আমার ভিতরে আমি স্বতন্ত্র জীবন যাপন করি।
পা দিলেই গোলাপ, মচাৎ করে পায়েঁর চাপে ভেঙ্গে গেল আরেকটি লাল গোলাপ। ভয়ে আত্না শুকিয়ে যাচ্ছে। সরু গলিতে এত গোলাপ কে রেখেছে। কোন মতে গোলাপ বাচিয়ে পা ফেলতেই আরেকটি গোলাপ সাপের মত ছোবল দিয়ে উঠলো শিহাবের পায়ে।
এবার আর এগুনো যাবে না। ঠায় দাড়িয়ে আছে শিহাব। হঠাৎ কিছু লাল পাপড়ি যেন উড়ে এসে ছোবল বসালো শিহাবের মুখে। নিরুপায় হয়ে কাঁদতে লাগলো শিহাব। মুখে অস্ফুট স্বরে “এত গোলাপ কেন, এত গোলাপ কেন? বলে দরদর করে ঘামতে লাগলো।
নাহ! এটা স্বপ্ন ছিলো। দুঃস্বপ্নটাই রোজই আসছে। কেবল দুঃস্বপ্ন না, গোলাপ ভীতিতে শিহাবের মানসিক অবস্থাও নড়বড়ে অবস্থা। এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গলায় দিলো। এখন ঘুমানোর চেষ্টা একেবারেই বৃথা।
রাত সাড়ে তিনটা। আর মাত্রতো দু ঘন্টা তারপরই ভোরের আলো আসবে জানালায়। প্রোমদ গুনতে গুনতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা ছাড়া আপাতত আর কিছুই করার নেই। চোখ খোলাই আছে, দরজায় চোখ পড়তে লাল শাড়ী পড়া একটি মেয়ে চোখে পড়লো। অপরুপ সুন্দরী।
আবছা আলোতে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটি শিহাবের দিকেই এগিয়ে আসছে। দেখা যাক কি হয়। এখন শব্দ করা যাবে না। মেয়েটি একদম খাটের কাছে, হাত দুটি পিছনে লুকিয়ে রেখেছে। সযতনে দুটি হাত সামনে এনে এক ঝুড়ি গোলাপ পাপড়ি শিহাবের গায়ে ঢেলে দিলো।
মা বলে চেঁচিয়ে উঠলো শিহাব। এক দৌড়ে লাইট জ্বালালো। নাহ কেউ নেই। ঘরের চারপাশে আবার চোখ বুলালো। কোথাও কেউ নেই।
রীতিমত কাঁপছে।
লাইট জ্বালানোই থাকলো। চোখ মুখে পানি দিয়ে বই নিয়ে আবার খাটে আসলো শিহাব। আচ্ছা মেয়েটা কি কণা ছিলো? কণাকে একবারই দেখেছিলো। মেয়েটার চেহারা মনে করার বৃথা চেষ্টা করছে শিহাব।
কণা অবশ্য এত সুন্দরী ছিলো না। কিছুটা হাল্কা লাগছে এই মুহুর্তে। কণার সাথে পরিচয় একেবারে আচমকা। এক বন্ধুর ফেসবুক স্ট্যাটাসে কমেন্টস পাল্টা কমেন্টসে কণার সাথে পরিচয়। এরপর বন্ধুত্বের আহবান পাঠিয়েছিলো শিহাব নিজেই।
কণা গ্রহন করেছিলো। তবে শিহাবের পরে মনে ছিলো না। এক রাতে কণাই প্রথম নক করে। ততদিন অবশ্য বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। মাত্র নিজের লেখা কবিতাকে গান বানিয়েছে শিহাব।
বেশ উত্তেজিত ছিলো। কণার হ্যালোর উত্তরে শিহাব বলেছিলো “গান শুনবে?
-চ্যাটেতো গান শোনা যায় না
-ধুত্তুরি ছাই, চ্যাটে কে শোনে? তোমার মোবাইল নম্বর দাও।
গান শোনার লোভে অথবা কোন এক রহস্যময় কারনে মোবাইল নম্বর দেয় কণা। ফোন করে হ্যালোটা পর্যন্ত বলেনি শিহাব। একটানা গান শুনিয়েই তারপর বললো “ওহো সরি তোমার টাইম নষ্ট করলাম, রাখি বাই”
শিহাবের রহস্যময় আচরনে কণা কিছুটা অবাক হয়েছিলো বটে।
এরপর শিহাব নিজেই কণাকে ফেসবুকে জিজ্ঞেস করেছিলো “এবার বল গানটা কেমন লেগেছে? মাত্র সুর দিলাম। একদম আতুর ঘর থেকে তোমার কাছে গেল”
-আমি মুগ্ধ !
