আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার বসবাস হতাশার নগরীতে!

ধুর বৈশাখীর ২য় দিন মাত্র! বাংলা বছরের ২য় দিন। সন্ধা হতেই আকাশে মেঘ, বাতাসটা যেন মেঘের থেকেও ঘন! ঘন ঠান্ডা বয়ে নিয়ে আসছে বাতাস। বোঝায় যাচ্ছে অদূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের প্রথম অংশে একটু বালি উড়লেও কিছু সময়ের মধ্যে পুরাপুরি প্রানবন্ত একটা পরিস্কার বাতাস। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি এসে সব গ্রাস করে নিল।

কেউ হয়ত জানালায় দাড়িয়ে বা ব্যালকনিতে দাড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল সেই বৃষ্টিতে। এই ইট কাঠের গাদাগাদির শহরে কারও হয়ত বোঝারই উপায় নেই যে বৃষ্টি হচ্ছে। কেউ বা মাত্র অফিস থেকে বের হয়েই আটকে গেছে রাস্তায়। কোন দোকানের সামনের ছোট্ট ছাউনির মধ্যে দাড়িয়ে বৃষ্টি চলে যাবার অপেক্ষা। কারও পরনে হয়ত আজকেই ধুয়ে আয়রণ করিয়ে আনা প‌্যান্ট, যা আরও কয়েকবার পরা যেত, কিন্তু এই বৃষ্টির জন্য ছিটে আসা হালকা কাদায় তা আর না ধুয়ে পরা যাবে না।

কারও বা বাড়ির সামনে জমবে এক হাটু পানি। সেই পানির পরিমান হাটু পরিমান হলেও তার প্রতি ঘৃণা কমপক্ষে গলা পর্যন্ত। বৃষ্টি নামার সাথে সাথে সিড়ি দিয়ে খুব সতর্ক ভাবে নেমে গেলাম নিচে। সতর্ক ভাবে নামতে খারাপ লাগছিল, কারণ একটু সময় নষ্ট মানে একটু বৃষ্টি মিস। কিন্তু বিদ্যুত চলে গেছে, কি আর করা? অন্ধকারেই পা বাড়াতে হল।

বয়স যা হয়েছে তাতে বৃষ্টি দেখলেই রাস্তায় বা ছাদে যেতে হবে তা মানায় না। শরীরের যেমন বয়স আছে, মনেরও বয়স আছে। আমার শরীরের বয়স অনেক হলেও মনের মধ্যে বৃষ্টির জন্য বয়সটা সেই ১২তেই আটকে আছে। প্রতিটি বৃষ্টি দেখলেই ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। করার চেষ্টাও করি, মাঝে মাঝে পারি, মাঝে মাঝে পারি না।

আস্তে আস্তে বৃষ্টি শেষ হলে ঘরে ফিরে কাপড় ছেড়ে কম্পিউটার নিয়ে বসি। ফেসবুক খুলেই অবাক, কম পক্ষে ৩০জন স্ট্যাটস দিয়েছে যে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কারও জন্য সেটা সম্ভব হয় নি। কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেই পেলাম কারও হয়ত বৃষ্টির পানিতে এলার্জি, কারও বা বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি জ্বর আসবে সেই ভয়। কারও আবার ইচ্ছাই করে, কিন্তু সে এত রোমান্টিক না।

সব কথার শেষ কথা বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। কিন্তু আফসোস করতে কেউ বাদ রাখেনি। শীতের মধ্যে প্রায় প্রতিবছরই অকাল বৃষ্টি হয়। গত কোন এক শীতে সাত মসজিদ রোডে এমনই এক বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মেসে ফিরছি। এমনিতে ঠান্ডা, তার উপরে বৃষ্টি।

প্রতিটি ফোটা যেন ফ্রিজ থেকে বের করা প্রচন্ড ঠান্ডা পানির ফোটা। সেটা উপেক্ষা করে হেটে চলেছি। মানুষ তাকিয়ে আছে। আবাহনি মাঠের কাছে আসতেই দেখলাম একটি জুটি বৃষ্টিতে ভিজছে। একজন অপরজনের হাতের মধ্যমা দিয়ে অন্যের হাতের মধ্যমা ধরে আছে।

