বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্নীতিবাজদেরকে অপসারন করুন শুরু করছি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালামকে দিয়ে। ড. কালাম অনেক দিক থেকেই রয়েছেন ভিন্ন মাত্রায় ও অবস্থানে। কিন্তু যা এ লেখার সঙ্গে সম্পর্কিত তা হল তার সাধারণত্ব ও দায়িত্ববোধ অর্থাৎ নিজস্ব মূল্যবোধ ও অবস্থান সঠিকভাবে ধরে রেখে শিক্ষার্থী-শিক্ষক তথা সব মানুষের সঙ্গে আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মেশার ক্ষমতা, মানসিকতা ও রীতি।
ড. কালামের ‘ভিশন ফর ইন্ডিয়া-২০২০’র আলোকে ইন্ডিয়ান এক স্কুল (সিআইআরএস) ২০০৭ সালে নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের কিছু ছুটিকালীন ভিন্নধর্মী অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের দেশ গড়ার কাজে অনুপ্রাণিত ও অভ্যস্ত করা। ড. কালাম এ সম্পর্কে কোন একভাবে অবগত হন।
শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবিত এক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ভারতের তিহার অঞ্চলে অবস্থিত এক কারাগারের বন্দিদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো ও মতবিনিময় করা। বিষয়টি ড. কালামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ড. কালাম ওই অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গে জড়িত ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণীর ৩২ জন শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকদের রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ জানান। ৭ মে, ২০০৭, বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ড. কালাম দেখা করেন আমন্ত্রিতদের সঙ্গে। প্রথমেই আমন্ত্রিতরা যথাযথভাবে আপ্যায়িত হয়েছেন কিনা তা জানতে চান তিনি।
পরে একে একে জানতে চান শিক্ষার্থীদের মূল উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। কথা প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীরা কারাবন্দিদের সম্বোধনে কোন এক প্রচলিত কিন্তু অনুচ্চ শব্দ প্রয়োগ করে। তৎক্ষণাৎ ড. কালাম একজন দায়িত্ববান শিক্ষক বা অভিভাবকের মতো শুধরে দেন শিক্ষার্থীদের- শিখিয়ে দেন কারাবন্দিদের সঙ্গে কথা বলার বিভিন্ন কৌশল। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কাছে দিয়ে দেন কারাবন্দিদের জন্য শুভেচ্ছাসহ এক বিশেষ বার্তা। কথা বলেন অন্যান্য বিষয়ে, জবাব দেন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের।
অবশেষে নিজে আমন্ত্রিতদের নিয়ে যান ফটোসেশন লনে। ফটো উঠানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মজা করতে ভোলননি তিনি। রাষ্ট্রপতি ড. কালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য ছিল- ‘প্রেসিডেন্ট ড. কালাম ইজ এ ইনসপায়ারিং টিচার অ্যান্ড এ লাভলি এলডার অব দ্য ফ্যামিলি। ’
এবার অন্য আরেকটি ঘটনা। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (্এনআইটি, রুকেলা) ৭ম সমাবর্তনে প্রধান অতিথি হিসেবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. কালামের উপস্থিত থাকার কথা।
কিন্তু বাদ সাধে প্রতিকূল আবহাওয়া। রাষ্ট্রপতিকে বহনকারী নির্দিষ্ট হেলিকপ্টারটির উড্ডয়ন কোনভাবেই সম্ভব ছিল না তখন। বাস্তবতার নিরিখে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে তিনি সমাবর্তনে যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন অথবা সমাবর্তন অনুষ্ঠান বিলম্বিত করবেন। কিন্তু এর কোনটিই ঘটেনি। ড. কালাম নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই ট্রেনে করে যাত্রা শুরু করেন এবং দশ ঘণ্টার যাত্রা শেষে যথাসময়ে এনআইটিতে পৌঁছান।
তার মুখে ছিল না কোন ক্লান্তি বা বিরক্তির ছাপ, বরং চিরচেনা হাস্যোজ্জ্বল মুখেই এলেন সমাবর্তন মঞ্চে। জানা যায়, প্রতিকূল আবহাওয়ায় দশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তিনি অবশেষে সমাবর্তনে এসেছেন দুটি কারণে- এক. তিনি সদ্য পাসকৃত শিক্ষার্থীদের সরাসরি অভিনন্দন জানানোর সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি, দুই. তিনি শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আশাহত করতে চাননি।
