আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতিচারণঃ পালিয়ে গিয়ে বিয়ে, সিনেমা স্টাইল এবং অতঃপর ........!!!

আমি একাই পৃথিবী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম http://www.facebook.com/kalponikvalo ১. সময়টা তখন ২০০০ সাল। কলেজে পড়ি। আমার এক বন্ধু ছিল হাসিব। আমাদের ছিল কম্বাইন্ড স্কুল কলেজ।

ছেলে মেয়ে এক সাথে পড়তাম। তারুন্যের নিয়ম মেনে সে এক মেয়ে এর প্রেমে পড়ল। মেয়ে সবে মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। মেয়ের নাম তনিমা। তখন পর্যন্ত আমার মনে হত আমার চেয়ে নিচু ক্লাসের মেয়েদের সাথে আবার কিসের প্রেম, তারা তো ছোট।

তাই আমি খুব বেশি একটা উৎসাহ দেখাইনি। হাসিব বিরক্ত হয়েছিল। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়ে বন্ধুর মন রাখার জন্য আমাকে উৎসাহ দেখাতে হলো। স্কুলের বারান্দায়, কলেজের পিছনের মাঠে তাদের প্রেমপর্ব চলতে লাগল। প্রেমপর্ব মানে দু'টাকার বাদাম কিনে এক সাথে খাওয়া, কোন বই আদান প্রদান করা।

খুব বেশি হলে মাঝে মাঝে অসর্তকভাবে একটু হাতের ছোঁয়া। তবে বেশির ভাগ সময়ই প্রেমপর্ব ছিল বাদাম কেন্দ্রিক। বাদাম শেষ মানে হচ্ছে অলিখিত ভাবে দেখা করার সময়ও শেষ। একদিন এই দু'টাকার বাদাম একটু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেদিন বাদামওয়ালার উপর হাসিবের সেকি রাগ। আমার কাজ ছিল তাদেরকে দূর থেকে পাহারা দেয়া।

কোন বিপদ দেখা দিলে আমি সংকেত দিতাম। এটাই ছিল আমার দায়িত্ব। দেখতে দেখতে আমরা কলেজ পাশ করে ফেললাম। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পালা। একদিন হাসিবের বাসায় গেলাম, শুনলাম তার এক মামা অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন।

মামা অস্ট্রেলিয়ার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি হাসিবকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চান। তিনি হাসিবকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করবেন। প্রেমের কারনেই হোক আর বাবা মা বা বন্ধুবান্ধবকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এই কারনেই হোক হাসিবের অস্ট্রেলিয়ায় যাবার ব্যাপারে খুব বেশি একটা আগ্রহ ছিল না। হাসিবদের পরিবারে তার বাবা উপর কেউ কোন কথা বলেন না।

তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন, হাসিবকে অস্ট্রেলিয়াতে পাঠানো হবে। তখনকার সময় অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়া খুব বেশি একটা কঠিন ছিল না। মাস তিনেকের মধ্যে দেখলাম হাসিবের সব ফাইনাল হয়ে গেল। যাবার ডেটও ঠিক হয়ে গেল। মোটামুটি সবার থেকে বিদায় নেয়া হয়েছে।

শুধু তনিমা বাকি। স্কুল বন্ধ। সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। তনিমা নিজেও পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। তনিমাদের বাসা কিছুটা কনজাভেটিভ।

তনিমার বড় ভাই তনিমাকে স্যারের বাসায় কোচিং এর জন্য নিয়ে আসত আবার নিয়েও যেত। আমার দায়িত্ব পড়ল এ যুগলকে কিছুক্ষনের জন্য দেখা করানোর ব্যাবস্থা করা। এই বিশাল দায়িত্বে আমি কিছুটা সংকিত ছিলাম। যাই হোক অনেক কষ্ট করে স্যারের বাসার সিড়িতে দেখা করাবার ব্যবস্থা করলাম। ভেবেছিলাম খানিকটা আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

