গণআন্দোলন, কবি ও কবিতা
সাযযাদ কাদির
গণতন্ত্রের নামে গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে আমাদের। আমাদের সংবিধান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলোর একটি, আমাদের সংসদ ভবন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সংসদ ভবনগুলোর মধ্যে সেরা। তবে আমাদের এই এত ভালো সংবিধান প্রায়ই অকার্যকর থাকে, আমাদের এই এত সুন্দর সংসদ ভবনে প্রায় সারা বছরই অচল থাকে সংসদ। একই ভাবে মহাতোড়জোড় করে নির্বাচন করি আমরা, কিন্তু ভোট গ্রহণ হয় এক রকম, আর ভোট গণনা হয় আরেক রকম। আমাদের রাজনৈতিক দল আছে অনেক, রাজনীতিক আছেন অনেক; তবে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতির আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়ে পড়ে পরোপকারের নামে নিজের উপকার।
আমাদের প্রশাসন সামন্ত ও ঔপনিবেশিক যুগের চলন বলন পছন্দ করে না, কিন্তু তাঁরা প্রায় সবাই মনমেজাজে শাসক—কেউই সেবক নন। খেলাত, ইনাম, তোহফা, উপঢৌকন, নজরানা, বখশিস ইত্যাদি তাঁরা এড়িয়ে চলেন, তবে উপরি, চাঁদা, ঘুষ ও কমিশনে আপত্তি করেন না বলেই জানা যায়।
আমাদের চতুর্থ স্তম্ভ খুবই সরব, খুবই সোচ্চার। তবে এসব স্তম্ভের বেশির ভাগের মালিকানা কাদের হাতে, তাঁরা কোন শ্রেণীর মানুষ, তাঁদের শ্রেণীচরিত্র কি— এসব জানা থাকলে বোঝা যায় আসলে কাদের স্বার্থ রক্ষা করেন তাঁরা। আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরও অনেকে খুবই সরব, খুবই সোচ্চার।
তাঁরা সভা-সেমিনারে একনিষ্ঠ, পত্রিকায় কলামনিস্ট, রেডিও-টেলিভিশনে টকিস্ট। তবে ষাটের দশকের শুরুতে এঁদের অনেকে বলতেন সাম্যবাদের কথা, অনেকে নিরঙ্কুশ সাম্যবাদের কথাও বলতেন। পরে তাঁরা সমাজতন্ত্রের কথা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, ইসলামী সমাজতন্ত্র, জনগণতন্ত্র ইত্যাদিও বলেছেন। এরপর তাঁরা বলেন, গণতন্ত্র চাই, তারপর বলেন সংসদীয় গণতন্ত্র চাই, তত্ত্বাবধায়ক গণতন্ত্র চাই।
শেষে বলেন, নির্বাচন চাই। তারপর বলেন, ভোটার তালিকা চাই। ওদিকে ১৯৫৮ সাল থেকে আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে যাঁরা চলছেন—ইতিমধ্যে তাঁর বুনিয়াদি গণতন্ত্র থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার নতুন গণতন্ত্র পর্যন্ত অনেক কিছু দিয়েছেন আমাদের। তাঁরা তিনে মিলে এক— সেনাবাহিনী, চেনাবাহিনী ও কেনাবাহিনী। আর আমরা— আমজনতা? আমাদের ভূমিকা কি?
একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে এখানে।
যেমন, আমরা জানি রন্ধন একটি শিল্প, কৃষি একটি বিজ্ঞান, ধর্ম একটি পরিপূর্ণ জীবন দর্শন; তারপরও আমাদের জীবন, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প, বিজ্ঞান ও দর্শনের ভার অর্পণের ক্ষেত্রে আমরা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি প্রায় নিরক্ষর পর্যায়ের অশিক্ষার ওপর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের রান্নাবান্না করে অশিক্ষিত নয় অল্পশিক্ষিত নয় অর্ধশিক্ষিত বাবুর্চি বা লোকজন। মাঠে মাঠে কৃষিকাজে যারা নিয়োজিত, তাদের ব্যাপারেও বলা চলে একই কথা। আর ধর্মীয় শিক্ষার দায়িত্ব কাদের ওপর দিয়েছি, তাদের বিদ্যাবুদ্ধি জ্ঞানগম্যির দৌড় কতখানি কি, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে। আর এই হাজার বছরে আমাদের মূল পেশার ধরন সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে অনেকখানি বদলে গেলেও ধারার ক্ষেত্রে সেই একই আছি আমরা।
চর্যাপদের “তূলা ধুণি ধুণি আঁসুরে আঁসু”র শান্তিপা-তান্তিপা’র উত্তরসূরিরা এখন নিয়োজিত আছেন গার্মেন্ট শিল্পে; কৈবর্ত-ধীবর কাহ্নুপাদের জীবন-জীবিকা হয়েছে পিসিকালচার-হ্যাচারি; শবরপা’র বংশধর ব্যাধেরা কাজ করছেন পোলট্রি-ডেয়ারিতে। আমাদের এই দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা, পরিবর্তনকে অস্বীকার করার মানসিকতার কারণেই রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন অথবা দুর্বৃত্তির ক্ষমতায়ন ঘটেছে। ফলে লুটেরা ধনিক, ঋণখেলাপি, করখেলাপি, কালো টাকার মালিক, ইয়াবা-ডাইল সংস্কৃতির ধারক বাহকদের হাত ধরে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে আনডারওয়ার্ল্ড, গডফাদার, টপটেরর, নব্য মোগল। তাই বলে একেবারে নিস্তরঙ্গ নয় এই হাজার বছরের জীবন। প্রথমে আধিদৈবিক-আধিভৌতিক, তারপর সামন্ত, শেষে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণাগ্রস্ত এই সমাজেই মাত্স্যন্যায়ের অবসান ঘটাতে প্রজারা গোপালকে রাজা নির্বাচিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন প্রাচীন গণতন্ত্রের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে ন্যায়সঙ্গত করেন কৈবর্তরাজ দিব্বোক, ধর্মধ্বজীদের প্রাপ্য ঘোষণা করেন ধনপতি বণিক—গলাধাক্কা দিয়ে ব্রাহ্মণকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে।
এই গর্বিত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায়ই বাংলা ও বাঙালি বারবার উজ্জীবিত হয়েছে পবিত্র দ্রোহে। সৃষ্টি হয়েছে বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বই। লড়াইয়ের পর লড়াই চলেছে, আর ক্রমাগত বিকাশ ঘটেছে গণতান্ত্রিক চেতনার। সেই চেতনার পথ ধরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে শুরু হয় স্বাধিকারের আন্দোলন, তারপর দেশ ও জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধে। এ চেতনা বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে অঙ্গাঙ্গী হয়ে।
তাই একজন নূর হোসেন বুকে-পিঠে সেই চেতনার রক্তপতাকা তুলে ধরে, বাঙালির কণ্ঠে তুলে দিয়ে যায় মরণজয়ী স্লোগান: স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক!
এ স্বপ্ন, এ আকাঙ্ক্ষা আমাদের যুগ-যুগান্তের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ক্ষুধা ও পিপাসা, আমাদের দু’বেলার দু’মুঠো ভাতের দুঃখ-বেদনা-কষ্ট। তাই সামপ্রতিক স্ফীতমূল্য বাজার অর্থনীতি যে অন্নাভাব প্রকট করে তুলছে, তা নতুন কোনও দুঃস্বপ্ন নয়। হাজার বছর ধরেই আমাদের “হাড়িত ভাত নাহি”, আমাদের “শিশু কাঁদে ওদনের তরে”, আমাদের আকুল-ব্যাকুল জীবনে একমাত্র প্রার্থনা হয়— “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”। এ উচ্চারণ সবকিছু ছাপিয়ে ওঠা এক জীবনসত্যের।