এবার তুলে ধরছি ভারতের সাধারণ এক নাগরিকের ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা, যিনি পেশায় একজন ডাক্তার এবং এক সেবা সংগঠনের (আইপিএইচ) স্বেচ্ছাসেবী। সংগঠনটির পক্ষ থেকে একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়ে থাকে নিয়মিতভাবে, যা ভিইডিএইচ সম্মেলন নামে আখ্যায়িত। সংগঠনের একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ডাক্তার সাহেবের ইচ্ছা হল রাষ্ট্রপতিকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর, যিনি সম্মেলনে এসে তাদের হয়ে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কিছু বলবেন।
রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি চিঠি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেন ডাক্তার সাহেব। চিঠি পাঠানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে যোগাযোগ করা হয় ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয় তাকে। সাক্ষাতের স্থান ছিল রাজভবন, মুম্বাই। আসলে রাষ্ট্রপতি ড. কালাম ওই সময়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে মুম্বাই পরিদর্শনে এসেছিলেন।
ডাক্তার সাহেব স্বাভাবিকভাবেই চলে এলেন রাজভবনে, সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। নির্দিষ্ট সময়েই রাষ্ট্রীয় সাক্ষাৎ কক্ষে প্রবেশ করলেন। রাষ্ট্রপতি উঠে এলেন এবং নিজেই হাত বাড়িয়ে দিলেন শুভেচ্ছা বিনিময়ের লক্ষ্যে। ডাক্তার সাহেব হাতের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিলেন। অতঃপর দু’জনে পাশাপাশি আসন গ্রহণ করলেন, যেভাবে রাষ্ট্রীয় প্রধানরা করে থাকেন।
সঙ্গে ছিল ফুলসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। ডাক্তার সাহেব একে একে তার নিজের এবং সংগঠন ও সম্মেলনের কথা বললেন, পূর্ববর্তী সম্মেলনের কিছু ছবিও দেখালেন রাষ্ট্রপতিকে। ড. কালাম খুব বিনয়ী হয়ে মতবিনিময় করলেন। তার সম্পর্কে ডাক্তার সাহেবের মূল্যায়ন ছিল- ‘হিজ ভয়েস ওয়াজ ভেরি সফট অ্যান্ড আই ফেলট অ্যাজ ইফ আই অ্যাম টকিং টু এ গ্রান্ড-ফাদারলি ফিগার। ’
এসব ঘটনা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি ও সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষক তথা নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক।
এই সম্পর্কে নেই কোন আন্তরিকতার অভাব। নেই কোন কৃত্রিমতা। এমন সম্পর্কই তো স্বাভাবিক এবং সবার কাম্য। নয় কি?
এবার ভাবা যাক নিজেদের কথা। ভাবা যাক আমাদের রাষ্ট্রপতি ও শিক্ষার্থী-শিক্ষক তথা সাধারণ নাগরিকের মধ্যে সম্পর্কে নিয়ে।
আমরা কি পারব অরাজনৈতিক সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততার বিশেষ কোন উদাহরণ দিতে? পারব কিছু অরাজনৈতিক ঘটনা তুলে ধরতে, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রপতি সাধারণ নাগরিকের প্রতি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক ও দায়িত্ব সচেতন? বর্তমানে আমাদের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে এক বিশেষ ধরনের অস্থিরতা- বুয়েট এর অন্যতম। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে আমরা শিক্ষকরা যেমন রয়েছি মানসিক যন্ত্রণায়, তেমনি শিক্ষার্থীরাও রয়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। আজকের এ পরিস্থিতি কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এর সূত্রপাত হয়েছিল বেশ আগেই। বিভিন্ন মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের শক্তিকে অভিহিত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি একাধারে বুয়েটের আচার্যও বটে।
স্বভাবতই বুয়েটের অস্থিরতার কারণগুলো সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন ও আছেন। বুয়েট অস্থিরতা ঘনীভূত হওয়ার সময় রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ কী ছিল? আদৌ কি কিছু ছিল? বর্তমান সম্পূর্ণ অচল অবস্থা নিরসনেই বা তার ভূমিকা কী? আচার্য হিসেবে তিনিই বুয়েটের প্রধান অভিভাবক। তার দায়িত্বপূর্ণ একটি বিবৃতি/ উদ্যোগ/ সিদ্ধান্তই হয়তো হতে পারত (এখনও পারে) অনেক কিছুর সমাধান। আমরা কি আজও তা পেয়েছি? প্রশ্ন থেকেই যায়।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য অপসারণের দাবিতে বুয়েটে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, বুয়েট পরিবার সিদ্ধান্ত নিল তাদের অভিভাবক মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের কাছে একটি স্মারকলিপি ও গণস্বাক্ষরপত্র জমা দেয়ার।
শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ গণযাত্রা শুরু হয় রাষ্ট্রপতি ভবন অভিমুখে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী থামিয়ে দেয় সে গণযাত্রা। অবশ্য এর পেছনে এক ধরনের যুক্তি হয়তো ছিল। অবশেষে অনুমতি মিলল এক প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে স্মারকলিপি ও গণস্বাক্ষরপত্র জমা দেয়ার। যাত্রা শুরু হল প্রতিনিধি দলের কিন্তু রাষ্ট্রপতির দেখা আর মিলল না।
তার কোন এক সচিব গ্রহণ করলেন স্মারকলিপি ও গণস্বাক্ষরপত্র। কী ভাগ্য আমাদের! পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যেখানে স্কুল পর্যায়ের (ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণী) শিক্ষার্থীদের নিজে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাষ্ট্রীয় রেওয়াজে দেখা করেন, সেখানে আমাদের রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিশেষ পরিস্থিতিতেও দেখা করতে পারেন না! এ বিচ্ছিন্নতা বা নিজেকে আড়াল করে রাখার অর্থ আমাদের বোধগম্য নয়। তবে এটা দৃঢ়ভাবে বলা যায়, এই জনবিচ্ছিন্নতা দেশের দক্ষ জনশক্তিকে একেবারেই আ্তকেন্দ্রিক করে তুলবে- কোনভাবেই দেশকেন্দ্রিক নয়। বুয়েট শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের গুরুত্ব যাই হোক না কেন, তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের গুরুত্ব রাষ্ট্রপতি অনুধাবন করবেন- এটাই সবার কাম্য। বুয়েটের ‘ঐতিহ্য আর গৌরব’ রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতিরও।
তার প্রতি অনুরোধ, শুধু নিরাপত্তার নয়- গড়ে তুলুন দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা ও মমত্ববোধের বলয়, যা কাছে টানবে সর্বস্তরের মানুষকে।
ড. ইকবাল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েটশুরু করছি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালামকে দিয়ে। ড. কালাম অনেক দিক থেকেই রয়েছেন ভিন্ন মাত্রায় ও অবস্থানে। কিন্তু যা এ লেখার সঙ্গে সম্পর্কিত তা হল তার সাধারণত্ব ও দায়িত্ববোধ অর্থাৎ নিজস্ব মূল্যবোধ ও অবস্থান সঠিকভাবে ধরে রেখে শিক্ষার্থী-শিক্ষক তথা সব মানুষের সঙ্গে আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মেশার ক্ষমতা, মানসিকতা ও রীতি।
ড. কালামের ‘ভিশন ফর ইন্ডিয়া-২০২০’র আলোকে ইন্ডিয়ান এক স্কুল (সিআইআরএস) ২০০৭ সালে নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের কিছু ছুটিকালীন ভিন্নধর্মী অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের দেশ গড়ার কাজে অনুপ্রাণিত ও অভ্যস্ত করা।
ড. কালাম এ সম্পর্কে কোন একভাবে অবগত হন। শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবিত এক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ভারতের তিহার অঞ্চলে অবস্থিত এক কারাগারের বন্দিদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো ও মতবিনিময় করা। বিষয়টি ড. কালামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ড. কালাম ওই অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গে জড়িত ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণীর ৩২ জন শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকদের রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ জানান। ৭ মে, ২০০৭, বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ড. কালাম দেখা করেন আমন্ত্রিতদের সঙ্গে।
প্রথমেই আমন্ত্রিতরা যথাযথভাবে আপ্যায়িত হয়েছেন কিনা তা জানতে চান তিনি। পরে একে একে জানতে চান শিক্ষার্থীদের মূল উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। কথা প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীরা কারাবন্দিদের সম্বোধনে কোন এক প্রচলিত কিন্তু অনুচ্চ শব্দ প্রয়োগ করে। তৎক্ষণাৎ ড. কালাম একজন দায়িত্ববান শিক্ষক বা অভিভাবকের মতো শুধরে দেন শিক্ষার্থীদের- শিখিয়ে দেন কারাবন্দিদের সঙ্গে কথা বলার বিভিন্ন কৌশল। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কাছে দিয়ে দেন কারাবন্দিদের জন্য শুভেচ্ছাসহ এক বিশেষ বার্তা।
