আলো অন্ধকারে যাই... উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। পদত্যাগ দাবিতে সমিতির চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে গতকাল বিকেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানরা একযোগে পদত্যাগ করেন। এর আগে গতকাল সকালে শিক্ষক সমিতি কর্তৃপক্ষের বুয়েট বন্ধের ঘোষণাকে অনৈতিক ও অবৈধ বলে আখ্যা দিয়ে দাবি আদায়ে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়। তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সংহতি প্রকাশ করেন। গত রাত সাড়ে ৯টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করছিলেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষকদের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনে চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
পদত্যাগ সম্পর্কে শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান জানান, শিক্ষক সমিতির চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে গতকাল বিকেলে বুয়েটের ১৭টির মধ্যে ১৬টি বিভাগের চেয়ারম্যান, পাঁচটি অনুষদের পাঁচজন ডিন এবং তিনটি ডিগ্রি প্রদানকারী ইনস্টিটিউটের তিনজন পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগপত্র বুয়েটের রেজিস্ট্রার ড. আবু সিদ্দিক বরাবর জমা দেওয়া হয়েছে। পদত্যাগকারীদের মধ্যে ২২ জন সশরীরে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় সমিতির নেতাদের ফোনে পদত্যাগ করতে সম্মতি দিয়েছেন।
বুয়েটের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সকালের খবরকে বলেন, বুয়েটে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, বুয়েটের উপাচার্যকে আজ রাতের (বুধবার) মধ্যেই সিন্ডিকেট বৈঠক ডেকে সবার মতামত নিতে বলেছি। আর কালকের (বৃহস্পতিবার) মধ্যে বিভাগীয় চেয়ারম্যানসহ সিনিয়র সব শিক্ষকের সঙ্গে বৈঠক করে সবার সামনে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে বলেছি। প্রসঙ্গত, গত ৩ জুলাই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাগুলোতে বিধির কোনো ব্যত্যয় হয়নি। সেদিনই শিক্ষক সমিতি তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে ও আন্দোলনের ঘোষণা দেয়।
গতকাল সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বৈঠকে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সমিতির সভাপতি লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। পরে বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পুরকৌশল বিভাগের সামনে থেকে একটি মৌন মিছিল বের করেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। এতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, সহ-সভাপতি মাকসুদ হেলালী, কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান, সাবেক ছাত্রকল্যাণ পরিচালক আমিনুল হক প্রমুখ নেতৃত্ব দেন। মিছিলের শুরুতেই শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের স্বাক্ষর করা একটি প্রচারপত্র ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
এতে সর্বাত্মকভাবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ডাক দেওয়া হয়। মিছিলের শুরুতে শতাধিক শিক্ষার্থী করতালির মাধ্যমে শিক্ষকদের উত্সাহ দেন ও তাদের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের হাতে ‘ভূতাপেক্ষার নামে নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ ও পদোন্নতির অপকর্মের অবসান চাই’, ‘উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে অপসারণ করে বুয়েটকে রক্ষা করুন’, ‘সরকারি অর্থ খরচ করে তথাকথিত সাংবাদিক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করুন’ প্রভৃতি লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। মিছিলটি বুয়েটের প্রশাসনিক ভবন হয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কাউন্সিল ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তটি জানান।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা দাবি করেন দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার ধর্মঘট পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমিতির সভাপতি লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের ঘোষণা দেন।
গত মঙ্গলবার রাতে কর্তৃপক্ষের বুয়েট বন্ধ ঘোষণা সম্পর্কে মুজিবুর রহমান বলেন, সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে বুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই উপাচার্য একক সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও তার স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ দিয়েছেন। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী আমরা ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। উপরন্তু অভিযোগ তদন্তে গঠিত প্রতিবেদনে উপাচার্যের মতামতই তুলে ধরা হয়েছে। সমাবেশে শিক্ষকরা দাবি করেন, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য আল্টিমেটাম দেওয়ায় ভয়ে বুয়েট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গত ৩ জুলাই শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এক জরুরি সভায় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ১৩ জুলাই পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে ১৪ জুলাই থেকে পুরোপুরি কর্মবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়। গত মঙ্গলবার রাতে উপাচার্য গ্রীষ্মকালীন অবকাশ, রমজান ও ঈদ উপলক্ষে ১১ জুলাই থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত বুয়েট বন্ধ ঘোষণা করেন।
অবস্থান ধর্মঘটের ব্যাপারে উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, এটা শিক্ষকদের নিজেদের বিষয়। আমি তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করব এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করবেন কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তো সরে যেতে চাই। কিন্তু মিথ্যা কোনো অভিযোগের দায়ভার নিয়ে আমি পদত্যাগ করব না। এটা কী মগের মুল্লুক যে মিথ্যা অভিযোগ দেবে আর আমি সরে দাঁড়াব।
এদিকে শিক্ষকদের আন্দোলন ও ক্যাম্পাস প্রায় দেড় মাস বন্ধ ঘোষণা করায় বুয়েট শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা করছেন। শিক্ষার্থী তানজিনা জাহান সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, বুয়েটের সমস্যার সমাধান না হলে আমরা চরম ভোগান্তির শিকার হব।
গতকাল শিক্ষকদের আন্দোলন চলাকালে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের প্যাডে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। প্রচারপত্রে লেখা আছে-নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাওহীদ ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির বুয়েট ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে। এ অবস্থায় যদি কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ছাত্রলীগ কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ সম্পর্কে বুয়েটের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি মিশু বিশ্বাস বলেন, এটা ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী করেছে, এর দায়ভার বুয়েট ছাত্রলীগের নয়। এ ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, বুয়েটের উপাচার্য নজরুল ইসলাম ও উপ-উপাচার্য হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘন করে ভূতাপেক্ষা নিয়োগ দেওয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ বুয়েট শাখার সভাপতি ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার কামাল উদ্দীনকে রেজিস্ট্রার করার উদ্যোগ, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশাসনের বিভিন্ন পদে দলীয়করণসহ ১৬টি অভিযোগ এনে গত ৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করে শিক্ষক সমিতি। পরে সঙ্কট নিরসনে শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ক্লাসে ফিরে যান শিক্ষকরা এবং বুয়েট কর্তৃপক্ষ কামাল উদ্দীনকে রেজিস্ট্রার করার উদ্যোগ স্থগিত করে। তবে অন্য দাবিগুলো আদায় না হওয়ায় শিক্ষকরা আবার আন্দোলনে নেমেছেন।
সূত্র: Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।