কলম চালাই ,এইগুলো লেখার পর্যায়ে পরে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে :) ব্লগের বয়স বছরের উপরে দেখালেও নিয়মিত লিখছি ১৭ আগস্ট ২০১২ থেকে :)
পর্ব (১-২) Click This Link
পর্ব (৩-৪-৫) Click This Link
ছয় .
আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে জুবায়ের । নিজেকে অচেনা লাগছে । অসুস্থ নাকি সে ? এলোমেলো চুল , ফ্যাকাসে চেহারা ! হাতে মুখে পানি দিল । চুলগুলোকে পরিপাটি করে সাজাল । বাহ ! এখন কিছুটা মানুষ মানুষ লাগছে ।
হাতের নখের মধ্যে কালো ময়লা । হ্যান্ড সোপ দিয়ে তা পরিষ্কার করল । এতো ময়লা কোথা থেকে আসল ? মুখে বিশ্রী গন্ধ , দাঁতের ফাকে কালচে কিছু জমে আছে যেন ! খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাও পরিষ্কার করল ।
কি করেছে সে যে তার এই অবস্থা ? কিছুই মনে করতে পারল না । হঠাৎই একটা মিস্টি ঘ্রান পেল সে ।
হাসনাহেনা ! নিশ্চয়ই নিলাদ্রি ঘোষ তার চেম্বারে এসেছে । মনটা প্রশান্তিতে ভোরে ওঠে তার ।
আরে ! সত্যিই তো ! নিলাদ্রি ঘোষ চেম্বারে বসে আছে । সেই মাধুশ্রী চেহারা , কারুকাজ করা শাল আর সৌরভ ।
-কেমন আছেন আজ আপনি ?
-ভালো ।
আপনি?
জুবায়ের প্রশ্ন করল । কণ্ঠে সমীহ ।
-জী । ভালো ।
মধুর একটা হাসি দিলেন নিলাদ্রি ঘোষ ।
-তো ! আপনার গল্প শোনা যাক !
-অবশ্যই । তবে গল্পটা আজকেই শেষ হয়ে যাবে ।
-শেষ হয়ে যাবে ?
বিষাদ নেমে এল জুবায়েরের চেহারায় ।
-জী । তাহলে শুরু করি !
বিষাদ বদনে একান্ত ভক্তের মত শুনতে লাগল জুবায়ের ।
‘’এভাবে অনেকদিন কেটে গেল । কিন্তু দিন দিন হত্যার পরিমান বেড়ে গেল । আমি সবসময় সুস্থ থাকতাম না । শুধুমাত্র যখন কলিজা খেতে পেতাম , তারপর ঘণ্টা কয়েক ভালো থাকতাম । বিমল দিন দিন বড় থেকে বড় কিছুর কলিজা নিয়ে আসতে লাগল ।
পাখি-মুরগি-হাস-চিল-কাক-বিড়াল-ছাগল এমনকি গরু । কিছুই বাদ যায় নি । মানুষ সন্দেহ করা শুরু করল । দিনকে দিন একঘরে হয়ে যেতে লাগলাম । একরাতে স্বপ্ন দেখে বিমল – আরও বড় কিছু হত্যা করতে হবে ।
মানুষ হত্যা । মানুষের কলিজা খেতে পারলে নাকি আমি পুরো একরাত সুস্থ থাকতে পারব ! আমরা পুলকিত হলাম । শিহরন বয়ে গেল ধমনী বেয়ে আমাদের সারা শরীরে । ভয়ও হতে থাকল । কিন্তু আমরা থেমে যাই নি ।
একে একে আটজনের কলিজা খেয়েছিলাম আমি । কাঁচা । চিবিয়ে চিবিয়ে । নোনতা লাগত । রক্ত লেগে চট চটে হয়ে থাকত ।
হাতে আঠা আঠা লাগত । মাঝে মাঝে কলিজার ভিতর থেকে বের হয়ে আসা কিছু শিরা বেয়ে গড়িয়ে পরত তাজা রক্ত । কলিজার সাথে থাকা পিত্ত থলিতে মাঝে মাঝে না দেখে চিবিয়ে বসতাম । তেতোয় মুখ ভরে যেত । কলিজা সবজায়গায় নরম ছিল না ।
