাহরণ। বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে সংসদ এখন উত্তাল। এটি একদিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম সংস্থার ক্ষমতা হ্রাস এবং অপরদিকে আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম উদাহরণ হতে পারে।
কারও ক্ষমতার উৎসের বিষয়টি অনুসন্ধানে আমরা উপহাস করে বলে থাকি 'ছাগল নাচে খুঁটির জোরে'। একটি ছাগলকে যখন দড়ির সাহায্যে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়, ছাগল দড়ির শেষ সীমা পর্যন্ত গিয়ে আর না যেতে পেরে লাফাতে থাকে। খুঁটিটি শক্ত করে মাটির গভীরে প্রোথিত থাকলেই ছাগলটি জোরে লাফাতে পারে। তাই খুঁটির শক্ত অবস্থানের সাথে ছাগলের শক্তি প্রদর্শনের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে। এরকম ক্ষমতাবান কোনো ব্যক্তির খুঁটির জোরও তার ক্ষমতার সামর্থ্যকেই নির্দেশ করে।
যার খুঁটি যত গভীরে প্রোথিত তার ক্ষমতাও তত বেশি। এটিই আমাদের কাছে চিরায়ত ধারণা।
এ কথা সত্য যে এরূপ আরোপিত ক্ষমতা কখনও চিরস্থায়ী হয় না। একসময় খুঁটিটি আলগা হয়ে গেলেই ছাগল লাফানো বন্ধ করে দিয়ে উদ্দেশ্যহীন দৌড়ুতে থাকে। তখন আর খুঁটিটি কোনো কাজে আসে না।
মাটির গভীর থেকে খুঁটিটি ওঠে গেলেই ছাগলের লাফানো নামক ক্ষমতারও সমাপ্তি ঘটে। হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদের ও খুঁটি উপড়ে গেছে।
তানভীর মাহমুদ একজন ঝানু লোক। তিনি বুঝতে পেরেছেন ক্ষমতার মূল নিয়ামক হচ্ছে অর্থ। এ অর্থ সংগ্রহে তিনি অভিনব এক উপায় বের করেছিলেন।
তা হচ্ছে অর্থের সরবরাহ স্থলে অর্থ ঢালা। যারা অর্থ সরবরাহ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত তারাই ছিল তানভীর মাহমুদের খুঁটি। এই খুঁটিগুলোকে তিনি প্রকৃত অর্থেই চিনতে পেরেছিলেন। তাইতো কাউকে দামী ব্রান্ডের গাড়ি, কাউকে নগদে বাড়ি দিয়ে কিনেছেন। আবার অনেককে গ্রহণকৃত ঋণ থেকে নগদ অর্থ দিয়ে কিনেছেন।
অর্থাৎ ব্যক্তি তানভীর মাহমুদও পরের ধনেই পোদ্দারী করে চার হাজার কোটি টাকা গ্রুপের নামে নিয়েছেন।
এমনিতেই ব্যাংক হচ্ছে পরের ধনে পোদ্দার। জনগণের পকেটের টাকা আমানত হিসেবে নিয়ে ব্যাংক পরের ধনে পোদ্দারী করে থাকে। সাধারণত ব্যাংকসমূহ একশ জনের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ করে এই অর্থ থেকেই আবার একজনকে ঋণ দেয়। তবে সাধারণ আমজনতা তাদের শত প্রয়োজনেও এই ঋণ পায় না।
এ ঋণ পায় খুঁটির জোর আছে এমন ব্যক্তিরাই। এই পরের ধনকে নিজের ধনে পরিণত করতে তানভীর মাহমুদের এই অভিনব পন্থা। ঋণগ্রহণ নামক এক জটিল মেকানিজম তিনি সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব কৌশলে। ঋণ প্রদানের খুঁটিগুলোকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন নিজস্ব কারিশমায়।
রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা হলমার্কের এই মেকানিজমে সহায়তা করেছেন।
অর্থাৎ তারা তানভীর মাহমুদের খুঁটির জোর হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু কোনো কারণে খুঁটিগুলো নড়বড়ে হয়ে যাওয়াতে তানভীর মাহমুদের মেকানিজম ধসে যায়। লেগে যায় ধুন্ধুমার কাণ্ড। পত্রিকাগুলো উঠেপড়ে লাগে এই কেলেংকারী ফাঁসে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেংকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে খুঁটির অপর প্রান্তের দড়িটি এখন তানভীর মাহমুদের গলায় ফাঁস হয়ে লেগে আছে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম ক্ষমতা দিয়ে। তানভীর মাহমুদ চার হাজার কোটি টাকার ক্ষমতাবান হয়েও এখন প্রায় ক্ষমতাহীন। যে দেশের মোট বাজেট এক লাখ কোটি টাকা তার পঁচিশ ভাগের এক ভাগ টাকা পকেটস্থ করার পরও অর্থমন্ত্রী বলেন যে, চার হাজার কোটি টাকা বড় অঙ্কের অর্থ নয়। তাহলে স্পষ্ট বুঝা যায় তানভীর মাহমুদের ক্ষমতার খুঁটি আরও গভীরে প্রোথিত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কৃপা কামনার জন্য পত্রিকায় উন্মুক্ত বিজ্ঞাপন দিয়ে শেষ খুঁটিটি ধরার প্রচেষ্টায় রত।
জানিনা শেষ পর্যন্ত তিনি খুঁটির জোরে টিকে থাকতে পারবেন কিনা। কিন্তু আমার মনে ক্ষমতা নিয়ে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তাহলে ক্ষমতা কি?
আসুন, জেনে নেই ক্ষমতা নিয়ে কতিপয় চিরন্তন বাণী। (নিচের এ অংশটুকু প্রথম আলো 'কথা অমৃত' থেকে সংগৃহীত)
'সে-ই সব থেকে শক্তিমান, যার ক্ষমতার উৎস তার নিজের মধ্যেই নিহিত'- সেনেকা (খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭-৫), রোমান কবি ও রাজনীতিবিদ।
'একজন বিশ্বাসীর ক্ষমতা ৯৯ জন স্বার্থবাদীর থেকে বেশি'- জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩), ব্রিটিশ সমাজ দার্শনিক।
'ক্ষমতা অর্জনের গোপন চাবিকাঠি হলো সামর্থ্য থেকে বেশি পারার চেষ্টা না করা'- হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬), নরওয়েজীয় নাট্যকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।