কথা বলেন অন্যান্য বিষয়ে, জবাব দেন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের। অবশেষে নিজে আমন্ত্রিতদের নিয়ে যান ফটোসেশন লনে। ফটো উঠানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মজা করতে ভোলননি তিনি। রাষ্ট্রপতি ড. কালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য ছিল- ‘প্রেসিডেন্ট ড. কালাম ইজ এ ইনসপায়ারিং টিচার অ্যান্ড এ লাভলি এলডার অব দ্য ফ্যামিলি। ’
এবার অন্য আরেকটি ঘটনা।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (্এনআইটি, রুকেলা) ৭ম সমাবর্তনে প্রধান অতিথি হিসেবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. কালামের উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু বাদ সাধে প্রতিকূল আবহাওয়া। রাষ্ট্রপতিকে বহনকারী নির্দিষ্ট হেলিকপ্টারটির উড্ডয়ন কোনভাবেই সম্ভব ছিল না তখন। বাস্তবতার নিরিখে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে তিনি সমাবর্তনে যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন অথবা সমাবর্তন অনুষ্ঠান বিলম্বিত করবেন। কিন্তু এর কোনটিই ঘটেনি।
ড. কালাম নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই ট্রেনে করে যাত্রা শুরু করেন এবং দশ ঘণ্টার যাত্রা শেষে যথাসময়ে এনআইটিতে পৌঁছান। তার মুখে ছিল না কোন ক্লান্তি বা বিরক্তির ছাপ, বরং চিরচেনা হাস্যোজ্জ্বল মুখেই এলেন সমাবর্তন মঞ্চে। জানা যায়, প্রতিকূল আবহাওয়ায় দশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তিনি অবশেষে সমাবর্তনে এসেছেন দুটি কারণে- এক. তিনি সদ্য পাসকৃত শিক্ষার্থীদের সরাসরি অভিনন্দন জানানোর সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি, দুই. তিনি শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের আশাহত করতে চাননি।
এবার তুলে ধরছি ভারতের সাধারণ এক নাগরিকের ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা, যিনি পেশায় একজন ডাক্তার এবং এক সেবা সংগঠনের (আইপিএইচ) স্বেচ্ছাসেবী। সংগঠনটির পক্ষ থেকে একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়ে থাকে নিয়মিতভাবে, যা ভিইডিএইচ সম্মেলন নামে আখ্যায়িত।
সংগঠনের একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ডাক্তার সাহেবের ইচ্ছা হল রাষ্ট্রপতিকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর, যিনি সম্মেলনে এসে তাদের হয়ে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কিছু বলবেন। রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি চিঠি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেন ডাক্তার সাহেব। চিঠি পাঠানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে যোগাযোগ করা হয় ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয় তাকে। সাক্ষাতের স্থান ছিল রাজভবন, মুম্বাই।
আসলে রাষ্ট্রপতি ড. কালাম ওই সময়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে মুম্বাই পরিদর্শনে এসেছিলেন। ডাক্তার সাহেব স্বাভাবিকভাবেই চলে এলেন রাজভবনে, সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। নির্দিষ্ট সময়েই রাষ্ট্রীয় সাক্ষাৎ কক্ষে প্রবেশ করলেন। রাষ্ট্রপতি উঠে এলেন এবং নিজেই হাত বাড়িয়ে দিলেন শুভেচ্ছা বিনিময়ের লক্ষ্যে। ডাক্তার সাহেব হাতের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিলেন।
অতঃপর দু’জনে পাশাপাশি আসন গ্রহণ করলেন, যেভাবে রাষ্ট্রীয় প্রধানরা করে থাকেন। সঙ্গে ছিল ফুলসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। ডাক্তার সাহেব একে একে তার নিজের এবং সংগঠন ও সম্মেলনের কথা বললেন, পূর্ববর্তী সম্মেলনের কিছু ছবিও দেখালেন রাষ্ট্রপতিকে। ড. কালাম খুব বিনয়ী হয়ে মতবিনিময় করলেন। তার সম্পর্কে ডাক্তার সাহেবের মূল্যায়ন ছিল- ‘হিজ ভয়েস ওয়াজ ভেরি সফট অ্যান্ড আই ফেলট অ্যাজ ইফ আই অ্যাম টকিং টু এ গ্রান্ড-ফাদারলি ফিগার।
’
এসব ঘটনা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি ও সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষক তথা নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক। এই সম্পর্কে নেই কোন আন্তরিকতার অভাব। নেই কোন কৃত্রিমতা। এমন সম্পর্কই তো স্বাভাবিক এবং সবার কাম্য। নয় কি?
