আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ আলি আজগরের পোষা বাঘ



মিরপুর ১০ এর গোলকধাঁধার লেজ বা পেট যেকোন একটার সাথে ঝুলে থাকা বাড়ির কোন ঘরে একটা বাঘ বাস করছে, ঢাকা শহরের নিরিখে বিষয়টা দুঃস্বপ্নেরও অধিক কিছু মনে হতে পারে, বা অনেকে এটাকে মেনি বেড়ালের সাথে গুলিয়েও ফেলতে পারে। কিন্ত আলি আজগর, যিনি মেরুদন্ডের নম্রতা হেতু সবসময় মাথা নিচু করেই জীবনের ৫০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন, যিনি নামের শেষে দৌড়ে চলা আলিকে মুল নামের আগে বেকায়দায় বসিয়ে নিজেকে কিছুটা উত্তরন করেছেন বলে অনেক আগে আত্মপ্রসাদে ভুগতেন, তিনি এক আস্ত রয়েল বেংগল টাইগারের মালিক হয়ে দিব্যি মিরপুরের গোলধাঁধায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আলি আজগরের দুকামরার বাসায় যেখানে মুখরা বউ ও এক বেকার ছেলে ও এক সোমত্ত মেয়ে নিয়ে কোনরকমে অনড় দিন গুলোকে ঠেলে গুতিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন, সেখানে একটি বাঘ যোগ হলে যেমনটা হওয়ার কথা ছিল তেমনটা হয় না। রোজকার মতো আলি আজগর সকাল সকাল ঘুম থেকে নিজেকে টেনে তুলে বাথরুমে ঢুকে পানি না পেয়ে ভাগ্যকে অভিসম্পাত করছিলেন এবং কোনরকমে নিজেকে সারাদিনের একঘেয়ে পিড়নের জন্য তৈরী করে বেরুতে যাবেন, এমন সময় তার মেয়েটি ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে তার সামনে দাঁড়ালে আলি আজগর তার বাঁ হাতের সাথে ঝুলে থাকা বহু পুরনো ঘড়ির কাঁটার দিকে আতংকে তাকান এবং মিরপুর থেকে মহাখালির দুরত্তটাকে তার কাছে অনতিক্রম্য মনে হতে থাকে। "বাবা, আমি তো আর কলেজে যেতে পারবো না।

পাড়ার ছেলেগুলো খুব বিরক্ত করতেছে। কালকে কলেজ থেকে আসার সময় আমার ওড়না ধরে টান দিছে। " মেয়েটার মুখ নিচু হতে হতে প্রায় শুন্য হয়ে যেতে থাকলে আলি আজগর বলে ওঠেন, "চিন্তা কইরো না মা, আমি দেখতেছি। " বলে আলি আজগর বেরিয়ে আসেন। গলিটা যেখানে ছিটকে রাস্তায় পড়েছে তার পাশে চা'র দোকানে পাড়ার বখাটে গুলোকে দেখে তিনি মাথা নিচু করে চলে যান এবং তার নিচু হয়ে যাওয়া মাথার সাথে বাড়ি খায় সোমত্ত মেয়েটার প্রায় শুন্য নত মুখ।

আলি আজগর মেয়েটার শুন্য মুখ নিয়ে বাসে উঠতে চাইলে যাত্রিদের অনেকেই তাকে মাড়িয়ে আগে উঠে পড়ে আর মহাখালি তার কাছে ক্রমশ আবছা হতে থাকে আর এই অস্পস্টতার সাথে বাড়তে থাকে তার কন্ঠায় উদ্বেগের ওঠানামা। আলি আজগর কোন রকমে নিজেকে ঠেলেঠুলে বাসে উঠিয়ে টের পান তার হাত থেকে টিকেটটা কোন ফাঁকে পড়ে গেছে এবং এতক্ষনে হ্য়ত কারো জুতো বা স্যান্ডেলের নিচে কুঁকড়ে মুকড়ে বাতিলের অপেক্ষায় ধুঁকছে। পুরোটা পথ আলি আজগরের কাছে আতংকের হীম সাপ হয়ে মেরুদন্ডের আশপাশে ঘুরফির করে এর মাঝে মেয়েটার প্রায় শুন্য মুখ যোগ হলে আলি আজগরের আর কিছুই করার থাকে না। মহাখালি ডিওএইচএস এর হা করা মুখের কাছে আলি আজগর আর সবার সাথে নিক্ষিপ্ত হন। ১৯ নম্বর রোডতক হেঁটে যেতে যেতে আলি আজগরের পাতলা হয়ে আসা চাঁদির উপর জুলাইয়ের তুখোড় রোদ ছিটকে পড়ে গলে গলে পড়ছে।

