আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কী লিখি, কেন লিখি

"জীবনবোধ মানুষকে তার রূপ-রস-রঙে ভরে তোলে কানায় কানায়, জীবনকে দেখবার প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৃথিবীটাকে মোচড় দিয়ে বদলে দিতে চায়" এটা মূলত একটা ‘আমি-আমি-আমি’মূলক লেখা, অনাগ্রহীগণ চাইলে ইগনোর করতে পারেন ... মাঝে মাঝে নিজের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হই, আমি আসলে কী লিখছি, কেনইবা লিখছি। এই লেখার দ্বারা কার কী উপকার হচ্ছে? আমার নিজেরই বা কী ধরনের প্রাপ্তি ঘটছে? পেশাগত কারণে আমাকে আমার অফিস থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর একটা বিশেষ প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছিল দেশের সুপরিচিত একটি অ্যাকাডেমিতে। সেখানে বেশ কয়েকটি কোর্সের মধ্যে একটির প্রশিক্ষক ক্লাসে প্রশ্ন করলেন, “আপনাদের মধ্যে কেউ একজন বলুন তো, কাজ কী?” আমি বললাম, “কোনো বস্তুর ওপর বলপ্রয়োগের ফলে যদি তার আকার, আকৃতি অথবা স্থান পরিবর্তন হয় তাহলে তাকে কাজ বলে। ” প্রশিক্ষকটি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আপনি যেটা বললেন এটা পদার্থবিদ্যার সংজ্ঞা। প্রকৃত ব্যবহারিক সংজ্ঞা এটা নয়।

আপনার কোনো প্রয়াস অথবা পরিশ্রমের বিনিময়ে যদি আপনি অর্থ উপার্জন করেন তাহলেই সেটা কাজ বলে গণ্য হবে। অর্থ উপার্জিত না হলে সেটা কাজ নয়। আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে পারেন। কিন্তু সেটি কাজ হবে না কেননা তার জন্য কেউ আপনাকে টাকা দেবে না। কিন্তু আপনি যদি অনেক দর্শকের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন তাহলে সেটি হবে কাজ কারণ এর জন্য আয়োজক আপনাকে অর্থ পরিশোধ করছে।

” এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি যে লেখালিখি করি সেটা কোনো কাজের পর্যায়ে পড়ে না, কেননা এর দ্বারা আমি কারো কাছ থেকে কোনো প্রকার অর্থ লাভ করি না। এমন নয় যে, আমার লেখাগুলি কোথাও প্রকাশের বিনিময়ে কেউ যদি আমাকে টাকা দিতে চায় তাহলে আমি সেটা নিতে অস্বীকার করব। কিন্তু আমি যখন লিখি তখন কোনো ধরনের অর্থ প্রাপ্তির কথা মাথায় নিয়ে লিখি না। অর্থাৎ অর্থ আয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আমি লেখালিখি করি না। তাহলে লিখি কেন? একটা সময় ছিল যখন স্বপ্ন ছিল লেখক হবো।

নিজের বক্তব্য প্রকাশে নিজস্ব ভাষাভঙ্গির অন্বেষণের যে আকর্ষণ, নিজস্ব সৃষ্টির বেদনা অনুভবে যে আনন্দ, সেটা সব সময় আমাকে কাছে টানত; বলতে গেলে সেই কৈশোরকাল থেকেই। একসময় অনেক হাবিজাবি লিখেছি। কৈশোরের সেই লিগাসি সদ্য তারুণ্যেও বহমান ছিল। এর মধ্যে চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটেছে, মানস-জগৎ পরিপক্বতা লাভ করেছে, জানাশোনার প্রসার ঘটেছে, চেতনার বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করেছি এ সময়ে। কিন্তু সিরিয়াসলি কী ধরনের লেখার লেখক হবো/হতাম আমি? মূলত উপন্যাস, পাশাপাশি কিছু কবিতা, প্রবন্ধ এবং ছোট গল্প।