কিছু ডায়লগও ঠিক করে রেখেছিলাম কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে তারা কোন আবেগ ঘন পরিবেশ সৃষ্টি না করেই একে অপরকে বিদায় জানাল। হাসিব জানাল, আমার মাধ্যমে নাকি চিঠির আদান প্রদান হবে। আমাকে কষ্ট করে তাদের ডাক পিওনের কাজ করতে হবে। কি আর করা বন্ধুর সুখের কথা ভেবে রাজি হলাম। তার একদিন পরে হাসিব চলে গেল।

গলাগলি করে কেঁদে এয়ারপোর্টে গিয়ে আমরা তাকে বিদায় জানিয়ে আসলাম। এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। আমার ঠিকানায় প্রতি সাপ্তাহে ২টি চিঠি আসে। একটি আমার জন্য অন্যটি তনিমার জন্য। আমি চিঠি পৌছে দিয়ে আসি।

কিছুদিন পর তনিমার চিঠি আমি নিয়ে এসে পোষ্ট করে দিই। ইতিমধ্যে আমাদের বন্ধু মহলে হাসিব এবং তনিমা জুটি প্রেমের এক মাইল ফলক হিসেবে নির্বাচিত হল। একদিন চিঠি আদানপ্রদান করতে গিয়ে তনিমার ভাই এর হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে উত্যক্তকারী ভেবে কঠিন ঝাড়ি দিয়েছিলেন এবং ভবিষৎ এ এই ধরনের অপচেষ্টা করলে আমার ভয়াবহ পরিনতি সর্ম্পকে হুশিয়ার করলেন। ফলে কিছুদিন চিঠি চালাচালি বন্ধ ছিল।

এর কিছুদিন পর তনিমা ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হলো। ইন্টারনেটও সহজলভ্য হল। ফলে আমি এই ডাকপিয়নের চাকুরি থেকে মুক্তি পেলাম। ২. আমি তখন ভার্সিটি কেবল শেষ করেছি। একদিন হাসিব মোবাইলে ফোন দিয়ে বলল, আগামী রবিবার সে দেশে এ আসবে।

সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে সরাসরি সে তনিমার সাথে দেখা করতে যাবে। তারপর বাসায়। তাই আমি যেন এয়ারপোর্ট এ থাকি। যথারীতি এয়ারপোর্টে গেলাম হাসিবকে রিসিভ করতে।

অনেকদিন পর প্রিয়বন্ধুর দেখা পেয়ে কিছুটা আবেগী হয়ে পড়লাম আমরা দুজন। আমি তনিমার ইউর্নিভার্সিটির সামনে গিয়ে তনিমাকে ফোন দিয়ে বললাম দেখা করতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তনিমা এলো। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। বললাম তোমার জন্য একটা উপহার আছে।

পিছনে ফিরে দেখ। যে আবেগী বিদায়টি দেখার ইচ্ছা ছিল বছর তিনেক আগের কোন এক বিকেলে সেই আবেগঘন দৃশ্যটি হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আমি নিজে কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলাম। আশেপাশের সব ভুলে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমি দূরে সরে এলাম। হাসিব সে বার প্রায় দেড়মাস বাংলাদেশে ছিল।

এর মধ্যে দুই পরিবার তাদের সর্ম্পকে জেনে ফেলায় কিছুটা জটিলতা দেখা দিল। হাসিবের দেশের বাড়ি নোয়াখালী। আর তনিমার দেশের বাড়ি সিলেট। আমি যতদূর জানি এই অঞ্চলের মানুষরা সাধারনত নিজেদের অঞ্চলে বিয়ে দিতে বেশি পছন্দ করেন। হাসিবও পাশ করেছে।

