গ্রাজুয়েশন অভিজ্ঞান (বাংলাদেশের একজন শিক্ষিত তরুণের স্বপ্ন) আমি তখন সবেমাত্র আমার গ্রাজুয়েশনের শেষ তাত্ত্বিক পরীক্ষা সম্পন্ন করেছি ৷ ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ক্লাস করতে যেতাম কলেজে ৷ মাঝে মাঝে সেমিনার রুমে বসে আড্ডা চলতো তুমুলভাবে ৷ আমাদের সবার চোখে তখন যুগপৎ হতাশা এবং নতুন জীবনের হাতছানি; কে কোথায় যাবে, কি করবে বা চাকুরী পাবো তো ? অনেকে তাদের নতুন জীবন শুরুর গল্প করতো, বলতো তারা বিয়ে করতে চায় নূন্যতম একটা চাকুরী জুটলেই; অনেকে আবার বলতো, চাকুরীর জন্য একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করার প্রয়োজন ছিলো, এখন একটা চাকুরী পেলেই হলো ৷ আমি কখনো কাউকে ক্ষুণাক্ষরেও আলাপ করতে শুনি নাই এখান হতে আমরা কী শিখলাম বা এই শিক্ষাটা আমাদের জীবনে কিভাবে কাজে লাগতে পারে এবং দেশের উন্নয়নে ৷ সবাই চিন্তিত ছিলো একটা সার্টিফিকেটের জন্য আর এখন একটা চিন্তা হলো চাকুরী পাওয়ার জন্য ৷ এখন সে চাকুরীটা যেভাবেই পাওয়া যাক, হয় ঘুষ দিয়ে, নতুবা মামাদের ধরে-বলে-কয়ে ৷ বাংলাদেশের একজন শিক্ষিত তরুণের জীবন যুদ্ধের পথচলা হয় এমন গত্ বাঁধা পথ ধরেই ৷ একটা চাকুরী জোটানোর জন্য সার্টিফিকেট যোগাড় করো, সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য যেকোন উপায় অবলম্বন করো; হয় নকল করো, পরীক্ষা হলে দেখাদেখী করো, পরীক্ষা হলের শিক্ষককে হুমকী দাও, প্রশ্নপত্র ফাঁস করো, বেঞ্চের উপর পিস্তল রেখে শান্ত মনে বই দেখে পরীক্ষা দাও; পরীক্ষা হলে বা পরীক্ষায় সুবিধা পাওয়ার জন্য ক্লাসমেটের সাথে বা শিক্ষকের সাথে চুটিয়ে প্রেম করো- যেটা সাধারণত মেয়েরা করে; কোচিং, স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ো- যেখানে স্যাররা প্রশ্নের উত্তরের জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিষয় শিক্ষা দিবে, নোট দিবে ৷ এভাবে কোনভাবে যখন একটা সার্টিফিকেট যোগাড় হলো তখন এমন যোগ্যতার জন্য হয়তো চাকুরী অনিশ্চিত; তখন শুরু হয় দ্বিতীয় দফা কারসাজি সে অমুক দলের নেতার খালাতো ভাই, পাঁচ হাজার টাকার সরকারী চাকুরীর জন্য একলাক্ষ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়, ওমুক নেতার তদ্বির, মামাদের খেলা, বিছানায় যাওয়া, প্রেম করা- বাংলাদেশের এগুলো গড়পড়তা ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন কথা ৷ সবাই এখন একটা ভালো চাকুরীর জন্য ভালো রেজাল্ট করতে চায় আর সে রেজাল্ট করাটা যেকোন উপায় অবলম্বন করা হয় এবং পরবর্তী ধাপে একটা ভালো চাকুরীর জন্যও যেকোন পথ অবলম্বন করা হয় ৷ চাকুরী পাওয়ার পর তাদের চলে নিজস্ব স্বপ্ন পূরণের খেলা; কে কত দ্রুত টাকা-পয়সার মালিক হতে পারে, কয়টা মেয়ে বা ছেলে নিয়ে ঘুরতে পারে, নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য কত ধরনের কূট-কৌশল প্রয়োগ করতে পারে, ঘুষ নিতে পারে, দূর্নীতি করতে পারে, গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে পারে- এ যেনো উল্কারবেগে ছোটা ! বাংলাদেশের বর্তমানে শিক্ষিত তরুণ সমাজের এমন চিত্র আমি প্রত্যক্ষ করি ৷ সব তরুণ চায় এখানে দ্রুত ধনী হয়ে উঠতে, বাড়ি-গাড়ী করতে, বিয়ে করতে বা যৌন লালসা পূরণ করতে ৷ একজন শিক্ষিত তরুণ এখানে চুটিয়ে প্রেম করতে চায়, সেক্স করতে চায়, ভালো চাকুরী বা ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে চায় আর সেগুলো কিভাবে আসছে বা কোথা হতে আসছে, তাতে দেশের মানুষ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্হ হচ্ছে, দেশের ক্ষতি হচ্ছে তা তারা বিবেচনায় নেয় না ৷ আর দেশে যদি তারা নিদেনপক্ষে কিছু করতে না পারে বা আরো ভালো কিছু করার আশায় তারা বিদেশে চলে যেতে চায় প্রচুর অর্থ উপার্জনের জন্য ৷ আজ বাসায় আসার পথে বাসে এমন একজন তরুণের স্বপ্নের কথা শুনছিলাম পাশের সিটে বসে, যে তার স্কুল পড়ুয়া প্রেমিকার কাছে মোবাইলে গল্প করছিলো ৷ সে বিদেশে যাবে, প্রায় তিন-চার কোটি টাকা উপার্জন করে দেশে ফিরে আসবে কাউকে কিছু না জানিয়ে; সে একটা গাড়ী কিনে সবার সামনে হাজির হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে ! ছেলেটির স্বপ্নের বিভোরতা দেখে আমি