আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতিময় বুয়েট

সবার উপরে মানুষ সত্য!

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। জ্বি হ্যাঁ, আজকে আমি আমার বুয়েট জীবনের কথাই বলব। বুয়েটে আমি সর্বমোট ৬ বছর অতিক্রম করেছি (স্নাতক ৫ বছর আর স্নাতকোত্তর ১ বছর)। ৬ বছরের এই স্মৃতিময় বুয়েটকে আপনাদের সামনে তুলে ধরার জন্যই আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। সাধারণত "বুয়েট" বলতেই সবার সামনে ভেসে ওঠে একদল ছেলে-মেয়ে সারাদিন পড়ালেখা করছে (যাদেরকে আমরা আঁতেল বলে থাকি).....তাদের কাজ হলো শুধু পড়া আর পড়া......দুনিয়ায় যেন পড়ালেখা ছাড়া আর কোন কাজই নাই।

বুয়েটের বাইরের সবার এইরমই ধারণা......বুয়েটে ঢোকার আগে আমারও তাই ধারণা ছিল.....কিন্তু আসলে কথাগুলা সম্পূর্ণই ভুল। প্রকৃতপক্ষে এইরূপ আতেলদের পরিমাণ বুয়েটে শতকরা ২০ ভাগ। এইবার আসা যাক প্রকৃত বুয়েটিয়ানদের কথায় (বাকি ৮০ ভাগ)...........তবে প্রথমেই বলে রাখি, এই স্মৃতিচারণমূলক লেখার প্রতিটা মন্তব্য আর কাহিনীই একান্তই আমার ব্যক্তিগত, আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা......অনিচ্ছাকৃত কোন নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠিকে আঘাত করে থাকলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি...... বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে ২০০৩ সালে আমার বুয়েটে আগমন.....বুয়েটে শুভাগমনের কাহিনী আজকে আর নাই বা বললাম.....সে এক মহাকাব্য হয়ে যাবে। প্রথম বর্ষের বেশির ভাগ দিনই ক্লাস শুরু হত সকাল ৮ ঘটিকার সময়......আর আমার কাজ ছিল পিছনের বেঞ্চে আরোও কিছু পোলাপাইনদের সাথে লাইন দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা......সেই ঘুম ভাঙত সকাল ১১ টায়, এর মাঝে উপস্থিতির কাগজ আসলে তাতে স্বাক্ষর করে আবার ঘুম। তো ঘুম নিয়ে অনেক মজার অভিজ্ঞতা আছে....... শীতের সকাল......মনিরুজ্জামান স্যারের ক্লাস....আমরা পিছনে গভীর ঘুমে মত্ত.......হঠাৎ স্যার বলে উঠলেন, "তোমরা সাথে লেপ-কাথা আর বালিশ নিয়ে আসলেও পারতে, তাহলে ঘুমটা আরো ভাল হত"......সাথে সাথে সারা ক্লাস হো হো হাসিতে ভরে উঠলো।

আরেক দিনের কাহিনী, মনিরুজ্জামান স্যার ক্লাস টেস্টের খাতা দিচ্ছেন......আমার ডাক পড়ল....গেলাম খাতা আনতে.....স্যার বললেন, "ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তো দেখি ভালো নম্বরই পেয়েছ".......আমি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে খাতাটা নিয়ে ফিরে এলাম...... এরপর ১১ টার ক্লাস শেষে, বন্ধুরা (বন্ধু বলতে ছেলে-মেয়ে সবাই, কোন লিঙ্গ-বৈষম্য নাই) মিলে শিক্ষক ক্যান্টিন যাওয়া.....সেইখানে সিড়িতে বসে খাওয়া হত সস্তা দরের জিলাপি, সিংগারা, আলুর চপ আর চা......আবার বুয়েট ক্যাফেতেও যাওয়া হত। এইভাবে সকাল পেরিয়ে দুপুর হলেই মধ্যাহ্নভোজের সন্ধানে বের হতাম.....প্রধান ধান্দা ছিল, কিভাবে কম খরচে অধিক খাবার খাওয়া যায়......সমাধান ছিল একটাই.....আর তা হলো, নজরুল ইসলাম হলের ডাইনিং-এ অবৈধভাবে প্রবেশ করা.......সামনে আর পিছনে আমার দুই বন্ধু (তারা আবাসিক ছাত্র), আর মাঝখানে আমি....