প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে আমার মূল আগ্রহের বিষয় ছিল প্রাচীন গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শন, দার্শনিক এবং মধ্যযুগীয় রেনেসা আমলের সাহিত্যিক-দার্শনিক-বিজ্ঞানীগণ। সময়টা ২০০০-২০০১ সাল; বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে পড়াশোনা আরম্ভ করেছি। এর মধ্যে একজন বন্ধুর উৎসাহে লিখলাম মধ্যযুগের রেনেসা সময়কালীন ধর্মযাজক এবং দার্শনিক জিয়োরদানো ব্রুনোর ওপর একটি প্রবন্ধ। ব্রুনোর চিন্তা এবং কর্মের প্রতি আগ্রহ আমার এমনিতেই কিছুটা ছিল, এর সাথে বন্ধুটি আমাকে জানিয়েছিল যে ব্রুনোর ওপর সে এ যাবতকাল বাংলায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভালো লেখা পড়ে নি। ব্রুনোর বিষয়ে তার ভাসা ভাসা জ্ঞান ছিল।

আমিও যে বাংলায় তখন তেমন কিছু পড়েছিলাম এমন নয়। তবে নিশ্চয় কিছু না কিছু ছিলই। এখন যেমন অনেক বাংলা লেখাই পাওয়া যায় ব্রুনো বিষয়ক। যাই হোক, নিজস্ব আলস্যজনিত এবং সময়াভাবে ব্রুনোর ওপর বইপত্তর যোগাড় করতে সক্ষম না হওয়ার কারণেই ইংরেজিতে তার ওপর লিখিত কিছু আর্টিকেল সংগ্রহ করি। যেখানে যা পাই পড়তে শুরু করি।

ইন্টারনেট এবং বইপত্রে যা কিছু পাই তার কোনোটাই বাদ দিই না। তবে সবই ইংরেজিতে লেখা; কেননা বাংলায় ব্রুনোর ওপর আমি তেমন কোনো লেখা তখন সংগ্রহ করে উঠতে পারি নি। সেই লেখাগুলো পড়ে আমি নিজের মনের মধ্যে ব্রুনোর একটা চিত্র দাঁড় করাই, আমার লেখায় কী কী বিষয় আনব সেটার একটা পরিকাঠামো তৈরি করি। গবেষণামূলক দীর্ঘ প্রবন্ধ অথবা বই লেখার কোনো চিন্তা আমার মাথায় ছিল না, সে সুযোগ, সামর্থ্য অথবা সময় কোনোটাই তখন আমার ছিল না। স্রেফ তরুণ কিছু পাঠক এবং পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ব্রুনোকে পরিচিত করে তোলাই ছিল উদ্দেশ্য।

তাছাড়া মনের মধ্যে এ ধরনের একটি লেখার আগ্রহ অনুভব করেছিলাম বলেই কাজটাকে দাঁড় করাতে পেরেছিলাম। আমি লেখাটা লিখি ২০০২ সালে। বন্ধু-বান্ধবদের দেখাই, তাদের কারো কাছ থেকে প্রশংসাসূচক দুয়েকটা বাক্য পেলেও তেমন আশাব্যঞ্চক কোনো সাড়া পাই নি। তবে ব্রুনো নিয়ে লেখার পর্যায়েই প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরাস এবং মিশরীয় গণিতবিদ হাইপাসিয়ার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি। ব্রুনোর মতোই এদের দুজনের ওপর যেখানে যা লেখা পাই সব এক জায়গায় জড়ো করি।

পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকি। আমি জানি, আমাদের দেশের বিদ্বান সমাজ তাদের বিষয়ে আমার চেয়ে অনেক ভালো জানেন। তাই তাদেরকে এদের বিষয়ে কিছু জানানোর জন্য আমি এই ধারাবাহিক লেখাগুলোর চিন্তা করি নি। সমবয়সী পাঠকদের কাছে, যারা জ্ঞানগর্ভ ভারি ভারি বইপুস্তক পড়তে আগ্রহী নয়, তাদের কাছে সংক্ষেপে কিছু চিন্তার উপযোগী বিষয় উপস্থাপনই ছিল এই লেখালিখির প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য। যেহেতু বলেছি, ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠাই আমার লেখক হয়ে ওঠার মূল ছিল।

এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই লিখি ‘অতিমানব’ নামে একটা উপন্যাস। কিন্তু সেটা পড়তে গিয়ে নিজের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, পিতা যেমন তার অবাধ্য পুত্রকে এক পর্যায়ে ত্যাজ্য করেন, আমিও নিজে নিজেই উপন্যাসটিকে পরিত্যাক্ত বলে ঘোষণা করি। এরপর লিখি ‘‌দ্রোহ’ নামে আরেকটা উপন্যাস। আমি লেখাটি কোথাও ছাপানোর চেষ্টা করি নি আজ পর্যন্ত, জানি যে আমার এই উপন্যাসটা কেউ ছাপাতে রাজি হবে না। কিন্তু এটি আমার অন্যতম পছন্দের একটি উপন্যাস।

কিন্তু সমকালীন সমাজ, আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং এর অভিঘাত আমাকে এক জায়গায় দাঁড়াতে দ্যায় নি। আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। নিছক ‘লেখক’ হয়ে ওঠার, নির্জনে বসে কলাকৈবল্যবাদী সাহিত্য চর্চার ইচ্ছেটা বিনষ্ট হয়ে যায়। অনেকদিন ধরেই আর নতুন কিছু লেখা হয়ে ওঠে নি। তাছাড়া ‘ব্রুনোর বিশ্ব’ নিয়ে এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়ানো, এবং অনেকের মুখেই প্রশংসাসূচক বাক্যের পর প্রকাশে অপরাগতার কথা শোনার পর আর নতুন কিছু লিখতে মনের ভেতর অনুপ্রেরণা বোধ করি নি।

এপিকিউরাস এবং হাইপাসিয়াকে নিয়ে আমার লেখাও আর হয়ে ওঠে নি বিভিন্ন কারণে। কোনো দিন লিখতে পারব কিনা তাও জানি না। পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অভিঘাতে এবং রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতায় এক সময় যে উপন্যাস, গল্প, কবিতা, দর্শন-বিষয়ক প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখার যে স্বপ্নবীজ প্রোথিত ছিল মনের মৃত্তিকায়, তা আর অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে চারাগাছ থেকে মহীরুহ হয়ে ওঠে নি। পরবর্তী দশকে আমার রাজনৈতিক চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত না থাকলেও আমি নিজের মধ্যে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং আদর্শকে বহন করে চলি।

সময়ের সাথে সাথে, পড়াশোনার পরিধি বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে এবং দৈনন্দিন জীবন যাপনে বিভিন্ন ঘটনাবলী প্রত্যক্ষের মাধ্যমে অভিজ্ঞতালাভ ও তার সাথে নিজের ভাবনাচিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে আমার মানসকাঠামো ধীরে ধীরে পরিপক্বতা লাভ করেছে। ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে আমি লিখতাম ইয়াহু ৩৬০ গ্রুপে। সে সময় ইন্টারনেটে বাংলা লেখার পদ্ধতি জানা না থাকায় আমার লেখাগুলো ছিল ইংরেজিতে। বেশির ভাগই ছিল রাজনীতি এবং আমার সাম্প্রতিক পড়া বইগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনার ওপর ভিত্তি করে। দুয়েকটা ছিল সমালোচনামূলক।

আমার অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাগুলো অপরের সাথে শেয়ার করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। মনে আছে ২০০৭ সালের অগাস্ট মাসে সেনা-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর মিলিটারিরা আক্রমণ চালিয়েছিল। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষকবৃন্দও বসে থাকেন নি। তখন ছিল এমনিতেই জরুরি অবস্থা। সেই অবস্থা আরো গুরুতর হয়ে উঠল।

গ্রেপ্তার চলতে থাকল। ২০ অগাস্ট কারফিউ জারি হলো রাত ৮টা থেকে। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হলো। একই সাথে দেশব্যাপী মোবাইল ফোন অপারেটরদের নেটওয়ার্ক সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো, যাতে কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে। আমার বন্ধু আমার কাছে এসে বলল, “দোস্ত, এখন কী করি বল! আমাকে হল ছাড়তে হবে।

