"হরি আছেন পূর্বে, আল্লা আছেন পশ্চিমে, তুমি তোমার হৃদয় খুঁজে দেখ- করিম ও রাম উভয়েই আছেন হৃদয়ে; এ জগতের সমস্ত মানব-মানবীই তাঁর অংশ। " (সন্ত কবীরের গান; তর্জমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) "ম্যাম, আসতে পারি?"
সম্মতিসূচক সাড়া পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। আমরা চারজন। আমি, মাসুম ভাই, মীনা আপু, শারমিন।
একটানা কথা বলতে হলে বড় করে নিঃশ্বাস নিতে হয়, বুকে জমা করতে হয় অনেকটা অক্সিজেন।
তা-ই নিয়ে মাসুম ভাই শুরু করল,
"ম্যাম, আমরা বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন থেকে এসেছি। আপনি নিশ্চয় জানেন বিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু, অচল অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ন্যুনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকার কথা তাও নেই, হল থেকে ক্লাসরুম পর্যন্ত সব জায়গায় চলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস ও দখলদারিত্ব। সব সরকারের আমলেই চিত্রটা একই রকম। তো, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের একটি আন্দোলন চলছে, ডাকসু নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন।
এটি চলছে একটি জেনারেল প্লাটফর্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অধিকার মঞ্চের ব্যানারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো এই মঞ্চে আছে। এছাড়াও দল মত নির্বিশেষে যে-কোনো মানুষ ডাকসু নির্বাচনের দাবীতে এখানে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আপনি জানেন আমরা একটা ধর্মঘটও ডেকেছিলাম গত ১৯ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং সে-টি সফলও হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তো, আগামী ২৯ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে একটি ছাত্র-শিক্ষক সংহতি সমাবেশের আয়োজন করেছে শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ।
আপনি নিমন্ত্রিত। আর ডাকসুর দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক নিয়ে আমরা বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন কলাভবন শাখা আমাদের প্রথম কাউন্সিল আয়োজন করছি আগামী ১লা আগস্ট। আপনি আসবেন, আপনার মূল্যবান মতামত রাখবেন। "
মাসুম ভাই যখন কথাগুলো বলছিলেন একটানা, আমি তাকিয়ে ছিলাম ম্যামের দিকে। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো একটা বইয়ে, তিনি বইটার পাতা উল্টোচ্ছিলেন অতি সন্তর্পনে।
কেউ প্রতিবাদের কথা কইতে এলে, আমি খেয়াল করেছি, আমাদের জ্ঞানপিপাসা কেনো যেনো খুব বৃদ্ধি পায়। আমরা আসলেই এত বইপাগল জাতি? নাকি...
তিনি মুখ তুললেন। মুখে এক ধরণের কঠোরতা। থমথমে কণ্ঠস্বরে তিনি বলে উঠলেন,
"তোমরা কার এজেন্ট হিশেবে কাজ করছো?"
মীনা আপুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, তিনি নিশ্চয় এ-ধরণের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন এর আগেও, তাই খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
"আমরা কারো এজেন্ট হিশেবে কাজ করছি না ম্যাম, আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিশেবে আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবীতে আন্দোলন করছি, আমরা আমাদের ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের দাবীতে আন্দোলন করছি। "
তিনি একটু জোরেই বলে উঠলেন,
"গণতন্ত্র? কিসের গণতন্ত্র? যেই দেশে দশ বছরের মেয়ে বেঁচে থাকবার জন্য শরীর বিক্রি করে সেই দেশে আবার কিসের গণতন্ত্র?"
আমি এবার মুখ খুললাম,
"ম্যাম, এই পরিস্থিতিটা তো পালটাতে হবে।
দশ বছরের মেয়ের যাতে শরীর বেচা না লাগে সেইরকম একটা দেশ গড়ে তুলতে হবে। আর সেই জন্যই গণতন্ত্র লাগবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু, বাংলাদেশের রাজনীতির রাজধানী, এখান থেকেই তো পরিবর্তনের সূচনা, বিপ্লবের..."