কঠিন ভাবের সহিত আমি নজরুল ইসলাম হলের ডাইনিং-এ ঢুকে পড়লাম.......অপেক্ষামান পাহারাদার ভাবলেন, আমি বুঝি এই হলেরই আবাসিক ছাত্র.......শুরু হয়ে গেল, মাগনা খাওয়া..........ভাত আর পানি ডাল যত্ত পারো খাও.......এর পর থেকে একাই ঢুকতাম, দারওয়ান মামা ভেবেই নিয়েছিলেন যে আমি একজন বৈধ কাস্টমার........এই নজরুল ইসলাম হলের কাছে তাই আমি আজও কৃতজ্ঞ........... মাঝে মাঝে যাওয়া হত নীলক্ষেতের ঐতিহাসিক গরুর তেহারি খেতে.....আসলে ঐটা যে গরু না মহিষ না কিসের মাংস ছিল, তা আজও আমার কাছে রহস্য......মধ্যাহ্নভোজের পর দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৫ ঘটিকা পর্যন্ত চলত ব্যবহারিক/ প্রায়োগিক ক্লাস......বিকালে আবার সবাই মিলে ক্যাফেতে অথবা পলাশীতে খেতে যাওয়া.......সন্ধ্যার পর ২/৩ টা টিউশনি করানো.........রাতে সবাই মিলে গ্রুপ-প্রজেক্ট করতে বসা........আবার সকাল..........আবার ক্লাসের মাঝে ঘুম................চলছে........... __________________________________________________________________________________________ রাত্রে সবাই মিলে শেরে-বাংলা হলে সিনেমা দেখছি......হঠাৎ খবর আসল নজরুল হলে বিদ্যুৎ চলে গেছে আর এইটাই সুযোগ..........সবাই মিলে চলে গেলাম নজরুল হলের ছাদে......গিয়ে দেখি আরো অনেকেই আছেন......পাশের ঢাকা মেডিকেলের কলেজের ছাত্রাবাসের উপর চলছে বাচনিক আক্রমন.......আমার প্রস্তুতির দরকার নাই, শুরু করে দিলাম মনের মাধুরী মিশিয়ে বাক-যুদ্ধ.......মেডিকেলের ছাত্ররাও থেমে নেই (যদিও তাদের হলে বিদ্যুৎ আছে), তারাও কম যায় না......হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই চলছে......হঠাৎ আমাদের দল হালকা লাগছে......কাহিনী কি.....নজরুল হলে কারেন্ট চলে এসেছে, ওহহহহ............হতাশ চিত্তে ফিরে গেলাম নিজ হলে...... মাঝে মাঝে পোলাপাইন নিয়ে, তিতুমীর হলের নিজ রুমের বাইরে রাত ঠিক ১১:৫৯ মিনিটে দাঁড়িয়ে থাকতাম......কখন বাজবে ১২ টা.....কেননা, ঠিক ১২ টায় ১ মিনিটের জন্য সমগ্র বুয়েটে কারেন্ট চলে যায়....আর এই ১ মিনিটের মহা-মূল্যবান সময়টাকেই কাজে লাগাতে হবে......আমাদের কঠোর প্রতিদ্বন্দী ছিল সামনের ব্লকের পোলাপাইনরা.....সে কি আনন্দের সময়, আহা......... বুয়েটে পড়াকালীন, আমাদের নগর পরিকল্পনা বিভাগের ছাত্রদের ক্রিকেট খেলার প্রতি ছিল একটা আশ্চর্যরকম ঝোঁক......আমাদের ক্রিকেট টিমটার সুনামও ছিল অনেক.....ক্যাফেতে টেপ-টেনিস ক্রিকেটে, আর কাউকে না পাওয়া গেলেও আমাদেরকে পাওয়া যাবেই......প্রতি সপ্তাহেই একাধিক ক্রিকেট ম্যাচ থাকবেই কোন না কোন দলের সাথে.......এরই সুবাদে অনেক বড় আর ছোট ভাইদের সাথে পরিচয়.....আর নিজেদের ব্যাচমেট তো আছেই.....মহান তুহিন ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে আর্কিটেকচার অনুষদের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে.....আরোও ছিল শাকিল ভাই, মাজহার ভাই, শুভ ভাই, রাজিব ভাই, পলাশ ভাই, মাসুম ভাই, টুটুল ভাই, সৈকত দা, এস্রাজ মামা, এমিন ভাই......... এই রকম বহু বহু বড় ভাইদের কথা মনে পড়ছে আজ......একসাথে আড্ডা, গল্প, ক্রিকেট, খেতে যাওয়া.......