......... প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
কাহিনী সংক্ষেপঃ
রেস্টুরেন্টে শিলাকে পায় না মারুফ জাবের। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সে বেরিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট থেকে। রাস্তায় তার দেখা হয় এক বন্ধুর সাথে। বন্ধুর নাম তাকসির। তাকসির মারুফ জাবেরকে নিয়ে আসে নগলা বাবা নামের এক পীর বাবার কাছে।
...........................................................................
৬।
মারুফ জাবের আর তাকসির যখন নগলা বাবার আরশে পৌঁছায় তখন মেঘ কেটে আকাশে বেশ উজ্জ্বল কিন্তু রুগ্ন এক চাঁদ উঠে গেছে। সুন্দর বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে এক পশলা মেঘ চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলছে।
চারদিকে অনেক মানুষ।
মহিলাদেরই বেশি দেখা যায়। তবে পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। মহিলাদের বেশিরভাগ বোরখাপড়া, অনেকের কোলে বাচ্চা, অনেক বাচ্চার নাক দিয়ে পানি পড়ছে। আশেপাশে এত মহিলা দেখে মারুফ জাবেরের কেমন অস্বস্তি বোধ হতে থাকে। কেমন একটা গন্ধ পায় সে, এ গন্ধ কেবল আশেপাশে অনেক বোরখাপড়া মহিলা থাকলেই পাওয়া যায়।
সামনে অনেক ভীড়। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে নগলা বাবার কাছে পৌঁছানো সহজ নয়। মারুফ জাবের, তাকসির পিছনেই দাঁড়িয়ে পড়ে। মারুফ জাবের এরকম আরশে আগে আসেনি। সে অবাক করা চোখে চারদিকে তাকায়।
নগলা বাবা যেখানে বসে আছে তার পাশে ছোট একটা স্টেজ। স্টেজে এক মেয়ে উঠেছে গান গাইতে। মেয়ে না মহিলা তা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার পরনে রবীন্দ্র স্টাইলের শাড়ি আছে এটা বোঝা যাচ্ছে।
স্টেজের দিকে তাকিয়ে থেকে তাকসির বলে, ভালো সময়ে আসছি, মৈত্রেয়ী বানু উঠেছেন গান গাইতে।
খুব ভালো গায় নাকি? মারুফ জাবের জিজ্ঞেস করে।
শুনে দেখ। উনার গান শুনলে বুকের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়। সবার মনে কেমন একটা অসহায় বোধ হয়। নিজেকে খুব একা একা লাগে।
মৈত্রেয়ী বানু গান শুরু করেন। কেন পীরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি...
কিন্নর কণ্ঠের এ গান সত্যিই কেমন একটা হাহাকার করা পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলল। আশেপাশের সবাই কেমন চুপ করে গেল।
বাতাসে ভেসে আসা গান মারুফ জাবেরকে কেমন উদাস করে ফেলে। সত্যিই তো, যদি চলেই যাবে তবে কেন শিলা পীরিতি বাড়াল? মারুফ জাবেরের খুব কান্না পায়।
নিজেকে আসলেই অসহায় মনে হচ্ছে তার। আকাশের দিকে তাকায় সে। মেঘ আর চাঁদের খেলা জমে উঠেছে।
একটু দূরে মনে হয় রান্না হচ্ছে। বাতাসে কেমন মম গন্ধ।
মারুফ জাবেরের খিদে পেতে থাকে। পকেট থেকে একটা বেনসন বের করে সে। সিগারেটের ধোঁয়া, চাঁদের আলো, গানের সুর মারুফ জাবেরকে পাগল করে তোলে।
একটু সামনে যেতেই মারুফ জাবের আর তাকসির পিয়াসকে পেয়ে যায়। পিয়াস মারুফ জাবেরের ক্লাসমেট।
তাকসিরও চেনে পিয়াসকে। পিয়াসের সাথে একটা ছাগল, শিন্নী দিতে এনেছে। মারুফ জাবের পিয়াসকে দেখে হতাশ হয়ে পড়ে। মারুফ জাবের এসেছে একদম খালি হাতে। বাবা নিশ্চয়ই মারুফ জাবেরকে সাহায্য করবে না।
কিরে পিয়াস কী জন্যে এসেছিস? জিজ্ঞেস করে মারুফ জাবের।
সামনে রেজাল্ট, ভুলে গেলি নাকি?