নরম জায়গাগুলো খেতে মজা লাগত । তৃপ্তি পেতাম । কিন্তু যেখানে শিরা-রগ থাকত , ঐ জায়গাগুলো শক্ত , চিবিয়ে ফেলে দিতাম । কলিজার উপরে একধরনের পাতলা আবরন থাকত । বিমল মাঝে মাঝে তা আমার জন্য ছাড়িয়ে দিত ।
বড় ভালো মানুষ ছিল সে , বড় ভালবাসত আমাকে ।
আমাদের বাড়ি থেকে পচা গন্ধ বের হতে লাগল । গ্রামবাসী বাড়ির পাশের রাস্তাটাও ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছিল । আমাদের জন্য ভালোই হয়েছিলো । সারা বাড়ির দরজা জানালা চুনাকাম ইট খসে খসে পড়তে লাগল ।
যেন পোড়াবাড়ি ।
এক রাত নবম খুন করে আনল বিমল । গ্রামবাসী সম্ভবত টের পেয়ে গিয়েছিল । হঠাৎই বাড়ির চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো । মশালের টকটকে আলো ।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম । বিমল আমার মাথা তার বুকে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল । আমার চুল তার হাতে বেধে উঠে যাচ্ছিল । আমি কিছুটা নির্ভরতা পেলাম যেন । দরজায় বিকট শব্দে কড়া নাড়ল তারা ।
না , আমরা দরজা খুলিনি । সে দরজা ভাঙা হল । আমি সবেমাত্র অর্ধেকটা কলিজা খেয়ে শেষ করেছিলাম । আমার সামনে মড় দেহ । চোখ খোলা ।
বুকের কাছে খাঁচা ভাঙ্গা – বিকট গর্ত – হাড় বের হয়ে আছে । মানুষ চিৎকার করে উঠলো । কেউ কেউ বমি করল – মূর্ছা গেল । তারপর , তারপর ওরা আমাদের দুজনকে ধরে বাইরে নিয়ে এল । বিমলকে আমার সামনে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করল ওরা ।
হাতের দা – বটি দিয়ে । ইশ ! কি বীভৎস মানুষ ওরা ! আমার বিমলকে হত্যা করে ফেলল ? আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম । মানুষগুলো যেন ভীতসন্ত্রস্ত । আমাকে দূর থেকে দেখছে গ্রামের মেয়েমানুষগুলো । আর ফিস ফিস করে কি যেন বলাবলি করছিল নিজেদের মধ্যে ।
একটা মাঠের মাঝখানে গর্ত করা হল । তাতে একটা বাঁশ পুতে খাড়া করা হল । আমাকে বাধল ওরা সেই বাঁশের সাথে । আমার গায়ে কি যেন ছিটাল ওরা । কেরোসিনের গন্ধ ।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম । চিৎকার করতে লাগলাম । চিৎকারের সাথে আমার মুখ থেকে বের হয়ে আসছিল থুথু এবং লালা । আমার গগনবিদারি চিৎকার সে রাতে অন্ধকার চিরে যেন ফালা ফালা করে দিল । বাতাস যেন থমকে দাড়াল ।
ভয়ে পিছিয়ে পড়ল অনেক জোয়ান গ্রামবাসীও । কোথা থেকে মাথায় টুপি পড়া , লম্বা দাড়ি আর আলখেল্লা পড়া এক লোক এল । কিছু একটা পড়ল আমার সামনে দাড়িয়ে । তার হাতে একটা কুপিবাতি । আগুন জ্বালিয়ে দিল আমার গায়ে ।
জলন্ত পুড়ে মারা যাচ্ছি আমি । পোড়া মাংস-চামড়া আর চুলের উৎকট গন্ধে ভরে উঠলো সারা এলাকা ।
-তারপর?
-তার আর কোন পর নাই ।
-বুঝলাম না !
-এখানেই শেষ । ঘুরে ফিরে এই স্বপ্নই আমি দেখি ।
আজ তাহলে আসি ডাক্তার সাহেব ।
-চলে যাবেন ?