স্বভাবের সমস্যায় আমি বড় বেশি কথা বলি। তবে আমার কথা তিনি শেষ করতে দিলেন না, মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বরং বললেন,
"পরিবর্তন কি তোমরা করবে? এই অল্প কয়েকজন..."
তাঁর ঠোঁটে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি। ভালো একটা খোঁচা দিতে পারার পরিতৃপ্তি খেলা করছে তার মুখমণ্ডলে।
মাসুম ভাই বললেন,
"আমরা সবাই মিলে করব। "
এবার তিনি মুখে এক ধরণের গাম্ভীর্য এনে বললেন,
"কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? ডাকসু নির্বাচন নাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার?"
আমরা একটু অবাক হয়ে গেলাম। এই প্রশ্ন কিসের প্রেক্ষিতে আসল?
মীনা আপু বললেন,
"ম্যাম, ডাকসু নির্বাচনের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্পর্ক কি?"
তিনি একটু কঠিন গলায় বললেন,
"না, এখন তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, তাই দেশবাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাবার জন্য কেউ তো নানা রকম পাঁয়তারা চালাতেই পারে। ডাকসু তো অনেকদিন ধরেই অচল, ঠিক এই সরকারের সময়ই এই আন্দোলন শুরু হল কেন? বিএনপি জামায়াত জোট সরকার যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন তোমরা এই আন্দোলন করনি কেন?"
আমাদের মধ্যে শারমিন একটু সহজ সরল; শাসকশ্রেণীর রাজনীতিতে রেটোরিকের খেলায় যে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়,
মহান মুক্তিযুদ্ধকে যে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করার
উছিলা হিসেবে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের বিপ্লবী চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়; সে-টা সে এখনো শেখেনি। সে বলে উঠল,
"ও আপনি ভেবেছেন আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে? না, মোটেই না।
আপনি জানেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি আর আনিসুল হকের মা? শাফি ইমাম রুমী আর মাগফার উদ্দিন চৌধুরি আজাদ আমার কত প্রিয় আর শ্রদ্ধার আপনি জানেন?"
মীনা আপু চোখের ইশারায় শারমিনকে থামতে বলল।
"না, আমি বলিনি তোমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে। তোমরা এখনো ছোট মানুষ, হয়তো তোমাদের বয়সসুলভ দ্রোহী মনোভাবের সুযোগ নিয়ে তোমাদের নেতারা ঘোলা পানিতে মাছ স্বীকারের চেষ্টা চালাচ্ছে। গিয়ে দেখ তাঁদের সাথে আসলে জামায়াত-শিবিরের কানেকশন আছে। শোন, এইসব পরিবর্তন আর বিপ্লবের চিন্তা বাদ দাও।
তোমাদের বয়সে থাকতে আমরাও অনেক বিপ্লব করেছি। এখন বুঝি এসব করে কিছু হয় না। মন দিয়ে লেখাপড়া করো। নিজের উন্নতি, দেশের উন্নতি। "
শেষের দুইটা লাইন বলার সময় ম্যামের মুখে হাসি উপচে পড়ে...
আমি আরেকটু হলে বলতে নিচ্ছিলাম,
"অনেক বিপ্লব করা যায় না ম্যাম।
বিপ্লব ওপেন এয়ার কনসার্ট না যে দুইদিন পরপর করা যাবে। অনেক আকাঙ্খা নিয়ে একটা বিপ্লব হয়েছিল বটে ১৯৭১এ, কিন্তু সেই বিপ্লব বেহাত হয়ে গেছে লুটেরাদের হাতে। 'স্বাধীনতা সব খেলো, মানুষের দুঃখ খেলো না'..."
শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিলাম।
মাসুম ভাই বললেন,
"ম্যাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা তো রাষ্ট্রের কাজ, ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা তো ঢাবির কাজ। যেখানে স্বয়ং ভিসি স্যার পর্যন্ত বলছেন যে তিনিও ডাকসু নির্বাচন চান সেখানে হচ্ছে না কেন?"
তিনি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,
"উফ! তোমরা কিছু বোঝো না।
এত সরল হলে হয়? বাস্তবজ্ঞান থাকা লাগে। ডাকসু নির্বাচন দিতে গেলে সহিংসতার সৃষ্টি হতে পারে। তখন কে দায় নেবে?"
