হাউকাউ পার্টি প্রকৃতির শক্তি কাছে মানুষ এখনও অনেকটাই অসহায়! মাঝে মাঝেই কিসের আক্রোশে কে জানে, খেপে ওঠে শান্ত প্রকৃতি, সব কিছু তোলপাড় করে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু মানুষ; সে তো চিরকালের যোদ্ধা, সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই জুঝে চলেছে এর সাথে। মাঝে মাঝেই বিরূপ প্রকৃতি তাকে ভেঙ্গে দিয়েছে, চুড়মার করে দিয়েছে তার তৈরি আবাস কিন্তু সেই ধ্বংস স্তুপের মধ্য থেকেই প্রকৃতিকে বশ মানিয়েই উঠে দাড়িয়েছে সে।
বাংলাদেশের মানুষ আমরা, প্রতি বছরই কালবৈশাখি, টর্নেডো, বন্যা, জ্বলোচ্ছাসের সাথে লড়তে হয় আমাদের, মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দেয় ভুমিকম্প!
বাংলা ভূখন্ডে অন্যতম প্রবল ভূমিকম্পটি হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন। গ্রেট ইন্ডিয়ান ভুমিকম্প নামে পরিচিত এই ভূমিকম্প মাত্রা ছিল রেক্টর স্কেল ৮.৭ এবং বার্মা, দিল্লী ও বিশেষ করে ভূটানের হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে।
বাংলাদেশেও যে ভাল ভাবেই আক্রান্ত হয়েছিল তার প্রমান আমরা এখনও অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনায় দেখতে পাই এত যুগ পরেও।
গ্রেট ইন্ডিয়ান ভুমিকম্পে আক্রান্ত ঐতিহাসিক স্থাপত্য গুলোর মধ্যে প্রথমেই বলবো বাংলাদেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন মন্দির 'কান্তজীর' কথা। পোড়ামাটির অলংকরন এবং চমৎকার স্থাপত্য শৈলির কারনে জগৎবিখ্যাত কান্তজীর মন্দিরটি আদতে ছিল একটা নবরত্ন মন্দির।
'রত্ন' শব্দটা হয়তো অনেকের কাছে কিছুটা ধোঁয়াটে লাগতে পারে, তাই এটার একটু ব্যাখ্যা দেই আগে। 'রত্ন' হলো মন্দিরের ছাদের উপরে তৈরি করা ক্ষুদ্রাকারের চুড়া, মূলত: অলংকরনের জন্য এগুলো বানানো হয়!
কান্তজীর মন্দিরে এক সময়ে, প্রথম তলায় ৪ টা, দ্বিতীয় তলায় ৪ এবং সব শেষে একটা এই বিন্যাসে সর্বমোট নয়টি চুড়া ছিল! তখন মন্দিরটিকে দেখতে কেমন লাগতো দেখুন............
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এই ৯টি চুড়োর সব গুলোই ভেঙ্গে পরেছিল, যা আর পরবর্তিকালে নতুন করে নির্মান করা সম্ভব হয়নি।
কান্তজীর মন্দির বর্তমানে।
এমন ভাবেই ভেঙ্গে গিয়েছিল সুলতান নাসির উদ-দীন শাহ নির্মিত বর্তমান রাজশাহীর বাঘায় অবস্থিত 'বাঘা মসজিদের দশটি গম্বুজ। এখন আমরা বাঘা মসজিদে যে গম্বুজ গুলো দেখি তার সবই পরবর্তী কালে তৈরি করা।
পুরানো ঢাকার হোসেনী দালানের কথা আপনারা সকলেই জানেন। শিয়া সম্প্রদায়ের পবিত্র স্থান হোসেনী দালানের আদিরূপটা এখন আর নেই, সেই একই ভুমিকম্পে পুরোপুরি ভেঙ্গে পরেছিল ১৭৯৬ সালে নির্মিত এই ইমারতটি।
হোসেনী দালান, ১৯০০ সাল!
পরবরর্তীকালে নবাব আহসান উল্লাহ এই হোসনী দালানটি পূর্ন:নির্মান করেন এবং অনেকবার মেরামতের পরে এখন সেই দালানটিই আমরা দেখি।
হোসেনী দালান বর্তমানে।
তাজাহাট প্যালেসের সাথে মর্মান্তিক ভাবে জড়িয়ে আছে ১৮৯৭ সালের এই ভূমিকম্প।
তাজহাটের জমিদার বংশের 'মহারাজা' গোবিন্দ লাল মারা গিয়েছিলেন এই ভূমিকম্পে নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে।
এখন আমরা যে তাজহাট প্যালেসটা দেখি সেটার গম্বুজ সহ বেশ কিছু অংশই পরবর্তি কালে তাঁর ছেলে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায়ের আমলে নির্মিত!
