দ্যাখো, গল্পের শুরুতেই যদি একটি মৃত দোয়েলের চোখের নিস্পন্দে বাঁধা পড়ে যাও; তবে ধরে নেয়া যায় গল্প হিসাবে এটি নেহায়েতই ব্যর্থ। একটি "দোয়েল" যেটি আবার "মৃত" এবং তার চোখের "স্থিরতা" পাঠককে কিছু আগাম খোরাকি দিয়ে দিলে লেখকের আর কী'ই বা করার থাকে!
এই অবলা পাখিটি আমার মগজে ফসিল হয়েছে সেই কবে! কালে ভদ্রে মধ্যদিনের তাপ তরংগে শৈশবের লেবু বাগানের সবুজ থেকে সকরুন শিষ উড়ে আসে ছুরির মতো। সেই বালক বেলায় ঐ মৃত দোয়েলের চোখে টুপ করে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই চোখের অতলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে পুলক বোধ হয়েছিল আমার, অনেকটা স্বমেহনের প্রথম পাঠের মতো। কতো দৃশ্য, রোদ, বিস্ময়, আনন্দ আর ভয়ের প্রতিফলন ছিল সেখানে! প্রতিটি সিঁড়ির ধাপে আমি চেখে দেখেছিলাম সেই দৃশ্য-শিকারী চোখের স্যুভনির।
ভাবতে পারো মরা পাখির চোখ নিয়ে কেন পড়লাম, যেখানে চিন্তা-আলোচনা-তর্কের জন্য বিষয়ের অভাব আছে পৃথিবীতে? কিন্ত ভাবো তো, সব প্রানীর অমোঘ গন্তব্য কী মৃত্য নয়? পাখিটি হয়তো কারো গুলতির নিশানা ছিল অথবা তার ছিল দুরতম কোন অসুখ। আমি ওকে পেয়েছিলাম বাড়ির পেছনে তরুন দুর্বার বুকের ঝাঁপিতে। কোঁকড়ানো দু'পা, একটু ফাঁক হয়ে থাকা মৃত্তিকাগন্ধি ঠোঁট আর খোলা চোখের স্থিরতা নিয়ে একঠায় তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমি হাঁটু গেড়ে বসেছিলাম ওর পাশটায়। ততক্ষনে হানাদার পিঁপড়ের ক্যারাভান ওর ধুসর-কালো-নরম বুকের চড়াই বেয়ে উঠে গেছে চোখের পাড়ে, আমি খুব সন্তর্পনে পিঁপড়ের দখল মুক্ত করে দেখি; ওর চোখ দুটো তখনো টলটলে।
জানো, ঠিক ঐ মুহুর্তে আমি আর ছোট্টটি থাকলাম না। ঐ জলমগ্ন কিন্ত নিথর চোখে ডুবে যেতে যেতে আমি নিজেকে অপরিচিত হয়ে উঠতে দেখছিলাম। তারপর খুব দ্রুতই শুকিয়ে এলো জল এবং আমি জীবন-মৃত্যর সংযোগ সেতুর ঠিক মাঝখানটায় অপ্রস্তত এবং অনাহুতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর জেনেছিলাম, একটা মুহুর্তের কণা কিভাবে অনন্তের কাছে বাঁধা পড়ে! তুমি জীবিত কোন চোখের দিকে সারা জীবন তাকিয়ে থেকেও সেই সিঁড়িটার হদিস পাবে না। কী মোহন মায়াবী আর দম আটকানো ভয়ের ধাপ ঐ সিঁড়ির! প্রতিটি ধাপে ধাপে কতো আবিস্কারের প্রহেলিকা! তবে খুব তাড়া থাকতে হবে তোমার, কারন মৃত্যপরবর্তি ওমের ঝাঁজ কমে এলেই মিলিয়ে যাবে চোখের অতলে জমে থাকা রত্নরাজি।
প্রথমে তোমার ভয় পাবে। অপার্থিব, স্নিগ্ধ নরম ভয়। এক পা দু'পা করে নেমে যাও আর সময়ের খোসা ছড়াতে ছড়াতে কেন্দ্রের নাভির কাছে পৌঁছে যাও; যতক্ষন চোখের টলোমলো'টা স্থির থাকে। জানো, এরপরে আমি অনেক চেস্টা করেছি জীবিত কারো চোখে নেমে যেতে কিন্তু পারিনি। জীবিত চোখ বড় বেশি কৌশলি, তুমি থই পাবে না সেখানে বা পাবে না সিঁড়ি ঘরের চাবি।
এখন আমি জানি, প্রায় প্রতিটি মানুষই তার কাছে-পিঠের সব জীবন্ত চোখের তারায় যা কিছুর প্রতিফলন দেখে, আদতে তা আসলে সে যা অবচেতনে দেখতে চায়- তাই। এইযে সারাটা জীবন তুমি কতো-শতো সম্পর্কের বা নির্দিস্ট করে বললে অভ্যস্ততার-নিয়মের দায় বয়ে বেড়াও, প্রকৃতির চক্র পুরনে ও চালনে নিবিস্ট থাকো, এর মাঝে আয়নায় কখনো নিজের চোখের দিকে তাকানোর ফুরসত মেলে?
