আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে মার্কিন নৌঘাঁটির চক্রান্ত প্রতিহত করতে হব.... বদরুদ্দীন উমর

আমরা হেরে যাইনি। এশিয়া কাপ না জিতলেও তোমরা আমাদের হৃদয় জয় করেছ। আমরা গর্বিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নৌশক্তির বড় অংশ অন্তত ৬০% এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে সরিয়ে আনার যে ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিপূর্বে দিয়েছে, সেই অনুযায়ী তারা নিজেদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বেশ চাতুর্যের সঙ্গেই এগিয়ে নেয়ার কাজ করছে। এই উদ্দেশ্যে তাদের এ অঞ্চলে একেক দেশের সঙ্গে একেক রকম চুক্তি করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে এ ব্যাপারে যে তারা গোপন চুক্তি করেছে এর প্রমাণ বিভিন্ন সূত্রের কথাবার্তার মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছে।

এ নিয়ে কোন ঘোষণা বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি দেয়নি, উপরন্তু একথা দুই পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু তা হলেও চুক্তি কার্যকর করতে শুরু করার আগে এ দেশের জনগণের চিন্তায় বিষয়টি ঢুকিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও তারা বসে নেই। বাংলাদেশ আগেই ১৯৯৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সোফা’ সামরিক চুক্তি করেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি সামরিক চুক্তি দু’দেশের মধ্যে হয়েছে, যার মাধ্যমে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে এমন সব সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে যার ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব তাদের প্রয়োজনে লঙ্ঘন করার অসুবিধা তাদের নেই। এখন মার্কিন নৌবাহিনীও বাংলাদেশে তার ঘাঁটি গড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।

সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের জলসীমায় সরিয়ে আনার ও নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত একাধিকবার অস্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে তাদের আলোচনা এগিয়ে চলেছে। এই উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সেক্রেটারি এ মুহূর্তে ঢাকা সফর করছেন। তার মতো একজন উচ্চতম পর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধি যে বাংলাদেশে ‘সৌজন্য’ সফরে আসেননি, এটা বলাই বাহুল্য। তিনি আসলে যে উদ্দেশ্যে এসেছেন তাকে মার্কিন নৌশক্তির অধিকাংশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে স্থানান্তরের পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতেই চিহ্নিত করতে হবে। বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ১১ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে।

‘সমুদ্র বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র’ এই শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরেও তারা বাংলাদেশকে অভিন্ন সুবিধা দেবে। এই শর্ত সংবলিত চুক্তি স্বাক্ষর করতে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এখন বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। ’ এক্ষেত্রে সব থেকে হাস্যকর বিষয়টি হচ্ছে, এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে যেসব সামরিক সুবিধা দেবে সেই ‘অভিন্ন’ সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশকে তারা তাদের দেশে দেবে! এই ‘অভিন্ন’ অধিকার বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিভাবে ব্যবহার করবে? এর প্রয়োজনই বা বাংলাদেশের কোথায়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার বিশাল নৌশক্তি সরিয়ে এনে চীনের মোকাবেলা করতে চায় এবং এজন্য তারা বাংলাদেশে সব রকম সুযোগ-সুবিধা নেয়ার ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ‘অভিন্ন’ অধিকার নিয়ে কী করবে? এটাকে এক তামাশা ছাড়া কি আর কিছু বলা যায়? রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, “তারা দুই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সম্পাদনের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্রণীত খসড়া চুক্তিটির নাম প্রস্তাব করেছে ‘একুইজিশন সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’। বেসরকারি টিভি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।

” এতে আরও বলা হয়, ‘পরিবর্তিত কিছু প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশের সঙ্গে গড়তে চাইছে সখ্য। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে একে অন্যের বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। স্থাপন করতে পারবে বেজ অপারেশন সেন্টারও। মজুদ গড়তে পারবে গোলা-বারুদের। ’ যুক্তরাষ্ট্র তো বাংলাদেশে এসব সুবিধা পেয়ে লাভবান হবে ষোল আনা।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের এ ধ্বংসের সুযোগ-সুবিধার কী প্রয়োজন হতে পারে? এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাও তো এক অবান্তর এবং হাস্যকর ব্যাপার। আপাতদৃষ্টিতে যা হাস্যকর মনে হয় আসলে এটা প্রতারণা ছাড়া আর কী? বাংলাদেশে মার্কিন নৌবাহিনীর এসব সুযোগ পাওয়া এখন তাদের জন্য জরুরি হলেও বাংলাদেশকেও তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একই সুবিধা দেবে একথা তারা কিভাবে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে এবং বাংলাদেশই বা এই তথাকথিত শর্ত কিভাবে স্বীকার করতে পারে যার কানাকড়ি মূল্যও নেই, যার অর্থ বলেও কিছু নেই? এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি মহাশক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া দেশের সার্বভৌমত্বকে বিদায় জানানো এবং দেশের স্বাধীনতা বিক্রি করে খাওয়া ছাড়া আর কী? এভাবে আমেরিকার কাছে দেশের স্বার্থ বিক্রির থেকে দেশ ও জনগণের সঙ্গে বড় বেঈমানী আর কী হতে পারে? ‘বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজে’র সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির বৃহৎ অংশ তারা এ অঞ্চলে স্থানান্তর করতে চাচ্ছে। আমাদের এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে এক দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হতে পারে। এ ধরনের চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন জাহাজ আমাদের বন্দরে এনে, তারা এই চুক্তির অধীনে আমাদের বন্দর থেকে বিভিন্ন লজিস্টিক সাপোর্ট নিতে পারবে। ’ এ ধরনের একটি সামরিক চুক্তি এক দেশের সঙ্গে করলে অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অক্ষুণ্ন থাকবে এটা মনে করা গর্দভতুল্য কাজ।