একটি ভালো কোম্পানীতে কাজও পেয়েছে। কিন্তু তনিমার পরিবার কোন ভাবেই নোয়াখালীর কোন ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে না। আর হাসিবের পরিবার কোন ভাবেই প্রেমের বিয়ে মেনে নিবেন না এবং মেনে নেয়ার যে সম্ভবনা সেটাও মেয়ে সিলেটি হবার কারনে মিলিয়ে গেল। আমি আঞ্চলিকতার এই ধরনের তীব্র রেশারেশীর সাথে খুব বেশি একটা পরিচিত ছিলাম না। ভালোমন্দ সব জেলাতেই আছে।

যারা এই সব আঞ্চলিকতার কথা বলেন তারা কখনো নিজেদের যুক্তি প্রমান করতে পারেন না। যারা এমনটা করে তারা শিক্ষিত হয়েও অশিক্ষিত। হাসিবের অনুরোধে আমি দুই পক্ষেই কথা বলতে লাগলাম। আমার কপালে জুটল নানা রকম তিরষ্কার। তনিমার ভাই বলল, তুই তাহলে তোর জন্য না, তোর বন্ধু জন্য কাজ করছিলি।

তিনি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তেন, বাংলা বিভাগে। অনেক হুমকি ধামকি দেখালেন। আমি চুপচাপ শুনলাম। ইচ্ছে করছিল বলি, আরে বেটা আমার পরিচয় দিলে তুই কাইন্দা আইসা পায়ে পইড়া মাফ চাবি। বন্ধুর হবু সম্বন্ধি, তাই ধৈর্য ধরে সব অপমান সহ্য করছিলাম।

এইদিকে হাসিবের বাসাতেও আমার অবস্থান হলো অনেকটা দুধ দিয়ে কাল সাপ পোষার মত। হাসিবের মা বলতে লাগলেন, তুমি আমার ছেলেটারে একটু বুঝাতে পারলা না? তোমারে এত আদর করছি, আর তুমি এইভাবে আমার ছেলের সর্বনাশটা হইতে দিলা। অবস্থাটা এমন, প্রেম করেছে তারা, আর সব ঝামেলা আমার উপর। মরার উপর খাঁড়ার ঘা, তনিমার ভার্সিটি আসা বন্ধ করে দেয়া হল। বা আসলেও সাথে ওর ছোট ভাই থাকে।

দেখা করা প্রায় খুবই অসম্ভব একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। এদিকে হাসিবের যাওয়ারও সময় হয়ে এসেছে। হাসিব কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ল। একদিন রাত তিনটার দিকে ও আমার বাসার নিচে এসে আমাকে ফোন দিল। কেরামতি করে নিচে নামলাম।

কিন্তু তার কথা শুনে আমি কিছুটা অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। হাসিব বলল ও নাকি আগামীকাল সকালে তনিমাকে বিয়ে করবে। কেউ কিছু জানবে না। বিয়ে করে ও চুপচাপ চলে যাবে। এইদিকে সব ঠান্ডা হোক।

এই ফাকে তনিমার কাগজও সে নাকি করিয়ে ফেলতে পারবে। কারন হাসিবের অস্ট্রেলিয়ান পিআর আছে। তারপর আবার দেশে ফিরে আসবে। তখন যদি কেউ রাজি না হয় তাহলে সে তনিমাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। আমি কিছুটা আতংকিত বোধ করলাম।

কারন বিয়ে করে তো দোস্ত আমার চলে যাবে, যা কিছু যাওয়ার আমার উপর দিয়েই যাবে। কিন্তু হাসিব অবিচল। কারন তনিমার সাথে নাকি চ্যাটে আলাপ হয়েছে। সে রাজি। সে নাকি ম্যানেজ করবে।

এখন আমার কাজ হলো কাজী যোগাড় করা এবং সাক্ষী হওয়া। সারারাত আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। সকাল বেলা ৮টার দিকে কাজীর খোঁজ করতে গেলাম। এত সকালে কাজী অফিসে কাউকে পেলাম না। কাজীর ফোন নাম্বারে ফোন করে উনাকে তাড়াতাড়ি আসতে অনুরোধ করলাম।

