আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌলিক থ্রিলারঃ মুখোশ

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! একটা আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে অ্যামস্টারডাম গিয়েছিলাম। সারাদিনের সম্মেলন শেষে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম প্লাস্টিক সার্জারির অন্যতম দিকপাল ড. স্নাইডারের বাসায়। ভদ্রলোক আমার আসার আগেই ই-মেইল করে আমাকে উনার বাসায় আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাজি না হবার কোন কারণ ছিল না আমার। মনে মনে আমি হয়তো এটাই চাচ্ছিলাম।

ভদ্রলোক গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমার জন্য। সম্মেলন শেষ করেই সোজা গাড়িতে উঠে পড়লাম। ড্রাইভার অদ্ভুত দ্রুততায় গাড়ি চালিয়ে ঢাকার এক ঘণ্টার রাস্তা পনের মিনিটেই পার হয়ে “স্নাইডার ম্যানশন”এ পৌঁছে গেল। ভদ্রলোক নিজেই নিচে নেমে এসেছিলেন আমাকে রিসিভ করতে। উনাকে দেখে আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম।

বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ মনে হচ্ছে তাকে, মাথায় সামান্য কগাছি চুল, মুখে কুৎসিত হাসি। ভদ্রলোক আমাকে বুকে জড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। কেমন ঘিনঘিন করে উঠল আমার সমস্ত দেহ। তাকে আলতো করে ঠেলে আলিঙ্গন সম্পূর্ণ করতে বাঁধা দিলাম আমি। ভদ্রলোক কুৎসিত হাসি হাসলেন।

আমি বললাম, “দুঃখিত, আমার সারা গায়ে ধুলাবালি, আপনার পোশাকটাকে নষ্ট করতে চাই নি”, আমার কথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন, যেন খুব মজার কোন কথা শুনেছেন। উনার সাথে দোতলায় গেলাম আমি। আমার রুমটা দেখিয়ে দিলেন উনি। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ডিনারের আমন্ত্রণ জানালেন ভদ্রলোক। আলিশান বাড়ির চকচকে বাথরুম দেখে ততক্ষণে আমার মাথা ঘোরা শুরু হয়েছে।

ঠিক কতটা ধনী হয়েছেন এই ভদ্রলোক? ঠিক কত টাকা হয়েছে তার? বারবার এই দুটো প্রশ্নই ঘুরেফিরে মাথায় বাড়ি মারছিল আমার। ফ্রেশ হয়ে নিচতলায় গেলাম। দেখি ভদ্রলোক একটা বড় ডাইনিং টেবিলের সামনে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। কথা শুরু হল। কথায় কথায় জানলাম, ভদ্রলোককে যতই বয়স্ক দেখাক না কেন, উনার বয়স আসলে পঁয়তাল্লিশ।

মেডিকেল পাশ করার পর মাত্র একুশ বছরেই তার এই পসার প্রতিপত্তি। এই সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান নাকি তার একাগ্রতা ও ধৈর্যের। সবিনয়ে আমাকে নিমন্ত্রণের কারণ জিজ্ঞেস করলাম আমি। তিনি বললেন, প্রতি বছর এই সময়ে এই শহরে আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন হয়। একেকবার একেক দেশ থেকে একেকজন লেখক এখানে নিমন্ত্রণ লাভ করেন।

এদের মধ্য থেকেই যাকে ইচ্ছা তাকে রাতে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন তিনি। গত আট বছর ধরে এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় নি। এর আগে নাকি ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের প্রথিতদশা লেখকদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন তিনি। আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন তিনি। নিজের কথা বলা শুরু করলাম আমি।

ছোটবেলার আর্থিক কষ্ট, মা বাবার ছাড়াছাড়ি। কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতার প্রশংসা পেয়ে লেখালেখি শুরু করা। প্রথম গল্প নিয়ে এগারোটা পত্রিকা অফিসে ঘোরা, ভালোবাসার মেয়েটার ছেড়ে চলে যাওয়া। সবই ধীরে ধীরে ভদ্রলোককে বললাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আমার কথা।