উনারা আমাদের সাথে ঠিক নিজেদের বন্ধুর মত করেই আচরণ করতেন, কখনো কিছু চেয়ে উনাদের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে আসিনি........মাঝে মাঝে মনে হত যেন উনারা আমার আপন ভাইদের চেয়েও অনেক বেশি.......উনাদের কাছ থেকে শিখেছিলাম কিভাবে মানুষ হয়ে মানুষের সাথে আচরণ করতে হয়......শিখেছি কিভাবে সবাই একই পরিবারের মত বেড়ে উঠতে পারি........কিন্তু আজ যখন দেখি, সিনিয়র আর জুনিয়র সংঘর্ষে বুয়েট বন্ধ......তখন নিজেকে একজন বুয়েটিয়ান হিসাবে পরিচয় দিতেও লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়...........!! এমনিভাবে ঘুম, ক্লাস প্রজেক্ট, ক্রিকেট, গল্প, আড্ডা আর টিউশনি করাইতে করাইতে দেখি সামনে বাঁশময় "টার্ম ফাইনাল" পরীক্ষা হাজির........২ সপ্তাহ ছুটির পর থেকে পরীক্ষা শুরু হবে.......এখন কি করা যায়.....পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতেই হবে, যার জন্য দরকার পর্যাপ্ত সময়........কিন্তু এই স্বল্প সময়ে পরীক্ষা দিয়ে তো ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব না......অধিকাংশ বুয়েটিয়ানদেরই একই হাল.....এমতাবস্থায় সমাধান একটাই, আবার জিগায়...........শুরু হলো পরীক্ষা পিছানোর আন্দোলন.......প্রতি রাতে সকল হলের ছাত্ররা মিলে এই মিছিল পরিচালনা করত.......রাত ১২ টার পর বিকট আওয়াজ উঠত......"জ্বালো, জ্বালো.......আগুন জ্বালো........ভিসির গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে"........এই মুহুর্তে আমাদের দাবি একটাই.........পরীক্ষা আরোও ২ সপ্তাহ পিছাইতে হবে আর ২ টি পরীক্ষার মাঝে ছুটি বাড়াতে হবে.........পর দিন সকালে আতেল-গ্রুপ ভিসির কাছে স্বারকলিপি দিলেন......আতেলরা চান পরীক্ষা যথাসময়ে হবে........আর কৈ যাবে.......আজকের রাতের মিছিলে নতুন একটা লাইন যুক্ত হলো......."আতেলের চামড়া, তুলে নিব আমরা"......আতেল তোরা মানুষ হ.............এইভাবেই সংখ্যালঘু আতেলদের পরাজয় ঘটল........জয়ী হল মেধাবী সাধারণ বুয়েটিয়ানরা.......এখন প্রতিটা পরীক্ষার আগে ১ সপ্তাহ ছুটি......এইভাবে বুয়েট আমাদেরকে শিখিয়েছে কিভাবে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়.......! এইবার পড়তে বসার সময়......খুঁজে দেখি কোন ক্লাস লেকচারই তুলি নাই.......চিন্তা নাই, আছে তোফায়েলের ঐতিহাসিক খাতা (সুন্দর হস্ত-লেখনীতে লেখা বিস্তারিত ক্লাস নোট).....সবাই মিলে তোফায়েলের সকল খাতা পলাশীতে মনির মামার দোকান থেকে ফটোকপি করাইলাম.....এইবার নতুন একটা সমস্যা এসে হাজির হল..........."এত্ত বিশাল ছুটিতে কি করা যায় ??".......নো চিন্তা, শুরু হল দুপুর বেলা টিউশনি করানো........সারারাত সিনেমা দেখা, এরপর রাতে পলাশীতে ডিম ভাজা আর পরাটা খাওয়া, সবাই মিলে মাঝরাতে জগন্নাথ হলের পুকুর পাড়ে গিয়ে আড্ডা.....আর গভীর-রাত্রে পুরান ঢাকার কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাসির পায়া দিয়ে নান রুটি খাওয়া......অথবা ঠাটারী বাজারের স্টার হোটেলের কাচ্চি বিরিয়ানি, লাচ্ছি আর রুই/রুঁপচাদা মাছের ঝোল......পেটপুরে খেয়ে এসে বুয়েট শহীদ মিনারের সিড়িতে বসে আবারও সুখ-দুঃখের গল্প.......