কিন্তু তিনি অনেকটা গদাই লস্করি চালে ৯:৩০ এর দিকে আসলেন। এসেই বললেন এই ধরনের কাজে রেট নাকি বেশি। আমরা সেই বেশি রেটে রাজি হয়েই তাড়াতাড়ি করে উনাকে নিয়ে ১০টার দিকে তনিমার ভার্সিটি হাজির হলাম। দারোয়ান মামাকে ৩০০ টাকা ঘুষ দিয়ে ভার্সিটিতে ঢুকলাম। সেখানে তনিমার ২টা বন্ধু অপেক্ষা করছিল।

তারা বেশ কাজের। একটা ফাকা ক্লাসরুম বের করে ফেলল তারা। সেখানে বসেই আমরা অপেক্ষা করছি। আমি ভীষন ঘামছি। পেটের ভিতর কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছিল।

এই ধরনের পরিস্থিতির কথা আমি কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। হাসিবও বেশ টেনশনে আছে। বার বার ঘড়ি দেখছে। আমি আসলে ঠিক বুঝাতে পারব না আমার সে সময়কার অনুভূতিগুলো। মাত্র ১০ মিনিট পার হলো।

মনে হলো কত বছর ধরে যেন বসে আছি। ঠিক ১০:৩০ এ তনিমা আসলো। বেচারীর টেনশনে চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। আমরা এই ব্যবস্থা করেছিলাম কারন তনিমার সাথে তার মা ও এখন তনিমাকে দিতে আসে। এসে বসে থাকে।

ক্লাস শেষ করে একবারে নিয়ে যায়। আজকেও মা এসেছে। নিচে বসে আছে। হাতে খুব বেশি সময় নেই। কাজীকে বললাম বিয়ে পড়ানো শুরু করতে।

কাজী বলল মেয়ের বয়স ১৮ হতে হবে। আমি মহা ঝাড়ি দিতে যাচ্ছিলাম। দেখি তনিমা মেট্রিক এর সার্টিফিকেট বের দিল। এর পর বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল। সাক্ষী হিসেবে আমি আর তনিমার একবন্ধু ছিল।

বিয়ে করানো শেষ হতেই হবাইকে চকলেট দিলাম। এত সকালে খেজুর পাইনি। তনিমা থেকে হাসিব তখনই বিদায় নিয়ে নিল। বেচারা বিয়ে করে বউকে নিয়ে যে একটু আলাদা সময় কাটাবে সে অবস্থা ছিলনা। কিন্তু তাদের ভালোবাসা দেখে আমরা সত্যি ভীষন আপ্লুত হয়েছিলাম।

সময়টা ছিল ২০০৫। ৩. হাসিব চলে গেল। আস্তে আস্তে পরিস্থিতিও কিছুটা শান্ত হল। তনিমাকে নিয়ে এখন আর তার মা বা ভাই আসেন না। ইতিমধ্যে আমি নতুন চাকুরীতে যোগদান করলাম।

নানা রকম ট্রেনিং, সেমিনার ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আমি বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলাম। বেশ কয়েক মাস এইভাবেই চলছিল। একদিন রাতে হাসিব ফোন দিল। তনিমাদের বাসায় নাকি নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে। তনিমার বড় ভাই তনিমার জন্য একটা ছেলে দেখেছেন।

ছেলে কোন এক চা বাগানের ম্যানেজার। সব ঠিক থাকলে রোজার ঈদের পর সিলেটে বিয়ে হবে। রোজা আসতে তখনও প্রায় তিনমাসের মত বাকি। হাসিব বলল, তনিমার জন্য সকল কাগজপত্র সে রেডি করে ফেলেছে। কিছুদিনের মধ্যে পাসপোর্ট জমা দিতে হবে।