রাত আটটার পর বাইরেও থাকতে পারব না। এদিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় ঢাকায় আত্মীয়স্বজন কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না যে কারো কাছে গিয়ে উঠব। ” আমি তাকে বললাম এই অবস্থায় আমার কীইবা করার আছে- আমি একটা কাজই করতে পারি, ঝামেলা মিটে না যাওয়া পর্যন্ত কয়েক দিনের জন্য আমার বাসায় রাখতে পারি তাকে। আমার মা বলল মেঝেতে বিছানা পেতে সাত-আটজনের শোয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু বন্ধুটি আমার ওখানে থাকতে রাজি হলো না (কারণটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না, যদ্দূর সম্ভব সাত-আটজনের বেশি থাকতে না পারার সমস্যা), সে একরকম উদ্ভ্রান্তের মতো বাসা ভাড়া পাওয়ার জন্য চলে গেল।

বিষয়টি আমার মনে অভিঘাত সৃষ্টি করে। অসহায় ক্রোধে আস্ফালন করে চিত্ত। ২৩ অগাস্ট রাতে ইয়াহু ৩৬০-তে আমি লিখি: Right now I am busy with the kind of idea that is coming back in my mind. You know what? This country belongs to the bourgeois governments, their near & dears, civil & army bureaucrats, some businessmen & so-called political creatures, not the 140 million people who live their everyday life & curse their lot for many things. Tell me about the last three days’ incidence, that unprecedented massacre with unbelievable speed which crossed the country, swung and twisted the total system, brought untold miseries to normal human lives. The failure of the state to control the whole situation is showing up. The government declared curfew from 8 p.m. on 22nd August, asked to evacuate the halls of D.U. as well, postponed all educational activities (including the publication of H.S.C. result) sine die. Not for unseen reason, I must admit. But what about those students who stay in the halls & involved in nothing about the reason behind the total scenario? What will happen to them? The authority seems to have no concern at all. Not only that, the Telecommunication Regulatory Commission asked the cell phone companies to cease their network. The order was followed within less than a minute. The students who live in those halls of D.U. are largely dependant on that thing at their hand for communication with others because they have no other good options. If they had to go elsewhere within 8 p.m. they had to communicate with friends, relatives or some other known persons in the city. I have seen my friends. They were running for covers. They can’t stay at hall; at the absence of communication system they may not be able to get a suitable shelter. Even they can’t spend the night on road because of curfew. Now can any of you tell me, where they will go? আমার লেখাটা দেখে বন্ধুরা মন্তব্য করল, এটা সরকারের চোখে পড়লে তারা আমাকেও গ্রেপ্তার করতে পারে। আমি জবাবে কিছু বললাম না। যাই হোক, সারা দেশে এতো ডামাডোলের মধ্যে ইয়াহু ৩৬০-তে কোথাকার কোন আবিদুল ইসলাম কী লিখল সেটা তাদের চোখে পড়ার কথা নয়, পড়েও নি।

কিন্তু পড়লে আমার ঘাড়ের ওপর বিপদের সম্ভাব্যতা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যেতো না। এভাবেই বিচ্ছিন্নভাবে যখন যা কিছু মনে এসেছে, লিখে সেটা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। আগেই বলেছি আমি এখন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত না হলেও একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চেতনা আমার মধ্যে কাজ করে এবং সেটা দিনে দিনে প্রসারতা লাভ করেছে। ২০০১-২০০৩ সময়কালের সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত থাকার সময় যে চিন্তাগুলো মনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করত, এখনো তা থেকে বিপরীত মুখে সরে যাই নি। কিন্তু পরিধি বিস্তৃত হয়েছে, ধারণা ব্যাপকতর হয়েছে, জানা বিষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সংঘটিত ঘটনাবলীর ভেতর কার্য-কারণ সূত্রায়ন প্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়কে ব্যাখ্যার ক্ষমতাও বেড়েছে কিছুটা।