লেখার প্রায় শেষদিকে চলে এসছি।
এবার বলি আপনাদের আরেকটা খুব চেনা স্থাপত্যের কথা.......আহসান মঞ্জিল।
উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এই শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ঢাকা তথা পুরো পূর্ববঙ্গে প্রভাব বিস্তারকারী আহসান মঞ্জিলও কিন্তু রেহাই পায়নি বিরূপ প্রকৃতির তান্ডব থেকে। সেটা অবশ্য গ্রেট এশিয়ান ভূমিকম্প ছিল না, আহাসান মঞ্জিলকে আঘাত করেছিল ১৮৮৮ সালের টর্নেডো।
আবদুল গনি সাহেব যখন আহসান মঞ্জিলটি নির্মান করেছিলেন ১৮৭২ সালে তখন এতে কোন গম্বুজ ছিল না।
আহসান মঞ্জিলের আদিরূপ।
১৮৮৮ সালের টর্নেডোতে ভীষনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আহসান মঞ্জিল। স্থানীয় একটা পত্রিকায় সেটার বর্ননা দেয়া হয়েছিল এভাবে.......... "নবাববাড়ির দক্ষিন পশ্চিম দিকে একটা স্তম্ভ বা হাতীশূঁড় নামিতে দেখা যায়। দেখিতে দেখিতে ঐ জলস্তম্বটি দ্বিখন্ড হইয়া একভাগ পশ্চিম দিকে আরেক ভাগ নবাববাড়ীর দিকে ধাবিত হয়, উহা দ্বিখন্ড হওয়ার সময়েই উহা হইতে সহস্র সহস্র অগ্নিময় গোলা উড্ডীন হইতে লোকে দেখিয়াছিল। যখন উহা নবাববাড়ির ধ্বংস সাধনে নিরত হয়, তখন দূরবর্তী লোকে নবাববাড়িটাকে যেন প্রজ্জলিত অগ্নিময় দেখিয়াছিল!
বাত্যাবর্ত্তের শব্দ শুনিয়া নবাব সাহেবগণ আপনাপন প্রকোষ্ঠ ছাড়িয়া উত্তর দিকের বারান্দায় আসিয়াছিলেন, যেই তাঁহাদের আসা অমনি পরিত্যাক্ত প্রকোষ্ঠ গুলো চুরমার হইয়াছিল"।
টর্নেডোতে ভেঙ্গে যাওয়া আহসান মঞ্জিলের একটা ঘর
এই ঝড়ের পরে আহসান মঞ্জিল আবার পূন:নির্মান করা হয়েছিল, এবং বর্তমানের সুরম্য গম্বুজটা সেই সমেয়ই বানানো।
আহসান মঞ্জিল বর্তমানে
পরিশিষ্ট: এতক্ষন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত মানুষের কথা বললাম, এখন বলি মানুষ কিভাবে নিজের স্বার্থে প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত করে তুলছে তার কথা।
আপনারা জানেন সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিশাল এক কয়লা বিদুৎ প্রকল্প স্থাপনার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। পরিবেশগত ছাড়পত্রের কোন রকম তোয়াক্কা না করেই ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির সাথে বিদুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তিও হয়ে গেছে।
" এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাইঅক্সাইড(SO2) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড(NO2) নির্গত হবে যার ফলে পরিবেশ আইনে বেধে দেয়া পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার সীমার(প্রতি ঘনমিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম) তুলনায় এইসব বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা অনেক বেশি হবে(প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি) যার ফলে এসিড বৃষ্টি, শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি সহ গাছপালা জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনী থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস যা চারপাশের পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৪ ৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূতি ছাই বা স্লারি ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে কারণ এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে! (দিন মজুর)
এখানে শুধু অল্প কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করা হলো, এই পরিবেশগত বিপর্যয় হবে আর ব্যাপক এবং বিস্তৃত।
প্রতিবছর ঘূর্নিঝড়, সিডর, আইলার মতো ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক তান্ডবের হাত থেকে উপকূলবর্তীয় অঞ্চল গুলোকে বাঁচিয়ে এসছে এই সুন্দরবন.....সেই বনটাই যদি না থাকে তাহলে অবস্থা কি হবে সেটা চিন্তাই করা যায় না।
আপনি হয়তো উপকূলে নেই, কিন্তু এই উপকূলীয় বিপর্যয় একসময়ে প্রভাব ফেলবে আপনার-আমার এলাকাতেই......বায়ূমন্ডল দূষিত হবে, মাটির লবনাক্ততা বাড়বে, বাড়বে ঝড়, ঝঞ্জা বা জলোচ্ছাসের প্রকোপ!
প্রকৃতির সাথে মানুষের অস্তিত্ব এক সুতায় বাঁধা, সুতরাং নিজের অস্তিত্বের জন্যই মানুষকে প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যকে বাঁচাতে, আমাদের বাংলাদেশকে বাঁচাতে রুখে দাড়ান এই অপচেষ্টার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।