I am very simple man শান্ত, আমার বাংলাদেশী ক্লাস-মেট, একজনকে দেখিয়ে দিয়ে মজা করে বলছে, ‘ও তো নোবেল পাবে!’
আমার আর এক ইরানি ক্লাস-মেট, আলি রেজার তাৎক্ষনিক উত্তর, ‘নোবেল, মেড ইন চায়না!’
আসলেই! চায়নিজ পণ্য সারা পৃথিবীর মার্কেটে যেভাবে ছড়িয়ে গেছে, এরপর কোনদিন যদি চায়না নোবেল পুরুস্কার দিতে শুরু করে তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না! কারণ, সুইডেনের গাড়ী নির্মানকারী কোম্পানী ‘ভলভো’ যখন চায়নার হাতে চলে যায়, কিংবা ‘সনি এরিকসন’ থেকে এরিকসন বাদ পড়ে সুধু ‘সনি’ হয়ে যায়, তখন আলফ্রেড নোবেলের উইল করে যাওয়া সম্পত্তি চায়না কিংবা অন্য দেশের দখলে যেতে কতক্ষন! আর সব সেক্টরে চায়নার এই জয়জয়কার হবেই বা না কেন! গুরুজীর কোর্সে বলা সেই গল্পটির কথা স্মরণ করুন না- “এক পাশে একটি বিশাল মাছ রাখা আছে, আর এক পাশে মাছ ধরার জাল। বাঙালী ইয়া আলী কিংবা মা কালী বলে মাছের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। বাঙালীর চিন্তা, আজকে এই মাছ দোপেয়াজো বানিয়ে খাওয়া যাবে। আর অপর দিকে সেই চাইনিজ, চ্যাং চুং বলে জালটি নিয়ে নিল। তার চিন্তা, সারা বছর এই জাল দিয়ে মাছ ধরে খাওয়া যাবে।
“
মার্কেটে যেয়ে কোন একটি জিনিস হয়তো খুব পছন্দ হলো; একটু নেড়ে চেড়ে দেখলেই একটি লিখা চোখে পড়বে, “Made in China”. এসব চাইনিজ প্রোডাক্ট যে বেশীদিন টেকে না, তা সকলেরই জানা। এ নিয়ে অনেক মজার কৌতুক রয়েছে। একটি কৌতুক এরকম- এক বাঙালী এক চাইনীজ মেয়েকে বিয়ে করেছে। কয়েক মাস পরেই বউ স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছে। তখন সেই বাঙালীর এক বন্ধু তাকে বলছে, ‘তোকে আগেই বলেছিলাম, চাইনীজ মেয়ে বিয়ে করিস না।
চাইনীজ প্রোডাক্ট বেশী দিন টিকবে না”। আর একটি কৌতুক এরকম, “Life is heaven if you have a German car, American salary, Chinese food and Bengali wife. But the life is hell if the car is Chinese, food German, wife American and salary Bengali.”
কৌতুক কথা কয়ে কি কাজ! আসল কথায় আসি। Cubus নামের একটি শোরুম থেকে একটি জিন্স প্যান্ট কিনেছি। বাসায় নিয়ে এসে পড়ে দেখছি কেমন লাগে। শোরুমে ট্রায়াল দেয়ার সময় ভালোয় লাগছিল! এখন দেখি আমার দ্বিতীয় স্বত্ত্বা কি কি সব বলছে! সে বলছে, এই প্যান্টের জিপার অনেক ছোট।
সুতরাং এটি লেডিস প্যান্ট হতে পারে। এটা পড়ে কোথাও বের হলে লজ্জ্বায় তোর মাথা কাটা পড়বে! গতকাল কেনার সময় স্যাল'স গার্লসরা এ ব্যাপারে কিছু বলে নি। হয়তো ভেবে থাকতে পারে, 'আমার গার্ল ফ্রেন্ডের জন্য কিনছি'! তাই কি আর করা, পরেরদিন সেটা চেন্জ করতে নিয়ে গেলাম। কিন্তু যে সেল্ফে সেই প্যান্টগুলো রাখা আছে সেগুলোর পেছনে বিশাল বিশাল কয়েকটি পোস্টার এবং কয়েকজন ছেলে মডেল এই ধরনের প্যান্টগুলো পড়ে আছে। তাহলে কি এখন এ ধরনের স্টাইলই চলছে! তখন প্রথম স্বত্ত্বা কথা বলা শুরু করল, “যা, এটিই নিয়ে যা।
চেন্জ করার দরকার নাই!”