আমি তো কিছু আনি নাই রে, একদম খালি হাত। বাবা তো আমাকে আশীর্বাদ দিবেন নারে। অস্থিরভাবে বলে মারুফ জাবের।
ব্যাপার না, আমি ব্যবস্থা করে দিব।
বাবা আমাকে ভালো করে চিনেন।
পিয়াসের কথায় আশ্বস্ত হয় মারুফ জাবের। তবু মনের ভেতর খচখচানি ভাবটা রয়ে যায়।
ঘন্টা দুই পরে মারুফ জাবের, তাকসির আর পিয়াস বাবার কাছাকাছি চলে আসে। পিয়াস সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিল।
পিয়াসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বোকা বোকা চোখে নগলা বাবার খুপরি ঘরে ঢুকে মারুফ জাবের।
ঘরে শুধু মারুফ জাবের আর নগলা বাবা। ঘর জুড়ে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। গাঁজার গন্ধে কেমন দমবন্ধ লাগতে থাকে মারুফ জাবেরের। নগলা বাবা একটা চাটাইয়ের উপর বসে আছে।
খালি গা। কোমরে কেমন যেন শিকল বাধা। মারুফ জাবের নগলা বাবার সামনে গিয়ে বসে।
কিরে ভালোবসিস কাউরে? নগলা বাবা আস্তে করে বলে।
মারুফ জাবের অবাক হয়।
বাব জানল কী করে?
ঢোঁক গিলে কাঁচুমাচু হয়ে বলে জ্বি বাবা।
নাম কী?
শিলা।
আরে গাধা তোর নাম কী?
মারুফ জাবের।
সমস্যা কী?
ও আমাকে পাত্তা দেয় না, ওকে খুঁজে পাই না। দেখা করার কথা বলে দেখা করে না।
বাবা আমি কী করব? ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
নগলা বাবা কেমন ফোঁস ফোঁস শব্দ করা শুরু করলেন। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
মারুফ জাবের অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নগলা বাবার দিকে। তার কেমন ভয় ভয় লাগে। এক মিনিট পরে নগলা বাবা চোখ খুলেন। মারুফ জাবেরকে এক পায়ের উপর দাঁড়াতে বলে আবার চোখ বন্ধ করলেন।
মারুফ জাবের একটু চিন্তায় পড়ে যায়।
কোন পায়ের উপর দাঁড়াবে, বাম পা নাকি ডান পা। ডান হাত দিয়ে আমরা খাই, সালাম দেই, হ্যান্ড শেক করি। মসজিদে ঢুকতে হয় ডান পা দিয়ে। ডান হাত-পা পবিত্র হওয়ার কথা। বাম হাত দিয়ে তো......ছিঃ ছিঃ না না, ডান পায়েই দাঁড়াতে হবে।
সবকিছু ভেবে ডান পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মারুফ জাবের।
হাঁক মাউলা বলে নগলা বাবা চোখ খুললেন। বললেন, পাপন নামের এক ছেলেকে ভালোবাসে নীলা।
বাবা, এখন আমি কী করব? চিন্তিত হয়ে বলে মারুফ জাবের।
ডান পায়ে কেন, বাম পায়ে দাঁড়া।
চিৎকার করে এতটুকু বলেই আবার চোখ বন্ধ করলেন বাবা।
মারুফ জাবের দাঁড়িয়ে পড়ে বাম পায়ে। বুকের ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার। শিলা পাপনকে ভালোবাসে, কেন এমন হল, শিলা কেন একথা আগে বলেনি। বাবা কী পারবেন কোন ব্যবস্থা বের করতে, নিশ্চয়ই পারবেন, বাবার অনেক ক্ষমতা।
সময় যাচ্ছে। মারুফ জাবের এক পায়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে । বাম পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে তার। ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। বাবাও চোখ খুলছে না।
তিন মিনিট হয়ে গেল প্রায়। কোন সাড়া-শব্দ নেই।
এমন সময় মারুফ জাবের একটা তেলাপোকা দেখতে পেল। বেশ বড় বদখত এক তেলাপোকা। হাঁটাহাঁটি করছে।
মারুফ জাবেরের পুরোটা শরীর ঘিনঘিন করতে লাগল। কলেজ লাইফে বায়োলজি প্র্যাকটিক্যালে তেলাপোকা কাটার কথা মনে পড়ে গেল তার। মারুফ জাবের তেলাপোকা ভয় পায়, কোনমতেই কাটবে না। কাটাকুটি তো দূরে থাক, ধরবে না পর্যন্ত এমন অবস্থা। মারুফদের বায়োলজি ম্যাডাম মিস শামীম আরা ছিলেন খুবই কড়া।
তিনি তেলাপোকা নিয়ে মারুফ জাবেরের হাতে দিয়ে দিলেন। মারুফ জাবের সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে ম্যাডামের উপর পড়ে যায়। বন্ধুরা বলে মারুফ জাবেরের মাথা একদম ম্যাডামের বুকের উপর যেয়ে পড়ে, মারুফ জাবেরের অবশ্য সে কথা মনে পড়ে না, তবে সে সিচুয়েশনটা মাঝে মাঝেই অনুভব করার চেষ্টা করে।