মেয়েটি তার বাম হাতে পায়ের জুতাটি ঘাড়ের উপর থেকে ঘুরিয়ে পিঠের কাছে ধরে রেখেছে। দেখে হয়ত মনে হবে যে ঐ জুতা জোড়ার যেন জন্মই ঐখানে থাকার জন্য, যেন ঐখানেই সুন্দর। এক বয়স্ক মানুষ হেটে যাচ্ছিলেন। তাদেরকে দেখে চুপ থাকতে পারলেন না। একটু জোরেই বলে ফেললেন, ইস প্রেম দেখে বাচিঁ না, আরও কত কি যে দেখব।

বয়স্ক ঐ লোকের দিকে তাকালাম, তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এমন বয়সে আমরাও কি কম ভিজেছি? তার চোখের দিকে তাকালাম, তিনি হাটছেন ঠিকই, কিন্তু চোখ ঐ জুটির দিকে। তার চোখে তাকালেই বলে দেওয়া যায় যে সে তাদের ভেজা নিয়ে কথা বললেও তাকে এখনই যদি ঐ বয়সে ফিরিয়ে এই সুযোগটি দেওয়া হয়, তাহলে তিনিও ছাড়বেন না। রিক্সায় করে যেই জুটিরা যাচ্ছে আসছে কিংবা রাস্তার পাশে ছাতি মাথায় ধরে যেই জুটিরা এগিয়ে চলেছে সবাই কেন যেন হিংসার চোখে এই জুটিকে দেখছে। সবারই ইচ্ছা আছে, কিন্তু কেন যেন উপায় নেই। হতাশাই ভরসা।

রাত্রের বেলায় ঢাকার শহর নাকি খুবই বিপদের শহর, ছিনতাই, চুরি আরও কত কি! সবার ইচ্ছা করে রাত্রে একটু বেড়াতে, কিন্তু কেউই সাহস করে বের হয় না। একটা কথা অনেককেই বলতে শুনি, বীর নাকি একবারই মরে। এই মানুষগুলি আর যাই হোক বীর না। আমি রাত্রে রাস্তায় ঘোরা মানুষদের একজন। কখনও একলা, কখনও বা কোন বন্ধুর সাথে।

কখনও খালি হাতে, কখনও বা ক্যামেরা হাতেই বের হয়ে পড়ি। দুর্ঘটনা ঘটেনি এমন না, কিন্তু প্রতিটি রাত্রে একটু ঘুরে যেই শান্তি, তার তুলনায় গত পাচঁ বছরে ঘটা একটি মাত্র দুর্ঘটনা এমন কিছুই মনে হয় না। এমন অনেক হতাশ লোক আছেন যারা রাত্রে ঘোরার ইচ্ছাটা ঘুমের ঘোরেই কাটিয়ে নেন। তারা হতাশ হতে রাজি আছেন, কিন্তু আশা পুরোনের একটা চেষ্টা করতেও ইচ্ছা নাই। আমি আফসোস করতে রাজি নেই।

অনেক বন্ধুকে দেখি পরীক্ষার হলে গিয়ে কপাল চাপড়াতে যে কেন আর একটু বেশি পড়লাম না। কেউবা আবার পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে কপাল চাপড়ায় কেন এইটা পারলাম না, কেন এইটা ভূল হল। আরে বাবা, যা হবার হয়েছেতো, এখন কপাল ফাটিয়ে ফেললেও কি লাভ হবে? প্রতিদিন পিজা হাট বা বিএফসি, কেএফসিতে যারা খেতে পারেন না, তাদের আফসোসের সীমা নেই। আহা, প্রতিদিন ঐখানে খেয়ে যেন কি না কি মজা। আমার আফসোস নেই।