-জী ।
বলেই তার সেই স্বভাবসুলভ হৃদয়চেরা হাসি দিলেন নিলাদ্রি ঘোষ । এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল জুবায়ের । তার দৃষ্টি যেন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ।
ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল চারিদিক ।
সাত.
পাকুটিয়ার জমিদার বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন সুরাইয়া । জরাজীর্ণ বিদ্ধস্থ ভুতুড়ে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে আছে । ড্রাইভারকে জিজ্জেস করলেন – ‘’ ঠিক জায়গায় এনেছ তো ?
-জী মাড্যাম । এই এলাকায় এই একটাই জমিদার বাড়ি আছে ।
চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে আছে সে । আচমকা পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো – কাউরে খুজেন , মায়জী ?
চমকে তাকাল সুরাইয়া । একজন বৃদ্ধ । মাথায় টুপি – দাড়ি । সুরাইয়া অপ্রস্তুত গলায় বলল – জী , পাকুটিয়ার জমিদার বাড়ি ?
-জে , এইডাই পাকুটিয়ার জমিদার বাড়ি ।
-না , মানে আমি জমিদার পরিবারের কাউকে খুজছিলাম ।
-জমিদারি তো চইলা গেছে বছর চল্লিশেক হইল মা । আর জমিদারের কোন উত্তরসূরিও বাইচে নেই আর । ঘোষ বংশ এইহানেই শেষ হইয়া যায় । এই গেরামে আর কোন ঘোষ নাই ।
লোকটার মুখে হাসি ।
-নিলাদ্রি ঘোষ ? চেনেন ?
লাফিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল লোকটি । মুখের হাসি উধাও হয়ে গেছে । সন্দেহের চোখে দেখছে ।
-অরে কি দরকার আপনার ?
-কেন কি হয়েছে ?
-ওঁইটা অ্যাছিল একটা ডাইনী , পিচাশিনী ।
-কি যা তা বলছেন ? আর ছিল মানে কি ?
-ছিল মানে ছিল । আমরাই ওঁদেরকে পুইড়া মারছিলাম । বছর ত্রিশেক আগেই । ও আর ওর স্বামী্রে । ঐ মাঠের মাঝখানে ।
হাত তুলে জংলা একটা মাঠ দেখাল বৃদ্ধ ।
-ওরা মানুষ খেক ছিল মায়জী । মানুষের কইলযা খাইত ডাইনী ।
এরপর যে গল্প শুনল , সুরাইয়ার হাত পা হিম হয়ে এল । হাতের তালু ঘামছে ।
তাহলে জুবায়েরের চেম্বারে যায় সে কে ? ভয়ের একটা শীতল বরফ পানির ধারা তার মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে গেল । ড্রাইভারকে বলল , যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরতে চায় সে । যত দ্রুত সম্ভব ।
--------------------------------------------------------------------
সুরাইয়ার বাসার সামনে অনেক জটলা । এ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশ ।
থর থর পায়ে এগিয়ে যায় সুরাইয়া । এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে একটা মরদেহ । সুরাইয়ার যেন কোন বোধ শক্তি নেই । শুধু শুনছে আর দেখছে । কারা যেন বলছে , বিলাতি খুন হয়েছে ।
বিলাতি তাদের কাজের মেয়ে । বুকের খাঁচা ভাঙ্গা । জুবায়েরকে ডাকছে পিশাচ বলে । সে নাকি মেয়েটার কলিজা বের করে খাচ্ছিল । পাশের বাড়ি থেকে জানালা দিয়ে কেউ একজন দেখে চিৎকার করে উঠেছিল ।
পুলিশ এসে স্টাডি রুমের দরজা ভেঙেছে । একটা ফ্রিজও পেয়েছে তারা । ফ্রিজ ভর্তি নানা ধরনের পশু পাখির কলিজা । জুবায়েরকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হল । তার হাত বাধা ।
মুখে চামড়ার বেল্টের একটা লাগাম । তার চোখগুলো ঘোলা ঘোলা । কিন্তু সে যেন হাসছে । তার শরীর কাঁপছে । ভয়ঙ্কর শরীর কাঁপানো সে হাসি ।
জ্ঞান হারাল সুরাইয়া ।
--------------------------------------------------------------
হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতালের বিশেষ সেলে রাখা হয়েছে জুবায়েরকে । জেলখানার চেয়ে কম না কোন অংশে । মাঝে মাঝে উৎসুক মানুষ আসে দেখতে । পাগল দেখে ।
জুবায়ের হাসে । সে তো পাগল না । সেদিন দুইটা মেয়ে এসেছিলো । যুবতী । অনেক ভালো করে কথা বলেছে ।
সাধারণত মানুষ তাদের সাথে এতো সুন্দর করে কথা বলে না । ভালো লেগেছে তার । তাকেও মনে হয় ভালো লেগেছিল মেয়েটির । জুবায়ের বুঝতে পারে । হেসেছিল সুন্দর করে ।
কলিজা খাওয়ার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল । উৎসুক । যাবার বেলায় বলে গিয়েছিল আবার আসবে বলে ।
ঘোলা চোখে ওপাশের সেলটিতে তাকাল সে । আবছা অন্ধকারে বোঝা যায় না ।
ঐ সেলটাতেও নাকি তার মত একজন আছে । মানুষের কলিজা খেত ।
ভালো লাগে জুবায়েরের । সে একা নয় !