রিকশা ভাড়ার বিলাসিতা নাকি দেরি করে বড় স্যারের ঝাড়ি এই ডিলেমায় ঘুরপাক খেতে খেতে আলি আজগর দেখেন তার মুখরা বউ জুলাইয়ের তুখোড় রোদের সাথে আঁতাত করে তার বেকার ছেলে ও সোমত্ত মেয়ের অনুজ্জল ভবিস্যতের দায়ভার তার সরু কাঁধে চাপিয়ে ১৯ নম্বর রোড পর্যন্ত উড়ে বেড়াচ্ছে। তার ওড়াওড়ির অনুসংগ হিসাবে মেয়েটার প্রায় শুন্য মুখ আর পাড়ার বখাটে ছেলে গুলোও তৎপর খুব। তো এসবের সাথে বাঘের সম্পর্ক এখন পর্যন্ত স্পস্ট হয় না বরং দীর্ঘায়িত হয়ে বিবিধ জটিলতার জন্ম দেয়। আলি আজগর সিঁড়ি ভেংগে ৪ তলায় অফিসে পৌছে দেখেন বিদ্যুৎ নেই, জুলাইয়ের চিড়বিড়ানি গরমকে ভেংচি কেটে এসিগুলো বন্ধ। ফ্রেশরুমের কাছাকাছি এক কোনায় তার ডেস্কে বসে কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে আলি আজগর প্রতিদিনের মনোটনাস অ্যাসাইনমেন্ট হাতড়াতে থাকেন।

ফকিরাপুল হয়ে জুরাইন ঘুরে মানি রিসিপ্ট এর তোড়া কতটুকু হালকা করতে পারবেন এই সংক্রান্ত চিন্তায় ছেদ পড়ে যখন প্রায় তার বেকার ছেলের বয়সি তরুন কলিগ ফ্রেশরুম থেকে প্যান্টের আধখোলা চেইন লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে আসে এবং বলে, "আজগর ভাই এমন অজগরের মতো ঝিম মেরে আছেন ক্যান? কোন মুরগী পাইছেন নাকি?" আলি আজগরের মুখটা তেতো হয়ে যায়। ঢোক গিলে তেতো ভাবটা গিলে ফেলতে চাইলে আলি আজগর দেখেন তার মোবাইলটা ফোনের বেয়াড়া রিংটোনের সাথে তার মুখরা বউ তেড়েফুড়ে আসছে। আলি আজগরের আর তেতো ভাবটা গেলা হয় না বরং তা আরো ঘনিভুত হয়ে জিভ এবং টাকরার মাঝে জমাট বাঁধতে থাকে। ফোনের ওপাশে আলি আজগর তার বউকে চিনতে পারেন না, তার মুখরা বউ ভেংগে পড়তে পড়তে তার কানে ছড়িয়ে পড়লে তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। "আরে কি হইছে বলো না ক্যানো? কানতেছো ক্যান তুমি? বাবুর কি হইছে? ক্লিনিকে ক্যান?" আলি আজগরের বিরতিহীন প্রশ্নে তার বউ আরো ভেংগে-চুরে তলিয়ে যান এবং এরপর আলি আজগরের তড়িঘড়ি করে দৌড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

তিনি অফিসের নিচে রাস্তায় দৌড়াতে থাকেন একটা সিএনজি ধরার জন্য কিন্তু জুলাইয়ের তুখোড় রোদে সবকিছুই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সিএনজি গুলো আলি আজগরকে টপকে বা মাড়িয়ে বা থেঁতলে চলে যায় এবং তিনি অসহায়ত্তে ছোট হতে থাকেন। ছোট হতে হতে আলি আজগর যখন রাস্তার ধুলো-বালি-কাঁকরে মিশে যাচ্ছিলেন তখন বাঘটিকে দেখতে পেলেন। মহাখালি ডিওএইচএস এর ১৯ নম্বর রাস্তায় হলদের ওপর কালো ডোরাকাটা আস্ত একটি বাঘ থাবা মেলে বসে আছে, উদ্ভ্রান্ত আলি আজগরের চোখে সেটা পুর্নতা পাওয়ার আগেই মস্তিস্কের কোথাও দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন করে ওঠে। থাবা মেলে বসে থাকা বাঘ এবং ছোট হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া আলি আজগর নিজের মধ্যে বাস্তব অবস্থা হিসেব করার আগেই একটা হলুদ ক্যাবের সামনে আছড়ে পড়েন এবং নিজেকে ক্যাবের ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে ড্রাইভারকে কী বলেন সেটার তর্জমা তার নিজের কাছেও পৌঁছায় না।