এ উচ্চারণ বাংলা ও বাঙালির কবির, যাঁর ঘোষণা “সবার উপরে মানুষ সত্য”। এ কবি নবজাগৃতির নায়ক, রেনেসাঁ-পুরুষ। মানবতাবাদ তথা গণতন্ত্রের পুরোগামী প্রবক্তা। বাংলা কবিতা এই অক্ষয় উত্তরাধিকারের গৌরবে মহীয়ান :
“... বাংলা কবিতা আসলে আমাদের এই বাংলা।
সে বাঁচে না স্বাধীনতাহীনতায়—
তাই বিদেশী ঠাকুর মানে না, ভিখারি রাঘবে ডরায় না।
যারা নিভিয়ে দেয় আলো, বিষিয়ে দেয় বায়ু
তাদের ক্ষমা করে না বাংলা কবিতা
সে হয়ে ওঠে সবেগে সমুদ্যত বিদ্রোহী ভৃগু
আর পদচিহ্ন এঁকে দেয় ভগবানের বুকে—
তারপর অঙ্গীকার করে এক বাসযোগ্য পৃথিবীর। ...” (‘বাংলা কবিতা’, বিশ্ববিহীন বিজনে, সাযযাদ কাদির)
এ চেতনা গণতান্ত্রিক সমাজবিনির্মাণের। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার বাহিনী তো থেমে নেই। কবি তাই জানিয়ে দেন গণতন্ত্রের শত্রুদের ঘাতক স্বরূপ :
“... আমাকেই হত্যা করে ওরা বায়ান্নর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই
আমাকেই হত্যা করে ওরা
পথের কিনারে
এভেন্যুর মোড়ে
মিছিলে, সভায়—
আমাকেই হত্যা করে, ওরা হত্যা করে বারবার। ...” (“দুঃসময়ে মুখোমুখি”: শামসুর রাহমান)
কিন্তু কোনও আত্মোত্সর্গই বৃথা যায় না, তাই জনচেতনা উদ্দীপ্ত হয় ঘাতকের বিরুদ্ধে।
কবি লেখেন :
“... আমরা সেই অমর শহীদদের জন্যে
তাদের প্রিয় মুখের ভাষা বাংলার জন্যে এক চাপ পাথরের মতো
এক হয়ে গেছি,
হিমালয়ের মতো অভেদ্য বিশাল হয়ে গেছি। ...” (“অমর একুশে”: হাসান হাফিজুর রহমান)
এই ঐক্য গড়ে তোলে প্রদীপ্ত প্রত্যয়। কবির কণ্ঠে আসে ঘোষণা :
“... এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল
কোনোদিন আমরা যে ভাঙবোই
মুক্ত প্রাণের সাড়া জানবোই
আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে
নতুন সূর্যশিখা জ্বলবেই
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই। ...” (“সংগ্রাম চলবেই”: সিকান্দার আবু জাফর)
এভাবে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে, দাবি ও অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে কবিতা সমস্বরে চলেছে পাশাপাশি। তাতে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনা শাণিত হয়েছে দিনে-দিনে।
কবির কাছে তাঁরা পেয়েছেন মনের কথা মুখে বলবার ভাষা। এছাড়া গণতান্ত্রিক চর্চার ফলে সামন্ত ও ঔপনিবেশিক যুগের অনেক ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত হয়েছে সমাজ। অনেক ভণ্ডামি, বুজরুকির মুখোশও উন্মোচিত হয়েছে এ চর্চার ফলে। অর্থনীতির ওপর জেঁকে বসা রক্তশোষক লুটেরা ধনিক চিহ্নিত হয় গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে।
“...বড় চোরেরা হাতড়িয়ে নিতে পারে আইন
কোর্ট-কাচারি—
এমন কি ম্যাজিস্ট্রেটের যুগল কান,
খাস-তালুক পেয়ে তারা খাসলত বজায় রাখে।
...” (‘বড় চোরেরা’, গোলাম কিবরিয়া পিনু)
এ দেশে গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে আশির দশকে কায়েম হয়েছিল স্বৈরাচার। কবিতা সেদিন ফেটে পড়েছিল বিক্ষোভে, বিস্ফোরণ ঘটেছিল অকুতোভয় কবিত্বের। জাতীয় কবিতা পরিষদের কবিরা, তাঁদের প্রেরণায় সারা দেশের কবিরা নতুন এক ধারা এনেছিলেন কবিতার—যা পরিচিতি পেয়েছে রাজনৈতিক কবিতা হিসেবে। সে কবিতা সরাসরি আক্রমণ করেছে প্রতিষ্ঠার প্রতিভূদের। সময়ের দাবিতে তখন ঝলসে উঠেছিল কবিতা, বদলে গিয়েছিল প্রেমের কবিতাও।
কিন্তু আজ আবার গণতন্ত্র যখন বিপন্ন, তখন কবিরা কোথায়? কোনও আশ্বাসবাণী কি আছে তাঁদের কাছে? কবি বলেন:
“... খাঁচা ভাঙতে অবিরল রক্ত ঝরে
প্রাণ বলি দিতে হয়
ঝাপসা হয় অপেক্ষা প্রহর
তারপর মহার্ঘ অর্জন
মানুষেরা খাঁচা ভাঙে
ভাঙতে গিয়ে আহত নিহত হয়
বংশপরম্পরাক্রমে চলতে থাকে
এই যুদ্ধ লড়াই সংগ্রাম...” (‘অপছন্দের বাস্তবতা’, হাসান হাফিজ) হ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।