বাসায় নিয়ে এসে মনে হলো, দেখি, প্যান্টটি কোন দেশের তৈরী। ও মা! এ তো দেখি ‘Made in Bangladesh’! ২৯৯ ক্রাউন (প্রায় ৩৫০০ টাকা) দিয়ে বাংলাদেশী প্যান্ট কিনলাম! বাংলাদেশে বিক্রেতা বিশাল ঠকান ঠকাইলেও এর দাম মনে হয় ১০০০টাকা হবে! এ মুহূর্তে ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে বুঝতে পারছি না! কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের গর্মেন্টস ওয়ার্কারদের আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় একটি লিখা পাঠিয়েছিলাম। সেখানে লিখেছি, “সুইডেনের H&M এর শোরুমে কোন বাংলাদেশী পোশাকের লেভেলে ‘Made in Bangladesh’ লিখাটি দেখলে ভালোই লাগে। সুধু ভালো লাগে বলাটা মনে হয় যথাযথ হলো না, আসলে একটা অন্যরকম অনুভূতিরর সৃষ্টি হয় যেটি লিখে বা বলে প্রকাশ করা যায় না!” কিন্তু এতো টাকা দিয়ে H&M এর শোরুম থেকে বাংলাদেশী পোশাক কখনো কিনতে ইচ্ছে করে নি! সুইডেনের অন্যান্য শোরুমও যে বাংলাদেশী পোশাক বিক্রয় করে তা তেমন জানা ছিল না। কিন্তু একটি বিষয়, সেই একই টাকা দিয়ে অন্য দেশের তৈরী প্যান্ট কিনলে মনটা কি খুব বেশীই আনন্দিত হত! আমার টাকাটা কি পুরোটাই উসুল হতো!
H&M একটি বহুজাতিক তৈরী পোশাক বিক্রয়কারী সুইডিশ কম্পানি।
বিশ্বের প্রায় ৪৩টি দেশে ২৩০০ শোরুম রয়েছে। এই কম্পানির আমদানিকৃত তৈরী পোশাকের একটি অংশ আসে বাংলাদেশ থেকে। H&M এর প্রতিটি শোরুমের অনেক পোশাকের লেভেলেই একটি লিখা চোখে পড়বে, ‘Made in Bangladesh’. কয়েকদিন আগে সুইডেনের “ডগেন ইন্ডাস্ট্রী” নামের একটি পত্রিকায় বাংলাদেশে গার্মেন্টস ওয়ার্কারদের আন্দোলন নিয়ে একটি ছোট্র নিউজ প্রকাশ করা হয়েছিল। নিউজটির শিরোনামে লিখা হয়েছে, “আন্দোলনের মুখে H&M এর ফ্যাক্টরী বন্ধ করতে হয়েছে”। আরও লিখেছে, “কয়েকদিনের আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের ৩০০ টেক্সটাইল ফ্যাক্টরীর মালিক, ফ্যাক্টরীর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
বিভিন্ন দাবি দাওয়ার মধ্যে কর্মিদের একটি দাবি হচ্ছে বেতন বাড়ানো। দেশের লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস কর্মিদের কমপক্ষে মাসিক বেতন ৩০০০ টাকা, যা প্রায় ২৭০ সুইডিশ ক্রাউনের সমান। ফ্যাক্টরীগুলোর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের রপ্তানীতে একটি আঘাত এসেছে এবং এতে ইউরোপের চাহিদার মাঝেও একটি ধস নেমেছে। “
২৭০ ক্রাউন, একজন সুইডিশ ক্লিনারের দুই/আড়াই ঘন্টার বেতন! যদিও বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া সুইডেনের যেকোন লেভেলের কর্মকর্তা বা কর্মচারীর আওয়ারলি বেতনের খুব বেশী পার্থক্য ঘটে না। অনেক ক্ষেত্রে একটি কোম্পানির ক্লিনারের এক ঘন্টার বেতন, ঊর্ধতন কর্মকর্তার এক ঘন্টার বেতনের চেয়ে বেশী হয়! যেহেতু ঊর্ধতন কর্মকর্তা সেই কোম্পানিতে ফুলটাইম কাজ করছেন আর ক্লিনারের কাজ দিনে দুই/তিন ঘন্টা; তাই ক্লিনারের চেয়ে ঊর্ধতন কর্মকর্তা বেশী বেতন পাচ্ছেন।
আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, সুধুমাত্র কাজের সময়ই মর্যাদার দিক থেকে একজন বস, কিংবা ক্লিনার। আর বাকী সময় সকলেই সমান! দেখা যায়, বস আর ক্লিনার হয়তো একই সাথে বসে লান্স করছে কিংবা কোন পার্টিতে এনজয় করছে! এবার আমাদের দেশের কথা ভাবছি। এমন কি ভাবা যায়! যেখানে একজন বস আর একজন পিয়নের পার্থক্য আকাশ-পাতাল বললেও অনেক কম বলা হয়ে যাবে! (ক্লিনারের নাম তো এখানে আনায় যাবে না! ) আর এই পার্থক্য বেতন, মর্যাদা সবদিক থেকেই। এতেই ক্ষান্ত নয়, অফিসের বাইরেও দেখা যায় একজন পিয়ন ছ্যার, ছ্যার করতে করতে মুখে ফ্যানা তুলছে। আমরা সবাই নবাবের বংশধর কিনা! একটু দূর্বলরা আমাদের গোলামি করবে, এই প্রথায় যেন আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে চলে আসছে!