এবার ভাবা যাক নিজেদের কথা।
ভাবা যাক আমাদের রাষ্ট্রপতি ও শিক্ষার্থী-শিক্ষক তথা সাধারণ নাগরিকের মধ্যে সম্পর্কে নিয়ে। আমরা কি পারব অরাজনৈতিক সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততার বিশেষ কোন উদাহরণ দিতে? পারব কিছু অরাজনৈতিক ঘটনা তুলে ধরতে, যা প্রমাণ করে রাষ্ট্রপতি সাধারণ নাগরিকের প্রতি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক ও দায়িত্ব সচেতন? বর্তমানে আমাদের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে এক বিশেষ ধরনের অস্থিরতা- বুয়েট এর অন্যতম। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে আমরা শিক্ষকরা যেমন রয়েছি মানসিক যন্ত্রণায়, তেমনি শিক্ষার্থীরাও রয়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। আজকের এ পরিস্থিতি কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এর সূত্রপাত হয়েছিল বেশ আগেই। বিভিন্ন মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের শক্তিকে অভিহিত করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি একাধারে বুয়েটের আচার্যও বটে। স্বভাবতই বুয়েটের অস্থিরতার কারণগুলো সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন ও আছেন। বুয়েট অস্থিরতা ঘনীভূত হওয়ার সময় রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ কী ছিল? আদৌ কি কিছু ছিল? বর্তমান সম্পূর্ণ অচল অবস্থা নিরসনেই বা তার ভূমিকা কী? আচার্য হিসেবে তিনিই বুয়েটের প্রধান অভিভাবক। তার দায়িত্বপূর্ণ একটি বিবৃতি/ উদ্যোগ/ সিদ্ধান্তই হয়তো হতে পারত (এখনও পারে) অনেক কিছুর সমাধান। আমরা কি আজও তা পেয়েছি? প্রশ্ন থেকেই যায়।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য অপসারণের দাবিতে বুয়েটে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, বুয়েট পরিবার সিদ্ধান্ত নিল তাদের অভিভাবক মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের কাছে একটি স্মারকলিপি ও গণস্বাক্ষরপত্র জমা দেয়ার। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ গণযাত্রা শুরু হয় রাষ্ট্রপতি ভবন অভিমুখে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী থামিয়ে দেয় সে গণযাত্রা। অবশ্য এর পেছনে এক ধরনের যুক্তি হয়তো ছিল। অবশেষে অনুমতি মিলল এক প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে স্মারকলিপি ও গণস্বাক্ষরপত্র জমা দেয়ার।
যাত্রা শুরু হল প্রতিনিধি দলের কিন্তু রাষ্ট্রপতির দেখা আর মিলল না। তার কোন এক সচিব গ্রহণ করলেন স্মারকলিপি ও গণস্বাক্ষরপত্র। কী ভাগ্য আমাদের! পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যেখানে স্কুল পর্যায়ের (ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণী) শিক্ষার্থীদের নিজে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাষ্ট্রীয় রেওয়াজে দেখা করেন, সেখানে আমাদের রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিশেষ পরিস্থিতিতেও দেখা করতে পারেন না! এ বিচ্ছিন্নতা বা নিজেকে আড়াল করে রাখার অর্থ আমাদের বোধগম্য নয়। তবে এটা দৃঢ়ভাবে বলা যায়, এই জনবিচ্ছিন্নতা দেশের দক্ষ জনশক্তিকে একেবারেই আ্তকেন্দ্রিক করে তুলবে- কোনভাবেই দেশকেন্দ্রিক নয়। বুয়েট শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের গুরুত্ব যাই হোক না কেন, তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের গুরুত্ব রাষ্ট্রপতি অনুধাবন করবেন- এটাই সবার কাম্য।
বুয়েটের ‘ঐতিহ্য আর গৌরব’ রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতিরও। তার প্রতি অনুরোধ, শুধু নিরাপত্তার নয়- গড়ে তুলুন দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা ও মমত্ববোধের বলয়, যা কাছে টানবে সর্বস্তরের মানুষকে।
ড. ইকবাল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েট ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।