সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো একের পর এক লাশ পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ছে বিকৃত ও নাম-পরিচয়হীন লাশের সারি। ভবনধসের ১৩ দিন পরও স্বজনহারা মানুষের ভিড় কমছে না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সঠিক তালিকা না থাকায় আরও কতজন ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছেন, তা কেউ বলতে পারছেন না।
গত রোববার রাত আটটার পর থেকে গতকাল সোমবার রাত নয়টা পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৬১টি লাশ।
গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর থেকে গতকাল রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ৬৬৮টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন নয়জন। সব মিলিয়ে ভবনধসের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৭৭ জনে। এর মধ্যে ৫৩৪টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে স্বজনদের কাছে। হস্তান্তরের অপেক্ষায় সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ৩২টি ও মর্গে ৪৭টি মৃতদেহ রয়েছে।
নাম-পরিচয়হীন ৬৪টি মৃতদেহ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্ধার অভিযানের নবম দিন ছিল গতকাল। এ কয় দিনে নয়তলা ভবনটির অষ্টম তলার ছাদ পুরোটাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অন্য তলাগুলোর ছাদের সামনের অংশ সরানোর কাজ চলছে। কিন্তু পেছনের দিকে আটতলার নিচের সব ছাদ চাপা পড়ে আছে।
শক্ত ও জালির মতো বেরিয়ে আসা রডের কারণে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ এগোচ্ছে না। সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, পুরো ধ্বংসস্তূপ সরাতে আরও অন্তত এক সপ্তাহ লাগতে পারে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, পেছনের দিকে এখনো লাশ পাওয়া যাচ্ছে। তাই দেখে-শুনে ধ্বংসস্তূপ সরাতে হচ্ছে। গতকাল রানা প্লাজার উত্তর দিকের আরএস টাওয়ারের দ্বিতীয় তলা থেকে দেখা গেছে, বিকৃত হয়ে যাওয়া বেশ কিছু লাশ ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে।
উদ্ধারকর্মীরা জানান, এসব লাশ যেখানে ঝুলে আছে সেখানে (ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণে) আরেকটি সিঁড়ি আছে। সেখানেও অনেক লাশ থাকতে পারে। বিকেলের দিকে ওই সিঁড়ি সরানোর কাজ চলছিল। ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে থাকা একটি সিঁড়ি ইতিমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। ওই সিঁড়ি থেকে গত কয়েক দিনে প্রায় ১৫০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
রোববার রাত ১২টা থেকে গতকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ওই সিঁড়ি ও এর আশপাশ থেকে আরও ৩১টি লাশ উদ্ধার করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্ধার অভিযান শুরু হওয়ার পর লাশ উদ্ধারের একটি তালিকা করেছে সেনাবাহিনী। এই তালিকায় দেখা গেছে, ২৮ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে গতকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ২৫১টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযানে জীবিত কাউকে উদ্ধার করা যায়নি।
ভবনধসের পর থেকে ২৮ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত দুই হাজার ৪৩৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
স্বজনদের ভিড় কমছে না: রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে আর কত মৃতদেহ চাপা পড়ে আছে সে হিসাব কারও কাছে নেই। ঢাকার জেলা প্রশাসন ১৮২ জন নিখোঁজের একটি তালিকা করেছে। প্রতিদিনই এই তালিকার বাইরে মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে। ঘটনাস্থল, অধরচন্দ্র বিদ্যালয়, ঢাকা ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে স্বজনহারা মানুষের ভিড় কমছে না। শত শত মানুষ নিখোঁজ স্বজনের ছবি হাতে নিয়ে ও গলায় ঝুলিয়ে সন্ধান পাওয়ার আশায় এসব জায়গায় ঘুরছেন।
এই নিখোঁজদের অনেকের নাম ওই তালিকায় নেই। এমন স্বজনদের একজন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মাসুদা বেগম। তাঁর দুই মেয়ে ঝর্ণা ও তানজিনা যথাক্রমে পঞ্চম ও সপ্তম তলায় কাজ করতেন। জেলা প্রশাসনের তালিকাতেও এ দুজনের নাম নেই। গত রোববার সকালে মাসুদা বেগম কাপড় দেখে একটি মৃতদেহ তানজিনার বলে শনাক্ত করেন।
পরে লাশ শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। পরে যোগাযোগ করা হলে মাসুদার আরেক মেয়ে শান্তা জানান, তানজিনার লাশ তাঁরা পেয়েছেন। দাফনের জন্য গ্রামে নেওয়া হয়েছে। তবে ঝর্ণার লাশ পাওয়া যায়নি। নাটোরের মেহেদী হাসান, তাঁর স্ত্রী শিরীন আক্তার ও বোন ডালিয়া ওই ভবনের বিভিন্ন তলায় কাজ করতেন।
ভবনধসের দিন বিকেলে ডালিয়া জীবিত উদ্ধার হন। শনিবার সন্ধ্যায় মেহেদীর লাশ উদ্ধার হয়। মৃতদেহের সঙ্গে থাকা মুঠোফোনের সিম দিয়ে পরিচয় শনাক্ত করে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। শিরীন এখনো নিখোঁজ। জেলা প্রশাসনের করা নিখোঁজ তালিকায় মেহেদী ও শিরীনের নাম নেই।
ওই তালিকায় নাম নেই মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের তোফাজ্জলের। আটতলার নিউওয়েব স্টাইলের কর্মী তোফাজ্জলের লাশ শনিবার সন্ধ্যায় উদ্ধার হয়। পরিচয় শনাক্তের পর লাশ নিয়ে যায় পরিবার। চাঁদপুরের কচুয়ার টুটুলের স্বজনেরা অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে পড়ে আছেন রাত-দিন। তাঁর নামও নেই তালিকায়।
তাঁর বাবা আনোয়ার হোসেন তালুকদার ডিএনএ পরীক্ষা করিয়ে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে। বিকেলে টুটুলের বোন মনি বেগম জানান, হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, লাশ শনাক্ত করা যায়নি। পরবর্তী সময়ে শনাক্ত হলে তাঁদের জানানো হবে। জেলা প্রশাসনের ওই তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ওই তালিকায় থাকাদের মধ্যে ৩৩ জন জীবিত বা মৃত উদ্ধার হয়েছে।
১৭ জনের তথ্য অসম্পূর্ণ থাকায় তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পাঁচজনের তথ্য একেবারে ভুল মনে হচ্ছে। সেই হিসাবে জেলা প্রশাসনের তালিকায় নিখোঁজ ১২৭ জন। কিন্তু এর বাইরে আর কোনো নিখোঁজ আছে কি না, তা কেউ বলতে পারছে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।