আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চরিত্র



বিপদ যে কখনো একা আসেনা তাহা উপলব্ধি করিলাম আরো একবার, সঙ্গে এও উপলব্ধি করিলাম যে, একক বিপদের চেয়ে সংঘবদ্ধ বিপদের মাত্রা গুণিতক আকারে যত হইবার কথা ছিল, বাস্তবে তাহার চেয়ে অনেক বেশি হয়। টিপটিপ বৃষ্টি পড়িতেছে, বাহিরে যাইবার জো নাই, কিন্তু বাহির হওয়াটা আমার খুবই জরুরী; নানার বাড়িতে বেড়াতে আসিয়াছি, আজই গৃহে ফিরিয়া সবকিছু গোছাইয়া শিক্ষানগরীতে যাইতে হইবে। আমি অপেক্ষা করিতেছি, বৃষ্টি শেষ হইলে রওনা হইব কিন্তু বৃষ্টিও ছাড়িল না আমার যাত্রাও আরম্ভ হইল না। এই অপেক্ষার মধ্যেই ঘটিল আরেক বিপত্তি। দেড় বছর বয়সী খালাতো বোন টুম্পা প্রাকৃতিক কর্ম সারিয়া অশুচী অবস্থায় কখন হইতে যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে তাহা লক্ষ্য করি নাই, আমার সামনা সামনি আসিবামাত্র তাহাকে কোলে তুলিয়া লইবার চেষ্টা করিলাম কিন্ত সে আসিতে চাহিল না।

আমি যতই জোর করিতে লাগিলাম শিশু ততই হাত পা ছোঁড়া-ছোঁড়ি করিয়া ভূমিতে নামিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিতে লাগিল। অবশেষে ইহাকে পরাস্ত করিয়া কোলে যখন স্থাপন করিলাম তখনই আবিষ্কার করিলাম যে জবরদস্তির ফলটা একটু বেশিই খারাপ হইয়াছে। ওয়াক থু বলিয়া টুম্পাকে মাটিতে ছাড়িয়া দিয়া ভীষণ চিৎকার করিয়া উঠিলাম, আশেপাশের সবাই দৌড়াইয়া আসিয়া আমার দূরাবস্থা দেখিয়া হাসিয়া গড়াগড়ি খাইতে লাগিল। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয় থাকিয়া আমিও তাহাদের সহিত যোগ দিলাম। শীগগীর কাপড় ধৌত করিবার ব্যবস্থা করা হইল কিন্তু উপযুক্ত সময়ে তাহা শুকাইল না এবং সেইদিনে গৃহবন্দিত্ব ছাড়া আমার কোন উপায় রহিল না।

রাত্রিটা কোন রকমে কাটাইয়া আমি পরের দিন প্রত্যুষেই রওনা হইলাম। এই একদিনের বিলম্বই আমার জীবনের গতিপথ পাল্টাইয়া দিয়াছে,মন্থর করিয়াছে চলার গতি এবং সঙ্গে বপন করিয়াছে আমার মনের ভেতরে বিচিত্র অনুভূতির এক বীজ; আজ তাহা প্রকাশ করিয়া হাল্কা হইবার চেষ্টা করিতেছি মাত্র। জানি, যে বোঝা ছাড়িবার ত্রুটিমাত্র করিতেছি না, তাহা কোনমতেই ছাড়া সম্ভব নহে কারন ছাড়িতে গেলেই বিপুল বেগে ইহা বুকের উপর জাঁকিয়া বসে, মস্তিষ্কের যে অংশ চিন্তার কাজ করে তাহাকে আরো বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে; এ যন্ত্রণা ছাড়িবার নহে, শুধুমাত্র চীরকাল বহিবার জন্যে। ট্রেন ভ্রমনের প্রারম্ভটা বিশেষ সুবিধার হইল না, প্রত্যেক কামরাতেই প্রচন্ড ভীড় উপরন্তু আমার টিকিট আসনবিহীন। অনেক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া একসময় প্রায় জোর করিয়া একজায়গায় বসিয়া পড়িলাম।

যাঁহারা সেইখানে বসিয়া ছিলেন, নতুন ঝামেলা জোটায় তাঁহার কিঞ্চিত বিরক্ত হইলেন কিন্তু আমি অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিলাম। স্বাচ্ছন্দ্যবোধের আরো কারন আছে, আমাদের বিপরীতমুখী আসনে বসিয়া আছে আমার এক সহপাঠীর বান্ধবী, তাহার সহিত আজই পরিচয় ঘটিয়াছে। ভাবিলাম একেবারে চুপচাপ বসিয়া থাকিবার চেয়ে গল্পগুজব করিয়া সময় পার করাটাই উত্তম। আমার ভাবনার ব্যত্যয় ঘটিল না, অল্পক্ষণেই নানা বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত হইল এবং অপরিচিতার সহিত মিশিতে আমার বেশি সময় লাগিল না। গল্পের তালে কিছুটা সময় ভালই কাটিল এবং ক্ষাণিকবাদে ট্রেন পরের স্টেশনে আসিয়া থামিল।

একে তো ভীড় তার উপর যতজন যাত্রী নামিল, উঠিল তাহার ঢের বেশি, সুতরাং জনসংখ্যা প্রচুর বাড়িয়া এমন হইল যে, কাহারো প্রকৃতির ডাক আসিলে বাধা ডিঙ্গাইয়া উপযুক্ত স্থানে যথাসময়ে গমন করিবার পূর্বেই দফা রফা হইবার আশংকাই বেশি। এমনই জমাট ভীড় ঠেলিয়া আঠারো-ঊনিশ বছরের এক যুবতী বাচ্চা কোলে করিয়া আমার সামনের আসনে নব-পরিচিতা বান্ধবীর ঠিক পাশেই বসিল। আমি ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া একবার তাহার দিকে তাকাইয়া ভাবিলাম, বাল্য বিবাহ কমিতেছে, না বাড়িতেছে ; যদি কমিয়াই থাকে তাহলে এত অল্প বয়ষ্কা মহিলা মা হইল কিভাবে ? উত্তরটা বিশেষ সুখকর হইল না ; কিছুক্ষন বাদেই অন্য একজন মহিলা হাঁপাইতে হাঁপাইতে যুবতীর পাশে বসিল এবং স্থীর হইয়া তাহার সন্তানকে কোলে লইয়া স্তন্য পান করাইতে লাগিল, বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত আমার কিছুক্ষন আগের ধারণা আর দ্বিতীয়বার মনে আসিল না এবং আমি উদযোগী হইয়া যুবতীকে সম্বোধন করিয়া বলিলাম, ভাবলাম বাচ্চাটা আপনারই, বাচ্চা কোলে আপনাকে চিরায়ত বাঙ্গালী মায়ের মতই লাগছিল। আমার কথা শুনিয়া তিনি হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন; এক্ষণে তাহার সহিতও পরিচয় ঘটিল। চলবে............


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।