তারপর ঘুম.....ঘুম থেকে উঠে টিউশনি............ভালই কাটছে মিছিলের মাধ্যমে কষ্টার্জিত ছুটির দিনগুলা....... হঠাৎ দেখি, আর মাত্র ৪ দিন পর পরীক্ষা.......এইবার আসলেই পড়ালেখা শুরু করলাম......সে যে কি কষ্ট ভাইরে, অন্যের চোঁথা আর খাতা দেখে পড়ার.......বুঝতে বুঝতেই অর্ধেক সময় শেষ........আমার হলের বিছানায় আমি একা কখনো ছিলাম বলে খুব একটা মনে পড়ছে না.....কেউ না কেউ থাকতই আমার সাথে........সারারাত পড়ার পর দুপুরে ঘুম থেকে উঠে ডাইনিং-এর সাদা ভাত, পানি-সদৃশ অমৃত ডাল আর এক টুকরা মুরগি/গরুর মাংস দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ.....এরপর বিকালে হলের ক্যান্টিনে "যা খুশি খাও, কিন্তু ৭ টাকা দাও" স্টাইলে খাইতাম.......মাঝে মাঝে আলম মামার উপরেও বাটপারি করতাম.......রুমে একটু পর পরই একটা পিচ্চি এসে ১ টাকা মূল্যের লেবু চা দিয়ে যেত........রাতে ঘুমানোর সময় রাকিব বিছানার তিন-চতুর্থাংশ জায়গা জুড়ে ঘুমাইত.......আর সাথে আছে 'ছার পোকা'র অদৃশ্য কামড়.....শেষ দিন না ঘুমিয়ে একটানা পড়ে পরীক্ষা দিতে যাইতাম......পরীক্ষা শেষে ক্লান্ত শরীরে বুয়েট ক্যাফেতে ক্রিকেট........আবার আড্ডা.........এইভাবেই শেষ হয়ে যায় টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাগুলা...........শুরু হয় নতুন আরেকটা টার্মের............ __________________________________________________________________________________________ এরই মাঝে শুরু হয় "লেভেল কমপ্লিশন" ..........ব্যাপকভাবে পরিচয় ঘটতে থাকে অন্যান্য বিভাগের নতুন বন্ধুদের সাথে.....আরেকটা নতুন জগতের সাথে যেন মিলন ঘটে.......লেভেল কমপ্লিশন উপলক্ষ্যে ফুটবল, ক্রিকেট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান, নাচ, কনসার্ট, পিকনিক....সে এক মহা-উৎসব.......আরো আছে আমাদের বিভাগের নবী-বরণ, প্রবীন বিদায়.......এই উপলক্ষেও ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিকনিক.....কোনটা থুয়ে কোনটা করব.....তারুণ্যের জয়-জয়কার যেন চারপাশে....এর মাঝে আছে আফতাব স্যারের এক ঝুড়ি চোথা মুখস্থ করা......সেই দুঃখে আমরা উনার ক্লাস বয়কট করলাম.....একদিন উঁকি দিয়ে দেখি ক্লাসে কেউই নাই, কিন্তু স্যার ক্লাস নিচ্ছেন........আমরা বিভাগীয় প্রধানের কাছে উনার ক্লাস করার পদ্ধতি নিয়ে নালিশ করলাম......কোন লাভ হল না, আফতাব স্যার এসে বললেন পরীক্ষা হবে......আমরা বললাম, আমরা তো জানি না সিলেবাস কি আর ক্লাসে তো কেউই ছিল না.........স্যার বললেন, "আমি ক্লাসের সময়ে ঠিকই ক্লাস নিয়েছি, তোমরা ছিলেনা তো কি হয়েছে, আমি বেঞ্চ আর টেবিলদের ক্লাস নিয়েছি....আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি".......আমাদের মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ল......অতঃপর ওই পরীক্ষা কোন-রকমে পাশ করলাম...... এমনিকরে কোন এক টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার সময় পড়ে গেল "বিশ্বকাপ ফুটবল".......শুরু হল প্রবল মিছিল.....এইবারের মিছিলের সুরের রাগিনী হল........."দেখব এইবার বিশ্বকাপ, ভিসি বলে বাপরে বাপ"............