মাঝে মাঝে আফসোসমূলক উহ আহ শব্দ করলেন। উনার সহানুভূতি সহজেই হৃদয় স্পর্শ করল আমার। উনাকে কেন যেন অনেক কাছের মানুষ বলে মনে হতে লাগলো। খাবার চলে এল। খাবার যে দিয়ে গেল তার আপাদমস্তক ঢাকা, মুখের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে শুধু।

দেখে মহিলা বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু শরীরের বাইরে থেকে দেখে বিভিন্ন অংশের অনুপাত আবার ভিন্ন কথা বলছে। স্ফীতি বা খাঁজ কিছুই বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। লক্ষ্য করলাম, খাবার দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল মানুষটা, একটা কথাও বলল না। জিজ্ঞেস করলাম, “কে উনি”? ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “ও? ও আমার হেড সার্ভেন্ট বলতে পারেন। ঘরের সব কাজ ও-ই দেখাশোনা করে”।

আমি বললাম, “পুরুষ?” ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন, “না। মহিলা। তবে পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়”। ভদ্রলোক চুপ হয়ে গেলেন।

আমিও আর কোন কৌতূহল দেখালাম না। খাবারের বেলায় দেখি এলাহি কাণ্ড। একসঙ্গে এত খাবার আমি কখনও চোখেও দেখি নি। খাওয়া শুরু করলাম। প্রত্যেকটা আইটেম শুধুমাত্র চেখে দেখতে গিয়েও পেট কখন ভরে গেল টেরই পেলাম না।

খাওয়া শেষ হল। ঘুমানোর আগে ভদ্রলোক বললেন, উনার নিজের জীবনের কিছু বিশেষ গল্প আমার সাথে শেয়ার করতে চান। আমি অনেক বড় লেখক হলেও আমার নাকি ভালো লাগবে। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক বললেন, গল্প শেষে তিনি আমাকে একটা প্রশ্ন করবেন।

তাই আমি যেন গল্পটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। খুব কৌতূহল হল। কি এমন গল্প আছে পঁয়তাল্লিশ বছরের এই সফল মানুষটির? আগ্রহ নিয়ে শোনা শুরু করলাম। ভদ্রলোকের নিজের ভাষায়ই তার গল্পটা তুলে দিচ্ছি... আমি যখন জন্মলাভ করি, তখন আমি খুবই কুৎসিত ছিলাম। এতই কুৎসিত যে, যে ডাক্তার আমাকে মাতৃগর্ভ থেকে বের করে আনেন তিনি আমাকে দেখে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে আমাকে হাত থেকে প্রায় ফেলেই দিয়েছিলেন।

একটু বড় হবার সাথে সাথেই আমি সবার অবহেলা টের পাওয়া শুরু করি। শুধু আমার মা বাদে অন্য সবাই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত। আমি যে একটা মানুষ, এটাও অনেকের মনে থাকত না। আমার বাবা যখন তখন আমাকে লাথি মারত, অনেক ভারী ভারী কাজ করাত। স্কুলে কেউ আমার সাথে কথা বলত না, শিক্ষকরা অযথা বেত দিয়ে মারত।

স্কুলে বা পাড়ায় আমার কোন বন্ধু ছিল না। আমার বন্ধু ছিল মূলত দুজন। আমার মা এবং বই। সারা পৃথিবীতে এই দুটো জায়গায়ই আমি সুখ খুঁজে পেতাম। আমাকে জন্ম দেবার জন্য একসময় বাবা আমাকে আর মাকে পরিত্যাগ করেন।

