একি আজব কারখানা...........
নীতু একটা প্যাচানো সিঁড়ির ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে।
অনেকটা সময় ধরেই নীতুর মনে হয় সে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে নামছে। কিছুখন উঠা নামার পর মনে হচ্ছে এই যায়গাটায় সে আগেও এসে দাঁড়িয়েছিলো। সেবার কি সে উঠে গিয়েছিলো নাকি নেমে গিয়েছিলো, নীতু ঠিক মনে করতে পারেনা। নিজের জীবনের সাথে কি অদ্ভুত এক মিল এই প্যাচানো সিঁড়িটার।
সারাটা জীবন সিঁড়ি বেয়েও কোথাও পৌছুনো গেলো না। ছোটবেলায়, যখন তার মা টা মরে গেলো, নিজেকে এক অন্ধকার ঘরে আবিষ্কার করে সে। খোলা দরজা দিয়ে এক চিলতে আলো আসছিলো। ছোট্ট নীতু দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখতে পায় একটা প্যাচানো সিঁড়ি। সেবারি প্রথম।
উপরে উঠার বদলে নীতু নেমে যায় নিচের দিকে। সিঁড়ি ভাংগতে ভাংগতে নীতু যখন আরেকটা দরজা খোলা পায়, তার বয়স তখন আট। একটু আলোর আশায় সে ঢুকে পড়ে দরজা দিয়ে। বাবাকে ওভাবে এক মহিলার সাথে দেখে সহ্য করতে পারেনি । বাবা তাকে দেখেনি, কিন্ত মহিলাটা দেখেছিলো।
কি ভয়ানক দৃষ্টি ছিলো, চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারেনি, কে যেন তাকে থামিয়ে দেয়। নীতু বেরিয়ে আসে দরজা দিয়ে। আবার সেই সিঁড়ি, তার পুরনো ঠিকানা।
ইন্টারে পড়া অবস্থায় নীতুর সিঁড়ি বেয়ে চলে অন্য এক ঘরে। কি আলো ! এইবার মনে হয় আর ফিরে যেতে হবেনা সেই স্যাতস্যাতে গন্ধওয়ালা অন্ধকার সিঁড়িতে।
একি, কোথায় এলাম ! আমি কোথায় ? কেউ জবাব দেয় না। আলো আধারির ঘোরে নীতু অনেকগুলো অয়োবয় দেখতে পায়। রঙ বেরঙ্গের লাইট আর ধোয়ার চোটে নীতু ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা, কে পুরুষ, আর কে রমনী। সবাই মিলে তাকে চেপে ধরতে চায়। তারপর কি হয়েছিলো নীতুর ঠিক মনে নেই, তবে নিজেকে সে ফিরে পায় সেই সিঁড়িঘরে।
আবছা অন্ধকারে মায়ের একটা ছায়া যেন সে দেখতে পায়। এই সিঁড়ি যেন তাকে টেনে ধরে রাখছে। মায়া সভ্যতার শিলালিপি তার কানে বেজে উঠে, সহস্র শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া তুমি মুক্তির স্বাদ পাইবে, ইহাই তোমার নিয়তি।
নিয়তির মাঝে আটকে গেছে নীতু। ভার্সিটিতে পড়া অবস্থায় ফিলোসফির টিচার যখন তার দিকে হাত বাড়িয়েছিলো, তখন নীতুর বড় ঘেন্না হয়েছিলো নিজের উপর।
আত্মহত্যা করতে পারেনি। নিয়তি তাকে আবার নিয়ে গিয়েছিলো সেই প্যাচানো সিঁড়িতে।
নিতু মাঝে মাঝেই ঘুরে বেড়ায় সিঁড়িতে সিঁড়িতে। কখনো উঠে, কখনো নামে। কখনো হারিয়ে যায়।
খুজে বেড়ায় কোন ঘরের আলো জলছে কিনা, দরজা খোলা আছে কিনা। অভ্যস্ততার কাছে হার মেনে নেয় প্রত্যাশা। রাফির কথা মনে পড়ে যায় নীতুর। এই একটা মানুষই তার হাত ধরে সিঁড়ি ঘর পর্যন্ত আসতে পেরেছিলো। সারাজীবনে সিঁড়ির মাঝে সেই সময়টুকুই ছিলো তার শ্রেষ্ঠ সময়।
নিতু জানেনা, কেমন করে সে হারিয়ে গিয়েছিলো বাধভাঙ্গা আবেগে। এইবার নিশ্চই সময় হয়েছে। তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে আলোকিত এক পৃথিবী। ছড়িয়ে দেয়া চুলে কাঁটা পরতে পরতে নিতু বেরিয়ে আসে সিঁড়ি থেকে। পিছনে থেকে হাহাকার গুলো মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে...হয়তো মিলিয়ে যায় না, তবে নীতু শুনতে পায় না কোন কারনে।
----------------------------------------------
নীতু বসে আছে একটা প্যাচালো সিঁড়িতে। দ্যজাভু একটা অনুভুতি হচ্ছে নীতুর মনে। এইখানে আগেও সে এসেছিলো। প্রতিবার এই যায়গা ছেড়ে যাবার পর আবার সে এইখানেই ফিরে আসে। বৃত্তবন্দী সেই সিঁড়িঘর।
রাফির কন্ঠ প্রতিদ্ধনি তৈরি করে যায় তার কানের কাছে- "আমি পুরুষ বলছি, আমাকে বিশ্বাস করো না..."
ঐতো দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি। ছোট একটা বাচ্চার প্রতিচ্ছবিও ভেসে উঠে নীতুর সামনে। সদ্যজাত এক শিশু। তবে মায়ের মত এত স্পষ্ট না।
নিতু বুঝতে পারে, শিশুটি এখনো আলোর মায়া ছেড়ে অন্ধকারে আসতে পারেনি....কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায় নীতু।
মনের ভিতর থেকে ডুকরে উঠা সত্তাকে চোখ বন্ধ করে সে জানিয়ে দেয়, সে আসছে...সিঁড়ি বেয়ে নতুন এক উদ্দ্যেশে পা বাড়ায় । তাকে যে করেই হোক, খুজে বের করতেই হবে, তার নবজাতক অস্তিত্বকে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।