কিন্তু সমস্যা হলো তনিমার পাসপোর্টের মেয়াদ বেশিদিন নেই। তাই আমাকে পাসপোর্ট রিনিউ এর ব্যবস্থা করতে হবে। পাসপোর্ট রিনিউ করে আগামী মাসে তনিমাকে ভিসার জন্য দাড়াতে হবে। ভিসা পেলে হাসিব দেশে চলে আসবে। যাই হোক সবকিছু প্ল্যান মোতাবেকই হলো।

তনিমা সকল কাগজ পত্র সহ পাসপোর্ট জমা দিল। ৫ দিন পরে তাকে ভিসা সহ পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হল। কি যে প্রচন্ড আনন্দ হচ্ছিল, বোঝাতে পারব না। হাসিবকে জানালাম। হাসিব বলল ও ঈদের আগের ৪/৫ দিন আগে দেশে আসবে।

রোজা শুরু হলো। হঠাৎ করে তনিমারা সবাই সিলেট চলে গেল। আমার অনেক প্ল্যান উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। হাসিবকে জানালাম। হাসিব বললো, তার বাসায় এবং তনিমার বাসায় আমাকে কথা বলতে।

শুধু বিয়ের কথা যেন না জানাই। আমি বিগত দিনের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে প্রথমে হাসিবের বাসায় গেলাম। চাচা আর চাচীকে ব্যাপারটা বলা শুরু করাতেই আবার শুরু হলো আমাকে প্রচন্ড অপমান। এইবার তো আমাকে সরাসরি বাসা থেকে বের করে দেয়া হল। কিচ্ছু করার নেই।

চুপচাপ হজম করা ছাড়া। তনিমার ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি তো আরো একধাপ এগিয়ে। পোলাপাইন পাঠিয়ে আমাকে অফিসে হুমকি দিলেন। বাসায়ও খবর গেল।

আমার আম্মা আব্বা মনে করলেন আমি মনে হয় পালিয়ে কোন মেয়ের সাথে বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাসায় যাওয়ার পর আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, তোমাকে পালিয়ে বিয়ে করতে হবে কেন? আমি গিয়ে কথা বলি? তারপর না মানলে তখন না হয় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবা। কিন্তু এখনই কেন? আমি হা করে আব্বার দিকে চেয়ে রইলাম। পরে আমি যখন সব বুঝিয়ে বললাম, তখন আব্বু বললেন যেন খুব বেশি ঝামেলায় না জড়াই। হাসিবকে সব জানালাম।

হাসিব কিছুটা মুষড়ে পড়ল। এত সব গালাগালি শুনে আমার মধ্যে একটা প্রচন্ড ক্রোধ কাজ করছিল। মনে মনে ঠিক করলাম শালার যাই আছে কপালে তনিমাকে সিলেটে ওদের বাড়ি থেকে তুলে আনব। তারপর যা হবার তা হবে। হাসিবকে বললাম।

ও রাজি হলো। ৪. তনিমাদের বাড়ি সিলেটে মীরা বাজারে। ওদের বাসার সাথেই প্রধান সড়ক। তনিমারা বেশ ভালোই পয়সাওয়ালা। আমার সিলেটে কিছু বন্ধু বান্ধব আছে।

এর মধ্যে একজন হচ্ছে বেশ প্রভাবশালী এক নেতার ছেলে। ওকে সব খুলে বললাম। আমাকে বলল, টেনশনের কিছু নাই। প্রয়োজন পড়লে বাসা থেকে তুলে আনতে পারবে। কিন্তু আমি ঠিক চাচ্ছিলাম না বাসা থেকে তুলে আনতে।

এতে তনিমাদের পরিবারের বেশি সম্মানহানি হবে। ঠিক হলো তনিমা বাসার নিচে নেমে আসবে। আমরা সেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করব। গাড়িতে করে সরাসরি বিমানবন্দর। সেখান থেকে ঢাকায়।

ঢাকায় কোন একটা হোটেলে উঠবে। তারপর একদিন বা দুইদিন পরে তারা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে। হাসিব ঢাকায় আসল অক্টোবরের ৫ তারিখে। ১১ তারিখে ছিল ঈদ। তেমন লাগেজ আনেনি এইবার।