শুধু মোবাইল বেয়ে তার মুখরা বউয়ের ভেংগে-চুরে পড়ে যাওয়া, সোমত্ত মেয়েটার ক্রমশ শুন্য মুখ, বেকার ছেলে আর অনিবার্য অনুসংগের মতো ক্লিনিক- এগুলো জোড়াতালি দিয়ে আলি আজগরের মধ্যে ঘনিয়ে উঠে বিস্ফারিত হতে চায়। তিনি দেখেন ঢাকা শহরের তাবৎ গাড়ি-বাস-সিএনজি-মানুষ কে যেন মহাখালি টু মিরপুর রুটে ঢেলে দিয়ে রাস্তাটাকে দুর্জ্ঞেয় করে দিয়েছে। আলি আজগর ভারি নিঃশ্বাষের শব্দে পেছনে চাইলে দেখেন ব্যাক সিটের পুরোটা জুড়ে বাঘটা বসে আছে দুই থাবায় মুখ গুঁজে। রাস্তার গাড়িগুলো গেঁথে গেছে। প্রোথিত গাড়িগুলোর ক্রমবর্ধমান শিঁকড় তার পাঁজরে ঢুকে পড়ে বিস্তৃত হতে চাইলে তিনি ক্যাব থেকে নেমে পড়েন এবং সামনের গাড়ির পশ্চাৎদ্দেশে কষে লাথি লাগিয়ে চিৎকার করতে থাকেন এবং যে কাজটা তিনি কখনো করেন নি এবং করবেন ভাবেননি! আলি আজগর মিরপুর ১০ এর কোন এক ক্লিনিকে তার বেকার ছেলেটাকে পড়ে থাকতে দেখেন।

ছেলের পেটে বাঁধা ব্যান্ডেজ উপচানো রক্ত এবং বউয়ের চোখে জমাট বাধা রক্তের মধ্যে তিনি কোন পার্থক্য করতে পারেন না এমনকি তার মেয়ের অস্পস্ট মুখটাকেও তার রক্তাক্ত মনে হয়। মোবাইলে প্রবাহিত হওয়ার সময় আলি আজগরের বউ এর কন্ঠ যতটা ভংগুর ছিল এখন আলি আজগরকে পেয়ে সেটা আবার জোড়াতালি দিয়ে ফিরে আসতে চায়। "আমার ছেলেটা কী করসে? তারে ক্যান চাকু মারলো?" কান্নার চড়াই উৎরাই বেয়ে বাক্যটা কোন রকমে আলি আজগরের কাছে পৌঁছালে তার বউ ফের ভেংগে পড়েন। আলি আজগরের সোমত্ত মেয়ে তার ক্রমশ শুন্য হতে থাকা মুখ নিয়ে বাবাকে জানায় পাড়ার ছেলেগুলো, যারা তার ওড়না ধরে টেনেছিল তারা ভাইকে ছুরি মেরেছে। আলি আজগর দেখেন ক্লিনিকের করিডরে বাঘটা অলস হাঁটছে, মাঝে মাঝে অবজ্ঞা নিয়ে দেখছে চারপাশ।

ছেলের পেট উপচানো রক্তে নিজেকে ভাসতে দিয়ে আলি আজগর করিডরে বেরিয়ে আসেন এবং তিনি টের পান তার তলপেটের একটু উপরে একটা ছুরি হাজারটা মুখ নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। তো এরপর, আলি আজগরের বা বাঘটির বা এই দুয়ের সমান্তরালে কোন ঘটনা ঘটে না বা ঘটলেও কোন কার্যকারন কারো কাছে স্পস্ট হয়না। সুতরাং আলি আজগরের সাথে বাঘের সম্পর্ক ঘোলাটেই থেকে যায়। তার প্রতিদিনের জীবনধারনে তেমন কোন পরিবর্তন চোখে না পড়লেও মিরপুর টু মহাখালি, মানি রিসিপ্ট হাতে ফকিরাপুল-জুরাইন-পল্টনে ঘুরাঘুরির সময় হঠাৎ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া বা কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া আলি আজগরের মুখরা বউ, বেকার ছেলে আর সোমত্ত মেয়ের চোখে খচখচ করে। আলি আজগর প্রতিদিন বাসা থেকে বাঘটিকে সাথে নিয়ে বের হন।