আবার অপামর বুয়েটিয়ানদের জয়-জয়কার.....বুয়েট বন্ধ হয়ে গেল ১ মাসের জন্য.......এই এক মাসের বন্ধে পড়ালেখা যাও বা পারতাম, সব ভুলে গেলাম.......নতুন পরীক্ষার রুটিনকে তাই কেউই মেনে নিলাম না, নতুন করে আবার আন্দোলন শুরু হল.......এইবারের বিষয়বস্তু হল, "আতেল হটাও, বুয়েট বাঁচাও"........কিন্তু পরিস্তিতি অন্যদিকে মোড় নিল.......মাননীয় ভিসির নির্দেশে পুলিশ চড়াও হল বিক্ষোভকারী ছাত্রদের উপরে.......ছাত্ররাও এর পাল্টা জবাব দিল প্রত্যেকটি হল প্রায় ভেঙ্গে-চুরমার করে......ফলাফল বুয়েট ৩ মাসের জন্য বন্ধ........এর পর থেকে বুয়েটে পরীক্ষা পিছানোর মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল........ __________________________________________________________________________________________ দেখতে দেখতে চতুর্থ বর্ষের শেষ টার্মে এসে পৌঁছুলাম........শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি উপলক্ষ্যে আনন্দ-উৎসব..........বুয়েট ক্যাফের দখল এইবার আমাদের হাতে আসল......ক্লাস শেষে ক্যাফের সামনে গিয়ে আড্ডা আর গান-বাজনা......বিদায় উপলক্ষে আমাদের বিভাগ থেকে দেয়া হল বিদায় সম্ভাষণ.......জুনিয়র আর শিক্ষকদের স্নেহ আর ভালবাসায় পরিপূর্ণ ছিল সেই দিনটা...........নিজেরা আয়োজন করলাম রং খেলা উৎসব, বিশাল মিছিল আর ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে রথ-যাত্রা, এর আগে সমগ্র ব্যাচ মিলে গিয়েছিলাম গাজীপুরে পিকনিকে.....আরো আছে ফুটবল/ক্রিকেট টুর্নামেন্ট.....৩ দিন ব্যাপী আনন্দ-উৎসব....সিনেমা প্রদর্শনী....সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান....বন্ধুরা সবাই মিলে আমাকে "সেরা লুইস" পদক তুলে দিল.....হল থেকে বিদায়......হলের উইং থেকে জুনিয়ররা দিল প্রাণঢালা বিদায়....এরপর সমগ্র ব্যাচ মিলে এক বৃষ্টি-ভেজা রাতে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানালাম আমাদের প্রিয় বুয়েটকে..............! এরপর বুয়েটে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হলাম.....কিন্তু ১ বছরের মাথায় বিদেশে পাড়ি জমালাম উচ্চ-শিক্ষার আশায়.......আসার আগে ২০০৯ সালে আবার আমরা আয়োজন করলাম হেয়ালি' ২০০২ ব্যাচের পুনর্মিলনী......এইত গত '৩ রা ফেব্রুয়ারী' হয়ে গেল বুয়েটের ১০ম সমাবর্তন......এর মাধ্যমে বুয়েটের সাথে আমার সকল আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল......আসলে ছিন্ন হয়ে গেল বললে ভুল হবে, আমি স্বপ্ন দেখি আবারও ফিরে আসব এই বুয়েটে.......এইবার হয়তবা 'বুয়েট এলামনাই' সংগঠনের কোন অনুষ্ঠানের সূত্র ধরে অথবা অতীত-স্মৃতি রোমন্থনের জন্য একাকী ঘুরে-ফিরব.......তবুও বার বার ফিরতে চাই আমি বুয়েটের মায়াবী ক্যাম্পাসে.......!! __________________________________________________________________________________________ কিছুদিন পূর্বে ফেইসবুকে, বর্তমানে বিদেশে শিক্ষারত একজন বুয়েটিয়ানের কাছ থেকে একটি মন্তব্য পেলাম.........."ছিঃ ছিঃ, বুয়েটের হলে একজন মানুষ থাকতে পারে কিভাবে?".......[সে হলের বাথরুম আর সাধারণ রুমের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল].......