আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাচীন বাঙলার ধর্মীয় উৎসব : গাছপূজা ও শবোরৎসব

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। প্রথম পর্ব : গ্রাম-দেবতা, ধ্বজাপূজা, ব্রতোৎসব ও কামমহোৎসব গাছ পূজারত নারী গাছপূজা : ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের প্রশ্নে প্রাচীন ভারতবর্ষের ঋষিরা বলেছেন প্রকৃতির মাঝেই তিনি বিদ্যমান- জড় প্রস্তর খন্ড থেকে শুরু করে গাছপালাপশুপাখি সবকিছুতেই তার ছায়া আছে। তাদের এ কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে অক্ষম মানুষের দ্বারা গাছ ও পাথর হয়ে গেছেন ঈশ্বর। কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য গাছপালা ঈশ্বরের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানকালের মতোন প্রাচীন বাঙলায়ও নারীদের মধ্যে ভোরে উঠে তুলসী, শেওড়া ও বট গাছ পূজার প্রচলন ছিল।

গ্রাম-দেবতা’র সাথে গাছপূজা’র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, একেকটি গ্রামে যে গাছের নিচে আঞ্চলিক দেবতার পূজা হতো কোন কোন সময় সেই গাছটিরও পূজা করা হতো। অশ্বত্থতলায় বুদ্ধ ভারতের বুদ্ধগয়ায় যেই অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে গৌতম বুদ্ধ বোধিস্বত্ত্ব লাভ করেছিলেন সেই গাছের পূজা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। আমাদের দেশের সুনামগঞ্জে করচগাছের নিচে ‘থান’ তৈরী করে করচগাছেরই পূজা করা হয়। সেখানে করচগাছ মাসের পর মাস হাওরের পানিতে ডুবে বেঁচে থেকে মাছকে আশ্রয় দেয়, মাটির ক্ষয়রোধ করে, স্রোতের বেগ কমিয়ে দেয়। তাই গ্রামবাসী করচগাছকেই রক্ষক গণ্য করে পূজো দেয়।

আবার দক্ষিণাঞ্চলে দূর্গাপূজার তালনবমী তিথিতে অপদেবতার কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে পানের বরজে কলার খোলে পাকা কলা, আতপ চাল, ফুল ইত্যাদি দিয়ে প্রতিদিন নৈবেদ্য দেয়া হয়। শুধু দক্ষিণাঞ্চলেই না, সারাদেশেই কুদৃষ্টি থেকে শিম, লাউ, কুমড়া রক্ষা পেরে মাচানে মাটির হাঁড়িতে কয়লা ও চুন দিয়ে মানুষের চেহারা এঁকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পেতে আজও বট-অশ্বত্থের বিয়ে দেয়া হয়। মানুষের বিয়ের মতন সেখানেও খাওয়া দাওয়া হয়, অনুষ্ঠান হয়, তারপর গাছ দুটিকে বেঁধে কোথাও লাগিয়ে দেয়া হয়। সেখানেই নতুন একটি ‘থান’ তৈরী হয়।

এসব গাছপূজার মধ্যে পরে। শুধু গাছই নয়, কিছু কিছু ফল ও শস্যও অন্তর্ভূক্ত ছিল পূজোর। আমাদের নানান আচারানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধান, দূর্বা, কলা, সুপারি, পান, নারকেল ইত্যাদির স্থান অ্যাখনো ভীষণভাবে জড়িত। এসব এসেছে প্রাচীন বাঙলার ফল ও শস্যের পূজা থেকে। আখমাড়াই ঘরের দেবতা হিশেবে পুন্ড্রাসুর’র পূজা করা হতো, এই পুন্ড্রাসুর হলো একপ্রকারের আখ।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অ্যাখনো পুন্ড্রাসুরের পূজার প্রচলন আছে, পরাসুর নামে। পুন্ড্রাসুর পূজার মন্ত্রটি ছিল এইরকম, পণ্ডাসুর ইহাগচ্ছ ক্ষেত্রপাল শুভপ্রদ। পাহি মামিক্ষুযত্রৈস্ত্বং তুভ্যং নিত্যং নমো নমঃ॥ পণ্ডাসুর নমস্তভ্যামিক্ষুবাটি নিবাসিনে। যজমান হিতার্থায় গুড়বৃদ্ধিপ্রদায়িনো॥ গাছপূজা ক্যামন ছিল, এইরকম বর্ননা পাওয়া যায় সদুক্তিকর্ণামৃতের একটি শ্লোক থেকে, তৈস্তৈর্জীরোপহারৈর্গিরি কুহরশিলা সংশ্রয়ার্মচয়িত্বা। দেবীং কান্তারদূর্গাং রুধিরমুপতরু ক্ষেত্রপালাউ দত্বা॥ তুম্বীবীণা বিনোদ ব্যবহৃত সরকামহ্নি জীর্ণে পুরাণীং।