হাসিবের এই ঘন ঘন আগমনে হাসিবের পরিবার খুব বেশি খুশি হলো না। তারউপর আমাকে সাথে দেখে তো আরো বিরক্ত হলো। হাসিব বাসায় এসে সরাসরি তনিমার প্রসঙ্গ তুললো। আগের মতই চিৎকার চেচামেচি এবং আরো খারাপ সিচুয়েশন হলো। কিন্তু যে ছেলে প্রেমের জন্য এত কিছু করছে তাকে আর যাই হোক এইসব স্পর্শ করছিল না।

আমরা যতবারই কারন জানতে চাচ্ছিলাম হাসিবের পরিবার কোন কারন দেখাতে পারছিল না। এটাযে এক ধরনের এক গুয়েমি সেটা বুঝা যাচ্ছিল। ঘুরে ফিরে সেই সিলেট প্রসংগই ফিরে এল। বিরক্ত হয়ে হাসিব আর আমি বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। ঠিক করলাম সিলেটে তনিমাদের বাসায় যাব।

রাতের বাসে রওনা দিলাম। ঈদের কারনে বাসে টিকিট পেতে খুবই কষ্ট হয়েছিল। যাই হোক সকালে তনিমাদের বাসায় যাবার পর তনিমার বাবা বললেন তিনি কেটে তার মেয়েকে সুরমা নদীতে ভাসিয়ে দিবেন, তাও তিনি নোয়াখালী বা প্রেম করে পছন্দ করা কোন পাত্রের কাছে বিয়ে দিবেন না। তনিমার বড় ভাই আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে গায়ে হাত তুলতে গেলেন। আমার আর সহ্য হলো না।

আমি বললাম, ভদ্রভাবে এতদিন কথা বলেছি, এটার অর্থ এই না যে আমরা কিছু করতে পারি না। যেকোন জিনিস দুই ভাবে বুঝানো যায় একভালো ভাবে, অন্যটা খারাপ ভাবে। আপনাকে ভালোভাবে বুঝাচ্ছি, কিন্তু আপনি পারছেন না। আপনি শুধু গায়ে হাত তুলে দেখেন, তারপর দেখেন আপনার কি অবস্থা করি। নিচে চেয়ে দেখেন আমি একা আসি নাই।

আপনি একটা দিবেন আপনি মিনিমাম ৫০টা খাবেন। আর আপনি যার পাওয়ারে এত লাফালাফি করেন, তিনি আমার বড় ভাই। আমার আপন খালাত ভাই। উনারে যদি বলি আপনি আমাকে এই রকম করছেন, তাহলে আপনি বুঝে দেখেন আপনার অবস্থা কি হবে। ইচ্ছা করছিল সেদিনই তনিমাকে তুলে নিয়ে আসি।

কিন্তু নিজেকে শান্ত করলাম। আমাদের এই পাগলামীতে যেটা হলো, তনিমার সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। এখন আর কোন পথ খোলা নেই। সেই তুলে আনার ব্যবস্থাই করতে হবে। রিপন ভাই এর সাথে যোগাযোগ করলাম।

আমার খালাত ভাই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠনের নেতা। তিনি বললেন, তুই যেহেতু হ্যান্ডেল করছিস, তাই আমি আর জড়াতে চাই না। তবে যখন দেখবি পারছিস না। আমাকে ফোন দিস।

তবে তোরা একটা জিডি করে রাখিস। সামনে কাজে দিবে। আমরা ঢাকায় ফিরে জিডি করলাম। ৬. ঈদ শেষ হলো। তনিমার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছি না।

