লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু। ১৪২০ সালের বাংলা পহেলা বৈশাখ প্রথম আলোর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত ‘'টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’' নামের গল্পটি দৈনিক পত্রিকায় যে-ধরনের গল্প ছাপা হয়, এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নয়। এর ব্যতিক্রমতা তৈরি হল কতিপয় পাঠকের এলার্জির কারণে। হ্যাঁ, এ গল্পের একটা দোষ হতে পারে, যে-পটভূমি এখানে উল্লিখিত, তাতে মূল নামের উল্লেখ সরাসরি না থাকলেও আনুষাঙ্গিক নানা বর্ণনার কারণে সুনির্দিষ্ট একটি মেয়ের জীবনে অভিঘাত তৈরি করতে পারে।
কারণ, শাহবাগসহ কতিপয় শব্দের উল্লেখ একে সুনির্দিষ্ট বৃত্তে আটকে ফেলার ফাঁদ তৈরি করেছে। আর তাই তরুণরা, অবশ্যই শাহবাগী তরুণরা, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ভার্চুয়াল জগতে এ-নিয়ে যে-ক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটেছে, তাতে বিষ্মিত হবার কিছু নেই। ক্ষুব্ধতার প্রকাশ মানবিকতারই অংশ। কিন্তু সমস্যা হল শালীনতার লঙ্ঘন।
শাহবাগী মানসিকতার অভিযোগ মতে, লেখক নিজে শালীনতার সীমা অতিক্রম করেছেন। প্রতিবাদের তোড়ে লেখক ও প্রকাশক এজন্য দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। প্রথম আলোর ওয়েবসাইট থেকে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। লেখকের কোনো গ্রন্থের আওতাভুক্ত হবে না বলে প্রতিশ্র“তি পাওয়া গেছে। এখন যারা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অশালীনভাবে ভেতরের ময়লা অন্তর্জালে ঝেরেছেন, তারা কি তা পরিষ্কার করবেন, করতে পারবেন? এজন্য তারা কি অনুতপ্ত হবেন?
উত্তপ্ত সমকাল গল্পটির কাল হয়ে দাঁড়াল।
আর তা না হলে এর ভেতরে, ফল্গুধারার মতো যে বার্তাটি আমাদের চকিত করে, তা প্রতিক্রিয়ার ক্রুরতায় চোখ এড়িয়ে গেলেও অস্বীকার করার উপায় বোধহয় নেই। আধুনিক সমাজের অন্যতম একটি দাবি বা প্রবণতা হল নারীর ক্ষমতায়ন। এর জন্য দরকার শিক্ষা। কিন্তু শিক্ষার সে-সুযোগ কি সবার জন্য সমানভাবে ঘটে? শিক্ষানবিশির দীর্ঘ এ সময়ে একটি ছেলের তুলনায় নারীর বাস্তবতা অবশ্যই ভিন্ন। এ ভিন্নতার রূপটা কী? এ-নিয়ে ভাবনা নেই, প্রশ্নও নেই কোনো।
আবার সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের তৎপরতা জারি আছে। এই অংশগ্রহণ সবসময় নিষ্কলুষ হয়, কেউ কি তা হলফ করে বলতে পারবে? তাই যদি হয় অবস্থা, তাহলে তা গল্পে প্লট হিসাবে ব্যবহৃত হতে বাধা কোথায়?
বোধহয়, বছর তিনেক পূর্বে ইডেন কলেজের ছাত্রীনেত্রীদের নানা কুৎসিত ঘটনা পত্রিকার পাতায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছে। মফস্বল থেকে আসা মেয়েরা সিট-বাণিজ্য বা রাজনীতির শিকার হয়ে যেভাবে ভোগ্যা হিসাবে পরিণত হয়েছে, তারই কাহিনি। এর পরপরই অপরাপর মহিলা শিক্ষায়তনের ভেতরের খবর বেরিয়ে আসে। হ্যাঁ, এর সব সত্য নাও হতে পারে।
কিন্তু যা কিছু রটে, তাকে একেবারে ঠেলে ফেলে দিলে সরলায়ন হয় না? এ মুহূর্তে একটি ছবির নাম ভুলে গেছি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত। একটি জায়গায় দেখা যায়, যুদ্ধাক্রান্ত এলাকায় একটি নারীকে একজন সৈনিক একটি বিবর পার করানোর সময় তাকে ঝাপটে ধরে যৌনাস্বাদ নিচ্ছে! আমাদের এই সমাজেও যারা বৈতরণী পারের মহানায়ক, তারা না-হয় মহৎ ও মহান (?), কিন্তু তাদের পেছনের বা নিম্নস্তরের নেতাকর্মীদের অবস্থা ও অবস্থানটা কোথায়? এ-নিয়ে কেউ কখনো তলিয়ে দেখেন নি, গরজবোধ করেন নি। কিন্তু কেন?
