আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দড়ি ধরে মারো টান...

স্কুলজীবনে ‘এইম ইন লাইফ’ কিংবা ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা সবাই লেখে। দুটো নম্বর বেশি পাওয়ার লোভে অনেকেই লিখে আসে ‘আমি শিক্ষক হতে চাই’। যেহেতু খাতাটায় নম্বর একজন শিক্ষকই দেবেন, তাঁকে খুশি করার ব্যাপার-স্যাপার তো আছেই। অনেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথাও জানায়। তবে কেউ লেখে না, ‘আমি মেয়র হতে চাই’।


কেন, মেয়র হলে সমস্যা কী? মেয়র হলে তো জনগণের সেবা করা যায়। মেয়র হলে একটি নগরের ‘পিতা’ হিসেবে নগরবাসীর দেখভাল করার পুণ্যি পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়র হলে ‘বৈধ’ উপায়েই আপনি আপনার আয় বাড়িয়ে নিতে পারবেন অনেক। অর্থবিত্ত-প্রাচুর্যের মেদ জমবে শরীরে।
খুলনার বিদায়ী মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের কথা ধরুন।

২০০৮ সালের মেয়র নির্বাচনের সময় খালেকের যা বার্ষিক আয় ছিল, সেটা দেখে চোখ পানি চলে আসতে পারে আপনার। মাত্র তিন লাখ ৬২ হাজার টাকা। এই দুর্মূল্যের বাজারে খালেক মাসে আয় করতেন মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
মেয়র হওয়ার পরই ভাগ্যদেবী তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। ২০১৩ সালে তাঁর বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৬৭ লাখ টাকায়।

ব্যবধানটা ‘সামান্য’ই। ২০০৮ সালের ‘তিন লাখ’টা এবার হয়েছে ‘চার কোটি’! আর ‘৬২ হাজার’টা হয়েছে ‘৭৬ লাখ’! খালেকের আয় বেড়েছে চার কোটি ৬৩ লাখ টাকারও বেশি! প্রত্যেক বাক্যের শেষে একটা করে ‘বিস্ময় চিহ্ন’ লাগছেই। খালেকের আয় যে এই সময়টায় বেড়েছে ১৩০ গুণ!
শুধু যে খালেকের আয় বেড়েছে তা কিন্তু নয়। ‘বৈধ’ভাবেই এ সময়টায় তাঁর ওপর নির্ভরশীল আত্মীয়স্বজনদের আয়ও বেড়েছে ৪৮ লাখ টাকা। আয় বৃদ্ধির পরিমাণটা অস্বাভাবিক বলেই অন্ধজনেরও চোখে লাগে।

রাতকানা রোগীও চোখ কপালে তুলে দেয়। তবে গত ১৬ মে ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত প্রতিবেদনে খালেক জানিয়েছেন, ‘গত পাঁচ বছরে বৈধভাবে ব্যবসা করে আমি এই আয় করেছি। ’ আমরা তাঁর এই কথার প্রতি শতভাগ আস্থাশীল। এ জন্যই বলছি, মেয়র হন। আমার ধারণা, কেবল মেয়রই একমাত্র ‘পেশা’, যার মাধ্যমে বার্ষিক আয় পাঁচ বছরের মধ্যেই ১৩০ গুণ বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব।

যেটা বিল গেটসের পক্ষেও সম্ভব নয় সম্ভবত।
শুধু খুলনার খালেক নন, এ সময়টায় বাকি তিন সিটি করপোরেশনের মেয়রেরও আয় বেড়েছে। তাঁদের দেওয়া হলফনামাই এর প্রমাণ। রাজশাহীর এ এইচ এম খায়রুজ্জামানের আয় দুই লাখ ৪৪ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৮ লাখ ৭৫ হাজার। বরিশালের শওকত হোসেনের আয় ছয় লাখ ১২ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে তিন কোটি ৪৬ লাখ; প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী সিলেটের বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের আয় দুই কোটি ২১ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ১৭ লাখ।

তিনিই সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। নিজের আয় বৃদ্ধি সম্পর্কে ‘প্রথম আলো’কে তিনি বলেছেন, ‘আমার উপার্জন, সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে পাওয়া সম্মানী এবং প্রবাসী আত্মীয়স্বজন ও বোনের উপহার থেকে এসব অর্থ পেয়েছি। ’ এমন দিলদরিয়া আত্মীয়স্বজন যেন আরও অনেকের কপালে জোটে।
এই লেখাটি লেখার সময় মোটামুটি নিশ্চিত, ক্ষমতাসীন চার মেয়রের দড়ি ধরেই হ্যাঁচকা টান মেরেছেন সেখানকার ভোটাররা। এই চার প্রার্থীই ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট-সমর্থিত।

এই চার প্রার্থী হেরে যাওয়া মানে শুধু প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরাজয় নয়। এই পরাজয় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন জোটের কাছে দেশের চারটি বড় শহরের ভোটারদের একটি বার্তাও। গত প্রায় পাঁচ বছরে যে পরীক্ষা দিয়েছে সরকার, সেটিরই খাতা দেখতে শুরু করেছেন ভোটাররা। সেখানে ‘এইম ইন লাইফ’ যা-ই লিখুন না কেন, ‘শিক্ষক’ হিসেবে সাধারণ মানুষের মন গলানো এত সহজ নয়।
কিন্তু এটাও কিছুটা, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক প্রকটভাবে সত্যি, আমাদের দেশে আসলে কোনো দলই জেতে না।

আমাদের দেশে একটা দল হারে। আর সেই হারের সুফল পায় অন্য দল। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি জোটের জয় যদি হয়ও, সেটি যতটা ১৮-দলীয় জোটের জয়, তার চেয়েও বেশি আওয়ামী লীগসহ ১৪-দলীয় জোটের পরাজয়।
নতুনভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের আগাম অভিনন্দন। তবে তাঁদের একটা কথাও মনে করিয়ে দেওয়া যায়।

‘খালেকের আয় বেড়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা’—গত ১৬ মে ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে শফিকুল ইসলাম নামের একজন অনলাইন পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘অদল-বদল করে আমরা আরও কয়েকজনকে বড়লোক বানাতে পারি। ’
সত্যিই কি তাই? দড়ি ধরে টান মেরে যেমন এক রাজাকে খানখান করা যায়, একইভাবে দড়ি দিয়ে টেনেই তো আরেক রাজাকে দাঁড় করানো হয়। ‘প্রজাতন্ত্রে’র এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সে রকমই আরেক ‘রাজা’র আসনে নিজেকে দাঁড় করাবেন, নাকি পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শিক্ষা নেবেন, সে তো সময়ই বলে দেবে। তবে আসল রাজা যে জনগণ, সেটা আরও একবার প্রমাণিত। জনগণের হাতেই রয়েছে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী জাদুর কাঠি, যার নাম ব্যালট!।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।