সে কথা থাক। এরপর মানে ঐ দোয়েলটির পর অনেক অনেক দিন আমি কোন মৃত চোখের হদিস পাইনি। একদিন বৃস্টির মাদলে ইশ্কুল মাঠে থ্যাঁতলানো মাটি আর বুড়ো দুর্বাদের পুনর্জন্ম হলে আমরা দলবেধে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলাম। বেয়াড়া বলটা কারো পায়ের কেরামতিতে নলিনী কাকুদের ভিটের পেছনে লুকিয়ে পড়েছিল।
দেয়াল ওপাশে নলীনি কাকুদের জংগুলে বাগানটা বৃস্টির বড়ো বড়ো ফোঁটার আদরে সবুজতর হয়ে উঠছিল। আর প্রাচীন আম গাছটার নিচে বলটা খুব সাদা দেখাচ্ছিল। বলটা কুড়িয়ে মাথা উঁচু করতেই দেখলাম গলায় ফাঁস দেওয়া মালতি'দী দুলছে এপাশ-ওপাশ। তুমুল বৃস্টিতেও বুঁজে নেয় বিস্ফরিত চোখ দুটো। এবং আমি দেখেছিলাম ঐ বিস্ফরিত খোলা চোখের টলমলোতে একটু অস্ফুট এবং অসম্পুর্ন জীবনের হামাগুড়ি।
সেই হামাগুড়ির পেছনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতেই আমি দেখেছিলাম হাসান ভাইয়ের দেবদুতের মতো হাসির ঢেউ, সেই ঢেউয়ে ভেংগে পড়া মালতি"দী, নলিনী কাকুর পান্ডুর মুখ, আমাদের ছোট্ট মফস্বলের মানুষগুলোর বদলে যাওয়া মুখের মানচিত্র, সীমান্তের ওপারে একটানা ঘন্টির গান। তুমুল বৃস্টি-বিদ্ধ আমি সেদিন জেনছিলাম একটি মৃত দোয়েল আর মানুষের চোখের শুন্যতার অনুবাদের ফারাক কতোটা অসমো!
জানো, চারপাশের জীবিত সবকিছুই একদিন তোমার হাতে চোখের সিঁড়ি ঘরের চাবি ধরিয়ে চলে যাবে কোথাও। খুব কাছের কেউ চলে গেলে তোমার মনে হবে, প্রগাঢ় বিষাদের ঘুর্নিতে তারা সয়ম্ভু হোক, ফিরে আসুক যে কোনও ভাবে, নিস্পন্দ চোখের টলোমলো বিস্ফরিত হোক, চোখের সিঁড়ি ঘরে তালা পড়ুক অনন্ত কালের জন্য। কিন্ত সাবার কী তাই হয়? সেই দোয়েলটির পর মালতি"দী, এরপর কাছের-দুরের অনেকে। কিন্তু আমি সেই বিধ্বংসি বিষাদের ঘুর্নিতে পড়ি নি কখনোই।
আমি শুধু চেয়েছি তাদের চোখের অতলে ডুব দিতে। নিজ আত্তজার কন্ঠনালী ছিন্ন করে হননের গান কীভাবে গাইতে পারে একজন বাবা? এবং অবলিলায় কীটনাশকের কীর্তিতে মুদ্রিত হয় সফেদ ফ্যানা? এর উত্তর আমি জানি। নিয়ামতপুরের ঔ বাবা-মেয়ের নিস্পন্দ চোখ এতো তিব্র টেনে নিয়েছিল আমায়! ক্ষুধা-অক্ষম ক্রোধ-পাশবিক বিপন্নতার অসংখ্য কোলাজ এবং সবশেষে টুটি-চেপা ভয়ের প্রতিফলন লেপটে ছিল সেখানে। নিয়ামতপুরের ঔ বাবার-মেয়ের মৃত চোখ ভ্রমনের অনেক অনেক দিন পরে আমি নীরাকে বলেছিলাম সে কথা। কোন এক অসফল সংগমের গ্লানি আর অবসাদের মধ্যবর্তি সময়ে আচমকা মৃত চোখে এইসব আবিস্কারের ঘটনা নীরার কাছে অসুস্থতা মনে হয়েছিল।
প্রায়ান্ধকার ঘরটায় আমাদের নগ্নতাকে আড়াল করে নীরার নরম এবং বড়ো বড়ো চোখ দুটো কুঁচকে উঠলেও আমি নির্বিকার ছিলাম।
"আর কিছু পেলে না বলার মতো? গা গুলাচ্ছে আমার!"