আমার জানা নেই, একজন গার্মেন্টস মালিককে তার ব্যালেন্স সিট এর ডেবিট-ক্রেডিট মেলাতে আর ইনকাম ইস্টেটমেন্ট এর প্রফিট বাড়াতে সেলারী এক্সপেন্স বাবদ কতটুকু কমাতে হয়।
আমার জানা নেই, যে সেলারীতে একজন ওয়ার্কারের অর্ধমাসও চলতে চায় না, সেই ওয়ার্কারের কাজ দিয়ে অর্জিত প্রফিটে গার্মেন্টস মালিকের নিজের ও দেশের কতটুকু উন্নয়ন ঘটছে। তবে এরকম একটি বিষয় সম্পর্কে আমার পরিস্কার ধারনা আছে যে একজন কৃষকের ৫টাকা কেজি দরে বিক্রি করা বেগুন শহরের একজন ক্রেতাকে ৫০ বা ১০০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। অথচ কৃষকের উৎপাদন খরচই উঠে না। আমাদের কৃষকের অভাবও ফুরায় না। কৃষক আর শহরের ক্রেতার মাঝে কি যেন একটা প্রসেস ঘটে যে প্রসেসকে নিঃসন্দেহে অসাধুতা বলা যায়।
ব্যাবসায় একজন বিক্রেতা কতটুকু লাভ করতে পারবে, ধর্মে নিশ্চয়ই এর মাসলা-মাসায়েল রয়েছে। একজন ব্যবাসায়ী কিংবা একজন ব্যাক্তি যদি সৎ না হন তাহলে কিভাবে আমাদের উন্নয়ন সম্ভব!
আমাদের এই ছোট্র একটি দেশে এত এত সম্ভাবনা। সুইডেনে যারা গবেষণা করে টাকা উপার্যন করতে চান তারা বাংলাদেশের মত অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ বেছে নেন। এরপর কোন একটি বিষয়কে ফোকাস করে রিসার্স পেপার তৈরী করেন, যা পরে কোন জার্নালে পাবলিকেশনও হয়। অনেক ক্ষেত্রে ডকুমেন্টারিও তৈরী হয়।
যেমন-কয়েকমাস আগে আমাদের এক বাংলাদেশী আপু, যিনি সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন; তিনি একটি প্রোজেক্ট ওয়ার্ক নিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তার কাজের বিষয় ছিল “Research on female garment workers in Bangladesh with focus on menstrual hygiene and water sanitation and solution by innovation and cooperation over borders.” যেখানে তাকে মূল বিষয়ের পাশাপাশি ফোকাস করতে হয়েছে মহিলা ওয়ার্কারদের দৈনন্দিন জীবনের উপর। পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে তারা কি ধরনের সমস্যার সম্মুক্ষীন হন এবং তারা সেগুলো কিভাবে সমাধান করেন; এছাড়া এসব সমস্যা সমাধনের জন্য বাড়িতে এবং কাজের জায়গায় কি ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। তার সেই রিসার্স পেপারটি সম্ভবত এতদিনে পাবলিকেশনও হয়ে গেছে। এসব বিষয় নিয়ে তিনি কয়েকটি সেমিনারেও কথা বলেছেন।
কিন্তু এসব করে কি সেসব গর্মেন্টস ওয়ার্কারদের সমস্যার সমাধান হয়েছে? তাদের সমস্যার সমাধান হোক না হোক, সেই আপু কিন্তু এ কাজের জন্য একটি ভালো এমাউন্ট পেয়েছেন। আর নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে কম্পনি এই প্রোযেক্টটি পরিচালনা করেছে তারা বাংলাদেশের এই ইস্যুটি দেখিয়ে একটি ভালো অর্থ উপার্যন করেছে। আসলে, আমাদের ভাগ্য আমাদেরই পরিবর্তন করতে হবে। কারন, সুরা আর রা’দ এর ১১ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে"। সুতরাং বুঝায় যচ্ছে, অন্য কেউ এসে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়ে যাবে না।
লিখার মাঝে বানরের লেজ ধরে বিভিন্ন ডালে চলে গিয়েছিলাম। যে কথা বলছিলাম, আমাদের মনছবির ২০২৫ সালের বাংলাদেশ যেন আমাদের প্রত্যয়নের মত হয়, “আমি এক অনন্য মানুষ। আমার আত্মিক ক্ষমতা অসীম। সারা পৃথিবী আমার। যেখানে দরকার সেখানে যাবো।
যা প্রয়োজন তা-ই নেবো, যা চাই তাই পাবো ......." এবং এই প্রয়োজনীয় জিনিস যেটা নেবো বা পাবো সেটাতে যেন লিখা থাকে ‘Made in Bangladesh’.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।