আমাদের ভরসা ছিল, তনিমা কোন না কোন ভাবে আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। কিন্তু অপেক্ষা আর ভালো লাগছিল না। সিলেটের পোলাপাইন দিয়ে খবর বের করলাম, তনিমা সেই বাসায়ই আছে। আমি হাসিবকে বললাম আর একদিন অপেক্ষা করব, তারপর যদি খোঁজ না পাই, তাহলে তনিমাদের বাসায় গিয়ে তনিমাকে তুলে আনব। রিপন ভাইকে বললাম, তিনি বললেন যা করবি ভেবে করবি।

শেষে আবার যদি মেয়ে বেকে বসে তাহলে কিন্তু অপহরনের কেস হবে। আমি বললাম ভাই, বাঁকা বাকির কিছু নাই। হুজুর ডেকে বিয়ে করা বউ। তিনি আমাকে সিলেটের কিছু নেতার ফোন নাম্বার দিলেন। আমি যোগাযোগ করলাম।

তারা বলল, আপনি এসে ফোন দিয়েন, আমরা আছি। ঠিক করলাম অক্টোবরের ১৬ তারিখে আমরা সিলেটে যাব। এর মধ্যে হাসিব ১৮ তারিখে তাদের দুইজনের টিকিট কনফার্ম করল। টিকিট কনফার্ম করে বের হয়ে আসতেই আমার মোবাইলে দেখি তনিমা একটা অন্য নাম্বার থেকে ফোন করল। আমি সাথে সাথে বললাম কালকে আমরা দুপুর ঠিক ২টায় তোমার বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করব।

তুমি যেভাবেই হোক বের হয়ে চলে আসবে। আমি হাসিবকে দিলাম। তারা ২ মিনিটের মত কথা বললো। হাসিব বলল, তোমার কোন কিছুই আনার দরকার নেই। শুধু কোন মতে একটা কাপড় পড়ে বের হয়ে আসবা।

আমরা তোমার জন্য ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর বাড়ির ভিতরে ঢুকব। এই বলে হাসিব ফোন রেখে দিল। আমরা পরদিন ভোর সাড়ে ৫ টায় রওনা দিলাম। হাসিব বাসা থেকে লাগেজ নিয়ে বের হয়েছে।

বাসায় কেউ দেখেনি। আমরা সিলেট পৌছলাম সকাল ১০ টার দিকে। আমাদের সাথে গেল আরো কয়েকজন। সিলেটে আমার সেই ছোটভাইকে ফোন দিলাম। তার সাথে দেখা হলো।

তাকে সব বুঝিয়ে বললাম। খুবই বুদ্ধিমান ছেলে। অল্পতেই সে বুঝে নিল কি করতে হবে। এরপর অপেক্ষার পালা। আমরা গাড়ির ভিতরে বসে আছি।

অপেক্ষা করছি তনিমার জন্য। কথা ছিল তনিমা দুপুর ২ টায় বের হবে। ২টা বাজতে আর ১৫ মিনিট বাকি আছে। এক একটা মিনিট আমার কাছে অনেক বড় হচ্ছে। ২টা ১৫ বাজে।

আমার প্রচন্ড টেনশন হতে লাগল। হঠাৎ দেখি তনিমাদের বাড়ি থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ভালো করে চেয়ে দেখি এটাই তনিমা। ওরনা মাথায় পেচিয়ে রাখতে চিনতে পারছিলাম না। সাথে সাথে আমরা গাড়ি স্টার্ট করলাম।

তনিমাকে গাড়িতে তুলে নিয়েই একটানে আমরা সেই এলাকা ছেড়ে বের হয়ে আসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম আমার মোবাইলে দেখি ফোন আসা শুরু হলো। তনিমার ভাই, বাবা আরো অনেকে আমাকে ফোন দিয়ে গালাগালি করছেন। তিনি থানায় যাচ্ছেন মামলা করার জন্য। আমার নামে নারী অপহরনের মামলা দিবেন ইত্যাদি।