তার ছেলের পেটে ছুরি মারা ছেলেগুলো গলির শেষ মাথায় সিগারেট ফোঁকে, ওদের পাশ দিয়ে বাঘটা চলে যায়। লোকাল বাসে আলি আজগরের পা ঘেঁসে বাঘটা বসে থাকে, ভাড়া নিয়ে ঝগড়ারত কন্ডাক্টর আর যাত্রিদের মাঝে লেজ নাচিয়ে বাঘটা তার মুখের দিকে তাকায়, আলি আজগরের চোখে কোন কম্পন নেই। এমনকি মহাখালি ডিওএইচএস এর রাস্তায় জুলাইয়ের তুখোড় রোদে কুন্ডলি খোলা রাস্তাতেও আলি আজগর নিঃশ্চুপ থাকেন। বাঘটির সাথে তার কোন কথা হয় না, বরং এ পর্যায়ে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা সংশয়ের ক্ষেত্র তৈরী হয়। বাঘটা অফিসের ফ্রেশরুমের সামনে আলি আজগরের ডেস্কের পাশে থাবা খুলে নখের পরিচর্যা করে, এমনকি আলি আজগরের বেকার ছেলের বয়সি জুনিয়র কলিগ আলি আজগরকে অশ্লিল কৌতুক শোনালেও বাঘটির নখের পরিচর্যায় কোন ছেদ পড়ে না।

ছেলের পেটের হাজার মুখ নিয়ে ঢুকে যাওয়া ছুরি যখন আলি আজগরের তলপেটের একটু উপরে স্থায়ি হতে চায় বা তার সোমত্ত মেয়ের মুখটা ক্রমশ শুন্য হতে হতে ঝুলে যায় তখন আলি আজগর বাঘটির দিকে তাকান। বাঘের চামড়ার নিচে ধাবমান পেশির নিচে ঘুমন্ত শক্তি দেখেন, হা করা মুখে স্বদন্তের ঝলকানি দেখেন, থাবার ভেতর ফুটতে চাওয়া নখ দেখেন এবং সবশেষে আবার স্থবিরতায় ডুবে যান। বাঘটা লম্বা হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর আলি আজগর মহাখালি ডিওএইচএস এর ১৯ নম্বর রাস্তায় যেখানে বাঘটিকে প্রথম দেখেছিলেন সেখানটায় বাঘটার সাথে প্রথম কথোপকথোনে জড়িয়ে পড়েন যদিও এতে করে তার সাথে বাঘটার সম্পর্কের যোগসুত্র আবিস্কৃত হয় না । "যেখান থেকে আসছো সেখানে চইলা যাও।

" বাঘটা নিরুত্তর থাকে। এমনকি লোকাল বাসে মানুষের ঘাম আর গন্ধে মাখামাখি হয়ে আলি আজগর চিৎকার করে ওঠেন, "তোকে যাইতে কইছি না? সুন্দরবনে গিয়া বান্দর খা গিয়া!" আবার কোন এক শুক্রবারের সন্ধ্যায় পরিবারের সাথে চা খাওয়ার সময় আলি আজগর হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন, "যা কইলাম বিলাইয়ের বাচ্চা বিলাই! নাইলে আমারে খা!" আলি আজগরের মুখরা বউ, বেকার ছেলে আর সোমত্ত মেয়ে তাদের সামনে আলি আজগরকে মোচড় খেতে দেখে, হলদে ঢেউয়ের ফাঁকে কালো ডোরাকাটায় আলি আজগর ঢুবতে ঢুবতে আবার ভেসে ওঠে, চকচকে স্বদন্তের মাঝে খসখসে জিভের লালা হয়ে গড়িয়ে পড়ে অথবা বাঁকানো নখে বুক চিরে কামড়ে ধরে মেঝেতে লাফাতে থাকা লেজ। তারা দেখে বাঘটা হাই তুলে মিরপুর ১০ এর গোলক ধাঁধায় ঢুকে পড়ছে উদ্দেশ্যহীন। গল্পটি ছোটকাগজ নিরিখে প্রকাশিত।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।