কারণ কি জানেন? কারণ একটাই, আমি প্রতিদিন ডাল পুরি খেয়ে যেই মজাটা পাই, যারা প্রতিদিন পিজা হাট, বিএফসি বা কেএফসিতে যায়, তারা সেই মজাটাও পায় না। এই খাবার গুলির সব আউটলেটের স্বাদ একই রকম, কোন ভ্যারিয়েশন নাই। কিন্তু আপনি ঝিগাতলায় ইউল্যাবের পাশে যেই পুরি পাবেন, তা শুধু ঐখানেই পাবেন, আজিমপুরের যেই পুরির দোকানে পুরি ভাল না, কিন্তু সসটা জোস, ঐ সস শুধুমাত্র ঐ দোকানেই পাবেন। পুরান ঢাকার কোন এক চিপা গলির মধ্যে যেই কাসুন্দি দেয়, এদর থেকে কাসুন্দি আর কে ভাল বানাতে পারে? আমি বরং হঠাৎ সুযোগ হলে পিজা হাট, বিএফসি, কেএফসিতে গিয়ে মজা পাই। অনেক দিন পর ভিন্ন স্বাদের কিছু খাওয়া হয়।

আমার আফসোস হয় না, বরং শান্তি লাগে যে আমি ভাল আছি, আমি প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন স্বাদ পাই। মাঝে পরিচয় হয়েছিল এমন একজনের সাথে, যে কিনা রাস্তার পাশের ছাপড়া কোন দোকান থেকে জিবনে কিছু খায়নি, খায়নি নীলক্ষেতের তেহারী। স্টারের খাবারের কোয়ালিটি নিয়েই যার সন্দেহ, সে কি করে নীলক্ষেতের খাবার খায়। জোর করে একদিন খাইয়ে দিলাম, প্রথমে না না না না করতে থাকলেও পরে ঠিকই বলে বসল, মামা কোয়ার্টার না, পুরা হাফ দাও! তার হতাশা, বাবা-মা-ভাই-বোন কে এই খবর বলাই যাবে না। এক দম্পতিকে চিনি, যাদের হাতে কোন সময়ই নেই ঘুরে বেড়ানোর, দুইজনেই চাকুরীজীবি।

শুক্রবার শুধু ছুটি, বিশ্রাম নিয়েই কাটিয়ে দেন, কি আর করবে? ঘুরতে যাবার তো যায়গা নাই, তাই বিশ্রাম। কোথায় ঘুরতে যাবে? সময় কই? সময়ের থেকে বড় সমস্যা হল টাকা কই? তারা জানেনই না যে গুলিস্থান থেকে মাত্র ৩৫ টাকা বাস ভাড়া, আর সাথে ১৫ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে চলে যাওয়া যায় সোনার গাঁও এ। যেখানে সকালে গিয়ে বিকালে ফিরে এসে দিনটা পার করা যায়। তারা হয়ত এটাও জানে না যে আশুলিয়ায় গিয়ে ফুসকার প্লেট ৫০-৭০ টাকা হতে পারে, কিন্তু ফুসকা না খেয়েও ঐ খানে ঘোরা যায়। মিরপুর ১ থেকে লেগুনাতে হয়ত ২০-২৫ টাকা ভাড়া।

তারা হয়ত এটাও জানেন না যে সাভার নামে একটা জায়গা আছে। তারা জানেন একটাই জিনিষ, তাদের মধ্যে হতাশা আছে। এই শহরের প্রতিটা মানুষ হতাশ। এই শহর নাকি আর বসবাসের উপযুক্ত নেই। কিন্তু সবাই কেমন যেন ঝুলই আছে।

"মাকড়সা হয়ে যেন ঝুলে আছি পটে, কোনমতে জীবনের সুতো ধরে রাখা"। আমি হতাশ না, আমি আমার প্রতিটি মুহূর্ত উপোভোগ করতে চাই। বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজে, আবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধঁলে সেই জ্বরের মধ্যে আইসক্রিম খেয়ে। প্রতিদিন পুরি-সিংগাড়া আর মাঝে মধ্যে মানুষের ঘাড়ে চড়ে পিজা খাওয়া। মাঝে মধ্যে ব্যাগ আর ক্যামেরা কাধে করে ঘুরে বেড়ান।

আমি প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করতে চাই। হতাশার নগরী আমার না, আমি এই শহরের বাসিন্দা, তবে হতাশ না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।