মা আমাকে নিয়ে শহরে চলে আসেন। সারা দিন তিনি আমার জন্য বাড়ি বাড়ি বুয়ার কাজ করতেন। আর আমি বস্তিতে বসে পড়ালেখা করতাম। ঈশ্বর আমাকে ঐ একটাই উপহার দিয়েছিলেন, মেধা। স্কুলে সবসময়ই ভালো রেজাল্ট করতাম আমি।

এইসব দেখে সব ছেলেমেয়ে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরত। আমাকে খেপাতে মাকে নিয়ে খারাপ কথা বলত। বলত আমার মা নাকি দেহপসারিণী, রূপোপজীবিনী ইত্যাদি। এইসব জঘন্য কথার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বারবার আমরা এলাকা পরিবর্তন করতাম। বড় হয়ে মেধার জোরে একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে যাই আমি।

খরচ বেড়ে যায় প্রচুর। মা যে কিভাবে এই খরচ যোগাতেন তা আজও আমার কাছে রহস্য। উনার সাথে আমার দেখা হত একমাস দুমাস পর পর। প্রতিবারই মা আগের বারের চেয়ে আরও কৃশকায় হয়ে আসতেন। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টের দুদিন আগে আমার মা মারা যান।

আমি কাঁদি না, পাথর হয়ে বসে থাকি। নিজের হাতে দাফন করি মায়ের মৃতদেহ। সময়মত রেজাল্ট দেয়। দেখা যায়, আমি প্রচুর নাম্বার নিয়ে পাশ করেছি। নিজের চেহারা খারাপ হবার ফলে আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল প্লাস্টিক সার্জারিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে মানুষের চেহারা পরিবর্তনে হাত পাকাব।

কিন্তু তখন টাকা একদমই ছিল না আমার কাছে। হঠাৎ ঈশ্বর আমার প্রতি সহায় হন। প্লাস্টিক সার্জারির এক প্রফেসরের মেয়েকে গর্ভবতী করে তার প্রেমিক পালিয়ে যায়। সেই মেয়েকে প্রফেসরের অনুরোধে বিয়ে করি আমি। বাচ্চাটা মায়ের পেটেই মারা যায়।

প্রফেসর আমাকে ভালবেসে নিজের ছেলের মত কাজ শেখাতে শুরু করেন। উনার সব অপারেশনে আমি হেল্প করতে থাকি। সারাদিন খাটার ফলে আমার অভিজ্ঞতা হু হু করে বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে প্লাস্টিক সার্জারির একজন এক্সপার্টে পরিণত হতে থাকি আমি। আমার বউ ছিল অসাধারণ সুন্দরী।

তাকে আমি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতাম। কিন্তু আমার মত কুৎসিত একটা লোককে সে কেন ভালবাসবে? তার পুরনো প্রেমিক তার সাথে গোপনে আবার যোগাযোগ করতেই বউ তার সাথে পালিয়ে যাবার প্ল্যান করে। ভালমানুষ আমি এর কিছুই জানতাম না। কিন্তু ঐ প্রেমিক আসলে ছিল একটা শুয়োরের বাচ্চা। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল আমার সংসারে আগুন ধরানো।

সে আমার বউকে মোটেও ভালবাসত না। আমার ফ্যামিলিতে বউয়ের সুখও তার সহ্য হচ্ছিল না। সুযোগ পেয়ে আমার বউয়ের মুখে অ্যাসিড মেরে ঝলসে দেয় শয়তানটা। তারপর আমার বউ যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে তখন পালিয়ে যায় সে। আমি তখন হাসপাতালে কাজ করছি।

রাস্তার লোকরা দেখতে পেয়ে বউকে আমার কাছে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সাথে সাথে প্রাথমিক মেডিকেশন দেয়া হয় ওকে। একটু পরেই শুরু হয় অপারেশন। কিন্তু আমাদের ডাক্তারদের পক্ষে ওকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। অপারেশনের মাঝামাঝিতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও শকের কারণে সে মারা যায়।