আমার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা শুদ্ধ কি ভুল, সেটা তর্কাতীত বিষয় নয়, এবং এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারও বটে- কিন্তু আমি নিজে যেটাকে সঠিক বলে জ্ঞান করি, তাতেই আস্থা রাখি- তা নাহলে বিদ্যমান চিন্তাকাঠামোটাই তো অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের সরকার, মূলধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পোষ্য বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া, সুশীল সমাজ, সামরিক-বেসামরিক এস্টাবলিশমেন্ট, এনজিও, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাম্রাজবাদী ঋণদাতা সংস্থা, বিচারালয়- প্রভৃতি আমাদের চারিদিকে কতোগুলো মিথ তৈরি করে রেখেছে। এগুলোর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে আপাত বিরোধিতা থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে পরস্পরের সাথে হাত ধরাধরি করেই এই মিথগুলো মতাদর্শিক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে, সমাজে প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন ট্যাবু- যেখানে যুক্তি-তর্কের প্রবেশাধিকারকে তারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাখে। এই মিথগুলোকে সমাজে টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্যমান শক্তিসমূহ সাধারণ জনগণের চিন্তার জগৎকে ঘোলাটে করে রাখে। এই ঘোলাটে পর্দা সরিয়ে তারা, এমনকি শিক্ষিত বলে কথিত জনসমাজ তথা মধ্যবিত্তের অধিকাংশ যাতে সরল সত্যকে দেখতে না পায় তার জন্য চালায় মতাদর্শিক আধিপত্য।

বিভিন্ন বিপরীতমুখী মূল্যবোধ আচ্ছন্ন করে রাখে জনমানুষের চেতনার জগৎ। সমাজের বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা এবং তাকে মহিমান্বিত করার জন্যই এসব করা হয়। আমাদেরকে শেখানো হয় কোনো কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়, মনে যতোই বিদ্রোহমূলক চিন্তার উদয় হোক না কেন। কার্য-কারণ সম্পর্কের সূত্রায়ন ঘটিয়ে পরিপার্শ্বের ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা সমাজে অনুপস্থিত। এবং এই প্রবণতার অনুপস্থিতিই অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে সমাজকে পরিবর্তনের চিন্তা এবং সংগ্রাম থেকে গণমানুষকে দূরে রাখে।

কিন্তু আমি যে ধরনের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী তা বিদ্যমান স্ট্যাটাস ক্যো-কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শেখায়, কার্য-কারণ সম্পর্কের সূত্রায়নের সাহায্যে সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যে পর্দার অন্তরালে বিদ্যমান ও ক্রিয়াশীল ক্ষমতা-সম্পর্ক ও কেন্দ্রকে সামনে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিভিন্ন মহল থেকে উপস্থাপিত ভাষ্যের মধ্যে সঠিকটিকে গ্রহণ করতে সক্ষম করে। আমি আমার লেখায় প্রায়ই যে মতাদর্শিক সংগ্রামের কথা বলে থাকি, সেটি হচ্ছে মূলত দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বচ্ছ করার সংগ্রাম- জনমানসে জমে থাকা চিন্তার আবর্জনাকে পরিষ্কার করে তার দৃষ্টিকে পরিচ্ছন্ন করার প্রয়াস। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমি নিজের লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করি এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত মিথ, ট্যাবু এবং প্রশ্নহীনতার ধারণাকে ভেঙে দেবার বিষয়ে সচেষ্ট হই। আরেকটা যে বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য তাহলো সমাজ এবং সেখানে বিদ্যমান ঘটনা-পরম্পরাকে বিশ্লেষণ করবার বিষয়ে শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গি।

মোটা দাগে আমাদের, এবং যেকোনো সমাজই তিন ভাগে বিভক্ত: তাহলো (১) উচ্চশ্রেণী (২) মধ্যশ্রেণী এবং (৩) নিম্নশ্রেণী। এই বিভাজন করা হয় ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে অবস্থান, প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং একাধিপত্য, উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা, আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক বিষয়ে প্রভাববিস্তারী ভূমিকা- ইত্যাদির ভিত্তিতে। এর মধ্যে উচ্চশ্রেণী তার পুঁজি সংগঠন, মুনাফা অর্জন, তাকে রক্ষা এবং এর বিকাশের জন্য নিম্নশ্রেণীর শ্রমশোষণ করে, তার ওপর নির্যাতন চালায়, চালাতে সাহায্য করে। এই উচ্চশ্রেণী সরকার, শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ আমলা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক, এনজিও প্রধান, মিডিয়া কর্ণধার প্রভৃতি নিয়ে গঠিত। নিজস্ব স্বার্থরক্ষার তাগিদেই তারা নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীদের ওপর চড়াও হয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় তাদের স্বার্থকে সুসংহত করে।