আট.
বীভৎস সংবাদটি দেখছে অনন্যা আর আসমাউল । নব দম্পতি ।
থাকে মোহাম্মাদপুরে ।
হেমায়েতপুরের বিশেষ সেল ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কে বা কারা যেন । সাধারণত বিপজ্জনক পাগলদের কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হত অংশটি । জলন্ত পুড়ছে কিছু মানুষ । কিছু পাগলকে খুঁজে পাচ্ছে না কতৃপক্ষ ।
আসমাউলের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই । বিয়ে করেছে আঠারো বছরের অনন্যাকে । সন্দেহ নেই অনন্যা তাঁকে টাকার লভেই বিয়ে করেছে । মাঝারি গোছের নেতা শ্রেণীর মানুষ সে । অর্থ – প্রতাপ ভালোই আছে তার ।
হঠাৎই তার মনে পড়ে যায় মমতার কথা । বারান্দায় চলে যায় সে । সিগারেট ফুকবে ।
-বুড়ো ভাম !!
বলে খিস্তি করে ওঠে অনন্যা । সংবাদে মন দেয় ।
বারান্দায় দাড়িয়ে চিন্তায় ডুবে গেল আসমাউল । তার বয়স ছিল বিশ । প্রেম করেছিল চৌদ্দ – পনের বছরের তার এক খালাত বোনের সাথে । অসাবধানতায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে সে । বিয়ে করতে চেয়েছিল আসমাউলকে ।
সে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল । সেবার কোরবানির ঈদের দিন সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করে মমতা । সেই থেকে যেন সে পাপ তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে । কিন্তু সে তো এতোটা খারাপ মানুষ নয় ! প্রতি বছর সে মমতার কবর যিয়ারত করতে যায় !
হঠাৎ সুন্দর একটা ঘ্রান পেল আসমাউল । হাসনাহেনা ! চোখ তুলে তাকাল ।
পাশের বাড়ির বারান্দায় কেউ একজন । দেবশ্রী চেহারা । যেন এই মাত্র গোসল সেরে এসেছে । দীঘল কালো চুল । চোখে ভারী কাজল ।
গায়ে তার কারুকাজ করা শাল । কেমন যেন একটা ঘোরলাগা আকর্ষণ আনুভব করল আসমাউল ।
মেয়েটা যেন টের পেয়েছে । ঘুরে তাকাল সে আসমাউলের দিকে । লজ্জা পেল আসমাউল ।
-আজ বোধয় বৃষ্টি হবে , তাই না !
মৃদু কিন্তু পরিশীলিত কণ্ঠে মেয়েটি বলল ।
আসমাউল বিব্রতভাবে বলল – জী । তাইতো মনে হচ্ছে । মেঘ করেছে অনেক । ঝড়ও হতে পারে ।
-ঝর ? হুম , ভালোই বলেছেন । ঝড় হতে পারে । যাই হোক , আমি নিলাদ্রি ঘোষ । আপনি ?
...............................................................(সমাপ্ত ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।