আমাদের সকল ধারনাই বাস্তব হতে চলেছে। প্ল্যান অনুযায়ী আমরা ঠিক করলাম করলাম মাইক্রোবাস ছেড়ে দিব। আমাদের সাথে যারা ঢাকা থেকে এসেছিল তাদেরকে বাসে চলে যাবে। আমি, হাসিব, তনিমা উঠলাম রবিন ( সেই সিলেটি ছোট ভাই) তার গাড়িতে। আমরা সরাসরি চলে আসলাম ওসমানী বিমানবন্দরে।

সেখান থেকে ঢাকায় চলে এলাম আমরা। ঢাকায় এসে যখন পৌছলাম তখন সন্ধ্যা ৭ টা। মোবাইল বন্ধ ছিল। খুলে দেখি অনেকগুলো মিসকল এলার্ট। কিছুক্ষন পর হাসিবের বাসা থেকে ফোন আসল।

তাদের কাছে তনিমাদের বাসা থেকে ফোন গেল। আমরা নাকি তনিমাকে অপহরন করে ঢাকায় এনেছি। তনিমাদের বাসা থেকে মামলা করা হচ্ছে। হাসিবদের বাসা থেকে আমার নামে এবং তনিমাদের নামে মামলা করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা বনানীর একটা হোটেলে উঠলাম।

হাসিব আর তানিয়াকে হোটেলে রেখে আমি বাসায় গেলাম। বাসায় গিয়ে শুনলাম কারা নাকি ফোনে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। আব্বু অনেক টেনশন করছেন। আব্বু আমার মেজ নানাকে ফোন দিলেন। তিনি পুলিশের সহকারী কমিশনার ছিলেন।

উনার সাথে কথা বলে আমি মোহাম্মদপূর থানায় গেলাম। সেখানে ওসি সাহেবকে আমার আগের করা জিডি দেখালাম। তারপর বিষটি খুলে বললাম। বিয়ের কাবিন এর ফটোকপি দেখালাম। তিনি সব বুঝে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকতে।

আসলে আর অনেক ঘটনা ঘটেছিল সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না। তারপর দিন সকালে হাসিবের হোটেলে গেলাম। তাদের নিয়ে মার্কেটে গেলাম। হাসিব তানিয়ার জন্য ড্রেস ও অন্যান্য জিনিস কিনল। তারপর বিকেলের দিকে হোটেলে ফিরে এসে প্রথমে হাসিবের বাসায় ফোন দিল, বলল সে তনিমাকে বিয়ে করে ফেলেছে।

আজ রাতেই তারা অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে। তারা যদি চায় তাহলে হোটেল রয়েলে তারা যেন ৬ টার মধ্যে চলে আশে। একই কথা তনিমাদের বাসায়ও বলা হলো। আমরা ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কেউ আসলো না।

আমি দুই বাসায় বিয়ের প্রমান স্বরুপ কাবিনের ফটোকপি পাঠালাম। তাদের স্বীকারোক্তি পাঠালাম, যেখানে তারা উল্লেখ্য করেছে তারা স্বেচ্ছায় একে অপরকে বিয়ে করেছে। নিচে তাদের সাইন। এবং সাক্ষী হিসেবে কয়েকজনের নাম। ঢাকা বিমান বন্দরে আমি দাঁড়িয়ে আছি।

হাসিব এবং তনিমা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদছে। আমিও কাদছি। কি একটা লজ্জাজনক একটা দৃশ্য। ২০০৮ সালে দুই পরিবার থেকে সর্বসম্মতিক্রমে এই বিয়ে মেয়ে নেয়া হয়। দুই পরিবারের মধ্যে গলায় গলায় ভাব।

আমার কাছে ক্ষমা চাইল। তনিমার বড় ভাই রনি ভাই এর সাথে আমার খুবই খাতির। শুনেছি তনিমা হাসিবের একটা বাবু হতে যাচ্ছে। আমার এই লেখাটা তার জন্য উৎসর্গ করা। পরিশেষঃ সিনেমার গল্প কি আসলেই জীবন থেকেই নেয়া হয়?? হয়ত, হয়ত না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।