শারমিন এবার মুখ খুলল,
"ম্যাম, আমরা কেউ তো সহিংসতা চাই না। কেউ যদি সহিংসতা তৈরি করে নির্বাচন নিয়ে, আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ব্যর্থ হয় সে-সময় শান্তিপ্রিয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে, তবে বুঝতে হবে খোদ কর্তৃপক্ষই সহিংসতার পক্ষে, সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের পৃষ্ঠপোষক। "
শারমিন বড় সরল।
ওপেন সিক্রেট এভাবে বলতে হয় নাকি! আরে, এটা তো সবাই জানে কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো ক্যাম্পাসেই সহিংসতা...
তিনি বললেন,
"তোমাদের যা ইচ্ছা কর। আমি এইসবে নেই। তোমরা এবার আসতে পারো। "
বলতে পারতাম যে এই কথাটা শুরুতে বললে আমাদের অনেক সময় বেঁচে যেত। বললাম না, বলাটা শোভন নয়।
বের হয়ে আসছি ম্যামের রুম থেকে সবাই। একেবারে দরজার কাছে গিয়ে কি মনে করে যেনো ফেরালাম মুখ। কি আশ্চর্য ! দেখলাম, ম্যামের নীল রঙের শাড়িটা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে কটকটে সবুজ শাড়িতে, শাড়ির এক অংশ শাদা, শাড়িতে বিশাল বাঁকানো এক চাঁদ আর ছোট এক তারা। দেখলাম, ম্যামের দাঁতগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে, ম্যামের হাতের নখগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে, ম্যামের চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। দেখলাম, ম্যাম মুখ খুলছেন, আর তাঁর মুখ থেকে বেড়িয়ে আসছে সাপের মতন হিসহিসানি, কিন্তু না, তিনি কিছু বলছেন।
কি বলছেন তিনি? আমি কান পেতে শুনলাম। তিনি বলছেন,
"রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাও? এত বড় সাহস? বাংলা হচ্ছে হিন্দুর ভাষা। আমরা মুসলমান। মুসলমানের ভাষা উর্দু। উর্দু এণ্ড উর্দু শ্যাল বি দা স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ পাকিস্তান এণ্ড নো আদার ল্যাঙ্গুয়েজ।
কি, কি বললে? আন্দোলন করবে? যদি আন্দোলন করতে গিয়ে সহিংসতা তৈরি হয় তো কে নেবে সেই দায়? তোমরা কিছু বোঝো না, হিন্দুরা তোমাদের লেলিয়ে দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ স্বীকার করতে চায়। এই সব বাদ দিয়ে ভালো করে পড়াশোনা কর। নিজের উন্নতি, ওয়াতানের উন্নতি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। "
আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করতে লাগল, আমি দেখতে পেলাম ম্যাম তাঁর ধারালো নখ বসিয়ে দিচ্ছেন একটা ছেলের গলায়।
ছেলেটার নাম কি? সালাম? বরকত? জব্বার? কি যায় আসে!
আমি ঘর থেকে প্রায় ছুটে বেড়িয়ে এলাম। দেখলাম, মাসুম ভাই, মীনা আপু আর শারমিন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
অনেকটা অপ্রকৃতিস্থের মত আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম,
"এটা কি ১৯৫২?"
ঋণস্বীকার
ছোটগল্পটিতে কবি হেলাল হাফিজের একটা কবিতার লাইন ব্যবহার করা হয়েছে। আর সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত "বেহাত বিপ্লব ১৯৭১" বইয়ের কেন্দ্রীয় ধারণাটি ব্যবহার করেছি। বেহাত বিপ্লবের ধারণাটি মূলত ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক আন্তনিও গ্রামসির।
এই ব্যাপারটি সাম্প্রতিক কালে মিসরের তাহরিরি স্কয়ারেও ঘটেছে, জনগণের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলেছে ইসলামি মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ইখওয়ানুল মুসলেমিন/মুসলিম ব্রাদারহুড। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।