হালাং মালুরকৌষের্যুবতি সহচরা বর্বরাঃ শীলয়ন্তি॥ অর্থাৎ, বর্বর লোকেরা পশুবলি দিয়ে পাথরের পূজা করে, রক্ত দিয়ে কান্তারদূর্গার পূজা করে, গাছতলায় ক্ষেত্রপালের পূজা করে এবং দিন শেষে তাদের যুবতী সহচরীদের নিয়ে তুম্বীবীণা বাজিয়ে নাচগান করতে করতে বেলের খোলে করে মদ পান করে আনন্দে মত্ত হতো। শবোরৎসব : প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চলের শবর-শবরীদের সংস্কৃতি সাধারণের আচারনুষ্ঠানেও প্রভাব ফেলেছিল। শবর শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যাধ, ব্যাধ জাতিগোষ্ঠী শবর নামে পরচিত। কুক, সাওতাল, মুণ্ডা, সুয়াং ইত্যাদি ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীও একসময় শবর নামে পরিচিত ছিল। শবর-শবরীদের জীবনযাত্রার মান ক্যান ছিল তা শর্বরীপাদের পদ থেকে আন্দাজ করা যায়, ছা ছা মাআ মোহা বিষম দুন্দোলী।

মহাসুহে বিলসন্তি শবরো লইআ সুণ মেহেলী॥ হেরি যে মেরি তইলা বাড়ী খসমে সমতুলা। ষুকড় এ সে রে কপাসু ফুটিলা॥ তইলা বাড়ির পাসের জোহ্ণা বাড়ি উএলা। ফিটেলি অন্ধারী রে অকাশ ফুলিআ॥ কঙ্গুরিনা পাকেলা রে শবরাশবরি মাতেলা। অণুদিন সবরো কিংপি ন চেবই মহাসুহেঁ ভেলা॥ চারিবাসে তা ভলা রে দিআঁ চঞ্চালী। তিনতলা বাড়িতে শবর শবরীকে নিয়ে মহাসুখে দিনাতিপাত করে।

মাঝে মাঝে শবরীর আহ্লাদে শবর তাকে তিরস্কার করে ভ্রমসৃষ্টিকারী বলে। তাদের কাছে মনে হয় তিনতলা বাড়ি শুন্যের সমতূল্য, সেই বাড়ির পাশে কার্পাস ফুটেছে, বাইরে জ্যোৎস্নায় চারিপাশ উজ্জ্বল। ফল পাকলে শবর-শবরী পানে মত্ত হয়, তারা পরম সুখে দিনাতিপাত করে। ধীরে ধীরে শবর-শবরীরা মূলস্রোতে ঢুকে পরে, সাথে তাদের সংস্কৃতি। উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিম-দক্ষিণ বঙ্গে তারা হিন্দু সমাজের নিম্নতম স্তরে প্রবেশাধিকার পায়।

কালবিবেক গ্রন্থ ও কালিকাপুরাণে পাওয়া যায় শারদীয় দূর্গাপূজার দশমী তিথিতে বাঙলার সাধারণ অধিবাসীরা শবর-শবরীদের মতোন নগ্ন দেহে গাছের পাতা, ময়ূরের পেখম, কাঁদা-তেল মেখে ঢাকের বাজনার সাথে নাচ-গান করতো। এটাই শবোরৎসব। এই উৎসবের প্রধান আকর্ষন ছিল যৌনলীলার নানা গান গাওয়া, কাহিনী বলা ও যৌন অঙ্গভঙ্গি করা। বিশ্বাস করা হতো এসব না করলে দেবী ভগবতী ক্রুদ্ধ হবেন। কোন গ্রন্থে এসব নিষিদ্ধ করা হয়নি তবে বৃহদ্ধর্ম পুরাণে এই বিষয়ে সামান্য বিধিনিষেধ আছে- মা বোনদের সামনে এবং শক্তিধর্মে দীক্ষা পায়নি অ্যামন মেয়েদের সামনে য্যানো এই আচরণ না করা হয়।

শবোরৎসবের সাথে কামমোহৎসবের মিল পাওয়া যায়। সূত্র : নীহাররঞ্জন রায় রচিত বাঙালির ইতিহাস, উইকিপিডিয়া, বাঙলা পত্রিকা  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।