কী সর্বনাশ! বদখত তেলাপোকাটা উড়াউড়ি শুরু করেছে। মারুফ জাবেরের মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যেতে থাকে।
তেলাপোকাটা উড়ছে, উড়ে যেয়ে এক জায়গায় বসছে, আবার হাঁটাহাঁটি আবার উড়াউড়ি। মারুফ জাবেরের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, দরদর করে ঘামতে শুরু করে সে। মারুফ জাবেরের মনে হতে থাকে তেলাপোকাটা এখনই ওর গায়ে এসে বসবে, হাঁটাহাঁটি করবে। একমনে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে সে।
একি! তেলাপোকাটা যে উড়ে তার দিকেই আসছে।
চিন্তাভাবনার খুব বেশি সময় পেল না মারুফ জাবের। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে ম্যাট্রিক্স স্টাইলে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে কোনমতে। ব্যালেন্স হারায় সে। ধপাস করে উল্টে পড়ে চোখ বন্ধ করে থাকা বাবার উপর। মারুফ জাবেরের ধাক্কা খেয়ে বাবা একদম চিত হয়ে শুয়ে পড়ে।
মারুফ জাবের বাবার উপর পড়ে যায় উপুড় হয়ে। চোখ খোলেন বাবা। খুলেই মুখের সামনে মারুফ জাবেরের ভয়াতুর মুখটা দেখতে পান তিনি। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন মারুফ জাবেরকে। প্রবল ধাক্কায় ব্যথা পায় মারুফ জাবের।
ব্যথায় আঃ করে চিৎকার করে উঠে সে। হা হয়ে যায় তার মুখ। ঠিক তখনই উড়ন্ত সেই তেলাপোকাটা উড়ে এসে মারুফ জাবেরের মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ে। মারুফ জাবেরের গা গুলিয়ে উঠে, পেটে কী যেন একটা পাঁক দেওয়া শুরু করে। মুখ ভর্তি করে বমি চলে আসে তার।
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় সে, বমি করে দেয় সামনে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকা বাবার উপর। বাবার সমস্ত শরীর মারুফ জাবেরের বমিতে মাখামাখি। থুতু ফেলে মারুফ জাবের। বেরিয়ে আসে তেলাপোকার কয়েকটি পা।
বাবা কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে।
তারপর চিৎকার করে বলে উঠেন বেরিয়ে যা এখান থেকে।
ভয় পেয়ে যায় মারুফ জাবের। চটাং করে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসে সে।
বাইরে এসেই কাছের এক কল থেকে মুখ ধুয়ে নেয় মারুফ জাবের। তারপর দেখা হয় তাকসিরের সাথে।
তাকসিরকে মাত্রই ঘটে যাওয়া ঘটনার কোন কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে সে। বের হয়ে আসে নগলা বাবার আরশ থেকে।
গা ঘিনঘিন করা অনুভূতিটা কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না মারুফ জাবেরের। গরম পানি দিয়ে গোসল করা দরকার। মুখের ভিতরেও কেমন টক টক ভাব।
আবার বমি পাচ্ছে। গা গুলিয়ে আসছে। চাঁদটাকে দেখতে আকাশের দিকে তাকায় সে। বমি মুখে চাঁদটাও কেমন অদ্ভুত লাগতে থাকে।
চল কিছু খাই।
তাকসির বলে মারুফকে।
খাবারের কথা শুনতেই আবার বমি পেয়ে যায় মারুফ জাবেরের।
না, এখন বাসায় যাই, কাজ আছে। বলেই বাসার দিকে হাঁটা শুরু করে মারুফ জাবের।
হাঁটতে হাঁটতে নগলা বাবার কথা মনে পড়ে তার।
বাবা বলেছে
শিলা পাপনকে ভালোবাসে। কে এই পাপন? চিন্তা করতে থাকে মারুফ জাবের। ফেসবুকে সার্চ দিতে হবে। শিলার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে হবে পাপনকে। ওর অনেক পরিচিত মাস্তান বন্ধু আছে, হুমকী ধামকী কিংবা চড় থাপ্পড় দিয়ে পাপনকে শিলার জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়া খুব একটা কঠিন হবে না।
তবে চিন্তা ভাবনা করে কাজ চালাতে হবে।
এগিয়ে যেতে থাকে মারুফ জাবের। আকাশে একা চাঁদ, চাঁদের চেয়ে নিজেকে একা মনে হতে থাকে মারুফ জাবেরের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।