আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাধিকার কোটায় নিয়োগ, আজকের বাস্তবতা।

এস এম আরিফ নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষ এখন নিজেকে দ্রুত পরিবর্তন করে নিচ্ছে। পুরাতন ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে ধরে রেখে খুব বেশি লাভ যে হচ্ছে তাও নয়। তাই বলা যায় সময় এখন পরিবর্তনের। সমগ্র বিশ্বে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। তবে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এখনও সেঁকেলে ধরণেরই রয়ে গেছেন।

এমনটা কেন হচ্ছে তা সহজে অনুমেয় নয়। অজস্র খাতের মাঝে চাকরির বাজারের কথাই ধরা যাক। তাঁরা কেন সংখ্যাগুরু মানুষের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করছেন না? লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর ভাগ্যের কথা ভেবে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত কেন তাঁরা নিচ্ছেন না? যাদের ভাগ্যের উপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর অব্যক্ত মনোভাবের অতিসাম্প্রতিক রূপটা হচ্ছে ঠিক এই রকমঃ ১। সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১২০০ পদে নিয়োগের জন্য শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে।

২। এর কিছুকাল পূর্বে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রায় ৫০০ পদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। ৩। ৩২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমেও প্রায় ১৫০০ লোক নিয়োগের সুপারিশ করবে পিএসসি। ৪।

তাছাড়া, অতিসম্প্রতি পিএসসি ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০৭২ লোক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে। উপরে উল্লেখিত ১,২ এবং ৩নং বিষয়গুলো উহ্য রেখে শুধুমাত্র ৪নং বিষয়ের দিকেও দৃষ্টিপাত করলে কিছু অসমতা চোখে পড়ে। যেমনঃ পিএসসির নিয়োগ বিধি অনুযায়ী বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৫% পদ কোটাধারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ব্যাপারটা হাস্যকর এবং দৃষ্টিকটু হলেও সত্যি যে সাধারণদের চেয়ে কোটাধারীদের আসন সংখ্যা বেশি। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০%, মহিলা কোটায় ১০%, জেলা কোটায় ১০% এবং উপজাতি কোটায় ৫% পদ বরাদ্দ থাকবে।

পিএসসি ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০৭২ পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে। অথচ সেখানে ২৮৪৫ পদে নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যাওয়ায় ৭৭৩ পদে কাউকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়নি। ২৮৪৫ এর ৫৫%(প্রাধিকার কোটা) করলে দাঁড়ায় ১৫৬৫। ১৫৬৫ পদের বিপরীতে পিএসসি সুপারিশ করতে পেরেছে ৭৯২ পদের জন্য।

যা প্রাধিকার কোটার জন্য মোট বরাদ্দ পদের ৫১%-এরও কম। প্রত্যেক বিসিএসেই প্রাধিকার কোটার প্রার্থীদের প্রায় একিই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত এই কারণেই পিএসসিকে বিশেষ বিসিএসের আয়োজন করতে হয়। একটি প্রশ্ন তখন মনে জাগে, বিশেষ নিয়োগের ক্ষেত্রে কি তবে সঠিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয়? স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় সঠিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয় না। কেননা যোগ্য প্রার্থী পেলে পূর্বেই তা পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা।

অবশ্য ‘বিশেষ আয়োজন’ করাই হয় স্বাভাবিক মানদণ্ডের নিচেরদেরকে বৈধ করার জন্য। যেখানে এমনিতেই অর্ধেকের বেশি নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করা হয়, সেখানে ‘বিশেষ আয়োজনের’ দরকারটাই বা কী? অবশ্য পূর্বে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা অন্যদের মাঝে বণ্টনের নিয়ম ছিল। কিন্তু পিএসসি ইতোমধ্যেই সে নিয়ম বাতিল করেছে। সবচেয়ে অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আমাদের সচেতন নাগরিক সমাজ বা বুদ্ধিজীবী মহল কোটা প্রথার বিপক্ষে খুব একটা সোচ্চার নন। তারা হয়ত ধরে নিয়েছেন প্রথাটি দেশ এবং সমাজের জন্য অনেক কল্যাণকর।

অথবা এমনটিও হতে পারে, তাঁরা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক হিশেবে দেখাতে চাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের কথাটি আসছে এ কারণে যে, প্রাধিকার কোটায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। তাছাড়া এটি একটি স্পর্শকাতর ইস্যুও বটে। যা নিয়ে কথা বললে দেশদ্রোহী বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া হয়ে যেতে পারে! যেমনটি বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটার আসলে অন্য রকম মানেও হতে পারে।

আমাদের জাতির সূর্যসন্তানেরা ৩০লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এনে দিয়েছেন আমাদের পরম কাক্ষিত স্বাধীনতা। লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা এসেছেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরত, অনেকে করেছেন পঙ্গুত্ব বরণ, মা-বোনেরা হারিয়েছেন তাদের সম্ভ্রব। এসব কিছুই তাঁরা করেছেন একটু মুক্ত নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য, স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য এবং সর্বোপরি একটি শোষণ মুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্য। তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের। তাঁরা নিশ্চয় কোন কোটা ব্যবস্থার জন্য যুদ্ধ করেননি।

তবে এটাও ঠিক যে, তাঁদের মহান ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে হলেও তাঁদের জন্য আমাদের কিছু করা উচিত। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রব হারানো মা-বোন, তাঁদের পরিবার, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে উন্নয়নের স্রোতধারায় সম্পৃক্ত না করে দেশের উন্নয়ন কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আবার সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা যাঁদের কথা উপরে বলা হয়নি, তাঁদের অবদানকেও খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। যুদ্ধকালীন মানসিক অবসাদগ্রস্থতা বা মানসিক চাপ পরবর্তীকালে যোদ্ধাদের বয়ে বেড়াতে হয়। যার প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের উপরও পড়ে।

ফলে বীর যোদ্ধাদের পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্মের কথা আমাদেরকেই ভাবতে হবে। বরং জনগণ বা রাষ্ট্র তাঁদের কথা না ভাবলে চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেবে। এজন্য তাঁদের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি কোটা সুবিধা চালু রাখাও আবশ্যক। তবে সেটা যেন হয় সবার স্বার্থ বজায় রেখে, সেদিকেও রাষ্ট্রযন্ত্রের নজর রাখা আবশ্যক। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১ম বর্ষ স্নাতকে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে ২.৫০% কোটাধারীদের জন্য বরাদ্দ রাখে। চাকরির ক্ষেত্রে ২.৫০% করতে হবে এমন কোন কথা নেই। সেটা আরও বেশিও হতে পারে। তবে তা ন্যায্যতা বজায় রেখে করাই উচিত। কোটা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীগুলোকে উন্নয়নের স্রোতধারায় নিয়ে আসা।

আমাদের দেশে সেটা এমনভাবে করা হচ্ছে, যেখানে সাধারণ জনগণ উন্নয়নের স্রোতধারার বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের মেধাবীরা দুর্নীতি ও কোটা ব্যবস্থার কাছে হার মেনেছে। তারা সরকারি চাকরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হচ্ছে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মুখথুবড়ে পড়ছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কথাই ধরা যাক। বেসরকারি ব্যাংকগুলো যখন সাফল্য পাচ্ছে, সেখানে দক্ষ জনবলের অভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। সবশেষে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী মহল এবং সচেতন নাগরিক সমাজের কাছে দেশবাসীর পক্ষ থেকে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার এটাই সঠিক সময়। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক, মেধাবী, সৎ, পরিশ্রমী লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য আপনাদের একটি সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে থাকিয়ে আছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।