বিস্মিত হই ৷ মিল খুঁজে পাই আমার আর সব বন্ধুদের সাথে, যারা একটা ভালো চাকুরীর জন্য বা একটা ভালো ব্যবসার জন্য বা পশ্চিমের দেশে গমনের জন্য একটা ভালো রেজাল্টের সার্টিফিকেট যোগাড় করে, মামা-চাচার জোর তদ্বির আশা করে, জীবনকে উপভোগ করার জন্য বিত্তবান হওয়ার স্বপ্ন দেখে, গাড়ি-বাড়ী করার, সেক্স করার জন্য অঢেল অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন, যেভাবেই হোক উন্নত ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন- এই একই স্বপ্ন বাংলাদেশর কোটি কোটি শিক্ষিত তরুণ দেখে বেড়ায় এবং সেভাবে তাদের জীবনকে সাজাতে চেষ্টা করে আর তা সাজানোর জন্য তারা সবিশেষ মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্তও নিতে পারে ৷ বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণরা প্রচন্ড আত্মকেন্দ্রিক, তারা নিজের স্বার্থপরতা ছাড়া কোন চিন্তা, কোন কাজ করতে পারে না ৷ তারা নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করে দেশকে ডুবিয়ে দিতে পারে ৷ তারা প্রচন্ড অসামাজিক, এক ঘরে টাইপ ৷ তাদের মধ্যে কোন নিজস্বতা বলে কিছু নেই, যা আছে সমস্তটাই আমদানিকৃত কৃত্রিমতা, তারা কখনোই খোলামেলা হৃদয়ের হতে পারে না, তারা কখনোই সত্যিকার ভাব প্রকাশ করতে পারে না ৷ তারা যখন পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে তখন তারা নিজ নিজ স্বার্থ থেকে কথা বলে ৷ বাংলার মাটির জনসাধারণের মত তারা সহজ-সরল-প্রাণখোলা না, তাদের মধ্যে বাংলার মানুষের মতো কোন আন্তরিকতা নেই; তারা দূর্ভেদ্য, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে চিনতে পারে না, তারা কি করছে তা তারা নিজেরাই জানে না ৷ শিক্ষা যেনো তাদেরকে আরো জটিল করে তুলেছে ৷ বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণদের কোন আদর্শবোধ নেই, নৈতিকতা নেই, সদচারিত্রিকতা নেই, তারা দেশ ও জাতির জন্য সামান্যতমও ভাবিত নয়, তারা দেশের রাজনীতির সাথে জড়িত হতে চায় না তা নোংরা বলে, তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের সামান্যতম বালাই নেই; তারা শুধু নিজের ক্যারিয়ার, ভোগ-বিলাসিতার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে ৷ সেটার জন্য তারা নিজের দেশকে গালাগাল করছে, জাতিকে অভিশাপ দিচ্ছে এবং এদেশ ছেড়ে যেতে পারলে তারা নিজেদেরকে মুক্ত ভাবছে, নিজেদের জাতিসত্তা মুছে ফেলতে তারা সে দেশে সেটেল হয়ে যেতে চাচ্ছে, নিজ বাঙালী জাতিসত্তা নির্দ্ধিধায় ঝেড়ে ফেলে ঐ দেশের নাগরিকত্ব নিতে সামান্যতমও কার্পণ্য করে না; বলতে পারেন, এটা বাস্তবচিত্র- জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য, তাদের জীবনের নিরাপত্তা, নিশ্চয়তার জন্য তাদের এমনটা করার অধিকার আছে ৷ যেটা আরো পরিস্কার করে, বাঙালী জাতিসত্তার অধিকারী হয়ে আমরা কত অনিশ্চয়তার ভিতর, অনিরাপত্তার ভিতর, দারিদ্রতার ভিতর আছি ৷ কিন্তু আমরা তো পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা ফিলিস্তিনী জনগণের মত অশান্তিতে, ঝুঁকিপূর্ণতার ভিতর নেই, তাদের তুলনায় আমরা বেশ শান্তিতেই আছি ৷ তাহলে এমনটা কেন হচ্ছে ? এসবের জন্য, এমন বাংলাদেশের জন্য কারা দায়বদ্ধ ? ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এ জবাবদিহিতা কারা দিবে ? আমি জানি না ৷ তবে বাঙালী শিক্ষিত সমাজকে আমার ভালো লাগে নাই ৷ আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ সবচেয়ে বেশী দূর্নীতির সাথে জড়িত ৷ যে শিক্ষা কোন জাতির উন্নয়নের হাতিয়ার, সে শিক্ষা বাঙালী সমাজে আজ ঘুষ খাওয়ার, দূর্নীতি করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে; যা বাঙালী জাতিসত্তায় অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে- তা আপনি সরকারী প্রশাসনের দিকে তাকালেই টের পাবেন হাড়ে হাড়ে, দেখুন সেখানে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয় নাকি !? অথচ সেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রগুলি কাজ করে ৷ তাই আমার কাছে মনে হয়েছে বাঙলীর বর্তমান অবস্হার জন্য বাঙালী শিক্ষিত সমাজ দায়ী ৷ বাপ্পিশান ১৮/১০/১০
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।