জড় এক প্রসঙ্গ কাঠামোর নিবিড় পর্যবেক্ষক :P প্রথমেই একটা গল্প শুনুন--
"তপু তখন সবেমাত্র বুয়েটে চান্স পেয়েছে, হলে সীট পায়নি। সকাল সন্ধ্যায় তাই বাসে করে তার শ্যামলীর বাসায় আসা-যাওয়া করতে হয়। বুয়েটে যারা নতুন আসে তাদের চোখে-মুখে থাকে রাজ্যের স্বপ্ন। সারাজীবনের কষ্টের ফসল হিসেবে তপু আজ বুয়েটের আঙ্গিনায় দাপিয়ে বেরাচ্ছে। নতুন-নতুন চান্স পেয়ে তপু যেন গ্যাস-বেলুন পিঠে লাগিয়ে আকাশে উড়ছিল ।
ক্লাস শেষে একদিন ক্লান্ত তপু উঠে বসল আজিমপুর থেকে শ্যামলীগামী এক লোকাল বাসে। তপু খুব একটা স্টুডেন্ট ভাড়া দেয় না। হাফ ভাড়ার জন্য হেল্পারের সাথে দস্তাদস্তি তার পছন্দ না। কিন্তু সেদিনের হেল্পারটা ছিল বড়ই বেয়াড়া। শ্যামলী যেতে ১০ টাকা চেয়ে বসল, অথচ ভাড়া কিনা ৫ টাকা!!! কি আর করা।
বাধ্য হয়েই তাকে বলতে হল "স্টুডেন্ট , ৫ টাকা রাখেন। " বেয়াড়া হেল্পারটা কটমট করে তার দিকে তাকাল "কোন কলেজের ইস্টুডেন্ট?"তপু কিছুটা বিব্রত বোধ করল। কিছুটা আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল "বুয়েট। " এবার হেল্পারের জবাব শুনে তপু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। শালা বলে কিনা " এইডা কোন কলেজ ? চিনি না।
এই কলেজের ইস্টুডেন্ট ভাড়া কাডি না। " তপু ভাবতেও পারেনি ঢাকা শহরে এমন লোক আছে যে কিনা বুয়েট চেনে না। গ্যাস বেলুনে সুঁই ফুটিয়ে আকাশে উড়ন্ত তপুকে মাটিতে নামিয়ে আনে এই হেল্পার। কি বলবে বুঝতে পারে না সে। এই সময় তার সাহায্যে এগিয়ে আসে এক মধ্যবয়স্ক আংকেল।
হেল্পারটাকে ঝাড়ি মেরে বলেন " ওই মিয়া তুমি জানো বুয়েট কি জিনিস? বুয়েট চিনো না তাইলে চিনোটা কি?" সেই যাত্রায় তপু বেঁচে যায়। হেল্পার লজ্জা পেয়ে হাফ ভাড়া নিয়ে চলে যায়। কিন্তু তপুর মনে একটা খুতখুত থেকেই যায়। এই হেল্পারটা বুয়েট চিনে না, অথচ ঢাকা কলেজ খুব ভালো করে চিনে। অন্তত ঢাকা কলেজের ক্ষেত্রে এইটাইপ কথা বললে একগাদা পোলাপাইন লাঠি-সোটা নিয়ে এসে তাকে ঢাকা কলেজ চিনিয়ে দিত।
একটা বেপারে সে সান্ত্বনা পায় অন্তত বাসের আংকেলটার মত সুশীল সমাজ চেনে বুয়েট কি, তার বুঝে কতটা স্বপ্ন আর পরিশ্রম করলে বুয়েট পরিবারের সদস্য হওয়া যায়। এই সান্ত্বনা নিয়ে তপু বাস থেকে নেমে বাসায় রওনা দেয়। "
উপরের গল্পটা কাল্পনিক। কিন্তু বুয়েটের বর্তমান অবস্থার সাথে গল্পটা কেমন যেন মিলে যায়। বর্ষাকালে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ দিয়ে গত মাসে বুয়েটে ৪৪ দিনের ছুটি ঘোষনা করা হয়।
একাডেমিক ক্যালেন্ডার বহির্ভুত এই ছুটির মেনে নিতে পারেনি সেশজটে জর্জরিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই। পরদিন থেকেই নানা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বুয়েটের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে বুয়েটের সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষার্থ- কর্মকর্তা-কর্মচারীগন। বুয়েট পরিবারের সবাই ভাবেছিল সরকার বিষয়টিকে গুরুত্তপূর্ন বিবেচনা করে অগ্রাধীকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিবে। কিন্তু না বুয়েটের সবাই আবারো উপলব্দি করে এটা বাংলাদেশ, তাদের হতাশ হতে হয়।