মেয়ের শোকে কদিন পরেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান প্রফেসর, আমার শ্বশুর। আমি হয়ে পড়ি একা। ঠিক সেদিন থেকে হাসপাতালটাকে নিজের ঘর বানিয়ে নিই আমি। সেদিন থেকে এ জীবনে কত রোগীর যে অপারেশন করেছি আর কত নায়িকা, ফিলমস্টার আর মন্ত্রীর বুড়ি বউদের চেহারায় যে ছুরি চালিয়ে ছুকরি বানিয়ে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। অথচ, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের চেহারায় কখনই সার্জারি করাই নি আমি, কারণ আমি চেয়েছিলাম, মানুষ আমার কর্ম দেখে আমাকে ভালবাসুক, চেহারা দেখে নয়।

গল্প শেষ হল। ভদ্রলোক বললেন, “এই হল আমার গল্প। মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন তো”? বললাম, “অবশ্যই”। উনি বললেন, “তাহলে প্রশ্নটা করতে পারি’? আমার মনে পড়ে গেল ব্যাপারটা। বললাম, “সানন্দে করতে পারেন, ডক্টর”।

উনি প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, আমার গল্পে আপনি কি কোন গোলমাল দেখতে পেয়েছেন”? অবাক হলাম। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? বললাম, “মানে? কি গোলমাল’? উনি বললেন, “না, মানে, আপনি তো অনেক বড় লেখক। আপনার ইমেজিনেশন তো অনেক উপরের লেভেলে। আপনি একটু ভেবে বলুন তো, গল্পটিতে আপনি কোন অসঙ্গতি পাচ্ছেন কি না”? আমি বললাম, “হ্যাঁ, তা হয়তো পাচ্ছি, কিন্তু ছোটখাটো অসঙ্গতি সবার জীবনেই থাকে। সবকিছুই যে ব্যাকরণ মেনে হবে এমন তো কোন কথা নেই, তাই না”? উনি আবার বললেন, “তাহলে আপনি শিওর আমার জীবনের গল্পে কোন অসঙ্গতি নেই”? আমি বললাম, “আছে হয়তোবা...আচ্ছা, আমি কি আরেকটু ভেবে বলতে পারি? ধরুন, সকালে চা খেতে খেতে বললাম।

চলবে”? উনি বললেন, “ইউ মে টেইক অ্যাজ মাচ টাইম অ্যাজ ইউ ওয়ান্ট। ওকে, গুড নাইট দেন”। রাতে একা ঘরে শুয়ে ঘুম আসছিল না। ভদ্রলোকের গল্পের কথা ভাবছিলাম। কি এমন অসঙ্গতি থাকতে পারে গল্পটায়? জন্মের সময় কুৎসিত ছিলেন, এতে কোন ঘাপলা নেই।

ছোটবেলায় মা ছাড়া সবাই শত্রুর মত আচরণ করত, এটাও মেনে নেয়া যায়। পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিলেন বলছেন, সেটাও ওকে, কারণ তা না হলে এতদূর আসা সম্ভব হত না। বউয়ের প্রেমিকের একটা ব্যাপার ছিল বলছেন, এটা থাকতেই পারে। অ্যাসিড মারার ঘটনাও সত্যি হতেই পারে, যেভাবে ভদ্রলোক বলেছেন। ঠিক এই সময় ঘড়িতে তিনটা বাজার সংকেত দিল।

আমার রুমের বাইরে কে যেন শব্দ করল, টক টক, টক টক। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিলাম। দেখি, আপাদমস্তক চাদরে আবৃত সেই মেয়েটা, যে আমাকে খাবার দিয়েছিল। আমি গিয়ে তার মাথা থেকে অবগুণ্ঠন সরিয়ে দিলাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল পোড়া মুখের অসম্ভব কুৎসিত একটা মেয়ে।