আমি নীরাকে দেখছিলাম অথবা ওর ভেতর ফেনিয়ে ওঠা বিবষিমা। সম্পর্কের এ্যাতো দিনেও কোন পরিনতি বা তার সম্ভাবনা না দেখায় আমরা দুজনেই ছিলাম ক্লান্ত, এমন কি এই যে এতোদিন পর পর নিজেদের শরীর খোঁড়ার সুযোগ পাই আমরা, সেটাও শীতল হয়ে গেছে, হয়ত অসাড়ও। ক্লান্তিকর অভ্যস্ততার ফাঁদে একমাত্র ব্যাতিক্রম ছিল নীরার নরম-বড়ো বড়ো চোখ।
"জানো, দোয়েলের চোখের সাথে তোমার মিল আছে অনেক?"
"এই যে আমার সাথে শুচ্ছ এভাবে, খারাপ লাগে না তোমার?"
নীরা মধ্যে কি সংশয় ছিল; দোয়েল পাখিও হতে পারে বা ঢাকায় ছবি দ্বিতীয় সারির নায়িকাও? একটা সময় ছিল আমি অনেক দুর থেকে নীরার মিস্টি গন্ধটা পেতাম।
নীরা এখন ঘ্রানহীন, হয়ত আমিও নীরার নিটোল নাকের সুড়ংয়ে পরিত্যক্ত হয়ে গেছি। একসময় সব কিছুই ফিকে হয়ে যায়!
"শোন, মরা মানুষের চোখে এ্যাতো কিছু দেখা লাগবে না তোমার। আয়নায় নিজের চোখ দেখে কিছু বোঝ না?"
নীরার নরম-বড়ো বড়ো চোখে প্রতিটা সঘন চুম্বনের সাথে তলিয়ে যেতে চেয়েছি কতো। পারিনি একবারো। ওতো মৃত নয়।
আমি ওকে বলেছিলাম আমার দেখা প্রতিটি মৃত চোখের মিউজিয়ামে কী কী জমে থাকে, প্রতিটি উপাদান ভিন্ন হলেও সবকিছুর বিন্যাসে কী অদ্ভুত সাদৃশ্যতা! এই চিরন্তন বিষয়টির আবিস্কার এতটা আয়াস সাধ্য ছিলনা একদমই। আমার বন্ধু নুরুলকে আমার মনে হয়েছিল সবার'চে আলাদা। ওর চোখ ছিল ছায়াহীন, কোনকিছুই প্রতিফলিত হতো সেখানে। তেতালার ছাদের কার্নিশ থেকে পড়ে বাঁ-হাত ভেংগে গেলেও ওর চোখ একটু কুঁচকে ওঠে নি। তোমাদের কী মনে হয় না, এমন দুর্লভ চোখের অতলে ডুব দিয়ে দেখা উচিৎ ছিল আমার? কিন্তু জীবিত নুরুলের চোখের তল কীভাবে পাবে তুমি? তরতাজা তরুন একজন ছেলে হুট করে মরে গিয়ে তোমার সুবিধা করে দেবে, এমনটা ভাবাও তো বোকামি; নয়কি? ফলে আমাকে কৌশলি হতে হয়েছিল এবং অবশেষে আমি জেনছিলাম আর সবার মতোই নুরুলের চোখও দুর্জ্ঞেয় নয়! আমি নীরাকে বলিনি নুরুলের কথা, যেমন বলিনি আমার পোষা বেড়াল বুলুর চোখে অবিশ্বাসের ঘুর্নির কথা, চলনবিলের তলদেশে শ্যাওলাময় মেয়েটির মৎস্যদেবী হয়ে যাওয়ার কথা।
এবং আমি নীরাকেও কখনো বলিনি ওর নরম-বড়ো বড়ো চোখের এই অবসাদ আর নিস্পৃহতার কথা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।