অর্থাৎ পারস্পরিক হাত-ধরাধরি সম্পর্কের মাধ্যমেই তারা শোষণের ব্যবস্থাটি বজায় রাখে। তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে বিদ্যমান এই শোষণ ব্যবস্থাটি আরো প্রকট, আরো নির্মম। কেননা এখানে উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মতো পুঁজির সংগঠন ও বিকাশ উচ্চস্তরে হয় নি, বিকাশের স্তর রয়ে গেছে অতি নিম্ন পর্যায়ে এবং এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে শাসক তথা উচ্চশ্রেণীর মানসকাঠামোর বিকাশ ও গঠনও প্রকৃত পুঁজিবাদী পন্থায় না হয়ে এর মধ্যে নানা ধরনের বিকৃতি এবং পশ্চাৎপদ উপাদানের প্রভাব রয়ে গেছে যথেষ্ট পরিমাণে। এ কারণে শ্রমজীবী সহ সমাজের নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ পুঁজিবাদের ব্যাকরণ অনুযায়ী সভ্যতার পদবাচ্য নয়। তাই শোষণ-নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে ব্যাপকতা ও পন্থার দেখা এই সমাজে পাওয়া যায়, তা উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অনুরূপ কিংবা অনুগামী নয়।

এদিকে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে উচ্চশ্রেণীর যাঁতাকলে তাদের শ্রমকে বিকোতে বাধ্য হয় এবং কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রান্তিক শ্রেণী হিসেবে কায়ক্লেশে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। জনবহুল এবং নিম্ন আয়ের দেশ বাংলাদেশে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা বিপুল। সুতরাং উৎপাদনযন্ত্রে শ্রমের যোগান কোনো ক্ষেত্রেই বাধাপ্রাপ্ত হয় না। এ কারণে এই শ্রমজীবী জনগণ সর্বদাই মালিক পক্ষের হাতে এক প্রকার জিম্মি অবস্থায় থাকে। বিকল্প শ্রমের মজুদ এবং যোগানের সম্ভাব্যতা তাদেরকে মানবিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হারের চাইতে অনেক নিম্ন মজুরিতে শ্রমদানে বাধ্য করে।

এ কারণে দেখা যায় যে উন্নত বিশ্ব তো বটেই, আশপাশের অনেক অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমের মজুরি পীড়াদায়ক হারে নিম্নপর্যায়ে। সর্বদাই বিকল্প শ্রমের যোগানের সম্ভাবনার সাথে সাথে মালিক শ্রেণীর সামন্তবাদী এবং লুম্পেন বুর্জোয়া আচরণ ও কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ে এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার একটা গ্রহণযোগ্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাসক গোষ্ঠী, তাদের পোষক বুদ্ধিজীবীদের সুমধুর বাক্যবিস্তার এবং তাদের সমর্থনধন্য মিডিয়ায় এই ব্যবস্থাকে মহিমান্বিতকরণের জন্য অবিশ্রান্ত প্রচারণায়। আমাদের সমাজে তাই শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের ঐক্যবোধের পরিবর্তে প্রায়শই লক্ষ করা যায় তাদের নিজ নিজ মালিকের স্বার্থের পক্ষ হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই শ্রেণীর প্রশ্নটিকে মুখ্য করে তার রাজনীতিকে এগিয়ে না নেয়া এবং তার ফলশ্রুতিতে শ্রেণীচেতনার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হওয়ার কারণেই এমনটা দেখা যায়। শ্রমিক শ্রেণীর একাংশ তার অপরাংশকে ভাই কিংবা বন্ধু হিসেবে দ্যাখে না, একই স্বার্থের অধীন অথবা একই ব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট অভিন্ন শ্রেণীর অংশ হিসেবে বিবেচনা করার মতো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং চেতনা অর্জন করতে পারে না।