দুচোখে জল টলটল করছে তার, অথচ মুখে একটা হাসি লেগেই আছে মেয়েটার। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। হঠাৎ করে মনে হয় আমি যেন আয়নায় নিজেকেই দেখছি। আমি হাত দিয়ে মেয়েটার ঠোঁট স্পর্শ করি। একটু নাড়াচাড়া করতেই বুঝে যাই, তার মুখের দুপাশে এমনভাবে সার্জারি করা যে দেখে মনে হবে সবসময়ই সে হাসছে।

আমি ওকে ধরে ধরে আমার বিছানায় বসাই। ও আমার বিছানায় দুহাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে। কোন কথা হয় না আমাদের মধ্যে। আমি প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে উঠি। ছটফট করে উঠি।

ও অনেকক্ষণ আমার বিছানায় বসে থাকে। অনেকক্ষণ। তারপর পাঁচটা বাজার সংকেত দেয় দেয়ালঘড়িতে। ডক্টরের ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়েছে। ও চলে যায়।

যাবার সময় ওর দুচোখে অদ্ভুত একটা আকুতি দেখতে পাই আমি। যেন ও বলছে, আমাকে বাঁচাও! আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও!! প্লিজ!!! সকাল হয়। ডক্টরের মুখোমুখি হই আমি। ভদ্রলোক বলেন, “কি লেখক সাহেব? পেলেন কোন অসঙ্গতি”? “পেলাম”, নাটকীয়ভাবে বলে উঠি আমি, “অ্যাসিড বার্নে কেউ এত তাড়াতাড়ি মরে না। শক বা রক্তক্ষরণ যেটাই বলুন, তাতে মরতে অনেক সময় লাগে।

এটা তো সবাই জানে, আপনি জানেন না কেন প্রফেসর স্নাইডার”? ভদ্রলোকের চোখমুখ অদ্ভুতভাবে কুঁচকে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, “কি বলতে চাও তুমি”? “আমি বলতে চাই”, বলি আমি, “সেদিন আপনার বউয়ের প্রেমিক নয়, আপনিই ওর মুখে অ্যাসিড মেরেছিলেন। তারপর পৃথিবীর কাছে রটিয়ে দিয়েছিলেন প্রেমিকের অ্যাসিডের ক্ষতে তার মৃত্যু হয়েছে। অথচ মেয়েটা মারা যায় নি। আপনি তার মুখকে সার্জারি করে এমন ভাবে ক্ষতবিক্ষত করলেন যেন কেউ বুঝতে না পারে এ আসলে কে, আপনি তার মুখ এমন ভাবে সেলাই করলেন যেন দেখে মনে হয় সে সবসময় হাসছে।

আর তার মুখটা এমনই কুৎসিত করে আপনি রাখলেন যেন লজ্জায় সে পুলিশের কাছেও না যেতে পারে”। এ কথা শুনে প্রফেসর হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “এসবের প্রমাণ কি? কোথায় আমার বউ? সে যদি বেঁচে থাকে তবে দেখাও, দেখাও আমাকে”! আমি মেয়েটাকে ডাক দিই। মেয়েটা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি বলি, “খোল তোমার অবগুণ্ঠন”।

মেয়েটা তার অবগুণ্ঠন খুলে দেয়। তার ভয়ানক কুৎসিত রূপটা আমাদের সামনে প্রস্ফুটিত হয় ভোরের আলোর মত। প্রফেসর হা হা করে হাসতে থাকেন। বলেন, “এটা? এটা আমার বউ? এই, এদিকে আয় তো, এদিকে আয়”। মানুষটা ভয়ে ভয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়।