কিন্তু তারা হাল ছেড়ে দেয় না।
সারা দেশের মানুষ আর পুরো ইলেক্ট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়াকে অবাক করে দিয়ে তারা শুরু করে এক অভূতপুর্ব অহিংস আন্দোলন। গাড়ি ভাংচুড় নয়, নয় কোন অগ্নিসংযোগ মিছিল-মিটিং। আবস্থান ধর্মঘট, মৌন-মিছিল, স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদি ছিল তাদের আন্দোলনের অন্যতম দিক।
এত কিছু করেও লাভ হয় না। বুয়েট পরিবারের ৯৯% সদস্য চাইলেও পদত্যাগ করেননি ভিসি নজরুল ইসলাম।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হল বুয়েট সমস্যা সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের গড়িমাসি ভাব । বুয়েটের চেয়ে অনুগত ভিসির পদরক্ষা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই শান্তিপুর্ন আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করারা জন্য বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর নামে দেয়া হয় জঙ্গী গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্টতার কালিমা( অথচ এটা সর্বজনবিদিত যে বুয়েটের ছাত্ররা খুব একটা ধর্ম-কর্ম করে না, করলেও তারা গোঁড়া নয় ) , সরকার সমর্থিত কয়েকটি পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল একের পর এক বানোয়াট ও ভিত্তিহীন খবর ছাপিয়ে বুয়েটের ভাবমূর্তি বিনিষ্ট করার অপপ্রয়াস চালায়। মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পশ্চিমা দেশগুলোতে এমনিতেই স্কলারশিপের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। এখন হয়ত আবেদন করলেই বলবে "তুমি তো বুয়েট, তুমি তো জঙ্গী" এই সার্কাসে সর্বশেষ সংযোজন হাইকোর্টের রিট।
যেখানে বুয়েটের শান্তিপূর্ন আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষনা করা হয়েছে।
৪৪ দিন বন্ধের পর আগামী ২৪ আগষ্ট বুয়েট খোলার কথা ছিল। কিন্তু এটা এখন ওপেন সিক্রেট যে ২৪ তারিখ বুয়েট খুলছে না। শিক্ষকরা আবার ধর্মঘটে যাবেন, আবার আন্দোলন হবে, আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়বে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এখানে পড়তে আসা ৫হাজার শিক্ষার্থীর জীবন।
এবার গল্পে ফিরে আসি।
"গল্পের তপু অবশেষে বুঝতে পারে সে এতদিন বোকার স্বর্গে বাস করছিল। সে অনুধাবন করে সেই লোকাল বাসের হেল্পার শুধু নয়, আমাদের সরকার আমাদের প্রশাসনও বুয়েট চিনে না। দু-চারটা বাসে আগুন দিয়ে কিংবা তিন-চারজন শিক্ষার্থীকে লাঠিপেটা করে হাসপাতালে পাঠিয়ে বুয়েটকে চেনানো যেতে পারত। তাহলে হয়ত ওই হেল্পার যেমন ঢাকা কলেজ চিনে তেমনি সরকারও চিনত বুয়েটকে। আর বুয়েটের সমস্যাও একদিনে সমাধান হয়ে যেত।
"বুয়েট থেকে পাশ করলেই সবাই বিদেশে যায়" তপু চেয়েছিল সে দেশেই থাকবে। কিন্তু এই দেশটা তো তার মত শান্তিপ্রিয় মানুষদের জন্য নয়। দেশটা একগাদা লোকাল বাসের হেল্পার দিয়ে পরিচালিত। তপু চায় এই লোকাল বাসটা থেকে তাড়াতাড়ি নেমে যেতে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।