কিন্তু এক্ষেত্রে মধ্যশ্রেণীর ভূমিকা কী? বর্তমান বাস্তবতায় মধ্যশ্রেণীর প্রধান সঙ্কট হলো তার স্থিতিস্থাপকতার অভাব, মননের অস্থিরতা। এই মধ্যশ্রেণী আবার দুটো ভাগে বিভক্ত, (১) উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং (২) নিম্ন-মধ্যবিত্ত। উচ্চ-মধ্যশ্রেণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, ব্যাংক-বীমা সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা, কর্পোরেট সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং তদপর্যায়ের অন্যান্য চাকুরে, ছোটখাটো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক, মধ্যস্বত্বভোগী, আড়তদার - ইত্যাদি। এই উচ্চ-মধ্যশ্রেণী কালক্রমে উচ্চশ্রেণীতে নিজের উত্তরণ ঘটাতে চায় এবং এই বাসনাতে উচ্চশ্রেণীর দালালি ও তোষামোদিতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে। শহরাঞ্চলে এই শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য অংশই সাধারণত মেধাবী এবং উচ্চ শিক্ষিত হয়ে থাকে।

নিজস্ব মেধা ও অর্জিত শিক্ষাকে তারা মালিক শ্রেণীর ধন উপার্জন এবং রক্ষার কাজে ব্যয় করে এবং এই প্রক্রিয়ায় উপার্জিত সম্পত্তি থেকে নিজস্ব প্রাপ্যের অংশে দখল প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্নমুখী চাপে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে নিম্ন-মধ্যশ্রেণীর একটা অংশ কালক্রমে নিম্নবর্গে অঙ্গীভূত হয় এবং আরেকটা অংশ কোনোমতে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখে। নিম্নবিত্তের মতোই তাকে একই প্রক্রিয়ায়, কিন্তু ভিন্নধর্মী পেশায় নিয়োজিত হয়ে নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে অন্ধ-মূক-বধির হয়ে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়। কিন্তু মধ্যশ্রেণীর প্রগতিশীল ভূমিকা নিহিত থাকে নিম্নশ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষকে- প্রকৃত শাসন-ক্ষমতা যার হাতে আসতে হবে বর্তমান ব্যবস্থা হতে উত্তরণের প্রধানতম শর্ত হিসেবে- যথার্থরূপে প্রশিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে, তার ভেতরে শ্রেণীচেতনা জাগ্রত করে তোলার পরিসরে। এর জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন সেটা হলো মধ্যশ্রেণীর মধ্যে নিজেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয়ভাবে প্রস্তুত করা, পরিবর্তনের জন্য নিজের মধ্যে তাগিদ সৃষ্টি করা।

শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের ক্ষেত্রে নিজেকে যথার্থরূপে শিক্ষিত করে তোলা এবং সংলগ্ন সংস্কৃতির চর্চা অপরিহার্য শর্ত হিসেবে এখানে অবস্থান করে। কিন্তু মধ্যশ্রেণীর সমগ্র অংশের কাছ থেকে এই আচরণ এবং কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করা যায় না। বস্তুত খুব কম সংখ্যকই এ কাজে এগিয়ে আসবে। কেননা মধ্যবিত্তের সাধারণ সংস্কৃতি তার পশ্চাদপসরণতা, তার পিছুটান, আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে এতো দৃঢ়ভাবে প্রবিষ্ট যে তাকে শেকড়ছিন্ন করে বিপ্লবী চরিত্র প্রদান কোনো সহজ কর্ম নয়, অনেক আয়াস এবং শ্রমক্ষয়ের ব্যাপার। সর্বাগ্রে যেটা প্রয়োজন তাহলো শ্রমজীবী নিম্নবিত্তের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের পর্যালোচনা।