এক হ্যাঁচকায় ডক্টর তার মুখ থেকে মুখোশটা খুলে ফেলেন। একটা সতের আঠার বছরের বালকের চেহারা বেরিয়ে পড়ে মুখোশের নিচ দিয়ে। ডক্টর পাগলের মত চিৎকার করে বলতে থাকেন, “দেখলে! দেখলে তো! তুমি ভুল! আমিই জিতলাম!! তোমার আগের সাতজনই ঠিক একই ভাবে আমার এই গেমে হেরে গেছে, হা হা হা”!!! . . . . . . আমি ঠাণ্ডা মাথায় ডক্টরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, “এই বছরের লেখক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে ড. সালেহর আসার কথা ছিল”। “কথা ছিল মানে”? হঠাৎ যেন প্রচণ্ড অবাক হন প্রফেসর।

“তুমি...তুমি তো এসেছ...” “বিশেষ কারণে ড. সালেহ আসতে পারেন নি”, বলতে থাকি আমি, “কিন্তু সেই কথাটা সম্মেলন কমিটি নিজেদের সম্মান বাঁচানোর খাতিরে কাউকে জানায় নি। এমনকি প্রেসকেও না। সবাই জানে, ড. সালেহ এসেছেন, কিন্তু প্রচণ্ড অসুস্থতার কারণে বক্তৃতা দেন নি”। প্রফেসর স্নাইডার হা করে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। “ড. সালেহ কেন আসেন নি সেটাও আমি জানি”, বলি আমি, “কারণ আমিই তাকে আসতে বারণ করেছিলাম।

তবে তার আগে বিশেষ কারণে আমাকে বাংলাদেশে গিয়ে উনার সাথে দেখা করতে হয়েছিল”। “আপনি...কে আপনি”? কথা হারিয়ে যেন তোতলাতে থাকেন প্রফেসর। “আমি”? একটানে মুখ থেকে ড. সালেহর মুখোশটা খুলে ফেলি আমি। বেরিয়ে আসে পোড়া, দগ্ধ, বিকৃত, হাসিহাসি একটি মুখ। “চিনতে পারছ”? ভয়ানকভাবে চমকে ওঠেন স্নাইডার।

চোখের পলক ফেলতেও ভুলে যান যেন। তারপর কোনমতে উচ্চারণ করেন, “তু-তু-তুমি”? “হ্যাঁ আমি”, নির্দ্বিধায় ব্যাগ থেকে পিস্তলটা তুলে সামনের দিকে তাক করি আমি, “তুমি অ্যাসিড মারার পর আমাকে অপারেশনের নামে বিকৃত করেছিলে। এর দুঘণ্টা পরেই আমার হার্টবিট চলে যায়। তুমি ভাবলে, আমি মারা গেছি। তখন তুমি পুরো দোষটা আমার প্রেমিকের ঘাড়ে চাপিয়ে একটা কাহিনী বানিয়ে ছড়িয়ে দাও।

কিন্তু মর্গে যাবার পর অলৌকিকভাবে আমার আবার হার্টবিট আসে। হয়তো তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যই ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। হয়তো এজন্যেই আমাকে মৃত্যু নয়, একটা Death Trance অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি”। “মর্গ থেকে পালিয়ে বিদেশে চলে যাই আমি। বাবার দেয়া টাকা ব্যবহার করে একজন সার্জনের কাছ থেকে ভোকাল কর্ড সার্জারি করাই আমি।

ফলে আমার কণ্ঠস্বর হয়ে যায় পুরুষদের মত। এছাড়া নিজের স্তনের ফ্যাটও সার্জারি করে অপসারণ করে নিয়মিত টেস্টোস্টেরন নিতে থাকি আমি, যাতে আমাকে মেয়ে বলে আর কেউ চিনতে না পারে। তারপর আবার নতুন মুখোশ তৈরি করে দেশে ফিরে আসি আমি। নতুন পরিচয়ে শুরু করি চাকরি। আর আড়াল থেকে তোমার সব খবরাখবর রাখা শুরু করি আমি।