মায়ের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো শিহাবের। কাকগুলো বেশ জোরেই ডাকা শুরু করেছে। মা ফজরের নামাজ পড়ে চা নিয়ে এসেছে। মায়ের সাথে কোন কথা হলো না।
চা খেয়ে ঘুমিয়ে গেল শিহাব। গত ছ’মাস যাবত এভাবেই রাতগুলো শেষ হয় শিহাবের।
আজ তামান্নার গায়ে হলুদ। এরকম নিরস গায়ে হলুদ তামান্নাদের পরিবারের আর কারো হয়নি। শিহাবের গোলাপ ভীতির কারনে পুরো বিয়ে বাড়ী গোলাপবিহীন।
গোলাপহীন বিয়ে বাড়ীকে রঙবেরঙের বাতি প্রাণ দিয়েছে বটে, তবে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভাব ঠিকই রয়ে গেছে। তামান্না শিহাবের বড় বোন। ছেলে মেয়েরা যখন হলুদ উৎসবে ব্যস্ত শিহাব তখন ছাদে বসে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। ঝাঁকঝমক তার ভালো লাগে না। ছোট ভাই ছোটন দুবার হলুদ দেয়ার জন্য ডাক দিয়েছে, কিন্তু শিহাবের যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
মনের অবস্থা জানে বলেই বেশী জোরজুরি করা হচ্ছে না। নিজের বোনের বিয়ে কেবল নিজেরই জন্যই এত পানসে হচ্ছে ভেবে খারাপ লাগছে শিহাবের। “মাকে অবশ্য বলেছিলো তোমার ঝাঁকঝমক কর। আমার সমস্যা হবে না”। কিন্তু মায়ের এক কথা “নাহ ! তোকে ছাড়া আমরা কোন উৎসব করবো না”।
তামান্নাও নিজের আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়েছে ভাইয়ের জন্য। আজকে বিয়েতে কণা থাকলে বেশ হতো। শিহাব সাদা পাঞ্জাবী পড়তো। কণা বলেছিলো “সাদা পাঞ্জাবী তোমাকে বেশ মানাবে”। এরপর আর সাদা পাঞ্জাবী পড়া হয়নি।
গান দিয়েই কণাকে মুগ্ধ করেছিলো শিহাব। সেদিনের পর শিহাবের প্রত্যেকটি নতুন গানের প্রথম শ্রোতা ছিলো কণা। ব্যাপারটা এমন দাড়িয়েছেলো কণার জন্যই গান বাঁধতো। সম্পর্ক বসে থাকার পাত্র নয়। গান শোনানোর বন্ধু ধীরে ধীরে প্রেমিকা হয়ে গিয়েছিলো।
কণাও ভালো গান গাইতো। শিহাবের সুর করা গান মোবাইলেই ডুয়েট হয়ে যেত।
রাত তিনটা বাজে। বিয়ে বাড়ী কিছুটা ঝিমিয়ে গিয়েছে। বড় বোনকে গায়ে হলুদ লাগানোর জন্যই ছাদ থেকে পা বাড়ালো শিহাব।
প্রথম সিড়িতে পা দেয়ার সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো। লাল গোলাপ। আত্না কেঁপে উঠলো। এক দৌড়ে বড় বোনের ঘরে ঢুকে গেল।
বিয়ে বাড়ী ব্যস্ত হয়ে পড়লো শিহাবকে নিয়ে।
ভয় পেয়ে ভীষন জ্বর এসেছে। মাথায় পানি ঢালছেন শিহাবের মা। তাকেই ঘিরেই সবাই দাড়িয়ে আছে। ‘কণা কণা,এক ঝুড়ি গোলাপ পাপড়ি নিবে? এক ঝুড়ি? তুলতে পারবেতো?
-নাহ আমি একশোটি গোলাপ নিবো। না না একশোটি নাহ।
একশো একটা গোলাপ নিবো।
ঘোরের স্বরেই বকে যাচ্ছে শিহাব। নিজের কথা, কণার কথা সবই বলছে। বাকির রাতটা উৎকন্ঠাই গেল। শিহাব কিছুই টের পেল না।
বেহুশের মত কেবল ঘুমাচ্ছে।
বড় একটি আকাশ। শিহাব উড়ছে, উড়ে উড়ে মেঘ ধরছে। একটি মেয়ে উল্টো পাশ থেকে উড়ে শিহাবের মুখোমুখী। মেয়েটার সাথে কণার মিল আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে শিহাব।
হুমম মিল আছে। মেয়েটা লাল জামা পড়েছে। পরক্ষনেই শিহাব বুঝতে পারলো নাহ কণার সাথে না সেদিন রাতে আসা মেয়েটির সাথে এই মেয়ে মিল আছে। হঠাৎ মেয়েটি আকাশ ফাটিয়ে হাসি দিলো। মুখে থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো হাজার হাজার লাল গোলাপ পাপড়ি।
চিৎকার দিলো শিহাব। ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এটাও স্বপ্ন ছিলো। চোখ খুলতে তীব্র আলো চোখে পড়লো। দেয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন দুপুর বারোটা।