বৃদ্ধ রিকশাচালককে তুই-তোকারি করে সম্বোধন করা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মধ্যবিত্ত কিংবা ফুটপাথে বিভিন্ন জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা হকারদের কাছ থেকে সুলভে কাঙ্ক্ষিত বস্তু ক্রয় করে আবার সামান্য অসুবিধার সম্মুখীন হলেই ফুটপাথ ‘দখল’ করে বসে থাকার জন্য বিড়বিড় করে গালিগালাজ করা পথচারী মধ্যবিত্তকে দিয়ে এ কাজ সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য। তাই এর জন্য যথার্থ মানসিকতা অর্জন, পড়াশোনা এবং আত্মশিক্ষণের মাধ্যমে, নিরন্তর সংস্কৃতি চর্চার প্রক্রিয়া মধ্যশ্রেণীর প্রগতিশীল অংশকে এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীকে যথোপযুক্ত রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তার হাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মশাল তুলে দিতে হবে। উচ্চশ্রেণীর দালালিতে ব্যাপৃত থাকা কিংবা পরিপার্শ্বের সাথে সম্পর্কহীন থেকে দিনগুজরান করার মানসকাঠামোকে ধ্বংস করে এবং এর মূলোৎপাটনের মাধ্যমেই সম্ভব এই অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন। মধ্যশ্রেণীর এই অংশ সুসংগঠিত গোষ্ঠী হিসেবে চলমান স্থিতাবস্থার অপরিবর্তনের সম্ভাবনাকে যেমন অস্বীকার করবে তেমনি উচ্চশ্রেণীর প্রতিনিধিরূপে বিদ্যমান ব্যবস্থার ব্যবস্থাপকের ভূমিকা গ্রহণকে প্রত্যাখ্যান করবে।

কিন্তু সেই মধ্যশ্রেণী কোথায়? মতাদর্শিক সংগ্রাম তাই এই রাজনীতি-সচেতন মানবিক মধ্যশ্রেণী গঠন এবং তার বিকাশের সংগ্রাম, আমাদের সুশীল সমাজ এবং লুম্পেন রাজনীতির ধারক-বাহক ও পোষ্য বুদ্ধিজীবীগণ যার প্রধানতম প্রতিবন্ধক। কিন্তু আমি আশাবাদী নই- বাস্তববাদী যে, মানবিক সমাজ একদিন গড়ে উঠবেই। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সাথে যার সামান্যতম পরিচয় আছে- তিনিই অবহিত আছেন, একটি উন্নত সম্প্রদায় হিসেবে তার ইতিহাস কোনো থমকে থাকার আলেখ্য নয়। শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন এবং অন্যান্য শাখায় সে ক্রমাগত নিজেকে বিকশিত করেছে, সম্পূরক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ গড়ে তুলেছে। এ কারণেই মানবসমাজ তার বর্তমান অবস্থায় অপরিবর্তনীয় রূপে সর্বদা বিরাজ করবে এই চিন্তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

আগামী কয়েক দশকে মানুষের চিন্তাভাবনা, তার জীবনব্যবস্থা, তার উপলব্ধির জায়গাতে বহু পরিবর্তন আসবেই। উন্নত মানুষ গড়ে তুলবে উন্নত ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাকে মানবতার সপক্ষে আনবার জন্য আবশ্যক যে শিক্ষিত, সমাজ-সচেতন, উন্নত চিন্তার মানবিক মধ্যশ্রেণীর বিকাশ- তার জন্যই এই মতাদর্শগত সংগ্রামে ব্যাপৃত হতে হবে। আর এই সংগ্রাম ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ যে মধ্যশ্রেণীর অনিবার্য এবং ইতিহাস-নির্দিষ্ট পরিণতি, আমি সেই শ্রেণীরই একজন। মধ্যবিত্তের সকল সংস্কার, আত্মকেন্দ্রিকতা, পলায়নপর মানসিকতা, পিছুটান আমার মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান।

স্বশ্রেণীচ্যুত হবার সক্ষমতা, সদিচ্ছা কিংবা বিপ্লবী মানসিকতা আমি অর্জন করতে পারি নি। নিজেকে মধ্যশ্রেণীর অংশরূপে আবিষ্কার করা এবং এই শ্রেণীতে নিজের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে পারার পর পরিপার্শ্বের বিদ্যমান ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের যে তাগিদ আমি অনুভব করি, সেই পরিবর্তনের জন্য স্বশ্রেণীর মধ্যে সমচিন্তার ব্যক্তিবর্গের সংসর্গ লাভ, তাদের সাথে ভাবনার আদান-প্রদান এবং একই সাথে পরিবর্তনের জন্য অনিবার্য যে দৃষ্টিভঙ্গি পরিচ্ছন্ন করার মতাদর্শিক সংগ্রাম- তাকে পরিচালনা করা আবশ্যক বিবেচনা করি। এ বিষয়ে আমার যাবতীয় কর্ম, চিন্তা এবং লেখালিখির মুখ্য উদ্দেশ্য কিন্তু সেটাই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।