আমি জানতে পারি, তুমি আমার ক্ষতবিক্ষত চেহারার মত একটা মুখোশ তৈরি করেছ, এবং সেটা পড়ে থাকার জন্য তুমি প্রতি বছর সতের আঠার বছরের একেকটা তরুণকে অনেক টাকা দিয়ে ভাড়া কর। প্রত্যেকবার যখন লেখক সম্মেলন হয় তখন তুমি একেকজন লেখককে সিলেক্ট করে তার সাথে একটা মাইন্ড গেম খেল। তাকে তুমি তোমার বউয়ের মনগড়া কাহিনী শোনাও, তারপর অসঙ্গতির কথা বলে তোমার বউ জীবিত না মৃত এরকম একটা কনফিউশন তৈরি কর, তারপর রাতে সেই সাজানো বিকৃত চেহারাটিকে লেখকের সামনে উপস্থাপন কর। লেখক তার কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মনে করেন তোমার বউ জীবিত, তারপর তিনি ঐ বিকৃত চেহারার মানুষটিকেই তোমার বউ বলে পরের দিন সকালে দাবি করেন। তখনই তুমি সবকিছু ফাঁস করে দাও।

লেখক ধোঁকা খেয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যান। নামকরা লেখকদের এভাবে মাইন্ড গেমে হারাতে পেরে তুমি পৈশাচিক আনন্দ পাও। তোমার তৈরি করা টুইস্ট যে ঐ প্রতিটা লেখকের লেখা টুইস্টের থেকে ভালো, এরকম কিছু একটা ভেবে তুমি একটা বিকৃত তৃপ্তি পাও”। বিস্ময়ে হা হওয়া ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আমি বলি, “বাংলাদেশের প্রতি তোমার আসক্তির কথা আমি জানতাম। তাই এটা আগেই অনুমান করেছিলাম যে তুমি বাংলাদেশের ড. সালেহকেই ইনভাইট করবে, তাছাড়া আন্তর্জাতিক লেখকদের সাথে উনার উঠাবসা থাকার কারণে উনারই নিমন্ত্রণ পাবার চান্স বেশি।

তাই আগে থেকেই আমি উনার সাথে যোগাযোগ করি। নিজের মুখোশ বানাতে সাহায্য করার জন্য রাজি করাই উনাকে। আমার চেহারা দেখে উনি সবকিছু বিশ্বাস করে ফেলেন আর সাহায্য করতেও রাজি হয়ে যান”। গুণে গুণে দুজনকেই ছ টা করে গুলি করি আমি। বেরিয়ে আসার সময় আমার ঘড়িতে হঠাৎ অ্যালার্ম বাজার শব্দ হয়।

নাহ, ঠিক আছে। নির্দিষ্ট টাইমলাইনের মধ্যেই কাজটা সম্পন্ন করেছি আমি। ড. সালেহর কথা মনে পড়ে যায় আমার। উনি এখন আজিমপুর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। সেটা অবশ্য কেউ জানে না।

সবাই জানে কুৎসিত চেহারার এক বিদেশিনী রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়ে ওখানে সমাহিত হয়েছে। এখন সারা বিশ্বে ড. সালেহর জন্য খোঁজ শুরু হয়ে যাবে। ড. স্নাইডার হত্যার প্রাইম সাসপেক্ট হিসেবে তাকেই সন্দেহ করবে পুলিশ। কারণ ড্রাইভারসহ আরও অনেকেই তার এখানে আসার সপক্ষে সাক্ষী দেবে। আমার পিস্তল থেকে ছোঁড়া ড. সালেহর বুকের খাঁচা ভেদ করে ঢোকা ছয়টা বুলেটের কথা ভেবে হঠাৎ করেই খুব কষ্ট হতে থাকে আমার।

ড. সালেহকে না মারলেও চলত। কিন্তু কি আর করা, যুদ্ধে তো কোল্যাটেরাল ড্যামেজ থাকবেই, ভেবে বাইরের সূর্যালোকে পা বাড়াই আমি। ভোরের সূর্য আমার সারা দেহে প্রশান্তির একটা আমেজ ছড়িয়ে দেয় যেন। (সমাপ্ত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।