রাতেই বড়বোনের বিয়ে। গত ছ”মাস ছাদ এবং নিজের ঘর ছাড়া কোথাও যায়নি শিহাব। আজ রাতে সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যাবে। শিহাব চিন্তা করছে একা বাসায় থাকবে কি করে। তবে এটাও জানে মা শিহাবকে ফেলে যাবে না।
আবার মেয়ের বিয়েতে মায়ের না যাওয়াটা বড় বেশী বেমানান। কণা থাকলে নিশ্চয় শিহাব বিয়েতে যেত। মায়ের না যাওয়া নিয়ে এত টেনশন করা লাগতো না। ছাদে বসে সিগারেট ফুঁকছে। কি অদ্ভুত, শিহাব এখন মায়ের সামনেই সিগারেট ফুঁকে।
তারচে অদ্ভুত বিষয় হলো শিহাবকে সিগারেট এনে দেয় তার মা।
কণাও সিগারেটের ব্যাপারের ১৪৪ ধারা জারি করেছিলো। তখন অবশ্য কণার সাথে দেখা হয়নি। কণা-শিহাবের সম্পর্কে নিরানব্বই তম দিনে এসে দুজনের প্রথমবারের মত ঝগড়া লাগে। সম্পর্কের একশতম দিনে তাদের প্রথমবার দেখা করার কথা ছিলো।
কিন্তু সেদিন দুপুরের পর শিহাবের সেমিষ্টার ফাইনাল পরীক্ষা থাকার কারনে দেখা করতে পারছে না। রাতভর ঝগড়া করে পরীক্ষার পড়া কিছুই হয়নি শিহাবের। শেষ রাতে ঝগড়ার ঝড় থেমে ঠিক একশ একদিনের দিন তাদের দেখা হবে। কে জানতো একটি দিন অনেক কিছু তৈরি করে রাখবে?
সকাল থেকে শিহাবের প্রস্তুতির শেষ ছিলো না। সময়ের এক ঘন্টা আগেই শাহাবাগ পৌছে যায়।
একশো একটি গোলাপ কিনে ঝুড়িতে রাখে। তখনও কণা আসেনি। টেনশনে শিহাবের বুকের চৌদ্দপুরুষ কাঁপছিলো। টানা ছয়টি সিগারেট খেয়ে মুখকে নিকোটিনের ডাষ্টবিন বানিয়ে ফেলেছে। মোবাইলের রিং বেজে উঠলো ।
কণা.
-কই তুমি?
-এ্যইতো আর ৫ মিনিট লাগবে। তুমি ফুলের দোকানের ঠিক সামনে দাড়াবে। এরপর আমরা রিকশায় ঘুরবো কিন্তু।
ফোন রেখে দ্রুত মুকে চুইনগাম দিলো। মুখের দুর্গন্ধতো ঢাকতে হবে।
রিকশায় ঘোরার জন্য আজ একেবারে মোক্ষম দিন। সরকারী বন্ধের দিনে সকাল সকালে ঢাকার রাস্তাগুলো রিকশার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কণা চলে এসেছে। হৃৎকম্পনের শব্দ কিছুটা কমেছে।
-এই তুমিতো ছবির চেয়ে আরও বেশী শুকনা?
-তুমি সামান্য মোটা
-সত্যিই তাই? এই বল না সত্যিই বুঝি
“নাহ, এই নাও” বলে একশো একটি গোলাপের ঝুড়িটি কনার হাতে দিয়ে দিলো শিহাব।
“গুণে নিও কিন্তু। একশো একটি আছে কিনা?
-বাসায় গিয়ে সত্যিই গুণবো।
ঘন্টার চুক্তিতে রিকশা ভাড়া করা হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা চষে বেড়িয়ে রিকশা তখন পিজি অতিক্রম করে শেরাটনের সামনে। কণা ডানহাতে লাল গোলাপের ঝুড়িটি ধরে আছে,বাঁহাতে ধরেছে শিহাবের হাত।
ছুটির দিনে গাড়ীগুলো বড্ড জোরে চলে। রিকশাও যেন পাল্লা দিতে চায়। শেরাটনের মোড় পার হতে গিয়ে বাম দিক থেকে হঠাৎ একটি বাস এবং ধপাস……..!
ব্যাথায় মাথা টনটন করছে শিহাবের। চোখ খুলেই কণার কথা মনে পড়লো। নাহ কণাকে দেখা যাচ্ছে না।
দূরে একটি গোলাপ দেখা যাচ্ছে। কে যেন শিহাবকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। কণা বোধহয়। “উঠুন, উঠুন” আবছা শুনতে পাচ্ছে শিহাব। দুতিনজনের সহায়তায় রাস্তা থেকে উঠে দাড়ালো।
মহুর্তেই চোখ গেল কালো চিকচিক করা রাস্তায় লাল রঙের আলপনা। নাহ আলপনা না রক্ত! এইতো কণা পড়ে আছে। থেতলে যাওয়া মুখে পড়ে আছে একশোটি লাল গোলাপ। একটি একটু দূরে। জ্ঞান হারালো শিহাব।
ছবি : ইন্টারনেট
ছবিটি এডিট করেছে শহিদুল ইসলাম ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।