এক্ষেত্রে যা ঘটার ষোল আনা সম্ভাবনা তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যে দেশ বা দেশগুলোর মোকাবেলার জন্য তাদের নৌশক্তি এ অঞ্চলে স্থানান্তর করছে, সেই দেশ বা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবধারিতভাবে ক্ষুণœ হওয়া। এমনকি এর ফলে অন্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের পরিবর্তে শত্র“তার সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ারই কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এ অঞ্চলে চীনকে তাদের সামরিক তৎপরতার টার্গেট হিসেবে রেখেই অগ্রসর হচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। কাজেই এই চুক্তি সম্পাদন এবং এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সব রকম সামরিক সাহায্য-সহযোগিতা দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতি অনিবার্যভাবেই ঘটবে। এটা ঘটবে না, একথা বলা তর্কবাজি কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ চুক্তি অনুযায়ী ‘খাদ্য, পানি, যানবাহন, উদ্ধারকারী বিমান, সেনা যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও মালপত্র রাখতে স্টোরেজ ও প্রশিক্ষণ সুবিধার কথা আছে। ’ সে সঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘চুক্তির সব তথ্য গোপন রাখা হবে। ’ এ ‘গোপন রাখার’ বিষয়টি থেকেই বোঝা যায় যে, এ চুক্তি সম্পর্কে প্রকাশ্যে যা কিছু বলা হচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি মারাত্নক ও বিপজ্জনক বিষয়াদি এর অন্তর্ভুক্ত আছে বা থাকবে। এই বিষয়গুলো যদি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর না হতো তাহলে এগুলো গোপন রাখার কথা বলা হতো না। এটা অবশ্য শুধু এই চুক্তিটির ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য তা নয়, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক এবং বেসামরিক চুক্তি যা হোক, সেগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।

যেসব শর্তের কথা প্রকাশ্যে বলা হয় সেগুলো চুক্তির সামান্য অংশমাত্র। এর আসল দফাগুলো পানির অনেক নিচে থাকে। এই গোপনীয়তাই প্রমাণ করে যে, সরকার নিজেদের দেশের স্বার্থকে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বড় কর্তা বাংলাদেশে এসে এখন এই চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার কাজই নিশ্চয় করবেন। এর সব থেকে বিপজ্জনক দিক হল, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের জলসীমা ও বন্দর ব্যবহার করে এখানে তাদের সামরিক নৌঘাঁটি স্থাপন করতে দেবে।

এ কাজে তারা ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে, কারণ হঠাৎ করে বড় ধরনের কিছু করতে গেলে প্রতিরোধের সম্ভাবনা। কিন্তু ধীরে ধীরে এ কাজ করলেও এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এখানে সামরিক ঘাঁটি করতে দেয়, তাহলে বাংলাদেশ অবধারিতভাবেই এই অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার মধ্যে বাংলাদেশের কোন স্বার্থ যে নিহিত নেই তা বলাই বাহুল্য। উপরন্তু এর ফলে বাংলাদেশকে এমন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়া হবে, যে পরিস্থিতি ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এ চুক্তির কথা রুটিন ব্যাপার হিসেবে অস্বীকার করে গেলেও কিভাবে এসব গোপন পরিকল্পনা কার্যকর করা হয় এটা অজানা নয়।

কাজেই এই মার্কিন পরিকল্পনা যাতে কার্যকর হতে না পারে, দেশকে এভাবে সরকার যাতে তাদের কাছে বিক্রি করতে না পারে, এজন্য এর বিরুদ্ধে সব দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও যুদ্ধবিরোধী জনগণকে প্রতিরোধ সংগঠিত করতে হবে। যে বিপদ এখন আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে, একে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। (সূত্র: যুগান্তর,১৫/০৭/১২) Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.