আমি নির্বাক হয়ে পড়লাম......আরোও এক গ্রুপকে দেখতে পাই, যারা কটুক্তি করছেন.......বাংলাদেশে চাকরি/কাজ করার সুযোগ অথবা বুয়েটের শিক্ষা-ব্যবস্থার অথবা বুয়েটের শিক্ষকদের শিক্ষাদান পদ্ধতি অথবা সামগ্রিক বুয়েট/ বাংলাদেশকে নিয়ে.......আমি বুঝতে পারছি, বহির্বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সুযোগ-সুবিধার তুলনায় বাংলাদেশ অথবা বুয়েট অনেক পিছিয়ে.........তাই বলে কি, নিজের দেশ আর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে তুচ্ছ করা মানে কি একর্থে নিজেকেই অপমাণিত করা নয়? নিজের মা কালো হলে কি সেই মাকে আপনি বলতে পারবেন, 'মা তুই পঁচা'.....তেমনি নিজের দেশ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিন্দা করার কোন অধিকার কি আমাদের আছে? আমাদের আজ ভুলে গেলে চলবেনা যে, এই দেশ আর এই গরিব দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা দিয়েই আমরা বুয়েটে পড়েছি......আমার জানা মতে, একজন স্নাতক পর্যায়ের বুয়েটিয়ানের পিছনে বাংলাদেশ সরকার গড়ে ৮/১০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন.....আর এই টাকার উৎস হল বাংলাদেশের সাধারণ গরিব মানুষ। তাই আপনাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ থাকবে, আপনারা যে যেখানেই আছেন (দেশ অথবা বিদেশ)........দয়া করে আপনারা নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য বাংলাদেশের অপমান করবেন না........আপনারা দরকার হলে বাকি জীবন আমেরিকা বা কানাডা বা ইউরোপে কাটিয়ে দেন, এতে আমার কোনই আপত্তি নেই.......কিন্তু দয়া করে বুয়েট তথা বাংলাদেশের অপমান করবেন না........মনে রাখবেন, এই বুয়েটেই পড়ালেখা করে আপনি আজ এত্ত বড় কোন অবস্থানে আছেন......নিজের শেকড়কেই যদি আপনি হেও করেন, তাহলে আপনার ডালপালার ভবিষ্যত অনুজ্জল বলেই আমি মনে করি.......! _____________________________________________ পাস করার অনেক দিন পর, আমার মোবাইলে অচেনা একটি নাম্বার থেকে কল আসল......ওপাশ থেকে একটি কন্ঠস্বর ভেসে উঠলো, "বায়েস ভাই, আমি আহাদ.....আপনার নাম্বার কালেক্ট করে ফোন দিলাম, আপনি কেমন আছেন?".........[আহাদ হলের ক্যান্টিনে কাজ করত......অতিরিক্ত হিসাবে, সে আমার জামা-কাপড় আর আমার হলের রুম পরিষ্কার করত].........আমি খুবই অবাক হয়ে পড়লাম.....কোন রকমে জবাব দিলাম, "আমি ভালো আছি, তোমার খবর কি?"........এইরকম একটা অশিক্ষিত ছেলে হয়েও, কোন কারণ ছাড়াই আমাকে কল দিল......আর আমি একজন বুয়েটের ডিগ্রিধারী হয়েও তার কথা ভুলে গেলাম, একবারও খবর নিলাম না....সে কেমন আছে ?? আহাদ আমাকে বুঝিয়ে দিল, কিভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়......শুধু স্বার্থ না থাকলেও যে মানুষ পর হয়ে যায় না, তা এই গরিব ছেলেটা আমাকে শিখিয়ে দিল......ওর মোবাইল নাম্বার এখনো আমার আমার কাছে সংরক্ষিত আছে......কিন্তু লজ্জায় আমি ওকে আর কোনদিনও ফোন দেই নাই......যেদিন মানুষ হব, সেইদিন আমি ওকে ফোন দিব.......প্রকৃত মানুষ হবার অপেক্ষায় রইলাম...............

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।