ডানধারার তাবড় তাবড় নেতাদের কথা বাদই দেওয়া যায়, কারণ এদের বসবাস তো সর্বগ্রাসী পুঁজির অতলান্তিক পুঁজের সাগরে। সুখ-ভোগ ও যৌন-সম্ভোগ যার চূড়ান্ত পর্যায়। কিন্তু যারা মানবতা-রক্ষার একান্ত কাণ্ডারি, সেই বামধারার রতি-মহারতিদের জীবনকাহিনি কি একেবারে নারীশূন্য, যৌনতার সম্ভোগশূন্য? কোনো নারী হয়ত ক্ষমতার সান্নিধ্যে থাকার লোভে ভোগ্যা হয়েছেন, কেউ কেউ তো নিতান্ত ফাঁদে পড়ে একান্ত অনিচ্ছায়ও ভোগ্যা হয়েছেন।
তাদের কথা কখনো কি আমরা বিবেচনা করেছি? আমরা তরতর করে নারীকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে, কিন্তু নারীর অসহায়তার সুযোগে মানবিক সাহায্যের আবরণে প্রাবৃত্তিক চাহিদা নিবারণের মোক্ষম উপায় হিসাবে গণ্য করে দাতা বনে যাওয়ার প্রবণতাকে কখনো কি আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছি? হাসনাত সাহেবের এই গল্পটিতে এমন প্রশ্নের উপাদান ছিল। কিন্তু প্রতিবাদের তোড়ে তা ভেসে গেল।
বাম মহলের প্রায় সবাই লেখক। তারা নিজেদের এই আবিলতাকে নানা যুক্তি দিয়ে ঢেকে রাখার প্রয়াস পান। অথচ তারাই কিন্তু বলেন, বাস্তব না হলেও কল্পনায় ভর করে লেখক লিখতে পারেন।
অথচ সেই কল্পনা যখন তাদের বাস্তবতাকে, বহমান প্রথাকে, মলিনতাকে আঘাত করে, তখন এর বিরুদ্ধে পরিস্থিতিকে যেভাবে তারা ফেনিয়ে তুলেন, তাতে মনে পড়ে যায় নদীর পাড়ে সেই লোকটির কথা, যিনি পাছা উঁচু ও মাথা নিচু করে মলত্যাগ করেন অন্যদের থেকে মুখটা আড়াল করার জন্য। অথচ নাকটা তখন মলের কাছাকাছি পৌঁছয়, উৎকট গন্ধটাকে দম বন্ধ করে হজম করতে হয়।
সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখার কথা মুক্তবুদ্ধির প্রায় সব লোকের কাছেই শোনা যায়। তাদের গল্পে-নাটকে ধর্মাবলম্বী নানা কিসিমের লোকের উপস্থিতি থাকে। বলাই বাহুল্য, এর অধিকাংশ এবং প্রায় সবই থাকে নেতিবাচক পর্যায়ে; বাস্তবতা ও কল্পনার মিশিলেই তা হয়ে থাকে।
এতে যখন কারো অনুভূতি আহত হয়, ফলে প্রতিবাদ হয়, তখন শিল্পের দোহাই তুলে তারাই একে আবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এমনকি ধর্মের প্রধান চরিত্রগুলোকে নিয়েও যখন আপত্তিকর নানা গল্প ফাঁদা হয়, তখন এর প্রতিবাদ করতে গেলে এরাই আবার একে প্রতিক্রিয়াশীলতা বলে গাল পাড়েন, নিজেদেরকে মুক্তবুদ্ধির একান্ত হকদার বলে জাহির করেন। আজ যখন সামান্য একটি গল্প তাদের চর্চিত জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তারা ক্ষেপে উঠছেন তুমুলভাবে। তাহলে ধর্মাচারী রক্ষণশীল জনতার দোষ কোথায়?
তরুণদের আবেগের কারবারি, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের দালাল প্রথম আলো আবারও ক্ষমাপ্রার্থী হল। আলপিনের পর ক্ষমাপ্রার্থনা নিয়ে যারা ক্ষোভপ্রকাশ করেছিলেন প্রথম আলোর নতজানু ভাব দেখে।
আজ তারাই প্রথম আলোকে নতজানু হতে বাধ্য করেছেন এবং তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। অনিসুল হকও একটি লেখার জন্য সম্প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মানে, শেকল বাড়ছে। কখনো অন্যরা বাড়াচ্ছে। তখন গ্রগতিপ্রেমীরা বলছেন, এ হল বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়াশীলতা।
আর কখনো এই প্রগতিপ্রেমীরাই বাড়াচ্ছে, সে হচ্ছে প্রগতিশীলতা! এভাবেই বাড়ছে হেফাজতের শেকল, কখনো হেফাজতের হাতে, কখনো শাহবাগের হাতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।